Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ধর্ম হচ্ছে জনগণের আফিম: ভুল বোঝার সমস্যা

ধর্ম প্রসঙ্গে কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩)-এর মত কী ছিল সে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত হল, “ধর্ম হচ্ছে জনগণের আফিম”— এই বাক্যটি। এই বাক্যটির নানান ব্যাখ্যা আছে। মার্কসবাদীদের একটি অংশ এবং মার্কস-বিরোধীদের অনেকেই মনে করেন যে, কার্ল মার্কস ওই বাক্যটির মাধ্যমে ধর্ম সম্বন্ধে খানিক ইতিবাচক মনোভাবই ব্যক্ত করেছেন। ওই বাক্যটির আগের আরও দু-একটি বাক্য জুড়ে উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁরা বোঝাতে চান যে, মার্কস আসলে এখানে আফিম বলতে বেদনানাশক বা পেনকিলারের কথা বলতে চেয়েছেন। তাঁদের মতে, মার্কস নাকি বোঝাতে চেয়েছিলেন এই নিষ্ঠুর জগতে ধর্মই খেটে খাওয়া নিপীড়িত মানুষকে খানিক শান্তি-স্বস্তি দেয়। তাই অনেক মার্কসবাদী এই ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে ধর্মর ব্যাপারে খানিক “ধীরে চলো” নীতি নিয়ে চলার পক্ষপাতী। আগে দেখে নেওয়া যাক যে বাক্যগুলি তাঁরা উদ্ধৃত করেন সেগুলি:

“ধর্ম হচ্ছে নির্যাতিত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, আত্মাহীন অবস্থার আত্মা। ধর্ম হচ্ছে জনগণের আফিম।”

এইটুকু দেখেই অনেকে এ-ও সিদ্ধান্ত করেন যে ধর্ম একটি হৃদয়হীন জগতে হৃদয়ের এবং আত্মাহীন অবস্থাকে আত্মার যোগান দেয়।

এই বাক্যগুলি মার্কস লিখেছিলেন ১৮৪৩ সালে। লেখাটি হেগেলের ১৮২০ সালে প্রকাশিত বই “এলিমেন্টস অফ দ ফিলোসফি অফ রাইট”-এর একটি সমালোচনা। মূলে জার্মানে লেখা এই সমালোচনা মার্কসের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মার্কস বেঁচে থাকতে পুরো লেখাটি প্রকাশিত হয়নি। শুধুমাত্র ভূমিকাটি ১৮৪৪ সালের “ফরাসি-জার্মান বাৎসরিকী” (“ডয়েচ-ফ্রা্নসোয়াজিশে ইয়ারবুখের”, “German–French Annals”)-এ প্রকাশিত হয়। এই ভূমিকাতেই কথাগুলি আছে। বই হিসেবে লেখাটি প্রকাশিত হয় “হেগেলের অধিকারের দর্শনের সমালোচনা” (জার্মানে “Zur Kritik der Hegelschen Rechtsphilosophie” আর ইংরেজিতে “A Critique of Hegel’s philosophy of right”)। বইটি মার্কসবাদীদের কাছে অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। এখন দেখা যাক ধর্ম নিয়ে সেই ভূমিকাতে মার্কস ঠিক কী বলেছিলেন, উদ্ধৃত বাক্যগুলির আগে আর পরে মার্কসের বক্তব্য কী ছিল।

ভূমিকাটি শুরুই হয় এই বলে যে, “জার্মানিতে ধর্মর সমালোচনা বস্তুত শেষ হয়েছে এবং ধর্মর সমালোচনা হচ্ছে অন্য সব সমালোচনার ভিত্তি।” এইখানে একটু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতটা বোঝা যাক। ১৮৩০-এর দশকে লুডভিগ ফয়েরবাখ, ব্রুনো বয়ার প্রমুখের মাধ্যমে জার্মানির দার্শনিক জগতে ধর্ম-সমালোচনার একটা জোয়ার আসে। মুখ্যত ফয়েরবাখ ধর্মর স্বর্গীয় মুখোশ একেবারে ছিঁড়ে ফেলেন। তিনি ধর্মতত্ত্বকে একেবারে নৃতত্ত্বর আওতায় নিয়ে আসতে চান। ঈশ্বরের জগৎ থেকে মানুষের জগৎ। তিনি বলেন ধর্ম সৃষ্টি করেছে মানুষ, ঈশ্বরকে মানুষ গড়েছে তাঁর নিজের আদলে। নিজের মধ্যেকার যত ভাল ভাল গুণ মানুষ ঈশ্বরের ওপর আরোপ করেছে। ধর্ম, ঈশ্বরের জগৎ এক অলীক জগৎ যে-জগতে বিশ্বাস রেখে‌ মানুষ নিজের বাস্তব অবস্থা সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করতে পারে না। ভূমিকাটির গোড়ায় মার্কস নিজের ভাষায় সেই সময়ের জার্মান দার্শনিকদের ধর্মের সমালোচনাগুলি লেখেন,

“অধার্মিক সমালোচনার ভিত্তি হল— মানুষ ধর্ম তৈরি করে, ধর্ম মানুষকে তৈরি করে না। যে মানুষ এখনও নিজেকে খুঁজে পাননি কিংবা ইতিমধ্যে আবার নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন, ধর্ম হল সেই মানুষের আত্মচেতনা এবং আত্মসম্মান। কিন্তু মানুষ তো জগতের বাইরে তাঁবু খাটিয়ে থাকা কোনও বিমূর্ত সত্তা নয়। মানুষ হল মানুষের জগৎ, রাষ্ট্র, সমাজ। এই রাষ্ট্র, এই সমাজ তৈরি করে একটা উলটো জগৎচেতনা কেননা সেগুলো হচ্ছে এক উলটো জগৎ। ধর্ম হচ্ছে সেই উলটো জগতের এক সামগ্রিক তত্ত্ব, সেই উলটো জগতের সর্ববিদ্যার সংক্ষিপ্তসার, জনপ্রিয় আঙ্গিকে সেই উলটো জগতের যুক্তি, সেই উলটো জগতের অধ্যাত্মিক সম্মানের আস্ফালন, তার উদ্দীপনা, তার নৈতিক প্রেরণা, তার আনুষ্ঠানিক পূরক, সেই উলটো জগতের সান্ত্বনা ও ন্যায়ের ভিত্তি। ধর্ম হচ্ছে মানুষের সত্তার উদ্ভট উপলব্ধি কেন না মানুষ তাঁর নিজের বাস্তব সত্তার উপলব্ধি করতে পারেনি। তাই ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হল ধর্ম যে উলটো জগতের অধ্যাত্মিক সৌরভ সেই জগতের বিরুদ্ধে পরোক্ষ যুদ্ধ।”

না, ধর্ম সম্বন্ধে কোনও ইতিবাচক মনোভাবের নামগন্ধও এখানে নেই। বরং ধর্ম যে অলীক উলটো উদ্ভট জগতের ফসল সেই জগতের বিরুদ্ধে যুদ্ধর আহ্বানই এখানে আছে। মার্কস কিন্তু জার্মানে kampf শব্দটিই ব্যবহার করেছেন। এর পরে মার্কস লিখছেন,

“ধর্মীয় জ্বালা-যন্ত্রণা (suffering) হচ্ছে একই সঙ্গে বাস্তব জ্বালা-যন্ত্রণার প্রকাশ ও বাস্তব জ্বালা-যন্ত্রণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।”

ধর্মীয় জ্বালা-যন্ত্রণা বা রিলিজিয়াস সাফারিং আদতে একটি খ্রিস্টীয় ধারণা। আদম আর ইভ তো ইডেন-উদ্যানে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে পৃথিবীতে পতিত হলেন। সেই থেকে পৃথিবী হল এক ফলেন স্যাড ওয়ার্ল্ড, পতিত দুঃখের পৃথিবী। খ্রিস্টান মতে এই জ্বালা-যন্ত্রণা সকলকেই সহ্য করতে হবে তবেই তাঁরা স্বর্গে জায়গা পাবে। এমনকি ঈশ্বর এই জ্বালা-যন্ত্রণার ব্যবহার করতে পারেন যাতে মানুষ স্বর্গের যোগ্য ধোপদুরস্ত হতে পারে।

Suffering causes our focus to turn inward, to face those parts of ourselves we might otherwise ignore. God can use suffering then to develop us into better people: the people who can love and enjoy Him forever (Romans 5:3-5; James 1:2-4).

তবে দেখা গেল ধর্মমতে ইহকালের জ্বালা-যন্ত্রণায় ভোগা আসলে পরকালের লাভের জন্য, গরিব মানুষদেরই ঈশ্বর বেশি ভালবাসেন। এইসব কথা যদি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তবে পৃথিবীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে শোষণ-শাসন করে মুষ্টিমেয় মানুষের অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ার ব্যবস্থাটা বহাল তবিয়তে থাকতে পারে।
মার্কস কিন্তু এখানে পরিষ্কার বলেছেন বাস্তব জ্বালা-যন্ত্রণা মানুষকে ভোগ করতেই হয় এবং সে তার থেকে মুক্তি চায়। কোনও বেদনানাশের কথা এখানে নেই। এরপরেই আসে সেই বিখ্যাত উদ্ধৃতি,

“ধর্ম হচ্ছে নির্যাতিত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, আত্মাহীন অবস্থার আত্মা। ধর্ম হচ্ছে জনগণের আফিম।”

আগের কথাগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে এই অংশটিকে আর মোটেও ধর্মর ব্যাপারে মার্কস ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতেন এমন কথা বলার সুযোগ নেই। সেটা আরও স্পষ্ট হয় এর পরের কথাগুলো পড়লে। তবে তার আগে এই উদ্ধৃতি নিয়ে কিছু বলার আছে। প্রথমে উদ্ধৃতির ইংরেজি অনুবাদ দেখা যাক। কারণ ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদই এক্ষেত্রে চলে। ১৯৭০ সালের অ্যানেট ইওলিন এবং জোসেফ ওম্যালির জার্মান থেকে ইংরেজি অনুবাদে উদ্ধৃতিটি এইরকম,

“Religion is the sigh of the oppressed creature, the heart of a heartless world, and the soul of soulless conditions. It is the opium of the people.”

মার্কসের বক্তব্যকে ভুল বোঝার মূল কারণ দুটি। প্রথমটি হল ‘‘heart of a heartless world’’ এই বাক্যটিতে অনুবাদকের কথার খেলা করা। মার্কস কিন্তু মূল জার্মানে হৃদয়হীন জগৎ বলতে herzlosen Welt শব্দটি ব্যবহার করেছেন। প্রথমবার কিন্তু তিনি herz শব্দটি ব্যবহার করেননি। বদলে ব্যবহার করেছেন Gemüt শব্দটি। এই শব্দ মন বা স্ব-ভাব অর্থেই বেশি চলে। অন্য একটি অনুবাদে দেখলুম প্রথমবার heart শব্দটি ব্যবহার না করে sentiment শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। এখন ওই বাক্যটির বাংলা করলে দাঁড়ায়, “[ধর্ম হল] হৃদয়হীন একটা জগতের স্বভাব বা ভাবপ্রবণতা”। এবার পরের বাক্য দেখা যাক, “[ধর্ম হল] আত্মাহীন অবস্থার আত্মা”। এখানে ব্যবহার হয়েছে ইংরিজি soul শব্দটি। তাহলে কী দাঁড়াল? মার্কস আসলে বলতে চেয়েছেন, ধর্ম হচ্ছে একটা হৃদয়হীন জগতের স্ব-ভাব এবং মানুষের আত্মাহীন অবস্থার আত্মা। অর্থাৎ মানুষের জ্বালা-যন্ত্রণায় ভোগার এই ব্যবস্থার একটা চালিকাশক্তি হচ্ছে ধর্ম। কোথাও ধর্ম সম্বন্ধে কোনও ইতিবাচক কথা নেই। ‘‘Heart of a heartless world’’ কথাটি অনুবাদকের কীর্তি।

দ্বিতীয় কারণ হল গবেষকদের আফিম নিয়ে বড় বেশি মাথা ঘামানো। মার্কসের সমসময়ে আফিম বেদনানাশক ওষুধ হিসেবে চিকিৎসার কাজে ব্যবহার হত তাই মার্কস ধর্মকে আফিম বলে আসলে ধর্ম যে যন্ত্রণা কমানোর কাজ করে সেই কথাই বলতে চেয়েছেন— এই হল অতিরিক্ত গবেষণার ফল।

আসলে আফিম যে কাজেই লাগুক না কেন আফিমের নেশা সারা পৃথিবীতেই সে-সময় চালু ছিল। আফিমের নেশায় মানুষ একটা উদ্ভট অলীক জগতে প্রবেশ করত। আফিমখোর কমলাকান্তকে একটি বিড়াল যে সোশিয়ালিস্টিক জ্ঞান দিয়েছিল সে তো বঙ্কিমচন্দ্র কবেই লিখে গেছেন। মার্কস আসলে এখানে আফিমের উপমা এনে মানুষ যে ধর্মর নেশায় একটা অলীক উদ্ভট জগতে বাস করে সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন। আর ধর্মর এই নেশা তাঁকে নিজের বাস্তব পরিস্থিতির দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখতে সাহায্য করে। আলোচ্য উদ্ধৃতির পরের অনুচ্ছেদে মার্কস লেখেন,

“মানুষের অলীক সুখ হিসেবে ধর্মকে উচ্ছেদ করাটা হল [আসলে] মানুষের বাস্তব সুখের দাবি করা। মানুষের বাস্তব অবস্থা সম্বন্ধে [ধর্মীয়] মোহ পরিত্যাগ করার দাবিটা হল মানুষের যে অবস্থার জন্যে মোহকে দরকার হয় সেই অবস্থাটাকেই পরিত্যাগ করা। তাই ধর্মের সমালোচনা হল ধর্ম যার জ্যোতির্বলয় সেই অশ্রু উপত্যকার সমালোচনার সূত্রপাত।”

অশ্রু উপত্যকার ধারণাটিও খ্রিস্টীয় একটি ধারণা। স্বর্গসুখ পেতে হলে এই পৃথিবীর অশ্রু উপত্যকা বা vale of tears পেরোতে হবে।

জার্মান দার্শনিকদের ধর্মর এই সমালোচনা কেন? কেন স্বর্গ থেকে ধর্ম আর ঈশ্বরকে মাটির পৃথিবীতে নামিয়ে আনা? এই সমালোচনার কারণ কি এই যে মানুষ এরপর থেকে ধর্মর অলীক উদ্ভট জগৎকে না মেনে, সেই জগতে আর সান্ত্বনা না খুঁজে ধর্মর শৃঙ্খলটা বয়ে বেড়াবে? না। মার্কস লিখছেন,

“ধর্মর সমালোচনা [ধর্ম]-শৃঙ্খলের কাল্পনিক ফুলটি উপড়ে নিয়েছে। তার কারণ এই নয় যে মানুষ উদ্ভট আর সান্ত্বনা ছাড়াই ওই শৃঙ্খলকে বয়ে বেড়াবে। [ওই সমালোচনার] কারণ মানুষ যাতে ওই [ধর্ম] শৃঙ্খলকে ছুড়ে ফেলে জীবন্ত [বাস্তব, কল্পনার বদলে] ফুল তুলতে পারে। ধর্মর সমালোচনা মানুষের মোহ কাটায়। একজন মোহমুক্ত মানুষ হিসেবে সে নিজের চেতনা ফিরে পায় এবং বাস্তব ভিত্তির ওপর তাঁর চিন্তা, কাজ, চাল-চলন গড়ে ওঠে। [এই মোহমুক্তির ফলে] মানুষ তাঁর নিজের বাস্তব সূর্যের চারপাশের ঘুরতে পারে। ধর্ম হল এক অলীক সূর্য। মানুষ যতক্ষণ না নিজের চারপাশে ঘুরতে পারে ততক্ষণ তাঁকে ওই অলীক সূর্যর চারপাশেই ঘুরে মরতে হয়।”

এরপরে মার্কস লেখেন ইতিহাস আর দর্শনের কর্তব্যর কথা:

“কাজেই অন্য [অলীক, ধর্মীয়] সত্যর জগৎ অদৃশ্য হয়ে গেলেই ইতিহাসের কাজ হল এই [বাস্তব] জগতের সত্য প্রতিষ্ঠা করা। মানুষের আত্ম-বিচ্ছিন্নতার [নিজের বাস্তব অবস্থার সঠিক উপলব্ধি না করার কারণে] পবিত্র [ধর্মীয়] ধাঁচার মুখোশ খসে পড়তেই ইতিহাসের সেবায় নিযুক্ত দর্শনের কাজ হল মানুষের আত্মবিচ্ছিন্নতার কারণ যে বিভিন্ন অপবিত্র [বাস্তব] ধাঁচাগুলো সেগুলোর মুখোশ খুলে দেওয়া। এইভাবে স্বর্গের সমালোচনা মর্ত্যের সমালোচনায় পরিণত হয়, ধর্মের সমালোচনা হয়ে ওঠে আইনের সমালোচনা আর ধর্মতত্ত্বর সমালোচনা পরিণত হয় রাজনীতির সমালোচনায়।”

অপবিত্র ধাঁচা মানে বাস্তব পরিস্থিতি। মানুষের জ্বালা-যন্ত্রণা, বঞ্চনার বাস্তব কারণগুলি। ধর্ম যে-কারণগুলিকে মানুষের কাছ থেকে আড়াল করে রাখে।

নিপীড়িত মানুষকে ধর্মর শৃঙ্খল ছুড়ে ফেলে ধর্মর উচ্ছেদের ডাক দিয়েছেন মার্কস এই ভূমিকাটিতে। ধর্মর ব্যাপারে কোনও ভালও কথা নেই এখানে। এই ভূমিকা প্রমাণ করে ১৮৪৩-এ ধর্মর ব্যাপারে মার্কসের তিতিক্ষা শূন্য। ধর্ম প্রসঙ্গে কার্ল মার্কস-এর জিরো টলারেন্স-ই এখানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়।

এই ধারণাকে আর একটু বিশদ করেছিলেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। “সমাজতন্ত্র ও ধর্ম” প্রবন্ধে লেনিন লিখছেন,

“ধর্ম আধ্যাত্মিক পীড়নের অন্যতম প্রকার বিশেষ।… যাঁরা [অন্যর জন্য] সারাজীবন খেটেও অভাবে জীবনযাপন করেন ধর্ম এ পৃথিবীতে তাঁদের নম্রতা এবং সহ্যশক্তির শিক্ষা দেয় আর তাঁরা [পরলোকে] স্বর্গীয় পুরস্কারের আশায় খানিক আরাম পান। কিন্তু যাঁরা অন্যর শ্রম শোষণ করেন তাঁদেরকে ধর্ম পার্থিব জীবনে বদান্যতা [চ্যারিটি] অনুশীলনের শিক্ষা দেয়। [খেটে খাওয়া মানুষদের] শোষণকে ন্যায়সঙ্গত করতে ধর্ম শোষকদের সুযোগ দেয় আর খুব সস্তার টিকিটে তাঁদের জন্যে স্বচ্ছন্দ্যে স্বর্গবাসের বন্দোবস্ত করে। ধর্ম হচ্ছে জনগণের জন্যে আফিম। ধর্ম একরকম আধ্যাত্মিক-দারু বিশেষ। যার নেশার মধ্যে পুঁজিবাদের দাসদের মানুষের মত বেঁচে থাকার দাবিও একেবারে ডুবে যায়।”

ধর্ম প্রসঙ্গে লেনিন-এরও জিরো টলারেন্স।

গত দেড়শো বছর ধরে ভারতের রাজনীতিতে— ধর্ম অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়, ওতে আঘাত দেওয়া যাবে না ইত্যাদি যুক্তি দেখিয়ে— ধর্মকে আতুতুতু করে রাখা হয়েছে। ফলাফল প্রতি ২৫-৩০ বছর অন্তর দেশ দুটো ভাগে নিয়মিত বিভক্ত হয়েছে। কখনও দেশভাগ কখনও দাঙ্গা। ধর্মবিশ্বাসকে নিও-নাটাল একটা বিশ্বাস ধরে চলতে গিয়ে সংখ্যাগুরুর ফ্যাসিস্ট মনোভাব আর সংখ্যালঘুর উগ্রপন্থার মনোভাবকেই কেবল উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। “ধর্ম হচ্ছে জনগণের আফিম” এই বাক্যর ভুল ব্যাখ্যা সমস্যা আরও বাড়িয়েছে। একদল মার্কসবাদী মনে করেছেন সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় উৎসবে না ভিড়লে বোধ হয় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে। তাঁরা ধর্মীয় উৎসবে ভিড়েছেন। কিন্তু যখন জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার পরিস্থিতি এসেছে ধর্মীয় উৎসবের এই অংশগ্রহণ তাঁদের বাঁচায়নি, জনবিচ্ছিন্ন হয়েছেন। আবার আর-একদল সংখ্যালঘু-ধর্মের মধ্যে সাব-অলটার্ন উপাদানের খোঁজ করেন। সংখ্যাগুরুর ধর্মকে আক্রমণ করতে গিয়ে সংখ্যালঘুর ধর্ম নিয়ে এমন গদগদ হয়ে পড়েন যে তাঁদের বক্তব্য প্রায়শই মৌলবাদী এবং সাম্প্রদায়িক কথার প্রতিধ্বনি হয়ে পড়ে। পেরেকের মাথায় ঘা দিলে পেরেক আরও দেওয়ালে গেঁথে যাবে মার্কা উপমা বয়ে বেড়ান অনেকে। কেউ কেউ আবার সংখ্যাগুরুদের দায়িত্ব ইত্যাদি নিয়ে বলেন। মোট কথা ধর্মর প্রতি কোনও না কোনও ভাবে দুর্বলতার একটা মানসিকতা পেয়ে বসে।

ধর্মর বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক কথা বলা, ধর্ম জাতের পরিচয়ের আগে খেটে খাওয়া মানুষের শ্রেণিপরিচয়কে গুরুত্ব দেওয়া, সংগঠিত ধর্মগুলির তীব্র বিরোধিতা করা— এইগুলি হল মার্কসবাদীদের অবশ্যকর্তব্যর অন্যতম। তা না করলে হয়তো ভোটের কিছু এদিক-ওদিক হতে পারে কিন্তু কাজের কাজ কিছু হবে না। ধর্মের অলীক জগতের বাইরে মানুষকে বার করার কাজটা না করলে মানুষকে তাঁর দুর্দশা আর বঞ্চনার জন্যে বাস্তব কারণগুলি উচ্ছেদের কাজে পুরোপুরি পাওয়া যাবে না।

এখানে অবশ্য একটা কথা বলে রাখা দরকার যে ধর্মর যে কোনও সমালোচকই কিন্তু মার্কসবাদীদের ভ্রাতৃপ্রতিম নন। মার্কসীয় অর্থনীতির মূল কথা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা— সেই বিষয়ে একমত না হলে কে ধর্মর বিরোধিতা করলেন আর কে করলেন না তাতে কিছু আসে যায় না।

কৃতজ্ঞতা: রিঙ্কু চৌধুরী

মার্কস ও লেনিনের বাংলা তর্জমাগুলি আক্ষরিক ততটা নয়, যতটা ভাবানুবাদ। মার্কস-এর উদ্ধৃতিগুলি অনুবাদের ভিত্তি এন বি এ-র “ধর্ম প্রসঙ্গে”, কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিশ এঙ্গেলস এবং লেনিনের উদ্ধৃতির অনুবাদের জন্য ব্যবহার হয়েছে ১৯৮২-র প্রগতি প্রকাশনের সংস্করণ।

“হেগেলের অধিকারের দর্শনের সমালোচনা” বইটির জার্মান পাঠ এবং ইংরেজি অনুবাদের জন্যে সাহায্য নেওয়া হয়েছে নীচের দুটি লিঙ্কের:

http://www.mlwerke.de/me/me01/me01_378.htm

https://www.marxists.org/archive/marx/works/1843/critique-hpr/intro.htm

এ ছাড়াও এ ব্যাপারে Dank Audio Stash নামের একটি একটি ইউটিউব চ্যানেলের একটি ভিডিওর সাহায্য নেওয়া হয়েছে।

চিত্র: গুগল
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »
শুভদীপ রায়চৌধুরী

শুভদীপ রায়চৌধুরীর দুটি কবিতা

অন্ধকারের তুমি,/ নরম পুঁইমাচার নিচে সবজেটে বহুরূপী/ তোমাকে আলোর কণার ভেতর গড়িয়ে যেতে দেখব বলে/ আমি এই পাগলের পৃথিবী ছেড়েছি/ টিলাপায়ে বাস করি/ নাম, সমুদ্রসম্ভব।/ পাতার ইমারত আছে, আছে/ কিছু দৈনন্দিন কাজ/ মাছ ধরার নাম করে/ বালসাভেলায় অনেকদূর যাওয়া/ যতদূর ভেসে গেলে ঢেউয়ের চুম্বন থেকে/ ছোবলটুকু আলাদা করাই যায় না

Read More »
নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | দ্বিতীয় পর্ব

সকালে চিড়ে নারকেল-কোরা আর গুড় খেয়ে আমি সাইকেলে চেপে ছুটিয়ে দিলাম— আট মাইল রাস্তা ঠেঙিয়ে যখন পৌঁছালাম— তখন গণগণে রোদ্দুর তেষ্টায় গলা কাঠ। ঘন্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে একটা বাড়ি দেখে সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম যদি একটু জল খাওয়া যায়। বাড়ির বারান্দায় একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি বসেছিলেন— তার কাছে উদ্দিষ্ট ঠিকানার কথা প্রশ্ন করতেই তিনি উঠে এসে আমার হাত ধরে আমাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে একটা পাটি পেতে বসতে দিলেন। আমি আবার জল চাইলে বললেন, “দাদাঠাকুর ব্যস্ত হবেন না— ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন।”

Read More »