সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে বিশ্ববন্দিত। এই উপমহাদেশে তো বটেই, এমনকি বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তিনি এক উজ্জ্বল প্রতিভা। তাঁর সম্পর্কে বিখ্যাত জাপানি চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরোসাওয়ার মন্তব্য, ‘I feel that he (i. e. Satyajit Ray) is a ‘giant’ of the movie industry… not to have seen the cinema of Ray means existing in the world without the sun or the moon’।
সত্যজিৎ মানে কেবল চলচ্চিত্র পরিচালক নন। বহুমুখী প্রতিভা ছিল তাঁর। কেবল সিনেমার কথাই যদি বলি, ছবির চিত্রনাট্য, সংলাপ, একটা পর্যায়ের পর সঙ্গীত পরিচালনা, এসব তিনি নিজেই করতেন। ক্যামেরায় বা শিল্পনির্দেশনায়, সম্পাদনায় অন্য লোক ছিলেন বটে, তবে এসব-ও মূলত তিনি-ই দেখতেন। ছবির জন্য অনেক সময় গান-ও লিখেছেন তিনি। ‘দেবী’ (এ-ছবির জন্য ব্রাহ্ম সত্যজিৎ শ্যামাসঙ্গীত পর্যন্ত লেখেন!), ‘চিড়িয়াখানা’, আর সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘গু গা বা বা’-র গানগুলি তাঁর রচিত। পরবর্তীকালে ‘হীরক রাজার দেশে’-র গানগুলিও। লিখেছেন অন্য পরিচালকের ছবির চিত্রনাট্য,— ‘বাক্সবদল’ (পরিচালক নিত্যানন্দ দত্ত), ‘উত্তরণ’, ‘গুপী বাঘা ফিরে এলো’ (পরিচালক সন্দীপ রায়)। বেশ কিছু তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন, কণ্ঠ দিয়েছেন একাধিক তথ্যচিত্রে।
ছবি করেছেন বাংলা, হিন্দি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষায়। তাঁর ছবির অধিকাংশ কাহিনি যেমন বিখ্যাত বাংলা গল্প-উপন্যাস থেকে নেওয়া, যেমন রবীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, পরশুরাম (রাজশেখর বসু) প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,— তেমনই নিজের কাহিনি নিয়েও বেশ কিছু ছবি তৈরি করেছেন তিনি। আবার ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘হীরকরাজার দেশে’, ‘আগন্তুক’ এবং ‘নায়ক’ প্রভৃতি ছবির সরাসরি চিত্রনাট্য লেখেন তিনি, অর্থাৎ এগুলির জন্ম চিত্রনাট্য রূপেই। এগুলোর মধ্যে ‘হীরকরাজার দেশে’ বাংলা সিনেমার ইতিহাসে অভিনব ও অভূতপূর্ব, কেননা ছবিটির চোদ্দ আনা অংশ-ই অসামান্য পদ্যে রচিত। বাংলা চলচ্চিত্রে এমন সার্থক নিরীক্ষা আর কারও নেই। এডওয়ার্ড লিয়রের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করে কবিতায় তাঁর দক্ষতা আগেই প্রমাণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু আগাগোড়া ছন্দে লেখা সিনেমা, আর সেই পদ্যবন্ধ সর্বসাধারণের কাছে বোধগম্য, উপভোগ্য আর রসমণ্ডিত করে তোলা, এজন্য তাঁকে আলাদা করে কুর্নিশ জানাতে হয়।
সত্যজিৎ রায়ের ছবি ও অন্যান্য কাজের মধ্যে তাঁর ব্যক্তিমানুষের কয়েকটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
প্রথমত, তাঁর অনুপ্রাসপ্রিয়তা। তাঁর লেখা ফেলুদা-কাহিনির নাম ‘কৈলাশে কেলেঙ্কারী’, ‘যতো কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’, ‘গোরস্তানে সাবধান’, এরকম। এমনকি তাঁর সৃষ্ট চরিত্র লালমোহনবাবু ওরফে জটায়ু যে গোয়েন্দাগল্প লেখেন, তার নাম-ও ‘সাহারায় শিহরণ’। সত্যজিতের ছবিতে যে সংলাপ ব্যবহৃত, সেখানেও সুযোগ পেলে তিনি অনুপ্রাস নিয়ে আসেন।
দ্বিতীয়ত, হাস্যরস তাঁর ছবি ও সাহিত্যে একটি বিরাট স্থান জুড়ে আছে। এ-ব্যাপারে তিনি পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর এবং পিতা সুকুমার রায়ের সার্থক উত্তরসূরি। পিতামহের মধ্যে হাস্যরসের মৃদুতা ছিল, পিতা তো সৃজনশীল লেখায় হাস্যরসের হিমালয়। সত্যজিৎ এমনকি তাঁর ছবির গাম্ভীর্যের মধ্যেও যে চকিতে সামান্য মুহূর্তের জন্য হাস্যরসের অবতারণা করতে পারেন, তার বহু প্রমাণ তাঁর ছবিগুলোতে আছে। এ নিয়ে দস্তুরমতো গবেষণা হওয়া সম্ভব।
তৃতীয়ত, তাঁর ছবি ও ছবি। অর্থাৎ চিত্র ও চলচ্চিত্র। প্রতিটি চলচ্চিত্র নির্মাণের আগে পুরো সংলাপের সঙ্গে তিনি ছবি এঁকে দৃশ্যগুলিকে নিজের কাছে স্পষ্ট ধরে রাখেন। আমরা জানি, আইজেনস্টাইন-ও করতেন এটা। অংশত আকিরা কুরোসাওয়া-ও। কিন্তু এত ব্যাপকভাবে নয়। পিতা-পিতামহের চিত্রশিল্পীসত্তা তাঁর ভিতর দিয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে বর্তেছে। তাছাড়া তিনি শান্তিনিকেতনের কলাভবনে কিছুদিন পাঠ নিয়েছেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় এবং নন্দলাল বসুর কাছে। পিতামহ একদা রবীন্দ্রনাথের ‘নদী’ কাব্য চিত্রায়িত করেছিলেন, আর তার-ই পরম্পরায় সত্যজিৎ গেলেন রবীন্দ্রসামীপ্যে, হাতেকলমে ছবি আঁকার পাঠ নিলেন, আর সেখানকার সমৃদ্ধ পাশ্চাত্য সঙ্গীতের রেকর্ড শুনে শুনে নিজেকে ঋদ্ধ করলেন। প্রসঙ্গত, সতেরো বছর বয়সে বিলেত গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ভর্তি হয়েছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্য কোনও ক্লাস না করে লাইব্রেরিতে কাটাতেন, আর ক্লাস করতেন কেবল পাশ্চাত্য সঙ্গীতের। যার ফলশ্রুতি ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’, এবং তাঁর বহু গানে পাশ্চাত্য সুর, চেলোর ব্যবহার। সেই সূত্রেই শান্তিনিকেতনে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের রেকর্ড আসত ভূরিভূরি, সমৃদ্ধ করতে পেরেছিল সত্যজিতের সঙ্গীতক্ষুধাকে।
চতুর্থত, ডিটেইলিং। তাঁর ছবির অনন্য বৈশিষ্ট্য এটা। কাহিনিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে, তা গল্প-উপন্যাস-ই হোক বা সিনেমা, ডিটেইলিং অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ঘটনা, চরিত্র আর পরিপার্শ্ব বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে এতে।
উদাহরণ দেওয়া যায় প্রচুর। একটা দেওয়া যাক। ‘চারুলতা’ ছবিতে ভূপতি একটি পত্রিকার সম্পাদক-মালিক। শ্যালক টাকা তছরুপ করে পথে বসিয়েছে তাকে। মানুষের এহেন নীচতায় ভূপতি বেদনার্ত। স্ত্রী চারুকে নিয়ে সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রগর্জন শুনতে শুনতে ভূপতি তার পত্রিকা পুনরায় প্রকাশে আগ্রহী হয়ে উঠে বলেন, ‘ওসব সমুদ্রগর্জনটর্জন যা-ই বলো, there is nothing but the sound of printing press’। সংলাপটি তাইতে অনেক অর্থবহ হয়ে উঠল, ভূপতির চরিত্রটি ওই একটিমাত্র বাক্যে গভীরপ্রোথিত হয়ে গেল। আবার ‘অশনিসঙ্কেত’-এ পাই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে গ্রামের মানুষের আলোচনার মধ্যে একজন যুদ্ধের ভয়াবহতা কিছু নেই, একথা বোঝাতে গিয়ে এই বলে নিশ্চিন্ত করে সমবেত লোকদের, ‘এতবড় কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হল আঠারোদিনে…’, অর্থাৎ চিরায়ত ভারতীয়ের মতোই সে সবকিছুকেই রামায়ণ-মহাভারতের তৌলে বিচার করে। এস. ওয়াজেদ আলীর ‘ভারতবর্ষ’ লেখাটিতে যেমন, এখানেও অনাদি ভারতের গণমনকে ছুঁয়েছেন সত্যজিৎ। তাঁর অসাধারণত্ব এখানেই।
পঞ্চমত, তাঁর ছবিতে নারীচরিত্র গভীর এবং সপ্রতিভ মাত্রা নিয়ে আসে। ‘মহানগর’ ছবিতে নায়িকার যে প্রতিবাদ, চাকরি ছেড়ে বেরিয়ে আসা, অথবা ‘সীমাবদ্ধ’-তে নায়কের অসততা জানার প্রতিক্রিয়ায় জামাইবাবুর উপহৃত ঘড়িটি ফিরিয়ে দেওয়া, ‘শাখাপ্রশাখা’-য় পুরো পরিবারটির কমবেশি স্বার্থান্বেষী স্বভাবের বাইরে গিয়ে বড়বউয়ের মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরা, কিংবা ‘আগন্তুক’-এ প্রধান চরিত্রটির আগাগোড়া স্বামীর সন্দেহপরায়ণতার (নায়িকার মামাকে তার সর্বদা অকারণেই জাল মনে হচ্ছিল) বিরুদ্ধে জেহাদ, নারীচরিত্রের দৃঢ়তা, সততা, ইতিবাচক দিকের সামান্য উদাহরণ মাত্র।
এরকম আরও বহুতর বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত ও অনন্যতায় ভাস্বর সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র। ছবির পরিচালক-চিত্রনাট্যকার-গীতরচয়িতা-সঙ্গীত পরিচালক, প্রযোজক। কখনও কখনও ক্যামেরা ও সম্পাদনাতেও হাত লাগাতেন। আর কেবল তো চলচ্চিত্রকার-ই নন তিনি, লেখক, ইলাসট্রেটর, ‘সন্দেশ’ নামে ছোটদের পত্রিকাটির সম্পাদক, এই সমস্ত ভূমিকা সার্থকভাবে পালন করে গেছেন আজীবন।
এইসব ও আরও অনেক কিছু নিয়ে সত্যজিৎ।