বাংলা সাহিত্যে তখন চাঁদের হাট। তিন বন্দ্যোপাধ্যায় কথাসাহিত্যের আঙিনা জুড়ে বসে আছেন। শরৎচন্দ্রের লেখার জাদু তখনও ছড়িয়ে আছে পাঠকের মনে। সর্বোপরি আছেন জ্বলন্ত ভাস্কর রবীন্দ্রনাথ। এই সময়ে বাংলা সাহিত্যে এলেন বিমল মিত্র (১৮ মার্চ ১৯১২-২ ডিসেম্বর ১৯৯১)।
তাঁর বাল্য-কৈশোর অবশ্যই এই সাহিত্যের আলোছায়ায় মাখা। গুরুজনদের শাসন ও নিষেধাজ্ঞা পেরিয়ে যেদিন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রথম পড়লেন (ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর), তাঁর মনে হল ব্রহ্মস্বাদ পেলেন। সমগ্র বঙ্কিম-সাহিত্য পড়ার পর তাঁর মনে জাগল ঔপন্যাসিক হওয়ার সাধ।
যদিও তার আগে কিছু অক্ষম কবিতা লিখেছিলেন; যেমন সব বাঙালি ছেলেই লেখে। (ছেলে শব্দটি সন্তান বোঝাতে ব্যবহৃত।) তবু ‘মাসিক বসুমতী’-তে ১৩৩৬-এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম রচনা— কবিতা। ‘তবু ভরিল না চিত্ত’। মনে হল যা বলতে চান, তা ওই কবিতার ছোট আধারে বলা যাবে না। গল্প-উপন্যাসে তিনি সীমা ছাড়াবার সাহস খুঁজে পেলেন। তাঁর ভাষায়—
‘আমার পৃথিবী, আমার সংসার, আমার ভালোবাসা, আমার দুঃখ, আমার লেখা, এই উপলব্ধিটা আমার নিজস্ব মানসিকতার পরিপ্রেক্ষিতে গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে যতটা স্পষ্ট হতো, কবিতায় বা গানে ততটাই হতো না।’
হ্যাঁ, বিমল মিত্র কাব্যের জগৎ ছেড়ে গদ্যের জগতে এলেন। শুরু হল গল্প দিয়ে। তারপর ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক-মশায়ের অনুরোধে ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে আরম্ভ করলেন। ‘সাহেব বিবি গোলাম’ তাঁর সেই স্মরণীয় কীর্তি— সাহিত্যিক জীবনের মাইলস্টোন। যে মহাগ্রন্থ পড়ে স্বয়ং ইন্দিরা দেবীচৌধুরাণী (রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ভাইঝি; প্রমথ চৌধুরীর স্ত্রী) বিমল মিত্রকে অসামান্য একটি চিঠি লেখেন। যেখানে লেখকের লেখার মুন্সিয়ানাকে তারিফ করেছেন। গল্পের অমোঘ টানে কীভাবে ভেসে গিয়েছেন তাও স্বীকার করেছেন। পরিশেষে বলেছেন চমকপ্রদ কথা— ‘আমার মনে হয় এই বইয়ের জন্য লেখকের নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত।’ এই মন্তব্যের পর অন্য কোনও পুরস্কার তুচ্ছ হয়ে যায়।
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার বিশেষ পাননি। তবে ১৯৬৪-তে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ গ্রন্থের জন্য পেয়েছিলেন রবীন্দ্র পুরস্কার। বিমল মিত্রের উপন্যাসের বড় গুণ তা সর্বস্তরের পাঠককে টেনে রাখে। রহস্য, সাসপেন্স, কৌতূহল, ঘটনার অপ্রত্যাশিত বাঁকবদল বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠাকে সজাগ রাখে। যে গুণ আমরা দেখেছি শরৎচন্দ্রের লেখায়। তবে পাঠকপ্রিয় হতে গিয়ে লেখক জীবনদর্শনকে তরল করে ফেলেছেন। আমরা মানি, তাঁর লেখায় উনিশ শতক বা পুরনো কলকাতা জীবন্ত হয়ে ওঠে। যেমন পুরনো ইংল্যান্ডকে সজীব করতে পারেন চার্লস ডিকেন্স।
চমৎকার কাহিনি, প্লট, মোচড় দেওয়া পরিণতি সত্ত্বেও কোথায় যেন অভাব বোধ হয়। ইতিহাস জীবন্ত হল বটে, চিরকালীন সত্য হল না। তবু মানতেই হবে, সেই সময়ে বিমল মিত্র অসাধ্যসাধন করেছিলেন। তারাশঙ্করকে রাঢ় বাংলার ও প্রান্তিক জীবনের রূপকার যদি বলি, তো বিমল মিত্র হারানো-পুরনো কলকাতার সফল রূপকার নিশ্চয়ই। তাঁর সাহিত্যকীর্তিকে প্রণাম জানাই।