Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বিমল মিত্র: তাঁর লেখায় পুরনো কলকাতা জীবন্ত

বাংলা সাহিত্যে তখন চাঁদের হাট। তিন বন্দ্যোপাধ্যায় কথাসাহিত্যের আঙিনা জুড়ে বসে আছেন। শরৎচন্দ্রের লেখার জাদু তখনও ছড়িয়ে আছে পাঠকের মনে। সর্বোপরি আছেন জ্বলন্ত ভাস্কর রবীন্দ্রনাথ। এই সময়ে বাংলা সাহিত্যে এলেন বিমল মিত্র (১৮ মার্চ ১৯১২-২ ডিসেম্বর ১৯৯১)।

তাঁর বাল্য-কৈশোর অবশ্যই এই সাহিত্যের আলোছায়ায় মাখা। গুরুজনদের শাসন ও নিষেধাজ্ঞা পেরিয়ে যেদিন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রথম পড়লেন (ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর), তাঁর মনে হল ব্রহ্মস্বাদ পেলেন। সমগ্র বঙ্কিম-সাহিত্য পড়ার পর তাঁর মনে জাগল ঔপন্যাসিক হওয়ার সাধ।

যদিও তার আগে কিছু অক্ষম কবিতা লিখেছিলেন; যেমন সব বাঙালি ছেলেই লেখে। (ছেলে শব্দটি সন্তান বোঝাতে ব্যবহৃত।) তবু ‘মাসিক বসুমতী’-তে ১৩৩৬-এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম রচনা— কবিতা। ‘তবু ভরিল না চিত্ত’। মনে হল যা বলতে চান, তা ওই কবিতার ছোট আধারে বলা যাবে না। গল্প-উপন্যাসে তিনি সীমা ছাড়াবার সাহস খুঁজে পেলেন। তাঁর ভাষায়—

‘আমার পৃথিবী, আমার সংসার, আমার ভালোবাসা, আমার দুঃখ, আমার লেখা, এই উপলব্ধিটা আমার নিজস্ব মানসিকতার পরিপ্রেক্ষিতে গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে যতটা স্পষ্ট হতো, কবিতায় বা গানে ততটাই হতো না।’

হ্যাঁ, বিমল মিত্র কাব্যের জগৎ ছেড়ে গদ্যের জগতে এলেন। শুরু হল গল্প দিয়ে। তারপর ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক-মশায়ের অনুরোধে ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে আরম্ভ করলেন। ‘সাহেব বিবি গোলাম’ তাঁর সেই স্মরণীয় কীর্তি— সাহিত্যিক জীবনের মাইলস্টোন। যে মহাগ্রন্থ পড়ে স্বয়ং ইন্দিরা দেবীচৌধুরাণী (রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ভাইঝি; প্রমথ চৌধুরীর স্ত্রী) বিমল মিত্রকে অসামান্য একটি চিঠি লেখেন। যেখানে লেখকের লেখার মুন্সিয়ানাকে তারিফ করেছেন। গল্পের অমোঘ টানে কীভাবে ভেসে গিয়েছেন তাও স্বীকার করেছেন। পরিশেষে বলেছেন চমকপ্রদ কথা— ‘আমার মনে হয় এই বইয়ের জন্য লেখকের নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত।’ এই মন্তব্যের পর অন্য কোনও পুরস্কার তুচ্ছ হয়ে যায়।

উল্লেখযোগ্য পুরস্কার বিশেষ পাননি। তবে ১৯৬৪-তে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ গ্রন্থের জন্য পেয়েছিলেন রবীন্দ্র পুরস্কার। বিমল মিত্রের উপন্যাসের বড় গুণ তা সর্বস্তরের পাঠককে টেনে রাখে। রহস্য, সাসপেন্স, কৌতূহল, ঘটনার অপ্রত্যাশিত বাঁকবদল বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠাকে সজাগ রাখে। যে গুণ আমরা দেখেছি শরৎচন্দ্রের লেখায়। তবে পাঠকপ্রিয় হতে গিয়ে লেখক জীবনদর্শনকে তরল করে ফেলেছেন। আমরা মানি, তাঁর লেখায় উনিশ শতক বা পুরনো কলকাতা জীবন্ত হয়ে ওঠে। যেমন পুরনো ইংল্যান্ডকে সজীব করতে পারেন চার্লস ডিকেন্স।

চমৎকার কাহিনি, প্লট, মোচড় দেওয়া পরিণতি সত্ত্বেও কোথায় যেন অভাব বোধ হয়। ইতিহাস জীবন্ত হল বটে, চিরকালীন সত্য হল না। তবু মানতেই হবে, সেই সময়ে বিমল মিত্র অসাধ্যসাধন করেছিলেন। তারাশঙ্করকে রাঢ় বাংলার ও প্রান্তিক জীবনের রূপকার যদি বলি, তো বিমল মিত্র হারানো-পুরনো কলকাতার সফল রূপকার নিশ্চয়ই। তাঁর সাহিত্যকীর্তিকে প্রণাম জানাই।

চিত্র: গুগল
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »