রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রধান এই ২০২৩-এর বিশ্বজুড়ে দীর্ঘ অতি উষ্ণ গ্রীষ্মকালের সময় ঘোষণা করলেন আমাদের পৃথিবী উষ্ণায়নের সময় পেরিয়ে বিশ্বস্ফুটনের সময়ে এসে পৌঁছেছে। মানুষের সভ্যতা যেন প্রতিদিন পরিবেশতন্ত্রের মূলগত বিধ্বংসী পরিবর্তন ডেকে আনছে। আজ থেকে চারশো কোটি বছর আগে পৃথিবীর বাতাবরণ ছিল অতি উষ্ণ; কার্বন ডাই অক্সাইড আর জলীয়বাষ্প পূর্ণ। সেই প্রাণহীন উষ্ণ পৃথিবীকে আজকের সহনীয় তাপমাত্রায়, নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন পূর্ণ বাতাবরণে রূপান্তরিত করেছে পরবর্তী দুশো-আড়াইশো কোটি বছরে। সেই সময়ের প্রাগৈতিহাসিক নীল-সবুজ শ্যাওলাদের আশীর্বাদে আজ এমন সপ্রাণ, শ্যামল পৃথিবী। কৃষি-নির্ভর সমাজ থেকে যেই নির্বিচার জীবাশ্ম-জ্বালানি নির্ভরতা বাড়তে শুরু হয়েছে, মাত্র গত দেড়শো বছরে আমরা আবার পেছনে হাঁটতে শুরু করেছি। যাকে আমরা অগ্রগতি ভেবে আহ্লাদিত ছিলাম, দেখা যাচ্ছে আসলে অধোগতি। আমরা পায়ে পায়ে কার্বন ডাই অক্সাইড আর জলীয়বাষ্প পূর্ণ, উষ্ণ প্রাণহীন পৃথিবীকে ফিরিয়ে আনতে এগিয়ে চলেছি।
বিশ্বের নিরিখে গত ছয় বছরে বিশ্বে প্রায় ৭০০ লক্ষ হেক্টর কৃষি জমি ভূউষ্ণায়নের প্রভাবে ঊষর হয়ে গেছে। ২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২-এর মধ্যে ভারতেই ৩৪০ লক্ষ হেক্টর কৃষি জমি অতিবৃষ্টি ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তেমনই ২০১৬-১৭ থেকে ২০২১-২২-এর মধ্যে অনাবৃষ্টি, অনিয়মিত বর্ষা ও খরায় প্রায় ৩৫০ লক্ষ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ভূউষ্ণায়নের ডেকে আনা নানা বিপদের মধ্যে একটি গুরুতর বিষয় মাটির নিচের জলসম্পদে টান। আবহাওয়ার খামখেয়ালি আচরণে কোথাও অনাবৃষ্টি, কোথাও অতিবৃষ্টি। অতিবৃষ্টিতে মাটির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তীব্র জলস্রোতের খুব কম অংশই মাটির নিচের জলের ভাণ্ডারকে পুষ্ট করতে পারছে। তেমনই অপর দিকে কোথাও অনাবৃষ্টি, দীর্ঘ খরা, মাটির নিচের জলের ভাণ্ডারকে ভরিয়ে তুলতে পারছে না। বিশ্বে প্রতি বছর ১০০ থেকে ৩০০ বর্গ কিলোমিটার জলসম্পদ কমে চলেছে। আর এই কমার হার বছরে ১% করে বাড়ছে। নিশ্চয় বোঝা যায় যে, আগামী দিনে শুধু কৃষিতে সেচের জল নয়, টান পড়বে পানীয়জলেও। ইতিমধ্যেই পৃথিবীর মানুষ পানীয়জলের চরম সংকটে। পৃথিবীর প্রায় ২৭% মানুষ আজ পানীয়জলের অভাবে সংকটাপন্ন। ভারতে এখনই ৬% মানুষের জন্য পানযোগ্য নিরাপদ জলের কোনও ব্যবস্থা নেই। এরই পাশাপাশি ভূউষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রতলের স্ফীতি ডেকে এনেছে আর-এক বিপদ; মাটির নিচের জলের ভাণ্ডারে মিশে যাচ্ছে লবণাক্ত জল। তাই ভূগর্ভস্থ জল অপরিবর্তনীয়ভাবে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এই দ্রুত পরিমাণে কমে যাওয়া আর তারই সঙ্গে ভূগর্ভস্থ জলের চরিত্রের বদল আগামী দিনে দারুণ দুর্দিন ডেকে আনবে, সন্দেহ নেই।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ৩৭ জন সামনের সারির গবেষক তাঁদের ২০১৯-এর খাদ্য সংক্রান্ত রিপোর্টে (The EAT-Lancet Commission on Food, Planet, Health-এর Food in the Anthropocene Report) জানিয়েছে, বিগত মাত্র দশ হাজার বছরে মানুষের আধিপত্যে থাকা পৃথিবীতে খাদ্যবৈষম্য কীভাবে আমাদের কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে। প্রায় ২০০ কোটি মানুষের খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত ভোজন, খাদ্যের অপচয় আর চটজলদি নানান খাবারের সম্ভার, এই বিশ্বে প্রতিদিন অভুক্ত রাখছে কমবেশি ১০০ কোটি মানুষকে। বিশ্বের ২১০ কোটি মানুষ যখন অতিরিক্ত ভোজনে অসুস্থ রকমের স্থূল চেহারার, তখনই প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে জরাজীর্ণ। শুধু আমেরিকার হিসেবে, সে দেশের উৎপাদিত খাদ্য, ফসলের খেত থেকে খাবার থালার অতিরিক্ত খাবার, সব মিলিয়ে ৩০-৪০% নষ্ট হয়। UNEP Food Waste Index Report 2021 অনুযায়ী, ভারতে বছরে মাথাপিছু ৫০ কিলোগ্রাম খাদ্য নষ্ট হয়, অর্থাৎ বছরে ৬৯০ লক্ষ টন খাবার আমরা নষ্ট করছি। অথচ এই ভারতেই প্রায় ২০ কোটি মানুষের কাছে উপযুক্ত পরিমাণ পুষ্টিকর খাদ্য পৌঁছয় না। ২০২২ সালে প্রকাশিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২১টি দেশের তালিকায় ভারত ১০৭তম স্থানে; ভারতের ক্ষুধা সূচক ২৯.১, যেটি ভারতকে ক্ষুধার দেশ বলেই চিহ্নিত করে। আর এই নিদারুণ অসম পরিস্থিতিতে, যখন হাজার রকম চটকদার মোড়কে কিংবা ফাস্ট ফুডের ঝকমকে আউটলেটে বিশ্বের নানান নামীদামি বহুজাতিক ব্র্যান্ডের লোভনীয়, অথচ অসার, জাঙ্ক ফুড আর সফ্ট ড্রিঙ্কে ভারতের বাজার ভরিয়ে তুলছে, তখন মানুষকে সতর্ক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে দেশের মানুষের সুস্থতার স্বার্থে, দুবেলা পুষ্টিকর খাদ্য ও পানের উপযোগী জল সবার কাছে পৌঁছে দেবার অঙ্গীকারে।
কৃষি, খাদ্য, পানীয় সবই প্রকৃতির নিরাপদ জল-নির্ভর। মনে রাখা দরকার, আমাদের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিই এখন বিশ্বের নানান কৃষি পণ্য, নরম পানীয় ও খাদ্য প্রস্তুতকারী বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসায়ের লক্ষ্যস্থল। আবার ভারতের মধ্যে তাদের লক্ষ্য পুবের রাজ্যগুলি। কেননা এই রাজ্যগুলিতে মাটির ওপরে ও নিচে জলের ভাণ্ডারে এখনও তেমন টানাটানি নেই। একা PepsiCo-ই বছরে প্রায় ৬,৫০,০০০ ঘনমিটার ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করে নানা কিসিমের নরম পানীয় বানায়। আর কেন্দ্রীয় সরকারকে ওয়াটার-ট্রেন নাম দিয়ে ট্যাঙ্কারের সারিতে ৫০০ ঘনমিটার পেয়-জল পাঠাতে হয় মহারাষ্ট্রের লাতুরে। গত শতকের ছয়ের দশকের শেষ থেকে কৃষিতে সবুজ বিপ্লব যে আদতে ভারতে কৃষিতে শঙ্কা ডেকে এনেছে, এখন বুঝতে আর বাকি নেই। অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার, যথেচ্ছ রাসায়নিক সার ও কীটনাশক কৃষি পরিবেশকে মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে, বিশেষত পশ্চিমের রাজ্যগুলি, যেখানে মাটির নিচে জলের ভাণ্ডার ছিল অপ্রতুল। এখন তাই জৈব কৃষি বা অরগ্যানিক ফার্মিং বেশ চালু শব্দবন্ধ। জৈব-সার, কীটনাশক নির্ভর দেশের প্রজাতির বীজে দেশের মাটিতে চাষ অনেক সুস্থায়ী হবার কথা; পণ্যও দামে তুলনায় সস্তা হবে। অথচ চাষের জমি ক্রমাগত চলে যাচ্ছে শক্তিশালী বড় ব্যবসায়ীদের কব্জায়। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, দীর্ঘ গ্রীষ্ম, অতিবৃষ্টি, এমন নানা প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দেশের ছোট ছোট জমির কৃষিনির্ভর মানুষ ইদানীং চাষে অর্থ বিনিয়োগে ক্রমশ বিমুখ হচ্ছে। মওকা বুঝে অন্তত তেরোটা বড় বড় দেশি ও নামী বহুজাতিক সংস্থা দেড়-দ্বিগুণ দামে জৈব-পদ্ধতিতে উৎপন্ন কৃষিপণ্য হরেক কায়দায় বাজারজাত করতে নেমে পড়েছে। ২০১৫-১৬-র কৃষি সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, ভারতে ৮৬% ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষিজীবী মানুষ; আর তাঁরাই ভূউষ্ণায়ন-জনিত জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। পরিবেশের টালমাটাল সময়ে এই কৃষিজীবী মানুষের সুরক্ষার বন্দোবস্ত সবচেয়ে জরুরি। আমাদের উপযুক্ত কৃষি উৎপাদনর স্বার্থে এই বিপুল সংখ্যক মানুষের চাষের জমি, সেচের জল, আনুষঙ্গিক কৃষি রসদের সুরক্ষার পাশাপাশি তাঁদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সরকারি সহযোগিতা অপরিহার্য।
আমরা জানি, কৃষিপণ্যই হোক অথবা হরেক রকম পানীয়, সবেরই মূলধন জল। Water Resources Group (WRG) জানাচ্ছে, আগামী ২০৩০-এ ভারতে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনের মাত্র ৫০ শতাংশ জল বেঁচে থাকবে! তাই জল সংরক্ষণের স্বার্থে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসতে বাধ্য। সম্পূর্ণ নিরামিষ খাবারের জন্য দিনপ্রতি জলের চাহিদা ১,১৩৭ লিটার অথচ মাংস-সহ এই খাবারের জন্য জলের চাহিদা ১৫,১৬০ লিটার। এক কিলোগ্রাম চাল উৎপাদনে যেখানে ২,৮০০ লিটার ও এক কিলোগ্রাম গম উৎপাদনে ১,৬৫৪ লিটার জলের প্রয়োজন হয়, সেখানে এক কিলোগ্রাম মুরগির মাংস উৎপাদনে জলের খরচ ৪,৩২৫ লিটার আর পাঁঠার মাংসে ১০,৪১২ লিটার। সুষম আহারে আমিষের প্রয়োজন জরুরি, যদিও ভারতে প্রাণিজ আমিষ খাওয়ার পরিমাণ গড়ে বছরে প্রতিজনে মাত্র ৪ কিলোগ্রাম। সেখানে আমেরিকার মতো সম্পন্ন দেশে এই পরিমাণ গড়ে ১২৪ কিলোগ্রাম! এইসব আর্থিকভাবে সচ্ছল দেশগুলিতে যত প্রাকৃতিক পেয়-জলের ভাণ্ডার কম হতে থাকবে, তেমনই বাড়তে থাকবে জল নিয়ে বিশ্বরাজনীতি। আগামী বিশ-পঁচিশ বছরে ভূউষ্ণায়নে পরিবর্তিত প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে আমাদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে খাদ্যাভ্যাস বদলে। এই লেখায় জানিয়ে রাখি যে, ভূউষ্ণায়নে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সাগর-মহাসাগরে জলতলের স্ফীতি, হিমালয়ের হিমবাহ, দুই মেরুর বরফের পুরু আচ্ছাদন, অতিবৃষ্টি, বন্যা, সাইক্লোন, অনাবৃষ্টি, খরা, মহামারী সব ছাপিয়ে দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে আমাদের খাবার টেবিলে।
পরিবেশে বেড়ে চলা কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ, ভৌগোলিক স্থান, ও প্রজাতি-ভেদে কিছু উদ্ভিদের ক্ষেত্রে পৌষমাস, সবটাই সর্বনাশ নয়। পর্যাপ্ত সূর্যালোক আর জলের যোগান থাকলে বাড়তি কার্বন ডাই অক্সাইড কাজে লাগিয়ে উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষের হার বাড়িয়ে নিয়ে উৎপাদন বাড়িয়ে চলবে। এজন্য আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগেই বিশ্বের উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা পরিবেশের বাড়তি কার্বন ডাই অক্সাইডকে কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত উৎপাদনকে স্বাগত জানিয়ে নাম দিয়েছিলেন ‘কার্বন ডাই অক্সাইড ফার্টিলাইজেশন’। কিন্তু অচিরেই বোঝা যায় এই ঘটনা সর্বক্ষেত্রে ঘটবে না। কেন না পৃথিবীর বিস্তৃত অঞ্চলে সূর্যালোক অপ্রতুল, তেমনই ভূগর্ভস্থ জলের যোগানও পর্যাপ্ত নয়। তাই পরিবেশের বাড়তি কার্বন ডাই অক্সাইড আদতে তেমন কোনও বাড়তি সুবিধা তো দিচ্ছেই না, বদলে দ্রুত কৃষিজ ফলনের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। পৃথিবীর যে সব অঞ্চলে কার্বন ডাই অক্সাইড ফার্টিলাইজেশনের সুবিধা পাওয়া যায় সেখানে ৩%, আর যেসব দেশে সেই সুবিধা পাওয়া যায় না সেখানে ১৬% পর্যন্ত কৃষি উৎপাদন কমেছে। আইএমএফ-র ‘ফাইনান্স ও উন্নয়ন ২০০৮’-এ ভূউষ্ণায়ন ও কৃষি বিষয়ক প্রতিবেদনে বেশ দুশ্চিন্তার ছবি আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি। বিষুবরেখার আশপাশের দেশগুলিতে কৃষি উৎপাদন আগামী পঞ্চাশ বছরে ২৫% অবধি কমে যেতে পারে। ভারতের অনেক রাজ্যেই এই হার ৩০-৪০% হতে পারে। আইসিএআরর-এর তথ্যে ফসলের প্রজাতিভেদে উৎপাদন কমার বিভিন্ন হিসেব পাওয়া যাচ্ছে। আগামী ২০৫০-এ সেচযুক্ত ধানচাষে ৭% আর ২০৮০-তে ১০% উৎপাদন কমে যেতে পারে। গম উৎপাদন ২১০০-র মধ্যে ৬-২৫% ও ভুট্টার উৎপাদন ১৮-২৩% কমে যাবে। অথচ ছোলা উৎপাদন ২৩-৫৪% বাড়ার সম্ভাবনা। তাই ভূউষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন আগামী পঞ্চাশ থেকে আশি বছরের মধ্যে বিশ্বজুড়ে কৃষিক্ষেত্রে ফসলের নির্বাচনে আমূল পরিবর্তন আনতে চলেছে; তেমনই, বলাই বাহুল্য, মানুষের খাদ্যাভ্যাসের আমূল বদল ঘটতে চলেছে। বুঝতে আর অসুবিধে নেই ভূউষ্ণায়ন এখন পা ফেলছে রান্নাঘরের দরজায়, উঠে পড়ছে খাবার টেবিলে।