জানি, শিরোনামের শেষ শব্দটি নিয়ে পাঠকের একটু খটকা লাগবে। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর নামের সঙ্গে কবিতা! কিন্তু এটা তো আমাদের কাছে অজানা নয়, বিশ্ববরেণ্য জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীরা আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য সম্বন্ধে যা দৃশ্যমান নয়, সেই নিয়মকানুন আমাদের সামনে তুলে ধরেন। তাঁদের প্রস্তাবিত সেই সব তত্ত্ব কেবলমাত্র তাঁদের চিন্তাভাবনা আর সৃজনশীলতার পরীক্ষাগারে প্রমাণ করে থাকেন তাঁরা। এভাবেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের সীমানা বিস্তৃত হয়েছে। একজন কবিও কি এই পন্থা অবলম্বন করেন না?
বস্তুত কবি এবং বিজ্ঞানীর মধ্যে যে সংলাপ আর সংযোগ, সে তো নতুন কিছু নয়। বেশ কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে গিয়ে আমরা যদি ১৬৩৮ সালে ফিরে তাকাই, দেখব, তরুণ কবি জন মিল্টন একদিন ফ্লোরেন্সে গিয়ে কিংবদন্তি জ্যোতির্বিদ গ্যালিলিও গ্যালিলির সঙ্গে দেখা করছেন। বৃদ্ধ গ্যালিলিও তখন অন্ধ এবং গৃহবন্দি অবস্থায় রাখা হয়েছে তাঁকে। কেন গ্যালিলিওকে বন্দি করা রাখা হয়েছিল, সে কাহিনি তো আমাদের কারও অজানা নয়। আকাশের গ্রহনক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে তাঁর অনুসন্ধানের কথা তিনিই প্রথম জোর গলায় বলেছিলেন, না সূর্য নয়, পৃথিবী ঘুরে চলেছে সূর্যের চারপাশে। এই সাক্ষাৎকারের বেশ কয়েক দশক পরে, কবি মিল্টন তখন বৃদ্ধ এবং সম্পূর্ণ অন্ধ, এ মহাবিশ্বের সূত্র-সম্পর্ক তুলে আনছেন তাঁর মহাকাব্য ‘Paradise Lost’-এ এবং যার মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন মহান জ্যোতির্বিদ গ্যালিলিও-কে।
আবার স্টিফেন হকিং-এর কথায় ফিরে আসি। কে না তাঁর নাম জানেন। স্টিফেন হকিং-এর নাম শোনেননি এমন মানুষের খোঁজ পাওয়া মুশকিল। পুরো নাম স্টিফেন উইলিয়াম হকিং (১৯৪২-২০১৮)। তিনি ছিলেন একজন ম্যাথেমেটিক্যাল-ফিজিসিস্ট, কসমোলজিস্ট এবং ইউনিভার্সিটি অফ কেমব্রিজের ‘থিয়োরেটিক্যাল কসমোলজি’ কেন্দ্রের রিসার্চ-ডিরেক্টর। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, তারা এবং ব্ল্যাক হোল নিয়ে তাঁর দিগদর্শী কাজের জন্যে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ‘স্পেস’ এবং ‘টাইম’ সম্পর্কে আমাদের সমস্ত ধারণার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদরা মনে করেন, তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার জগতে সেরার তালিকায় বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের পরেই যাঁর নাম আসবে, তিনি স্টিফেন হকিং। বস্তুত কিংবদন্তি বিজ্ঞানীদের তালিকায় গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইনের সঙ্গে উচ্চারিত হয় স্টিফেন হকিং-এর নামও।
স্টিফেন হকিং-এর কথায় আবার পরে আসব। এখন বিশ্ববন্দিত অ্যাস্ট্রো-ফিজিসিস্ট স্টিফেন হকিং-এর সঙ্গে তাঁর কর্মকাণ্ডের বিপরীত মেরুতে থাকা ‘কবিতা’-র সহাবস্থান কী করে ঘটেছিল, সেই প্রসঙ্গে আসি।
দিনটি ছিল ২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর। ২১তম ইউনাইটেড কিংডম (UK) জাতীয় কবিতা দিবস উদযাপন। কবিতা দিবসের থিম ছিল— ‘আলো’। সেই বছর ছিল আইনস্টাইনের ‘থিয়োরি অফ জেনারেল রিলেটিভিটি’ আবিষ্কারেরও একশো বছর। তাই ওই থিম নির্বাচন। সারা হাউ নামে একজন ইংরেজ কবি, যিনি রেডক্লিফ ইনস্টিটিউটে (হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি) অ্যাডভান্সড স্টাডিজের একজন ফেলো, সাহিত্যের অধ্যাপনা ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। সারা হাউ-এর লেখা একটি কবিতা পড়া হবে সেই অনুষ্ঠানে। যে কবিতার নাম ‘রিলেটিভিটি’। বস্তুত যা বিজ্ঞান ও কবিতার এক অপরূপ মেলবন্ধন।
সারা হাউ তাঁর কবিতাটি উৎসর্গ করেছেন স্বনামধন্য পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং-কে। বিজ্ঞান এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে সারা-র অনুরাগের কথা স্টিফেন আগেই শুনেছিলেন। সেজন্যেই স্বয়ং বিজ্ঞানী আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সারা-কে, যাতে তিনি তাঁর সেই কবিতাটি পড়ে শোনাতে পারেন। শুধু শোনাই নয়, পরে হকিং তাঁর ভয়েস-প্রসেসরের সাহায্যে পাঠ করেছিলেন সারার লেখা সেই কবিতাটি। কণ্ঠস্বর এবং ছবি রেকর্ডও করা হয়েছিল ওই অনুষ্ঠানের।
অনুষ্ঠান-শেষে সারা-কে স্টিফেন হকিং বলেন— ‘পদার্থবিদ এবং কবিদের বিভাগ আলাদা হতে পারে, কিন্তু উভয়েই তারা যা অনুসন্ধান করে এবং যে সব কিছুর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে, তা হল আমাদের চারপাশে থাকা বিশ্বপ্রকৃতির সৌন্দর্য!’ এখানে সারা হাউ-এর লেখা সেই কবিতাটি থাকল:
Relativity
By Sarah Howe
[For Stephen Hawking]When we wake up brushed by panic in the dark
our pupils grope for the shape of things we know.Photons loosed from slits like greyhounds at the track
reveal light’s doubleness in their cast shadowsthat stripe a dimmed lab’s wall—particles no more—
and with a wave bid all certainties goodbye.For what’s sure in a universe that dopplers
away like a siren’s midnight cry? They saya flash seen from on and off a hurtling train
will explain why time dilates like a perfectafternoon; predicts black holes where parallel lines
will meet, whose stark horizon even starlight,bent in its tracks, can’t resist. If we can think
this far, might not our eyes adjust to the dark?
২০১৮-র ১৪ মার্চ স্টিফেন হকিং প্রয়াত হন, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ছিয়াত্তর বছর। তবে বলতে গেলে, তাঁর তো মৃত্যু হওয়ার কথা ছিল মাত্র তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সেই! ডাক্তাররা পরীক্ষা করে সেরকমই তো বলেছিলেন। হকিং-এর যখন একুশ বছর বয়স, ডাক্তার পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন, হকিং-এর শরীরে বাসা বেঁধেছে এক দুরারোগ্য রোগ। যে রোগের নাম— ‘অ্যামায়োট্রফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরসিস’ (Amyotrophic lateral sclerosis বা ALS)। যে বিরল রোগে ‘আপার মোটর নিউরন’ ও ‘লোয়ার মোটর নিউরন’— দুই-ই অচল হয়ে পড়ে। আয়ু খুব বেশি হলে বছর দুয়েক! সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের অন্তর্গত সজীব স্নায়ুগুলি সব পেশির কার্যকারিতা জারি রাখে। সেই পেশিগুলি ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে পড়ে এই রোগে। শরীরের যে-কোনও অঙ্গের পেশির কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলা মানে পঙ্গুত্ব নেমে আসা। ধীরে ধীরে সেটাই সত্যি হল। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর সপ্রতিভ একজন তরুণ একটু একটু করে যেন নির্জীব জড়বস্তুতে পরিণত হলেন।
প্রাণ থাকলেও একে তো আর বাঁচা বলে না। কেবল জীবনধারণ করা। মৃত্যুকে পরাজিত করে শুধু বেঁচে থাকাটুকুই। অন্যান্য অঙ্গে পঙ্গুত্ব নেমে আসলেও এই রোগে মস্তিষ্কের ক্ষমতা যে সব সময় নষ্ট হয়ে যায়, এমনটা সম্ভবত সব ক্ষেত্রে হয় না। হয় না যে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ স্টিফেন হকিং নামের এই মানুষটি। পুরোপুরি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নেমে এসেছে। যন্ত্রচালিত হুইলচেয়ারে বসা। একদিকে ঈষৎ হেলানো মাথা। অসার হাতের ওপর অন্য হাত রাখা। এমনকি কথা বলতেও অক্ষম। ভয়েস-প্রসেসরের সাহায্যে বক্তব্য প্রকাশ করতে হয়। তবু সজাগ ও সচেতন তাঁর মগজ। এরকম অবস্থার মধ্যে এক-আধ বছর নয়, বেশ কয়েক দশক কেটেছে। শরীর হার মেনেছে তবু তাঁর মগজ বিজয়রথ চালিয়ে নিয়ে গেছে। বিজ্ঞানের উচ্চমানের মৌলিক গবেষণা চালিয়ে গেছেন এই অবস্থায়। এ যেন বিস্ময়তাকেও হার মানায়। জীবনের এরকম জয়ের উদাহরণ আর অন্য যে-কোনও জয়কে হার মানায়। জীবনমৃত্যুর সাধারণ সব ধারণা ওলটপালট করে দিয়েছে স্টিফেন হকিং-এর এই অভাবনীয় জীবন।
তরুণ বয়সে যখন জানতে পারলেন যে, তাঁর পরমায়ু আর মাত্র কয়েক বছর, স্বভাবতই তখন নিজের ইচ্ছা স্বপ্ন সব কিছু তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। গভীর হতাশার কালো অন্ধকার ঘিরে ধরল। একদিকে মৃত্যুর হাতছানি, অন্যদিকে এক-একটি দিন নতুন করে অতিরিক্ত হিসেবে পাওয়া। নতুন করে বাঁচা! হকিং সেসময় ভেবেছিলেন, বেঁচে থাকাটা যদি আরও কয়েক বছর দীর্ঘায়িত হয় কোনওভাবে, তাহলে পিএইচ.ডির কাজ শুরু করবেন। সত্যি হল হকিং-এর ইচ্ছা। শুরু করলেন পিএইচ.ডি-র কাজ। তবে গবেষণার কাজ শেষ হবে কি না তখনও নিশ্চিত ছিলেন না কেউই। এ-রকম অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে শুরু হল গবেষণার কাজ এবং ওইরকম অবস্থার মধ্যেও উচ্চমানের গবেষণা করে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করলেন হকিং।
এইভাবে এক একটা দিন, মাস, বছর যেন যোগ হতে থাকল স্টিফেনের আয়ুর সঙ্গে! আরও পরে এই স্টিফেন হকিং-ই হয়েছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর। তাঁর লেখা ‘A Brief History of Time’ (১৯৮৮) বই আন্তর্জাতিক বেস্ট-সেলার হবে। যে বই মাত্র সাড়ে চার বছরে বই বিক্রির সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গিয়েছিল! যদিও তাঁর নিজের লেখা এই বই সম্পর্কে হকিং ঠাট্টা করে বলেছিলেন- ‘the least-read, most-purchased book in history’। সম্ভবত তিনি বুঝেছিলেন, সবার পক্ষে তাঁর ওই বইটি অনুধাবন করা হয়তো একটু কঠিন হবে। আর সে জন্যেই তিনি পরে আবার চারটি বই লিখেছেন যাতে করে পাঠকদের বোঝার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে সহজ হয়। সেই বইগুলি হল ‘A Briefer History of Time’, ‘Black Holes’, ‘Baby Universe’ এবং ‘The Universe in a Nutshell’। শুধু তাই নয়, তার পরে কন্যা ল্যুসি-র সঙ্গে যৌথভাবে হকিং লিখেছেন ছোটদের জন্যে বিজ্ঞান আর রোমাঞ্চর মিশেলে আরও পাঁচ-পাঁচটি বই।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, যে মানুষটি ‘ব্ল্যাক হোল’ সম্পর্কে বা ‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ড’ সম্পর্কে আমাদের সমস্ত ধারণা বদলে দিয়েছিলেন, সেই হকিং স্কুলে একদম সাধারণ মানের ছাত্র ছিলেন এবং পরীক্ষাতে ভাল নম্বরও পাননি কখনও। এমনকি আট বছর বয়স পর্যন্ত ভাল করে পড়তে পর্যন্ত পারতেন না তিনি।
তাঁর বৈপ্লবিক গবেষণার ফলাফল উপহার দিয়েছেন, তবু নোবেল পুরস্কারের জন্যে কখনও নমিনেটেড হয়নি তাঁর নাম। যদিও তিনি Albert Einstein Medal, the Order of the British Empire (Commander) কিংবা Wolf Prize in Physics পদক এবং সম্মান পেয়েছেন।
আজ ৮ জানুয়ারি। বিস্ময়-বিজ্ঞানী, সত্যসন্ধানী ও সুন্দরের পূজারী স্টিফেন হকিং-এর জন্মদিন। তাঁর প্রতি আরও একবার আমরা আভূমি প্রণত হই।
চমৎকার লেখা। হকিং সম্পর্কিত কবিতাটির বঙ্গানুবাদ দিলে আরও ভাল হত বোধহয়। লেখককে অজস্র ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধা এমন বিষয় আমাদের কাছে তুলে ধরবার জন্য।
আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ জানাই। আপনি যথার্থই বলেছেন, ইংরেজি সনেট টির বঙ্গানুবাদ করা গেলে ভালো হত। নমস্কার জানবেন।
খুব সুন্দর লেখা। প্রকৃতই তিনি এক “বিস্ময় বিজ্ঞানী”। জন্মদিনে তাঁর জন্য রইল আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। 🙏 আর এই লেখা’র সঙ্গে সারা হাউ’এর অসামান্য সুন্দর কবিতা “:Relativity” যে পড়ালেন তার জন্য আপনাকে আরো একবার ধন্যবাদ জানাই।
ধন্যবাদ জানাই, লেখাটি পড়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া জানালেন বলে।
অভিনন্দন ও প্রাণঢালা শুভেচ্ছা
Thank You