চিন্তানায়ক সরদার ফজলুল করিম (১ মে ১৯২৫-১৫ জুন ২০১৪), রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রিয় সরদার স্যার মানব-জীবনকে অর্থহীন, বিবর্ণ কিংবা তুচ্ছ মনে করেননি কখনও। সত্যনিষ্ঠা ও দার্শনিক উপলব্ধি দিয়ে আমৃত্যু তিনি জীবনের অর্থময়তা খুঁজেছেন। প্রচণ্ড আশাবাদী মানুষ ছিলেন তিনি। নিজে বিশ্বাস করতেন, তাঁর সমগ্র জীবনটাই নাকি লাভের, লোকসান বলে কিছু নেই। চারবার ১১ বছরের জেলজীবন, ৫৮ দিনের অনশন, কমরেড মুজাফফর আহমেদের সামনে বিলেতে বৃত্তির আমন্ত্রণপত্র ছিঁড়ে ফেলা, কমিউনিস্ট পার্টির হুকুমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়া, ৮৫ বছর বয়সে পা রেখেও জীবিকার জন্য ছোটাছুটি করা, এ-ও নাকি লাভ, আনন্দ, বেঁচে থাকার— জীবন যাপনের। তিনি বলতেন, ‘তোমরা হতাশার কথা বলো? হতাশ হওয়ার কী আছে?’ তিনি আরও বলতেন, ‘জীবন একটা একমুখো অন্ধগলি। এখানে সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া পিছিয়ে আসার কোনও উপায় নেই। হয়তো কেউ ভাবতে পারে, এই রাস্তাটা ঠিক না, তখন সে পিছিয়ে যেতে পারে। এরপর আবার এগিয়ে যেতে হবে সামনে। জীবন শুধু সামনেই এগিয়ে যায়।’
বিপ্লবের মাধ্যমে বৈষম্যমুক্ত, ন্যায়ানুগ ও সুষম সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি নিরাপদ জীবন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ত্যাগ করে বেছে নিয়েছিলেন আত্মগোপনের রাজনীতি, কমিউনিস্ট পার্টি করতে গিয়ে কারাভোগ করেছেন। তারপরও সমাজের পরিবর্তন হয়নি, মানুষের সামগ্রিক মুক্তির জন্য বিপ্লব সংঘটিতও হয়নি। এতে তিনি হতাশায় ম্রিয়মাণ হয়ে যাননি। বরং তিনি মনে করতেন, ‘সমাজে অনেক পরিবর্তন এসেছে, যা আগে কল্পনা করতেই পারতাম না। তোমরা বলো বিপ্লব আসবে, আমি বলি, বিপ্লবের মধ্যে আমার বসবাস।’ তার পরও ব্যক্তি মানুষ হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে তাকিয়ে কখনও কখনও হতাশ হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘শিশুতীর্থ’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, ‘কিন্তু সূর্য আর ওঠে না। অন্ধকার গভীর থেকে গভীরতর হয়। আর্তনাদ ওঠে। এখন কি উপায়? কোথায় যাবো আমরা? কোথায় যাচ্ছি? এখন কে আমাদের পথ দেখাবে?’— এত মৃত্যু, হত্যা, যুদ্ধ দেখে সরদার স্যার মাঝে মাঝে ক্লান্ত, হতাশ হয়েছেন। ক্ষোভ আর বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। সিদ্ধান্তের দ্বন্দ্বে অস্থির ও পীড়িত বোধ করেছেন। তাই রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাতে চাননি, চূড়ান্ত বিচারে তিনি মানুষের প্রতি আস্থাশীল হয়ে জীবনের জয় ঘোষণা করেছেন আশাবাদী মানুষ হিসেবে। প্রবল আত্মশক্তিতে ও আশাবাদে উজ্জীবিত হয়ে উচ্চারণ করেছেন, ‘জীবন বনাম মৃত্যুর যে-লড়াই আজ চলছে, তাতে জীবনই জয়ী হবে, মৃত্যু নয়।’ তিনি স্বপ্নের মানবিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য ‘হাজার বছর’ লড়াই করতেও প্রস্তুত ছিলেন। খরা, বন্যা, মারি মড়ক, ফসলহানিতেও একজন কৃষক ধৈর্য্যচ্যুত হন না, তেমনই সরদার স্যারও জীবনযুদ্ধে ধৈর্যহারা হননি। ‘কৃষকের পোলা’ হিসেবে ‘শুধু বাপের ঋণ শোধ করতে’ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন সারাজীবন। তিনি সবাইকে পূর্বপুরুষের ঋণ শোধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে তাগাদা দিয়ে গেছেন বারবার। কালিতে-কলমে, বর্ণে-বর্ণনায়, সভায়-সেমিনারে। মানুষের অমিত শক্তি ও সম্ভাবনার জয়গান গেয়েছেন।
তাঁর জন্ম বরিশালের এক কৃষক পরিবারে। তার পিতা খবিরউদ্দিন সরদার কৃষিকাজ করতেন, সরদার স্যার নিজেকে ‘কৃষকের পোলা’ হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন। কৃষি ও কৃষকরা যে পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের আধার তা এই ‘কৃষকের পোলা’ বিস্মৃত হননি তিলেক দণ্ডের জন্যও। এই কৃষকসমাজই নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য লড়াই করেছে, রক্ত দিয়েছে। সেই লড়াইয়ের একজন অংশীজন হিসেবে এক অতুলনীয় গৌরব অনুভব করেছেন।
তিনি ‘আমাদের সময়ের এক অসাধারণ মানুষ— যেন বাংলাদেশে এ যুগের সক্রেটিস। মানবমুক্তির দর্শনে আজীবন বিশ্বাসী বাঙালি জাতির এক বাতিঘর। শিক্ষক, বিপ্লবী, জীবনঘনিষ্ঠ দার্শনিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাহিত্যিক— এসব পরিচয়েই যাকে বাঁধা যায় না, তিনি এর বেশি আরও কিছু।’ তাঁর উচ্চচিন্তা, মানবিকতা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞান, সাধারণ জীবনের প্রতি ভালবাসা থেকে বাঙালি প্রজন্ম-পরম্পরায় অনুপ্রেরণা পাবে, সংকট-সমস্যায় পাবে ধ্রুবতারকার দিশা। তাঁর অনুবাদকর্মের মাধ্যমেই আমরা গ্রীক ও পাশ্চাত্য দর্শনের বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। প্লেটোর সংলাপ, অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স, রুশোর সোশ্যাল কনট্র্যাক্ট, এঙ্গেলসের অ্যান্টি-ডুরিং তাঁর মাধ্যমেই বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
সরদার স্যারের অনূদিত প্লেটোর সংলাপের পাঠ গ্রহণ করলে বোঝা যায় যে, সত্যিই তিনি এ যুগের সক্রেটিস ছিলেন। প্লেটোর সংলাপ থেকে জানা যাবে সক্রেটিসের মৃত্যু নিশ্চিত। কারারুদ্ধ সক্রেটিসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন তাঁর পরিজন, স্বজন ও বন্ধুরা। দেখা করতে আসা এক ধনী বন্ধু তাঁকে পালিয়ে যেতে অনুরোধ জানায়। কিন্তু বন্ধুটির অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে সক্রেটিস জানান যে, ‘তিনি পালাবেন না’। তিনি বলেন, ‘কোনও মানুষের যেমন আত্মহত্যার অধিকার নেই, আত্মহত্যা করা এক ঘৃণ্য অপরাধ, তেমনই রাষ্ট্রের আইন লঙ্ঘন করে পালিয়ে যাওয়াও এক ধরনের অপরাধ।’ সক্রেটিস তাঁর বন্ধুকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন যে, তিনি পালাবেন না বরং মৃত্যুকেই মঙ্গলময় জেনে আলিঙ্গন করবেন। বন্ধুর সঙ্গে সক্রেটিসের সংলাপ এত হৃদয়গ্রাহী, সাবলীল, ক্ল্যাসিক যে, তার উত্তাপ ও বর্ণনা সহজেই পাঠকের অন্তরে পৌঁছে যায়। এর কারণ, সরদার স্যার কেবল অনুবাদক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন প্রজ্ঞাদীপ্ত দার্শনিক। তিনি সক্রেটিসের নৈতিক দর্শন আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন বলেই এ অনুবাদটি সহজ ও সাবলীল হয়েছে।
ছাত্র হিসেবে সরদার স্যার ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য, আইএ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনবিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৬ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু মানুষের মুক্তির জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ত্যাগ করেন। এ কালের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক কি সরদার স্যারের পথ অনুসরণ করতে পারবেন? স্বাধীনতার পর প্রফেসর আবদুর রাজ্জারে প্রচেষ্টায় সরদার স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পুনরায় ফিরে এসেছিলেন।
যৌবনে তিনি যোগ দিয়েছিলেন মানবমুক্তির সংগ্রামে। প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তনের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন বামপন্থী মতাদর্শে প্রাণিত হয়ে। জীবনের সায়াহ্নেও তিনি বাংলাদেশের জনপরিমণ্ডলে দার্শনিক চেতনা ছড়িয়ে দেয়ার কাজ বেছে নেন গ্রন্থ ও নিবন্ধ রচনা, অনুবাদকর্ম ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান-সেমিনারে বক্তৃতা প্রদানের মাধ্যমে। তিনি যেমন ক্ল্যাসিক ও মৌলিক বই লিখেছেন ও অনুবাদ করেছেন; তেমনই মননশীল গ্রন্থ রচনা করেছেন সমাজকে উজ্জীবিত করতে। তিনি রাজনৈতিক বিশ্বাসে বামপন্থী হলেও জ্ঞানসাধনায় ছিলেন নির্মোহ, নিরাসক্ত ও মানবিক। তিনি নবি করিম (সা.)-এর জীবনাদর্শ থেকে শিখতে চেয়েছেন, আবার সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, গৌতম বুদ্ধ, বিবেকানন্দের দর্শনকে নিজ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মান্য করেছেন। তিনি বলতেন, ‘নিজেকে জানো— বলে সক্রেটিসের একটি কথা আছে। তুমি নিজেকে জানো, মানে নিজেকে মানুষ করো তবেই না তোমাকে দেখে আর-একজন উদ্বুদ্ধ হবে। (সংস্কৃততে বলে, ‘আত্মানাং বিদ্ধি’) স্বামী বিবেকানন্দ, গৌতম বুদ্ধ সবারই ব্যাপার হচ্ছে এই। গৌতম বুদ্ধ নিজের সন্তান-সন্ততি ফেলে চলে এলেন, কাদের জন্য? দুঃখ-জরা এগুলো জয় করার জন্য। কাদের জন্য জয় করা? নিজের জন্য জয় করা না। মানুষের জন্য জয় করা।’
তিনি কেবল বামপন্থী দার্শনিকদের নিয়ে লেখেননি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও লিখেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে মনে করতেন সান ইয়াৎ সেন, গান্ধী, নেহরুদের পর্যায়ের মহান নেতা। তিনি বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নামের সঙ্গে ১৯৭১ সালের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবনের আবেগময় সম্পর্ক রয়েছে, একদিন হয়তো তার ব্যঞ্জনা ও তাৎপর্য ইতিহাসের গবেষণার বিষয় হবে। সরদার স্যার যে কত বড়মাপের মানুষ ছিলেন আর কত বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছেন, তা দূর থেকে অনুমান করা খুবই মুশকিল। তাঁর আর-একটি অসামান্য কাজ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ: অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে আলাপচারিতা’। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক কোনও বই লেখেননি, এইচ জে লাস্কির অধীনে তিনি যে থিসিসটি করতে লন্ডনে গিয়েছিলেন সেটিও অপ্রকাশিত আছে, তিনি চাননি সেটি প্রকাশিত হোক। সরদার স্যার অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের দার্শনিক চিন্তাকে কালের গ্রাস থেকে বাঁচিয়ে রাখতে উল্লিখিত বইটি রচনা করেন। এ যেন শিষ্যের সৃষ্টির মধ্যে গুরুর বেঁচে থাকা। আর এভাবে বেঁচে আছেন সক্রেটিস ও নববৈষ্ণববাদের প্রবর্তক চৈতন্যদেব।
সরদার ফজলুল করিম ছিলেন প্রচারবিমুখ মানুষ। নিজ জীবন সম্পর্কে কোনও কিছুই তিনি বলেননি, কোনও টিভি চ্যানেলে তাঁকে দেখা যায়নি। লোকচক্ষুর অন্তরালে সাধকের মতো একাগ্রচিত্তে নিজ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ জানতেন না পথের শেষ কোথায়, সরদার স্যারও পথের শেষ নিয়ে ভাবেননি। হয়তো সে কারণে, নয় দশকের জীবন-পরিক্রমা আর জ্ঞানসাধনায় অবসর নেয়ার চিন্তা করেননি। সক্রেটিসের মতো তিনি জানতেন, জীবনযুদ্ধে পালাবার পথ নেই। তাই নিজ জীবন উৎসর্গ করে গেছেন জীবন রক্ষার তাগিদে। তিনি মানতেন, জীবন দিয়েই জীবন রক্ষা করতে হয়, মৃত্যুকে মেনে নিয়েই জীবন জয়ী হয়। আশাবাদী মানুষ হিসেবে সরদার স্যার গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, ‘জীবন-মৃত্যুর দ্বন্দ্বে জীবনের জয় হয়। মৃত্যুর নয়। জীবনের নবজন্ম হয়, মৃত্যুর নয়।’ এ বিশ্বাস সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক— সরদার স্যারের প্রাক-শতবর্ষ উপলক্ষে এই প্রার্থনা।