Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

এক বিস্মৃত প্রতিভা: মাড লিনোরো মেনটেন

আজ থেকে প্রায় একশো চুয়াল্লিশ বছর আগের কথা। কানাডার অন্টারিও প্রদেশের নদী-ঘেরা ছোট্ট একটি জায়গা ‘ল্যামটন’-এ জন্ম হয়েছিল মেয়েটির। বাবা ছিলেন নৌকা-ফেরি সার্ভিস অপারেটর। ফ্রেজার নদীর ওপর চলাচল করত সেইসব নৌকাগুলি। ফেরি সার্ভিস ছাড়াও একটি হোটেল ও রকমারি সামগ্রীর দোকানও ছিল বাবার, যেগুলির দেখাশোনা করতেন সেই মেয়েটির মা। স্থানীয় একটি পোস্ট অফিসে পোস্ট মিস্ট্রেসের কাজও করতেন তিনি।

মেয়েটির ফোটো তো দূরের কথা, তাঁর নামটিও আমাদের সকলের কাছেই অজানা ও অচেনা। মেয়েটির নাম ‘মাড লিনোরো মেনটেন’ (Maud Leonora Menten, ১৮৭৯-১৯৬০)। তবে প্রাণরসায়ন বিজ্ঞান পড়ুয়াদের কাছে মেয়েটির নামের ‘মেনটেন’ অংশটি শোনা শোনা লাগার কথা। কেননা, স্নাতক স্তরে বায়োকেমিস্ট্রির যে-কোনও টেক্সট বইয়ে ‘Michaelis-Menten equation’ নামের সমীকরণ সবাইকেই পড়তে হয়। উল্লিখিত সমীকরণটিতে দুজন আবিষ্কারকের নামের অংশ বিশেষ রয়েছে, যাঁদের প্রথমজন ‘মিশালিস’ আর দ্বিতীয়জন হলেন ‘মেনটেন’। কেউ কেউ আবার Michaelis-Menten একটি নাম হিসেবেই মনে করে থাকেন। সে যাই হোক, সেই ‘মেনটেন’ নামের মেয়েটির কথা বলব এই লেখায়। সত্যি কথা বলতে কী, তাঁর জীবনের কথা, প্রতিভা, অবদান আর জীবন সংগ্রামের কথা আমরা কেউই প্রায় জানি না।

সারা পৃথিবীতে এমনকি নিজের জন্মভূমি কানাডাতেও ব্যাপকভাবে অপরিচিত তিনি। আর এর একমাত্র কারণ যে তিনি মহিলা বলেই, সেকথা বুঝতে অসুবিধা হয় না। পৃথিবীর সব দেশেই বহু শতাব্দীকাল ধরে চলে আসছে মহিলাদের প্রতি এই বৈষম্য, বঞ্চনা আর যথাযোগ্য স্বীকৃতি না-দেওয়ার মানসিকতা। মেনটেনের সময়ে উচ্চশিক্ষা; বিশেষত বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার ক্ষেত্রে মেয়েদের সামনে ছিল প্রতি পদে পদে প্রতিবন্ধকতার দেওয়াল। যে সময়ের কথা, তখন মহিলাদের ভোটাধিকার ছিল না, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ছিল অলঙ্ঘনীয় বৈষম্য। তবু সমস্ত রকমের বাধা অতিক্রম করে নিজের যাত্রাপথ তৈরি করে নিয়েছেন মেনটেন।

তরুণী মাড লিনোরো মেনটেন।

মেনটেন ছিলেন কানাডার প্রথম মহিলা, যিনি টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিসিনে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। এছাড়াও নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরও ছ’টি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন তিনি, যার মধ্যে তিনটি ছিল ডক্টরেট ডিগ্রি— মেডিসিন, ফিজিয়োলজি এবং বায়োকেমিস্ট্রিতে। গবেষণা করার ইচ্ছে ছিল কানাডা ইউনিভার্সিটিতে, তবে সেখানে কোনও সুযোগ পেলেন না। অগত্যা জার্মানিতে পাড়ি দিলেন। নর্থ আটলান্টিক সমুদ্রে টাইটানিক জাহাজডুবির যে ঘটনা তা হয়েছিল এপ্রিলের ১৯১২। এর কয়েক মাস পরেই জার্মানির উদ্দেশে একাই পাড়ি দিলেন মেনটেন। বার্লিনে গিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বরিষ্ঠ জার্মান বায়োকেমিস্ট লিওনুয়া মিশালিসের (Dr. Leonor Michaelis) গবেষণাগারে ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট হিসেবে এবং ‘হসপিটাল অ্যাম আরবান’-এ ব্যাক্টেরিয়োলজিস্ট হিসেবে যোগ দেন মেনটেন। এক বছরের কিছু পরে, ‘Michaelis-Menten equation’-এর জন্ম হয় যুগ্মভাবে মেনটেন ও মিশালিসের হাত ধরে। যুগান্তকারী যে আবিষ্কার ইতিহাস সৃষ্টি করে। প্রথমে জার্মান ভাষায়, পরে ইংরেজি অনুবাদে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হতেই সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত হয় তাঁদের নাম।

কী জন্যে মেনটেন-মিশালিসের ‘ইক্যুয়েশন’ যুগান্তকারী আবিষ্কার হিসেবে বলা হয়? আসলে তাঁদের এই আবিষ্কারের ফলে যে-কোনও ‘এনজাইম’-এর সক্রিয়তা পরিমাপ সম্ভব হয়। এনজাইমের সাহায্যে চলা প্রত্যেক রাসায়নিক বিক্রিয়ার পরিচায়ক হল সংশ্লিষ্ট এনজাইমের ধ্রুবক, Km (Constant/ধ্রুবক)। এই Km-কে সাধারণভাবে ‘Michaelis Constant’ বলা হয়ে থাকে। বস্তুত একটি ‘এনজাইম’ কতখানি ‘সক্রিয়’, তা বোঝা যায় ওই ইক্যুয়েশন থেকে নির্ণয় করা Km থেকে। এই ‘ইক্যুয়েশন’ ব্যবহার করে আমরা যে-কোনও এনজাইমের নির্দিষ্টতা (স্পেসিফিসিটি), দক্ষতা (এফিসিয়েন্সি), কুশলতা (প্রফিসিয়েন্সি) যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি। সমস্ত প্রাণীর অভ্যন্তরে এনজাইম কীভাবে প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়াগুলি নিয়ন্ত্রিত করে, তা তাঁর আবিষ্কার থেকে বোঝা যায়। আবিষ্কারের একশো বছর পরেও মেনটেন-মিশালিসের দিগদর্শী আবিষ্কারের গুরুত্ব একই রকম রয়ে গিয়েছে। মেনটেনের ইক্যুয়েশন-টির কেন এত বিপুল গুরুত্ব? কোন কোন ক্ষেত্রে তা কাজে লাগে, এসব কথা বুঝতে হলে প্রথমে এনজাইম ঠিক কী? কী তাদের কাজ? এসব কিছু জানা দরকার।

‘এনজাইম’ কী? তা জানার পাশাপাশি জানা দরকার শরীরের মধ্যে যে প্রাণ-রাসায়নিক বিক্রিয়া চলে, সে সম্বন্ধেও। আমাদের বা যে-কোনও প্রাণীর শরীরে যে সমস্ত প্রাণ-রাসায়নিক বিক্রিয়া সুনিয়ন্ত্রিতভাবে ঘটে চলেছে, তার জন্যেই জীবন। তার জন্যেই আমাদের বেঁচে থাকা। আর এইসব বিক্রিয়াগুলি যারা সংঘটিত করে, তারা ‘এনজাইম’ গোত্রের একধরনের পদার্থ। ‘এনজাইম’ আছে বলেই জীবনের রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলি সংঘটিত হতে পারে। তাই, প্রাণ বা জীবনের হালহকিকত সম্পর্কে বুঝতে হলে এনজাইমের কার্যকলাপ, গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি বোঝা আবশ্যিক।

এনজাইম হল ‘প্রোটিন’ গোত্রের বিশেষ একধরনের পদার্থ, অতীব ক্ষুদ্র জটিল রাসায়নিক মেশিনের সঙ্গে যার তুলনা করা চলে। যে-কোনও প্রাণীর দেহকোশের মধ্যেই রয়েছে ‘এনজাইম’। মানুষের শরীরের কোশের মধ্যেও রয়েছে হাজার হাজার এনজাইম, এদের ‘বায়োলজিক্যাল-অনুঘটক’ বা ‘উৎসেচক’-ও বলা হয়। অন্যান্য ‘প্রোটিন’ যেমন তাদের নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করে, তেমনই বিভিন্ন এনজাইম শরীরের বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় (মেটাবলিক প্রসেস) অনুঘটক হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিক্রিয়াকে চালিত করে। এরকম অসংখ্য বিক্রিয়া চলে। যেমন ‘ডিএনএ’ এবং ‘আরএনএ’ সংশ্লেষণ করা কিংবা ‘গ্লুকোজ’ তৈরি করা ইত্যাদি। এরকমই অজস্র বিক্রিয়া চলে শরীরের অসংখ্য কোশের অভ্যন্তরে। এক-একটি বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে, এক-একটি নির্দিষ্ট এনজাইম। যে নির্দিষ্ট ‘বিক্রিয়ক-অণু’-র বিক্রিয়াকে এনজাইম দ্রুতগামী কোরে নতুন আণবিক পদার্থ (বিপাকীয় বস্তু) সৃষ্টি করে, সেই বিক্রিয়ক-অণুকে ওই এনজাইমের ‘সাবস্ট্রেট’ বলা হয়। স্বাভাবিক শারীরিক কার্যকারিতার জন্য বিক্রিয়াজাত এইসব সৃষ্ট বিপাকীয় বস্তুগুলি অপরিহার্য। নির্দিষ্ট ‘সাবস্ট্রেট-অণু’ যখন সংশ্লিষ্ট এনজাইম অণুর গায়ে সুনির্দিষ্ট ভাঁজে (অ্যাক্টিভ-সাইট) খাপে খাপে বেঁধে যায়, তখনই বিক্রিয়া চালিত হয়। উল্লেখ্য যে, একটি ‘সাবস্ট্রেট-অণু’ কতটা আঁটোসাটো মাত্রায় ‘এনজাইম’-অণুর গায়ে বাঁধল, তার ওপর নির্ভর করে বিক্রিয়াজাত ‘চূড়ান্ত বস্তু’ সৃষ্টি হওয়ার গতি তথা হার।

যে-কোনও প্রোটিন, কোনও পদার্থের ওপর কার্যকর হলে মেনটেনের সমীকরণ প্রযোজ্য হবে। ভ্যাকসিন এবং যে-কোনও ওষুধ ডেভেলেপমেন্টের ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীতে মিশালিস-মেনটেন সমীকরণ বায়োকেমিক্যাল এবং মেডিক্যাল গবেষণাগারের ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য হাতিয়ার। ১৯১৩ সালে যখন মিশালিস এবং মেনটেনের গবেষণাপত্রটি প্রকাশ হয় তখন এনজাইম সম্পর্কে খুব কমই জানা ছিল।

আগেই ‘Km’ ধ্রুবকের কথা বলেছি। একাধিক বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী মনে করে থাকেন যে, ‘Km’ যতখানি মৌলিক তাঁর সঙ্গে সম্ভবত তুলনা করা চলে ১৯০১ সালে জার্মান তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাংকের আবিষ্কৃত ‘h’ ধ্রুবকের, যিনি এই আবিষ্কারের জন্যে ১৯১৮ সালে ফিজিক্সে নোবেল পুরস্কার পান। মেনটেনের মৌলিক আবিষ্কারের এত বিপুল গুরুত্ব, তবু আশ্চর্যের কথা তা বিজ্ঞান মহলে কোনও সময়ই স্বীকৃতি পায়নি। এরকম উচ্চতার একটি আবিষ্কারের জন্যে কোনও যথাযোগ্য পুরস্কারও পাননি মেনটেন।

মেনটেন তাঁর কেরিয়ার বিকশিত করেন আমেরিকায় এসে। তিনি প্রথমে নিউ ইয়র্কে ‘রকেফেলার ইন্সটিটিউট ফর মেডিক্যাল রিসার্চ’-এ যোগ দেন এবং প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রাফ প্রথম প্রকাশ করেন। পরে ক্লিভল্যান্ডের ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ-ফেলো হিসেবে যোগ দেন। সেখানে রক্তে হাইড্রোজেন আয়নের ঘনত্বের প্রভাব ও গুরুত্ব নিয়ে কাজ করেন। ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গ স্কুল অফ মেডিসিনের প্রফেসর এবং পিটসবার্গ চিলড্রেন হসপিটালের প্যাথোলজি ডিপার্টমেন্টের প্রধান হন মেনটেন। যখন তাঁর একাত্তর বছর বয়স, যে বছর তিনি পিটসবার্গ ইউনিভার্সিটি থেকে অবসর নিচ্ছেন, সেই বছরেই পূর্ণ অধ্যাপক হয়েছেন মেনটেন। মাতৃভূমিতে নিজের কেরিয়ার তৈরি করার সুযোগ পাননি, তবু আজীবন ভালবেসে গেছেন দেশকে। অবসরগ্রহণের পরে ফিরে এসেছেন কানাডায়, যেখানকার নাগরিকত্ব তিনি কোনওদিন ত্যাগ করেননি।

আজীবন ভালবেসে গেছেন দেশকে।

মেনটেনের গবেষণার পরিধি ছিল বহুধাবিস্তৃত— প্যাথোলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ক্যানসার বায়োলজির বিভিন্ন ক্ষেত্রে। কিডনি ফাংশন, হিমোগ্লোবিনের ধর্ম, বাচ্চাদের থাইরয়েড টিউমার, ব্লাড সুগার মাত্রার নিয়ন্ত্রণ— এরকম বহু বিষয় নিয়েও কাজ করেছেন। এছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার বৈশিষ্ট্যও সফলভাবে দেখেছিলেন মেনটেন। স্কারলেট অসুখের ইম্যুইনাইজেশেন প্রোগ্রামে বিশেষ সাহায্য করেছিল তাঁর আবিষ্কার। মেনটেনের একাধিক আবিষ্কার চিকিৎসা ক্ষেত্রে আজও ব্যবহার করা হয়। ‘এনজাইম হিস্টোকেমিস্ট্রি’ বিভাগে মেনটেন একজন পথিকৃৎ। অস্বাভাবিক কিডনি ও লিভারের সক্রিয়তা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে মেডিক্যাল এবং বায়োকেমিক্যাল রিসার্চ ও প্যাথোলজি ল্যাবরেটরিতে মেনটেন উদ্ভাবিত ডাই (রং) বিক্রিয়া, কোশ এবং টিস্যুর বিশেষ প্রোটিন চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আজও ব্যবহৃত হয়। প্রোটিন অণু নেগেটিভ এবং পজেটিভ চার্জ যুক্ত হওয়ার যে গুরুত্ব, সেকথা মেনটেনই প্রথম উল্লেখ করেন। এই জ্ঞান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কেন না, চার্জ অনুযায়ী বিভিন্ন প্রোটিন পৃথক করা হয়ে থাকে। সব মিলিয়ে একশোটিরও বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন তিনি।

জীবনভর গবেষণায় রত ছিলেন। বিয়ে করেননি। বিভিন্ন ভাষা নিয়েও ছিল তাঁর দারুণ আগ্রহ, শিখেছিলেন বেশ কয়েকটি ভাষা। বার্লিন হাসপাতালে কাজ করার সময় খুব কম সময়ের মধ্যে শিখে নিয়েছিলেন জার্মান ভাষা। এছাড়াও রাশিয়ান, ফরাসি, ইতালিয়ান, নেটিভ আমেরিকান ভাষাতেও স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি। ভালবাসতেন মিউজিক। ক্ল্যারিনেট বাজাতেন। ফুরসতে পর্বত অভিযানে যেতেন। ছিলেন একজন শখের অ্যাস্ট্রোনোমারও। চিত্রশিল্পে তাঁর অনুরাগের কথাও আলাদা করে বলতে হয়। বস্তুত তিনি ছিলেন একজন পরিপূর্ণ চিত্রশিল্পী। মূলত তেলরঙে ছবি আঁকতেন। আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনী হয়েছে তাঁর চিত্রশিল্প।

মাড লিনোরো মেনটেন অঙ্কিত একটি চিত্র।

মজার কথা, সবকিছু অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সামলাতে পারলেও একটি বিষয় তিনি কোনওদিনই ঠিকঠাক ‘মেইনটেন’ করতে পারতেন না। সেটি হল তাঁর শখের মডেল-টি ফোর্ড গাড়ি চালানো। তিনি পিটসবার্গে অকল্যান্ডের আশেপাশে কিংবা ছায়াময় কোনও জায়গায় সময় পেলেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন,  তখন তাঁর গাড়িটি বিপজ্জনকভাবে একদিকে কাত হয়ে থাকত। কখনও এদিক তো কখনও রাস্তার অন্যপাশে। সেখানকার বাসিন্দারাও বিষয়টি ভাল করেই জানতেন, তাই মেনটেন গাড়ি নিয়ে বের হলেই, পথচারীরাও সতর্ক হয়ে সরে যেতেন।

‘Michaelis-Menten Equation’-এর শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে FEBS Journal of Science-এর একটি রচনায় লেখা হয়েছিল, আদতে ইক্যুয়েশনটি ছিল মেনটেনের মস্তিস্কপ্রসূত। আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার, সেই যুগান্তকারী গবেষণাপত্রে প্রথম গবেষক হিসেবে নাম ছিল মিশালিসের এবং মেনটেনের নামটি দ্বিতীয়। পাশাপাশি, মেনটেনের নামের আগে ‘Dr’ না লিখে লেখা হয়েছিল ‘Miss’।

আধুনিক ওষুধ, চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং প্রাণরসায়ন বিদ্যার ভিত্তিই হল মেনটেনের আবিষ্কার। তবু মেনটেন সম্পর্কে আজও কাউকে জিজ্ঞেস করলে, অন্য প্রান্ত থেকে পাল্টা প্রশ্ন আসে: ‘কে তিনি?’ আসলে, সেই অগ্র্গামী গবেষক-চিকিৎসকের কথা সকলের বিস্মৃতির অন্ধকার আড়ালে চলে গিয়েছে। তবে ১৯৯৮-এ মেনটেনকে মরণোত্তর ‘কানাডিয়ান মেডিক্যাল হল অফ ফেম’ প্রদান করা হয়, তা সম্ভবত এই বিস্ময়কর প্রতিভাময়ীকে বিস্মরণের কিছুটা পাপস্খালনের চেষ্টা।

বায়োকেমিস্ট্রির অগ্রপথিক হিসেবে স্বীকৃতির যোগ্য মেনটেন। গবেষণায় তাঁর অবদান সম্পর্কে  জানার পাশাপাশি মেনটেনের অসম্ভব মনের জোর, কঠিন সংকল্প, মনোবল ও অসীম সহ্যশক্তির কথা জানুক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যা সকলকেই অনুপ্রাণিত করবে সন্দেহ নেই।

আজ ২০ মার্চ। মাড লিনোরো মেনটেনের জন্মদিন। আমাদের শ্রদ্ধা মেশানো ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিলাম তাঁর স্মৃতিতে।

চিত্র: গুগল
5 5 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Nushan
Nushan
1 year ago

শ্রদ্ধা।

মোহাম্মদ কাজী মামুন
মোহাম্মদ কাজী মামুন
1 year ago

মেনটেন সত্যি অনাবিষ্কৃত। আমি প্রথম এই নিবন্ধ থেকেই তাকে জানলাম। ছোট্র পরিসরে খুব সুন্দর করে তাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। গাড়ি চালানোর বিষয়টা ইন্টারেস্টিং ছিল।

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »