Search
Search
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ছোটগল্প: পরিযায়ী

মোবাইল ফোনটা একবার বেয়াড়াভাবে ট্যাঁ-ট্যাঁ করে উঠল।

কখন যে চোখদুটো লেগে গেছিল, টের পাননি শ্যামলীদেবী। মোবাইলের আওয়াজে তন্দ্রাটা ভেঙে গেল। পাশে রাখা মোবাইলটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। ধুস, মোবাইল কোম্পানির কীসব অফারের একটা মেসেজ।

‘এই এক জ্বালা, সারাদিনে পঞ্চাশটা মেসেজ আসে!’ খানিকটা স্বগতোক্তির ঢঙে বলে মোবাইলটা রেখে আবার পাশ ফিরে শুলেন শ্যামলীদেবী। প্রথম যখন মোবাইলটা তাঁর জিম্মায় এল, তখন খুব বিরক্তি লাগত! সারাদিনের সংসারের হাড়ভাঙা খাটুনির পর এইসব হাবিজাবি মেসেজ বসে বসে ডিলিট করো রে বাবা। এখন আর অতটা বিরক্তি লাগে না। বোধহয় ধাতে সয়ে গেছে। বরং যখন ওই ‘আপনি মোটা অঙ্কের ডলার জিতেছেন, আপনার ব্যাঙ্ক ডিটেলসটা পাঠান’ গোছের ভুয়ো মেসেজ আসে, তখন খানিক মজাই পান।

নাহ, এখনও ছেলের কোনও মেসেজ আসেনি। মোবাইলের ঘড়িতে সময়টা দেখলেন, সবে সওয়া তিনটে। ছেলের এখনও এয়ারপোর্ট পৌঁছতে দেরি আছে। বেশ কিছুকাল ধরেই ছেলে পড়াশুনার সূত্রে ব্যাঙ্গালোরবাসী। বছরে একবার ছুটি মেলে। তখন ওই মাসখানেকের ছুটিতে বাড়ি আসা। বরও কাজের সূত্রে ভিনরাজ্যবাসী, বছরে দু’বার ছুটি মেলে যদিও। তবে এবারের মতো সবসময়ই যে দুজনের বাড়ি আসার সময় মিলে যায়, তেমনটা নয়। বরের কর্মস্থলে ফেরার সময় হয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। আজ ছেলে রওনা দিল। মফস্বলের দু’কামরার ভাড়াবাড়িতে আবার শ্যামলীদেবী একা। প্রথম প্রথম একটু ভয় ভয় লাগত, মাঝরাতে খুটখাট আওয়াজে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠত। এখন থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ‘শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবেন তাই সয়!’ বিড়বিড়িয়ে বলে নিজের মনেই একবার হেসে ফেললেন শ্যামলীদেবী।

চিৎ হয়ে শুতেই মাথার ওপর ফ্যানটার দিকে নজর গেল। ইসস, বেশ খানিকটা ঝুল জমেছে। ভেবেছিলেন পুজোর আগে টুলে উঠে নিজেই পরিষ্কার করবেন, কিন্তু কাজের চাপে আর শেষমেশ করে ওঠা হয়নি। গরমকালটায় টানা চলার পর এই ঝুলটুল জমে কি ফ্যানটাকে একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছে?

‘যত দিন যাচ্ছে, মা তোমার বাতিকটাও যেন বাড়ছে!’ ছেলের কথাগুলো কানে ভেসে এল! সত্যিই বোধহয় একা থাকতে থাকতে আজকাল এইসব আজগুবি ভাবনাগুলো অজান্তেই এসে ভিড় করে। কোভিডের সময় এই ফ্যান নিয়ে এক উদ্ভট ব্যামো চেপেছিল। তখন বাইরে বেরনো বারণ, ট্রাম-বাস-ট্রেন সব বন্ধ, বাপের জম্মে এমন পরিস্থিতি দেখেননি। প্রাথমিক বিহ্বলতাটা কাটতে একদিন ছেলেকে খানিকটা অনুযোগের সুরেই বলেছিলেন, ‘সারাদিন ঘরে বসে থেকে কী করি বল তো? আর কিছুদিন এইভাবে চললে বাত ধরে যাবে!’

ছেলের চটজলদি নিদান, ‘এ আর এমন কী! এক কেজি চালে ক’টা চাল থাকে গুনে দেখো! নাহলে মাথার ওপর বনবন করে ঘোরা ফ্যানের ব্লেডগুলো মিনিটে ক’বার পাক খায় সেটা গোনো!’

ঝোঁকের মাথায় শুরু করেছিলেন! ফ্যানটা দুইতে ঘুরলে ব্লেডগুলো মিনিটে পঁচাত্তর বার পাক খায়, একে ঘুরলে উনপঞ্চাশ! পরে নিজের বালখিল্যটায় নিজেই বেশ একচোট হেসেছিলেন শ্যামলীদেবী। বাড়তি বিড়ম্বনা এড়াতে বেমালুম কথাটা চেপে গেছিলেন, আর বলেননি কাউকে।

মোবাইলটা আবার ট্যাঁ-ট্যাঁ করে উঠল। নাহ, এবার ছেলেরই মেসেজ: ‘আমি ডানকুনি প্রায় পৌঁছে গেছি।’

যাক, খানিকটা নিশ্চিত হওয়া গেল। আগে এই মফস্বল থেকে দমদমে ফ্লাইট ধরতে ছেলে সেই বাস-ট্রেনের হ্যাপা পেরিয়ে যেত, ইদানীং বাড়ি থেকে টানা গাড়িতেই যায়। একটু বেশি পয়সা যায় বটে, তবে ওই বাস-ট্রেনের হ্যাপা থাকে না। বলা যায় না, গোদের ওপর বিষফোঁড়া কখন যে কী ইস্যুতে বাস-ট্রেন বন্ধ করে বসে! তখন বোঝো ঠ্যালা।

‘আচ্ছা, রাস্তায় কোথাও দাঁড়িয়ে একটু চা খেয়ে নিস।’ মেসেজের একটা ছোট্ট জবাব দিয়ে মোবাইলটা রেখে আবার পাশ ফিরে শুলেন শ্যামলীদেবী।

নিজেরও একবার চা খেলে হয়, শরীরের ক্লান্তিটা একটু কাটে। দিনটা ছোট হয়ে আসছে, পড়ন্ত বিকেলের মরে যাওয়া রোদটা পশ্চিমের জানালা গলিয়ে আলগোছে বিছানায় এসে পড়েছে। বাইরের মিউনিসিপ্যালিটির কলটা থেকে ছড়ছড় করে জল পড়ছে! সাড়ে তিনটে বেজে গেল!

‘উফফ, আবার কোন উজবুক কলটা খুলে রেখে পালিয়েছে!’ নিজের মনেই খানিকটা গজগজ করলেন শ্যামলীদেবী। অন্য সময় হলে উঠে বেরিয়ে কলটা বন্ধ করে আসতেন। চারদিকে পানীয়জলের আকালের যা খবর ছাপে, তাতে বুক শুকিয়ে যাবার যোগাড়। আরও কতদিন এই পৃথিবীতে বাঁচতে হবে, তখন সকালের স্নানের জল মিলবে কি না— সেসব ভাবলেই কেমন যেন সব গুলিয়ে যায়। কিন্তু আজ শরীরটা ছেড়ে দিয়েছে, অহেতুক নড়ানড়ি করতে ইচ্ছে করছে না। ‘ধুর, যা জল পড়ে পড়ুক, আর উঠতে পারছি না’— ভেবে হাই তুলে আর একবার মোবাইলটায় চোখ বোলালেন শ্যামলীদেবী। নাহ, আর কোনও নতুন মেসেজ আসেনি।

ক্যানক্যানে গলায় ‘দুধ নেবেন, দুউধ’ বলে সিধু গয়লা পাড়ায় দুধ দিতে এসেছে। ব্যাটার ভারি দেমাক। কথায় কথায় লোকজনকে শুনিয়ে বলে— ‘আমি দুধে জল মেশাই, কিন্তু জলে দুধ মিশিয়ে লোক ঠকাই না!’

মোড়ের মাথায় প্রতিবেশীরা জটলা করে বৈকালিক পরনিন্দা-পরচর্চার আসর বসিয়েছে, সমবেত গলার আবছা আওয়াজ ভেসে আসছে!

‘রোজ রোজ বাবা এরা পারেও বটে! সারাদিনে কী খায় কে জানে যে, এইসব করার এত্ত এনার্জি পায়!’— নিজের মনে ভেবেই খানিকটা করুণা উদ্রেককারী হাসি হাসলেন শ্যামলীদেবী। কার মেয়ে কার ছেলের সাথে ঘুরছে, কোন বাড়ির কাজের লোক একসপ্তাহের মাথায় ছেড়ে গেছে, দুর্গাপুজোয় কে কম চাঁদা দিয়ে বেশি প্রসাদ ঘরে নিয়ে গেছে— এদের ছেঁদো গপ্পের যোগানের কমতি নেই!

ছেলে ভাল বলে— ‘মা, আসলে পাড়াটা গলির মধ্যে তো, তাই যেমন সূর্যের আলো সোজা না পড়ে খানিকটা তেরছাভাবে পড়ে, তেমনি এদের ক্ষেত্রে শিক্ষার আলোটাও তেরছাভাবে পড়েছে।’ ষাট ছুঁইছুঁই বয়সে এসে এই কেচ্ছায় অংশগ্রহণ করতে চান না শ্যামলীদেবী। তার চেয়ে ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়া বা এফএম রেডিওতে গান শোনা ঢের ভাল।

আজকাল কারওর চিন্তাধারার সাথেই ঠিক মেলাতে পারেন না শ্যামলীদেবী। বয়সের ভার? কে জানে! এই তো ও’পাড়ার কাকলির বছরচল্লিশের বরটা দুম করে ক্যানসারে মারা গেল। এই এক হাড়আপদে রোগ! যখন ধরা পড়ল তখন অলরেডি স্টেজ ফোর, দু’দিনের মধ্যেই সব শেষ। সেই নিয়ে পাড়ায় আলোচনা হচ্ছে, ‘এইবয়সে ছেলেটা চলে গেল, এবার সংসারটা চলবে কী করে’— এইসব বলছেন শ্যামলীদেবী, ওমা! হঠাৎই পাড়ার বাবলু বেশ মুরুব্বিচালে বলে— ‘যাই বলুন কাকিমা! আর যদি ১২ ঘণ্টা লাস্টিং করত, তাহলেই একটা ইতিহাস হয়ে যেত! জন্ম-মৃত্যুদিন সেম। ভাবতে পারছেন! পুরো বিধান রায়ের মতো ব্যাপার!’

এর প্রত্যুত্তরে কী বলবেন বুঝে না পেয়ে গুটিগুটি বাড়ি ঢুকে পড়েছিলেন! জন্ম-মৃত্যু একই দিনে হয়ে ওই অকূলপাথারে পড়া সংসারটার কী যে সুরাহা হত, সে আজও মাথায় ঢোকেনি শ্যামলীদেবীর!

নাহ, এবার চা না খেলেই নয়! গড়িমসি করে বিছানা ছেড়ে নেমে গ্যাসে চায়ের জল বসালেন শ্যামলীদেবী। চারটে বাজলেই আবার খাবার জল ধরতে হবে। ভুলে গেলেই জল ফুড়ুৎ, পরের জলটায় ক্লোরিন না কীসব মেশানো থাকে, খেতে কেমন বিস্বাদ।

শরীরটা যে বেশ ভাঙছে, মাঝে মাঝে ভালই টের পাচ্ছেন শ্যামলীদেবী। আগে সারাদিন হেঁশেল সামলেও দশবার অনায়াসে ছাদে ওঠানামা করে জামাকাপড় রোদে দিয়েছেন। এখন বারদুয়েক ওঠানামা করলেই কেমন বুকে হাঁফ ধরে, মাঝপথে থেমে একটু জিরেন নিতে হয়। উপোষ করলে সন্ধের দিকে শরীরটা কেমন টলটল করে। একা মানুষ, কিছু হলে কে দেখবে— এই সাতপাঁচ ভেবে আর নির্জলা উপোষ করেন না। ছেলে মাঝেমাঝেই বলে— ‘অনেক তো হল! আর এইসব উপোষ করে কী হবে!’ ওই যাকে বলে জাড্যধর্ম! ঝোঁকের বশে করে যান আর কী। নাহ, আজ চায়ের সাথে দুটো বিস্কুট খেতেই হবে, নাহলে শরীরটা আর চলছে না! রাতের জন্য পরোটা করাই আছে, পরে খেলেই হবে। এই আর এক বাতিক শ্যামলীদেবীর। ছেলে কোথাও ফ্লাইটে গেলে ভাত-রুটি কিছু খান না!

ছেলে পইপই করে বলে— ‘এসব করে কী লাভ! তুমি না খেলে কি পাইলট আরও বেশি সাবধানে প্লেন চালাবে? যতসব বাতিক তোমার!’

‘ওসব তুই বুঝবি না’— পাশ কাটানো গোছের উত্তর দেন শ্যামলীদেবী।

‘না বোঝার কী আছে! এ কি রকেট সায়েন্স নাকি? বোঝাতে পারলে ঠিকই বুঝব!’ ছেলেও ছাড়বার পাত্রও না।

আর বেশি কথা বাড়ান না শ্যামলীদেবী, শুধু মৃদু হাসেন একটু। কী করে বোঝান যে, মায়ের অপত্যস্নেহের কাছে এইসব লজিক সবসময় খাটে না!

মোবাইল ফোনটা ট্যাঁ-ট্যাঁ করে উঠল। কোনও মেসেজ এল বোধহয়।

চা নিয়ে ঘরে এসে দেখেন ছেলের মেসেজ— ‘আমি এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেছি। আবার বোর্ডিং শুরু হলে জানাব।’

যাক, খানিকটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।

জীবনে কোনওদিন এয়ারপোর্টে যাননি শ্যামলীদেবী, প্লেনে চড়া তো দূরঅস্ত! যুগের থেকে পিছিয়েপড়া মানুষ। সাথে একটু ভিতুও। সাঁইসাঁই করে প্লেন উড়ছে ভাবলেই কেমন বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করে। জীবনে কখনও সাহস করে মারপিটের সিনেমা দেখতে পারেননি, সিনেমাতে হঠাৎ মারপিটের সিন এসে গেলে ঝপ করে চোখ বুজে ফেলেন!

যা ওই ছেলের থেকে শুনে শুনেই জেনেছেন— ব্যাগেজ ড্রপ, সিকিরিওটি চেক-ইন হ্যানোত্যানো। বড্ড হ্যাঙ্গাম বাব্বাহ।

‘একটা স্মার্টফোন তো নাও এবার! প্লেনে না চড়ো, প্লেন ওড়ার ভিডিও তো দেখতে পাবে!’ ছেলে মাঝেমাঝে জোরাজুরি করে।

‘আমার মতো আনস্মার্ট লোকের জন্য এই পাতি ফোনই ঠিক আছে!’ খানিকটা এড়িয়ে যাওয়ার মতোই উত্তর দেন শ্যামলীদেবী। ওই ইয়া বড় গাব্দা ফোন হাতে নিয়ে কথা বলতে হবে ভাবলেই কেমন কেমন করে। খালি মনে হয়, এইবুঝি হাত ফস্কে পড়ে ভেঙে দু’খান হয়ে যাবে। বা কোন সুইচ টিপতে কোন সুইচ টিপে ফেলব, ব্যস সব টাকা কেটে নেবে।

অন্যদিন এইসময়টায় একটু এফএম রেডিওতে গান শোনেন শ্যামলীদেবী, বা একটু খবরের কাগজটা নেড়েচেড়ে দেখেন। কিন্তু আজ আর সেই এনার্জি নেই। খাবার জলটা ভর্তি করে আবার বিছানায় এসে শুলেন। বিকেলের আলোটা বেশ মরে এসেছে, কার্তিক মাস পড়ে গেছে, বিকেলের দিকে একটু শিরশিরে হাওয়াও দিচ্ছে। একটা হাল্কা চাদর গায়ে ঢাকা দিয়ে গুটিসুটি মেরে শুলেন শ্যামলীদেবী।

কখন যে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন শ্যামলীদেবী, টের পাননি। মোবাইলটা বাজতে তন্দ্রাটা ভাঙল।

হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিয়ে দেখেন ছেলের মেসেজ— ‘মা, বোর্ডিং শুরু হচ্ছে, আমি ব্যাঙ্গালোর নেমে আবার জানাব।’

‘আচ্ছা, সাবধানে যাস!’ ছোট্ট একটা জবাব দিয়ে মোবাইলটা পাশে সরিয়ে রাখলেন শ্যামলীদেবী।

ইসস, ছ’টা বেজে গেছে! সারা ঘরটা অন্ধকার, বাইরে স্ট্রিটলাইট জ্বলে গেছে। উঠে জানালাগুলো বন্ধ করলেন, না হলে মশা ঢুকে পড়বে! বেশ কয়েকদিন ধরে বাড়িটায় কথাবার্তায় গমগম করছিল, আজ থেকে আবার কেমন যেন মনখারাপ-করা নিস্তব্ধতা। অ্যাশট্রে-তে পড়ে থাকা সিগারেটের টুকরো, ছড়িয়ে থাকা টুকিটাকি ছেলের জিনিসগুলো কি শূন্যতাকে আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে? কে জানে…

আবার বছরখানেকের প্রতীক্ষা, মাঝে শতযোজন ভৌগোলিক দূরত্ব, দিনান্তে একবার ফোনে কথা। আজকাল স্মার্টফোনে ভিডিও কল করা যায়, ছেলে বলে। সে যাই হোক, সামনাসামনি কথা বলার স্বাদ কি আর মেটে! মিষ্টির দোকানের শো-কেসে সাজানো মণ্ডামিঠাই যতই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকো, খাবার স্বাদ কি মেটে?

মাঝেসাঝে ঘরটা যে ফাঁকা লাগে না তা নয়। বাজারে আম-লিচু উঠলে, বর্ষায় পাড়ায় ‘টাটকা গঙ্গার ইলিশ, মাত্র ৯০০ টাকা কেজি’ বলে ফেরিওলা হাঁকলে, এক-আধবার মনে হয় ‘ইসস, ছেলেটা ঘরে থাকলে ভাল হত!’ পরক্ষণেই আবার ভাবেন— ‘নাহ বাবা, দূরে আছে, এই পরিযায়ী জীবনই ভালই আছে, অন্তত কাজটা ঠিক করে করার সুযোগ মিলছে!’ সকাল থেকে খবরের কাগজ খুললেই রাজ্যের দৈন্যদশা চোখে পড়ে। চারদিকে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি, চুরি-জোচ্চুরি, যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা দিনের পর দিন হত্যে দিয়ে পড়ে আছে সুবিচারের আশায়, প্রশাসনের কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই! নিজের ঘরেও একটা ছেলে আছে, ওইরকম চাকরির আশায় হত্যে দিয়ে পড়ে আছে ভাবতে গেলেই কেমন হাড় হিম হয়ে আসে শ্যামলীদেবীর। এ বাবা, তার থেকে ভাল, মাস গেলে কাজের পয়সাটা তো ঘরে আসে বর-ছেলের! ছেলে ভাল বলে— ‘মা, এ জগতে অ্যাবসলিউট ভাল বলে কিছু হয় না!’

তাই সই! আর আজকাল তো কত ছেলেমেয়েই কর্মসূত্রে ভিনরাজ্যের বাসিন্দা। তাদের বাড়ির লোকজনও যেমন চালিয়ে নিচ্ছেন, তিনিও ঠিকই পারবেন সবটা একা সামলে নিতে।

নাহ, এবার বেশ খিদেটা পেয়েছে, এবার কিছু না খেলেই নয়! ঘরের আলোগুলো জ্বেলে রান্নাঘরে এলেন শ্যামলীদেবী। টেবিলে রাখা আজকের খবরের কাগজ। হেডলাইনটার দিকে চোখ গেল। কোনও এক মন্ত্রীর দিনবদলের মধুর প্রতিশ্রুতি।

একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে আবার খাবারের আয়োজন করলেন শ্যামলীদেবী। কাল থেকে আবার একাকী দিন গুজরান। চরৈবেতি, চরৈবেতি…

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest


2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Dr. S K Mukhopadhyay
Dr. S K Mukhopadhyay
1 year ago

বাঃ, সুন্দর লেখা। গল্পে একাকিত্ব বেশ আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকলেও, তারই সঙ্গে প্রচ্ছন্ন আছে মনের আসল জোর জায়গাটি। সেই জোরটি প্রবাসী একমাত্র পুত্রের নিয়মিত দূরভাষী যোগাযোগ; সেইসব মিলিয়ে এই গল্পে এসময়ে বাঙলার দশটি ঘরের নয়টি ঘরের মায়ের বিষন্নতা মিশে আছে। চমৎকার

Soumavo Ghosh
Soumavo Ghosh
1 year ago

ধন্যবাদ স্যার!

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
Generic filters
Generic filters