অন্নদাশঙ্কর রায় লালন ও পাগলা কানাই সম্পর্কে বলেছেন, ‘পাগলা কানাই নাম যার তিনি পাগলও না, হিন্দুও না। তিনিও লালনের মতো মুসলমান। হিন্দু-মুসলমান ভেদবুদ্ধির ঊর্ধ্বে।’ লালন ফকির মুসলমান ছিলেন কিনা জানি না, তবে তাঁর জাতধর্ম, জীবন-কাহিনি, বংশ পরিচয় ও জন্মস্থান নিয়ে যত আলো-আঁধারি ও গালগল্প রয়েছে তার এক-দশমাংশও নেই পাগলা কানাইকে নিয়ে। একুশ শতকের দাঁড়িয়েও বিস্ময় জাগে, একজন ফকিরকে নিয়ে কেন এত আলো-আঁধারি? কেন এত কিংবদন্তি? লালনের জীবনপ্রত্যয়, দর্শন ও সঙ্গীতজগৎকে একপাশে সরিয়ে রেখে তাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়ে এত তর্ক-প্রতর্ক ডালপালা মেলল কেন? আর কেনই বা লালনের জীবনকাহিনি নিয়ে এত মিথ বানিয়ে তোলা হল? লালনের মতো পাগলা কানাইও ছিলেন উনিশ শতকের একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। লালনের মতো তিনিও বাংলার লোকায়ত সঙ্গীত জগৎকে সমৃদ্ধ করে গেছেন নানা ধরনের গান রচনা করে এবং তা শুনিয়ে। তারপরও কানাইয়ের জীবনকাহিনিতে তেমন নাটকীয়তা নেই, বর্ণাঢ্যতাও নেই, যেমনটি আছে লালন জীবনকাহিনিতে।
এসব কারণে বাংলার ভাবান্দোলনের অন্দর-অন্তরের খোঁজ-খবর যারা রাখেন, যারা বাংলার ভাবজগৎ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন তারা কখনওই লালন ফকির ও পাগলা কানাইকে এক কাতারে দাঁড় করান না। আবার দুজনকে দু’মেরুতে প্রতিস্থাপনও করতে চান না। বাঙালির ভাবজগতে দুজনের অবদান-অবস্থান দু’রকমের। তবে দু’জনেই বাংলার ভাবজগৎ ও গানের ভাণ্ডারকে এক বিস্ময় উদ্রেককারী বিভা ও বৈভব দান করেছেন। মাটির নায়ক হিসেবে দুজনেই বাংলার জনসাধারণের অন্তরের কাছাকাছি অবস্থান করে তাদের রস-পিপাসা নিবারণ করেছেন রসপূর্ণ গানের ভাষা-সুর ও কথার ঝলক দিয়ে। লালন গানে গানে মানব-মনের অপার কৌতূহল ও রহস্য উন্মোচন করেছেন। সাদামাটা ভাষায় প্রেমভক্তি ও মানবিকতার সারসত্য ব্যাখ্যা করেছেন। অপরদিকে পাগলা কানাই গ্রাম-গ্রামান্তরে স্বরচিত ধুয়োজারি গেয়ে আমজনতাকে আনন্দ দিয়েছেন। লালন ছিলেন এক নিঃসঙ্গ বাউল সাধক, আর পাগলা কানাই বাউল হলেও ছিলেন আসর মাতানো বয়াতি ও জারিয়াল, আক্ষরিক অর্থে মধ্যযুগ ছুঁয়ে-যাওয়া উনিশ শতকের সেলিব্রিটি গায়ক।
কবিয়াল ভোলা ময়রা, এন্টনি ফিরিঙ্গি যে-অর্থে সেলিব্রিটি ছিলেন, সেই একই অর্থে পাগলা কানাইও তাঁর সমকালে সেলিব্রিটি গায়ক ছিলেন। তিনি তাঁর সমকালে এত জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন যে, এক পর্যায়ে কিংবদন্তিতুল্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। লালনও তাঁর সমকালে সঙ্গীত রচয়িতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন, তবে জনপ্রিয়তার নিরিখে পাগলা কানাইয়ের সমতুল্য ছিলেন না। বাংলাগানের শ্রোতা-সাধারণের রুচির ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, পাগলা কানাইয়ের গানের প্রতিতুলনায় লালন ফকিরের গানের বিনোদনমূল্য ও সমাদর বেশ কম ছিল। উনিশ শতকের বঙ্গদেশে লালনের গান একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমিত ছিল এবং কেবলই সাধন সঙ্গীত হিসেবে আখড়া-আশ্রমে গীত হত। কিন্তু কানাই ছিলেন একেবারে মেঠো জনতার চারণকবি, গ্রামবাংলার সঙ্গে তাঁর ছিল নিবিড় সম্পর্ক। তাঁর জাদুকরি প্রতিভা ও সুরের ছোঁয়ায় উনিশ শতকের বঙ্গীয় ভাবজগতে বসন্ত এসেছিল। বাসন্তী কোকিলের কুহুরাগিনী, পাখিদের কলকাকলির মতো তাঁর গান পাড়া-মহল্লা থেকে আসরে-মজলিশে, জোতদারদের আঙিনায়, হাট-বাজারে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
লালন-কানাই দুজনেই গানের ভুবনের মানুষ এবং ভাব-ভাবুকতার বিচারে প্রায় সমসাময়িক, তারপরও তাঁদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য ছিল। পাগলা কানাই বাউল হলেও পেশাদার কবিয়াল ছিলেন, গান গেয়ে রোজগার করতেন। কিন্তু লালন টাকা-পয়সার বিনিময়ে কখনওই গান গাইতেন না। পাগলা কানাইয়ের কবিধর্ম, মেজাজ-মর্জি ও মানস যে লালন ফকিরের থেকে আলাদা তা ড. মযহারুল ইসলামের মন্তব্য থেকেও অনুধাবন করা যায়, ‘একটু খেয়ালি ছিলেন হয়তো সংসারধর্মে একটু উদাসীন ছিলেন কিন্তু তিনি সংসার বিবাগী ছিলেন না, কেননা তাঁকে আসরে দাঁড়িয়ে গান করতে হত, গানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে হত এবং এ জন্য তিনি রীতিমাফিক অর্থ গ্রহণ করতেন। আর এই অর্থে তাঁর সংসার চলতো। অধিকাংশ সংসার বিবাগী বাউলের মতো তিনি ছিলেন না। চিন্তায় ও মননে তিনি ছিলেন জাত বাউল, তাঁর গানে এর স্বাক্ষর ব্যাপকভাবে বিদ্যমান কিন্তু জীবনাচরণে তিনি ছিলেন সংসারী। তাঁর সংসার ছিলো, স্ত্রী ছিলো, দুই পুত্র গহরালী ও বাছের আলীর পিতার সস্নেহ দৃষ্টিলাভের সৌভাগ্য ছিল।’ (মযহারুল ইসলাম: ‘কবি পাগলা কানাই’, দ্বি-স, ঢাকা, ১৯৯৭। পৃ. ৫৪)
মযহারুল ইসলামের বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, পাগলা কানাই চিরায়ত বাউলদের মতো গূহ্য সাধন-ভজনে বিশ্বাসী, সংসারবিবাগী উদাসীন সাধক ছিলেন না। তিনি ছিলেন জনসাধারণের একজন এবং জনগণ তাঁকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত। অপরদিকে লালন ফকির নিজেকে প্রচলিত সমাজ ও ধর্ম থেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। বিপুল জনতার সঙ্গে তাঁর তেমন যোগাযোগ ছিল না, কেবল চেনা শিষ্য-ভক্ত, গুণগ্রাহী সমঝদারদের কাছে নিজ ভাবরসের কথা আদান-প্রদান করতেন। ব্যতিক্রমী কায়দায় অধ্যাত্মচর্চা করতেন, একতারা বাজিয়ে আপনমনে গান গাইতেন, তবে গানকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেননি। শিষ্য-সামন্ত, সাধনসঙ্গী ও পালিত পুত্রকন্যাদের নিয়ে তিনি সংসারে বসবাস করতেন, কিন্তু প্রথাগত সংসারধর্ম পালন করেননি। জীবন-জগৎ, সমাজ-সংসার খুবই ভালবাসতেন, তারপরও নিজেকে জাহির করতে চাননি। বড় অভিমানী ও প্রচারবিমুখ ছিলেন তিনি, উচ্চমানের গীতস্রষ্টা হয়েও নিজের গানকে জনসমাজে প্রচার করতে চাননি। সমাজ ও নিজ ধর্মের লোকজনের কাছ থেকে দাগা পেয়ে ক্ষোভে-অভিমানে নিজেকে তিনি গুটিয়ে নিয়েছিলেন। ভদ্রসমাজ ও পূর্বপুরুষের লালিত বিশ্বাসের জগৎ-সংসার ছেড়ে বেছে নিয়েছিলেন ফকিরি জীবন, বাস করতেন শিষ্য-সামন্ত নিয়ে কালীগঙ্গার পাড় ঘেঁষে ছেঁউড়িয়ার নির্জন আখড়ায়। নির্জন জীবনের অব্যক্ত ব্যথা-বেদনা ব্যক্ত করতে গিয়েই তিনি গান বেঁধেছেন। সাধনসঙ্গী-সহধর্মিণী থাকা সত্ত্বেও সংসারী ছিলেন না আবার জীবনবিবাগীও নন। ছিলেন মাটির নায়ক— ভালবাসতেন মাটি ও মানুষের কাছাকাছি থাকতে। তাঁর যত কায়-কারবার, যত ধ্যানজ্ঞান সবই ছিল বৃহত্তর মানবসমাজকে ঘিরে। শিষ্ট সমাজের বাইরে অবস্থান করেও বহু মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধনে বাঁধা ছিল তাঁর প্রাত্যহিক জীবন। আর সব সাধারণ মানুষের মতো তিনি গান ভালবাসতেন, গান দিয়েই মানুষকে কাছে টানতেন। তাঁর সমকালে নানা ধরনের গানের ধারা প্রচলন ছিল নদীয়া-যশোর-পাবনার গ্রামগঞ্জে, ছিল প্রথাবিরোধী ধর্মচর্চা।
লালনের মতো তাঁর সমসাময়িক বাউলরাও ছিলেন প্রথাবিরোধী, ভিন্ন পথের যাত্রী, ভিন্ন সংস্কৃতির নির্মাতা। জমিদার-অমাত্যদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই তাঁরা একটি নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে তোলেন। আমাদের দেশে তখন ব্রাহ্মণ্যবাদ ও মোল্লাতন্ত্রের প্রবল জোয়ার ছিল। সেই জোয়ারে কেউ কেউ স্রোতের বিপরীতে ভেলা ভাসিয়েছেন, অন্যরা খড়কুটো, ভিটেমাটি, গাছপালা আঁকড়ে কোনওমতে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বাংলার বাউলরা ব্রাহ্মণ্যবাদ ও মোল্লাতন্ত্রের দাপট-আধিপত্যের বিপরীতে নিজের মতো বাঁচতে চেয়েছেন। ‘আত্মসমর্পণমূলক প্রাণরক্ষার যে সহজ পথ সেদিকে তারা যায়নি। তারা বেঁচে থেকেছে, তাদের ধর্মমত নিয়ে। যে কারণে তারা না-হিন্দু না-মুসলমান। তারা স্বতন্ত্র।… এই সম্প্রদায়ের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ধনী নয় মোটেই, কিন্তু মনের দিক থেকে যে গরিব হতে সম্মত তা-ও নয়। (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ‘বিচ্ছিন্নতার সত্য মিথ্যা।’ কুঁড়েঘর প্রকাশনী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬। পৃ. ১৫২)
এই স্রোতের অনুরাগীরা সম্প্রদায়-ঊর্ধ্ব মানুষ, ধর্মের নামে ভাগাভাগিতে এঁরা বিশ্বাস করেন না। প্রথাবিরোধী সাধন-ভজন, গানবাজনা, গুরু-শিষ্যের তাত্ত্বিক আলোচনার মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের ধর্মমত ব্যাখ্যা করেছেন। বাউলগানের মধ্যে নিহিত গভীর তত্ত্বজিজ্ঞাসা ও প্রবল আবেগ মানুষকে খুব সহজেই কাছে টানতে পারে। লালন ফকির, পাগলা কানাই, মদন বাউল, গগন হরকরারা গ্রামে বসবাস করতেন, কিন্তু চিন্তা-চেতনায় ছিলেন অগ্রসর ও যুক্তিবাদী মানুষ। তাঁদের ভাব-ভাষা-সুর সবই ছিল সবল, সপ্রাণ, গীতল ও গতিময়। তাত্ত্বিক, আবেগী, জীবনরসিক মানুষগুলির ছোঁয়ায় বাংলার বর্ধিষ্ণু গ্রামগুলিতে গান জেগে ওঠে, গড়ে ওঠে পালাগান, কবিগান ও কীর্তনের দল। আজবচাঁদ, রসিকচাঁদ-এর নামেও গানের দল তৈরি হয়। বিষাদসিন্ধু প্রণেতা মীর মশাররফও নাটক-নভেলের পাশাপাশি গান লিখতেন। তিনি তাঁর গানে লিখেছেন, ‘কলির শেষে ফিকিরচাঁদে, আজবচাঁদে রসিকচাঁদে মন মেতেছে।/ কোথা আর পাগলা কানাই লালন গোঁসাই/ সব সাঁই এতে হার মেনেছে।’
শিলাইদহের জমিদার বাড়িতে পুণ্যাহ উৎসবে পালাকীর্তন হত, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথও মাঝেমধ্যে তা প্রাণভরে উপভোগ করতেন। সর্বক্ষেপী নামক এক বোষ্টমীও কুঠিবাড়িতে রসালাপ ও গান করতে আসতেন। পাগলা কানাই (১৮০৯-১৮৮৯) সেই সময় গানের প্লাবন বইয়ে দেন। তাঁর জন্মভূমি যশোরের ঝিনাইদহ মহকুমায় কদর ছিল, কুষ্টিয়াতেও এ গানের গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিল। জনপ্রিয়তা প্রাপ্তির লোভে ও যুগের হুজুগে বনেদি ভদ্রলোকরাও গানের দল গড়ে তোলেন, কাঙাল হরিনাথের মতো লেখক-সংবাদপত্রসেবীও ফিকিরচাঁদ নামে গানের দল তৈরি করেন। উনিশ শতকীয় বঙ্গীয় ভদ্রসমাজে বাউলগানের লোকপ্রিয়তা ছিল উল্লেখ করার মতো। কাঙাল হরিনাথের গানেও বাউল গানের ছাপ ফুটে উঠেছে, তাঁর গান শিষ্টসমাজে আদরণীয় হয়ে ওঠে। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে নিজে গানরচনায় হাত দেন। শিক্ষিত সমাজেও সখের বাউল গজিয়ে ওঠে। সে সময় পাগলা কানাইয়ের দল ছিল খুবই জনপ্রিয়, খুবই সচল। গ্রামীণ জনপদে তাঁর ধুয়োজারি অসাধারণ জনপ্রিয় ছিল। গানে গানে তিনি পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গ প্লাবিত করে দেন। তাঁর কোনও কোনও গানে অভাব-আকাল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের বর্ণনা আছে সন-তারিখ উল্লেখ করে। তাঁর একটি আছে: ‘সন ১২৮০ সনে বাধছে বিষম খরা/ মরব বলে খাই পচাঝরা’ এবং ‘খেতের শস্য যায় শুক্যায়া ধানপাটের কর্মসারা’।
পাগলা কানাইয়ের গান সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল শ্রমজীবী কৃষকমহলে। জলধর সেন তাঁর ‘কাঙ্গাল হরিনাথ’ গ্রন্থে বলেছেন, কাঙাল হরিনাথ বলতেন, ‘তোরা তো কানাইয়ের গান শুনিস নাই, তাহার গান শুনিলে মানুষ পাগল হইয়া যাইত।’ তিনি আরও বলেন, ‘এক সময়ে পাগলা কানাইয়ের গানে যশোর, ফরিদপুর, পাবনা ও নদীয়া জেলার অংশবিশেষ ভাসিয়া গিয়াছিল। তাহার গান শুনিবার জন্য এক এক সময় চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার নিম্ন শ্রেণির হিন্দু-মুসলমান একস্থানে সমবেত হইত।’ (জলধর সেন: কাঙ্গাল হরিনাথ ২য় খণ্ড, পৃ. ৪২) লালন ফকিরের চেয়ে ৩৭ বছরের ছোট ছিলেন তিনি, কিন্তু লালনের দেহত্যাগের এক বছর আগেই ইহধাম ত্যাগ করেন। কানাইয়ের সঙ্গে লালনের সম্পর্কটা কেমন ছিল, তাঁদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে কিনা জানা যায় না। তবে পাগলা কানাই ভক্তিমান ছিলেন, লালন ফকিরকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। তিনি হরিশপুরের এক আসরে গেয়েছিলেন: ‘হরিশপুর তাঁর জন্মমাটি,/ লালন শাহ ফকির খাঁটি,/ জানালাম সেও কথাটি,/ হাজার সালাম চরণে তাঁর।’
লালন ও কানাই দুজনেই স্বভাবকবি, তবে তাঁরা কবিতা রচনা করেননি, রচনা করেছেন গান। দু’জনেই ভাব-ভাষা-ছন্দ ও রসসৃষ্টিতে মুনশিয়ানা ও বলিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছেন। পেশাদার গায়ক হিসেবে পাগলা কানাই বিভিন্ন আসরে গান গাইতে গিয়ে শ্রোতাদের তাৎক্ষণিক চাহিদার প্রেক্ষিতে গান বেঁধেছেন, সে সব গানে রয়েছে ব্যক্তিগত জীবনালেখ্য, সমকাল ভাবনা, সমাজভাবনা ইত্যাদি। ১৮৮৪ সালে পাবনার চকিদহ গ্রামে নতুন হাটের উদ্বোধন উপলক্ষে আমন্ত্রিত হন এবং আসরেই গান বেঁধে ফেলেন। ১৮৭৮ সালে পাবনার এক বারোয়ারি মেলায় বয়াতি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। বাংলা ১২৭৮ সনের ৫ই আশ্বিনে সারা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এক ভয়াবহ ঝড়-তুফান বয়ে যায়। পাগলা কানাই এই তুফানের কবলে পতিত হন, এ নিয়েও তিনি গান বেঁধেছেন। আসরে গান গাইতে গিয়ে ধর্মের মাহাত্ম্য ও মর্মশাঁস বর্ণনা করেছেন।
অপরদিকে, লালন ফকির সমাজ জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় সম্পর্কে কোনও গান রচনা করেননি কিংবা করতে চাননি। সমাজ ও সংসারের সব খর্বতাকে অতিক্রম করে সর্বজনের মঙ্গলসাধনায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। লালন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না বটে, কিন্তু তাঁর অন্তর ছিল পাণ্ডিত্যে, বৈদগ্ধ্যে, উচ্চায়ত চিন্তা ও দার্শনিকতায় পরিপূর্ণ। আর কানাইয়ের ভেতর ছিল স্বভাবকবির উদ্দামতা, উচ্ছলতা এবং তাঁর কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ত এক অলৌকিক সঙ্গীত মধুরিমা। দু’জনেই ছিলেন বাংলার লোকজীবনের প্রাণের মানুষ। তবে লালন ফকিরকে আমরা বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষের ভক্তি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করি। তাঁর গান ভক্তিসাহিত্য তথা ভক্তি আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা যখন ভক্তি আন্দোলনের কথা বলি, তখন আর একটি সমাজতাত্ত্বিক মাত্রা স্পষ্ট হয়। ভক্তি বিষয়টি মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত, কিন্তু ভক্তি আন্দোলনের সামষ্টিকভাবে সমাজ সম্পৃক্ত। আসলে অনেকগুলো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভক্তি আন্দোলন গড়ে ওঠে। পাগলা কানাইও ভক্তি সাহিত্য রচনা করেছেন, কিন্তু তাঁকে ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারি না।