Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

যখন মাইলস্টোন ছিল না, তখন পথ চেনাতেন ‘পাথর বুড়ি’

একথা আমরা অনেকেই জানি, পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কলকাতায় আসার পথে বালক ঈশ্বরচন্দ্র পথের পাশের মাইল-ফলক (Milestone) দেখে দেখে ইংরেজি বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। আধুনিক কালের মাইলস্টোন আসলে মাইল বা দূরত্ব নির্দেশক স্তম্ভ বা প্রস্তর। কিন্তু তারও আগে যখন রাস্তার ধারে কোনও দূরত্ব-নির্দেশক স্তম্ভ বা পাথর ছিল না, তখন পথ চেনাতেন ‘পাথর বুড়ি’। স্তূপের আদলে আদিকালের মাইল-ফলক ‘পাথর বুড়ির থান’ এখনও পথিককে পথ চেনায়। লৌকিক দেবী ‘পাথর বুড়ি’-র ঠিকুজিকুষ্ঠি জানার আগে, আসুন, রাঢ়বাংলার ইতিহাস খানিক জেনে নিই।

জানা যায়, বীরভূমের আদি নাম ছিল ‘রাঢ়’। রাঙামাটির দেশ। এই রাঢ়ের উত্তর-পূর্বে ছিল গৌড়, পূর্বে গঙ্গা, দক্ষিণে সমতট বা মেদিনীপুর এবং পশ্চিমে মিথিলা। রাঢ়ের দুটি ভাগ— উত্তর রাঢ় এবং দক্ষিণ রাঢ়। গঙ্গা, ভাগীরথী আর অজয় পরিবেষ্টিত অংশ হল উত্তর রাঢ়, যা রাঢ়ের মূল ভূমি হিসেবে গণ‍্য। অন্যদিকে, অজয় ও দামোদরের মধ‍্যবর্তী ভূ-ভাগটি দক্ষিণ রাঢ়, যেটি রাঢ়ের দক্ষিণ দিকের সম্প্রসারিত বা বর্ধিত অংশ। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকের ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দিনের লেখা ‘তবকৎ-ই-নাসিরি’-র বর্ণনা অনুযায়ী, গঙ্গার পশ্চিমে ‘রাল’ অর্থাৎ ‘রাঢ়’। সুতরাং, ঐতিহাসিক মিনহাজের বয়ান অনুসারে, খ্রিস্টীয় দ্বাদশ থেকে অন্তত খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত ‘রাঢ়’ নামটি প্রচলিত ছিল।

‘রহ্’ ধাতুর সঙ্গে ভাবার্থে ‘ঘঞ্’ প্রত‍্যয় যোগে নিষ্পন্ন হয়েছে ‘রাঢ়’ শব্দ, যার অর্থ হল ‘নিয়ত গতিশীলতা’। আসলে ত‍্যাগব্রতধারী পরিব্রাজক আর্য ঋষিরাই ছিলেন নিয়ত গতিশীল। কোনও একটি বিশেষ জায়গায় মায়ার বাঁধনে বাঁধা না পড়ে তাঁরা ছিলেন সতত বিচরণশীল। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বিচরণ করে বেড়াতেন তাঁরা এবং তাই তাঁরা ছিলেন ‘রাঢ়া’। আর এই ‘রাঢ়া’-দের বিহারক্ষেত্র বলে তাদের লালমাটির এই ভূমির নাম ‘রাঢ়’। রাঢ়ভূমির উত্তরাংশের নাম পরবর্তীকালে হয়েছে ‘বীরভূম’। রাঢ়ের এই ‘বীরভূম’ নামকরণ আমরা দেখতে পাচ্ছি, খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীতে ‘মহেশ্বরের কুলপঞ্জিকা’-তে। সেখানে উল্লিখিত রয়েছে, ‘বীরভূঃ কামকোটী স‍্যাৎ প্রাচ‍্যাং গঙ্গাজয়ান্বিতা’।

বীরভূমের সদর শহর সিউড়ি-রাজনগর পিচ রাস্তার ধারে লৌকিক দেবী পাথর বুড়ির থান।

বোঝাই যাচ্ছে, খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যেই রাঢ়ের নতুন নাম হয়েছে ‘বীরভূম’। আবার পরে বীরভূমেরই আরেক নাম হয় ‘ঝাড়খণ্ড’। অনেকগুলো খণ্ড খণ্ড ঝাড়-জঙ্গল ছিল বলেই এই নাম। আজও আমরা খণ্ডাংশ বোঝাতে ‘ঝোপঝাড়’, ‘বাঁশঝাড়’ ইত্যাদি শব্দ ব‍্যবহার করে থাকি। ঘন জঙ্গলাকীর্ণ এই বীরভূমের মাটির বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছিলেন ভাণ্ডীরবনে ঋষি বিভাণ্ডক, বক্রেশ্বরে শ্বেতমুনি শুক্রাচার্য-পতঞ্জলি ও অষ্টাবক্র, তারাপীঠে বশিষ্ঠ, বেহিড়ায় বৃহদারণ‍্যক মুনি, দুবসায় মহর্ষি দুর্বাশা এবং কাঞ্চীক্ষেত্রে মহর্ষি রুরু। ঘন জঙ্গলের জন্য পঞ্চপাণ্ডবরাও তাই তাঁদের অজ্ঞাতবাসের নিরাপদ স্থান হিসেবে এই বীরভূমকেই বেছে নিয়েছিলেন। বীরভূমের বেশি বৈদ‍্যনাথপুর, কোটাসুর, বর্ধমানের পাণ্ডবেশ্বর, ঝাড়খণ্ডের তন্ত্রেশ্বর ও আমজোড়া প্রভৃতি জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে পাণ্ডবদের অজ্ঞাত বাসপর্বের জনশ্রুতি।

একদা ঘন জঙ্গলের মধ্যে যাতে পথ হারিয়ে না ফেলে, সেই আশঙ্কায় এবং বন্য জন্তুর আক্রমণের হাত রেহাই পেতে হাতে পাথর নিয়ে চলাচল করতেন সাধারণ মানুষ। মানুষের আদি অস্ত্র পাথরের টুকরো বা ঢেলা। এক গ্রাম থেকে বিয়ে বা অন্য কোনও প্রয়োজনে পায়ে হেঁটে এই জঙ্গল পেরিয়ে গন্তব্যস্থলে যেতে হত। গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা যেতেন লাঠি হাতে, আর কমবয়সী ছেলেরা মাসির বাড়ি-পিসির বাড়ি যেত পাথরের ঢেলা হাতে এবং এটাই ছিল তখনকার দিনের রেওয়াজ। তারপর নিরাপদ অঞ্চলে পৌঁছে নিশ্চিন্ত হয়ে সেসব পাথরের ঢেলাগুলি ফেলে দিত। নির্দিষ্ট জায়গায় অনেক পাথর জমতে জমতে একসময় সেটাই হয়ে যেত পথের নিশানা। আধুনিক মাইল ফলকের আদি সংস্করণ। এসব পাথরের স্তূপ দেখে পথিকের পথ হারানোর ভয় থাকত না।

এখন আর এলাকায় ঘন জঙ্গল নেই। কিন্তু অনেক জায়গাতেই রয়ে গেছে সেই পাথরের স্তূপ এবং এগুলো আজ পরিচিত হয়ে গেছে ‘পাথরবুড়ির থান’ হিসেবে। গ্রামের পথের ধারে এভাবেই তৈরি হয়েছে এই লৌকিক দেবীর স্থান। পথচলতি মানুষ আজও এই পাথর বুড়ির উদ্দেশে পথের বিপদ কাটাতে প্রণাম জানান। ইটবোঝাই লরি দুটো থান ইট ফেলে দিয়ে যায় পাথর বুড়ির উদ্দেশে। সিউড়ি-রাজনগর পিচ রাস্তার ধারে বড়কোন্দা গ্রামের কাছে এভাবেই মানুষের বিশ্বাসে এখনও দাঁড়িয়ে লৌকিক দেবী এক পাথর বুড়ির থান।

সে জঙ্গল আর নেই। ক্রমে ক্রমে সব জঙ্গল সাফ হয়ে চারপাশে গড়ে উঠেছে চাষের জমি ও আর মানুষের বসতি। কারণ, ‘চাষ’ করতে গেলেই সেই চাষের ফসল সংরক্ষণের জন্য সেখানেই ‘বাস’ করতে হয়। তাই ‘চাষবাস’ শব্দবন্ধের জন্ম। বসতবাড়ি ও চাষ জমির পেট চিরে চলে গেছে পাকারাস্তা। সেই রাস্তার ধারে ‘পাথর বুড়ি’-কে কেউ সরাতে সাহস করেনি আজও। অতীত এখনও মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে। জেটযুগেও দেবতারা বহাল তবিয়তে রয়েছেন তাঁদের নিজেদের জায়গাতেই।

তথ‍্যসূত্র :
১. Annuls of Rural Bengal : W.W. Hunter
২. ব‍্যক্তিগত ক্ষেত্রসমীক্ষা।

চিত্র: লেখক
1 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সোমেন চন্দ: এক বহ্নিময় কথাকার

মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন, যদিও তা অসমাপ্ত থাকে। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘বন্যা’। পরবর্তীকালে উপন্যাসটি অসমাপ্ত-ই থেকে যায়। আরও দুঃখের বিষয়, এর বৃহদংশ হারিয়েও গেছে। আজ যে সোমেন চন্দের লেখককৃতির জন্য আমরা তাঁকে স্মরণ করি, তা হল তাঁর বেশ কিছু অসামান্য ছোটগল্প। সংখ্যায় খুব বেশি নয়, মাত্র চব্বিশটি। আরও কিছু গল্প লিখলেও তা কালের ধুলোয় হারিয়ে গেছে। গল্পের সংখ্যা সামান্য, তবে অসামান্যতা রয়েছে সেগুলির রচনার পারিপাট্যে, বিষয়বস্তু চয়নে, শিল্পিত প্রকাশে ও লেখনীর মুনশিয়ানায়। এছাড়া তিনি দুটি নাটিকাও লেখেন, ‘বিপ্লব’ ও ‘প্রস্তাবনা’। লেখেন কিছু প্রবন্ধ। তাঁর ছোটগল্পগুলি এতটাই শিল্পোত্তীর্ণ ছিল যে, তাঁর জীবিতকালেই একাধিক ভাষায় তা অনূদিত হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »