Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

নাইজেরিয়ার গল্প: যুদ্ধের ছায়ায়

বেন ওক্‌রি

অনুবাদ: মানব সাধন বিশ্বাস

সেদিন বিকেলে গাঁয়ে এল তিনজন ফৌজি। তারা গাঁয়ের ছাগল আর মুরগিগুলোকে একেবারে ছোড়ভঙ্গ করে ছাড়ল। তালপাতার বেড়া-দেওয়া শুঁড়িখানায় ঢুকে তারা লাউয়ের ভাঁড়ের তালকীর অর্ডার দিল। তারপর মাছি-ভনভন ঘরে তালকী গিলতে লাগল।

ওমোভো জানলা দিয়ে ওদের দেখছিল। ওর বাবার এখন কাজে বেরিয়ে যাওয়ার সময়, সে এখন তার অপেক্ষায় আছে। দুজনই রেডিয়োর খবর শুনছিল। যুদ্ধ যখন শুরু হল, শহরের একটি পরিবার দেশ ছাড়ার সময় ওর বাবার কাছে জলের দরে বেচেছিল গ্রুন্ডিগ কোম্পানির ওই পুরনো রেডিয়ো। সাদা কাপড়ে পরিপাটি করে রেডিয়োটা ঢেকে রাখা বাস্তুদেবতা-সম খাতিরে। দেশের অন্দরে শত্রুপক্ষের যত্রতত্র বোমাবাজির খবর, আচমকা বিমান-হামলার খবর ইত্যাদি তারা কান পেতে শোনে। ওর বাবা গুছিয়ে চুল আঁচড়ে তৈরি হয়ে নিল। দাড়ি কামানোর বালাই নেই, স্রেফ গালে-মুখে লোশন লাগিয়ে, আঁটোসাঁটো পুরোনো ছেঁড়া কোটখানা কসরত করে গায়ে চাপিয়ে নিল।

ওমোভো জানলার বাইরে তাকিয়ে রইল। বাবার ওপর সে বেশ রেগে আছে। আজ নিয়ে পরপর সাতদিন হল, ঢোলা-জামা আর কালো কাপড়ের ঘোমটায় মাথা-মুখ ঢেকে সেই অদ্ভুত মহিলা ঠিক ওই সময়েই ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া-আসা করছে। গাঁয়ের পথ দিয়ে সোজা এগিয়ে এক্সপ্রেস সড়ক পার হয়ে সে জঙ্গলে মিলিয়ে যায়। ওমোভো তাকে দেখার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে।

রেডিয়োয় বড় খবর তখন শেষ হয়েছে। ঘোষক রাতে এক্‌লিপ্সের পূর্বাভাস দিল। মুখে জমে-ওঠা ঘাম হাতের তালুয় মুছে এক্‌লিপ্স নিয়ে ওমোভোর বাবা বেজার মুখে বলল, ‘মনে হচ্ছে যেন এই একটা যুদ্ধটা থামিয়ে দেবে।’

‘এক্‌লিপ্স কী?’ ওমোভো জিজ্ঞেস করল।

‘ওটা হল— যখন পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যায়, তখন অদ্ভুত অদ্ভুত সব ব্যাপার-স্যাপার চলতে থাকে।’

‘কীরকম ব্যাপার-স্যাপার?’

ওর বাবা একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘তখন মরে-যাওয়া লোকজন ফের উঠে পড়ে, আর হাঁটাহাঁটি শুরু করে। তুই কিন্তু বেশি রাত জাগিস না, বুঝলি!’

ওমোভো মাথা নাড়ল।

‘হেক্‌লিপ্সরা বাচ্চাদের একদম দেখতে পারে না, বাচ্চাদের ধরে খায়।’

বাবার কথায় ওমোভোর ভরসা হল না। বাবা মুচকি হেসে হাতখরচার দশটা কোবো হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘রেডিয়ো বন্ধ করে দে। বাচ্চাদের এতসব যুদ্ধের খবর শোনা একদম ঠিক না।’

ওমোভো রেডিয়ো বন্ধ করে দিল। নিয়ম মেনে ওর বাবা আঁজলা করে দোরগোড়ায় কয়েক ফোঁটা তালমদ ছিটিয়ে বাপ-ঠাকুর্দাদের উদ্দেশে প্রার্থনা সেরে নিল। ওমোভো দেখল তার বাবা ব্রিফকেসটা নিয়ে পা-চালিয়ে বড় রাস্তার ভিড় ঠেলেঠুলে বাসস্টপে পৌঁছে গেল। একটা ড্যানফো বাস এসে দাঁড়াতেই সে বাসে উঠে পড়ল। ওমোভো এবার ফের রেডিয়োটা চালিয়ে দিয়ে জানলায় বসে সেই মহিলাকে দেখার জন্যে জানলায় গিয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। শেষের বার সে দেখেছিল, হলদে রঙের কুঁচি দেওয়া ঢিলে জামা পরে সেই মহিলা রাস্তা দিয়ে যেন খ্যাপা হাওয়ার মত উড়ে চলেছে। বাইরে রাস্তার বাচ্চাগুলো হকচকিয়ে গিয়ে খেলা থামিয়ে হাঁ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারা বলছিল, রাস্তায় মহিলার কোনও ছায়া পড়েনি, তার পা মাটিও ছোঁয়নি। মহিলা বাচ্চাদের পার হয়ে যেতেই বাচ্চারা তার দিকে যা-পায়-তাই ছুড়তে শুরু করল। মহিলা কিন্তু একটুও না-থেমে, পেছনে একটিবারের জন্যেও না-ফিরে, চলার গতি না-বাড়িয়ে একইভাবে আগের মতই চলতে লাগল।

হাঁসফাঁস-করা গরম তখন। হৈহট্টগোলের দাপট বেশ খানিকটা কমে এসেছে। রোজকার হরেকরকম কাজ সামলাতে গাঁয়ের লোকেদের একেবারে নাজেহাল দশা— সব তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। মনে হল তারা সব যেন ঘুমের মধ্যে খেই হারিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটছে। ফৌজি তিনজন তালকী খেয়ে ড্রাফ্‌ট খেলতে বসে গেল। বাইরের ঝাঁঝাঁ রোদ্দুরের চোখ-ধাঁধানো হলকার মধ্যেই তারা খেলতে বসে গিয়েছে। ওমোভো লক্ষ করল, বাচ্চারা শুঁড়িখানার ধারপাশ দিয়ে গেলেই ওরা তাদের কাছে ডেকে নিচ্ছে, তাদের সঙ্গে কথা বলছে আর কিছু পয়সা হাতে গুঁজে দিচ্ছে। সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে শুঁড়িখানা পেরিয়ে খানিকটা যেতেই ফৌজিদের নজরে পড়ে গেল। ঘরে ফিরে আসার পথে একজন ফৌজি তাকে ডাকল।

‘নাম কী তোর?’

সে দোটানায় ছিল, তবু দুষ্টু হাসি হেসে বলে দিল, ‘হেক্‌লিপ্স।’

ফৌজি হেসে ফেলল। তার থুথু ছিটকে এসে পড়ল ওমোভোর মুখে। লোকটার মুখের শিরাগুলো যেন সব বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। মনে হল ওকে নিয়ে ফৌজির স্যাঙাৎদের তেমন আগ্রহ নেই— মাঝে মাঝে ঝটকা মেরে মাছি তাড়াচ্ছে, তাদের মন খেলার দিকে। বন্দুকগুলো টেবিলে রাখা। ওমোভো নজর করে দেখল, বন্দুকগুলোতে নম্বর দেওয়া আছে। লোকটা বলল, ‘পেল্লায় ঠোঁটের জন্যেই বুঝি এরকম একটা নাম দিয়েছে তোর বাপ?’

এবার স্যাঙাতেরা ওমোভোর দিকে ফিরে তাকিয়ে একসঙ্গে হেসে উঠল। ওমোভো ঘাড় নেড়ে সায় দিল।

‘এই তো খাসা ছেলে!’ খানিক থেমে ফৌজিটা এবার একটু অন্যরকম গলায় প্রশ্ন করল।

‘কালো কাপড়ে মুখ-ঢাকা মহিলাকে তুই দেখেছিস?’

‘না।’

লোকটা ওমোভোর হাতে দশ কোবো দিয়ে বলল:

‘ও কিন্তু চর, আমাদের দুশমনদের মদত করে, ওকে দেখতে পেলেই আমাদের খবর দিবি কিন্তু, বুঝেছিস?’

ওমোভো পয়সাটা ফিরিয়ে দিল, সটান ওপরতলায় ওদের ঘরে ফিরে গিয়ে আবার জানলায় বসে পড়ল। ফৌজিগুলো মাঝে মাঝে ওকে দেখছিল। গরমের দাপটে কাহিল হয়ে ওমোভোর চোখ বুজে এল, বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়ল একসময়। সন্ধের দিকে বেজার হয়ে নিতান্ত অনিচ্ছায় মোরগগুলো ডেকে উঠতে ওমোভোর ঘুম ভেঙে গেল। সে বেশ বুঝতে পারছে, গরমের তেজ বিকেল থেকে খানিকটা করে মিইয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে সন্ধের দিকে যাচ্ছে। ফৌজিগুলো শুঁড়িখানায় বসে বসে ঝিমোচ্ছিল। প্রতি ঘণ্টায় যে খবর হয়, ওমোভো শুনছিল সে খবর, কিন্তু ক’জন মারা গেল আর ক’জন জখম হল, বোঝা গেল না। ঘোষক ওই হতবুদ্ধিকর অবস্থায় মুষড়ে পড়েছে, হাই তুলে বারবার মাফ চেয়ে নিয়ে লড়াইয়ের আরও কিছু খুঁটিনাটি খবর দিচ্ছিল।

ওমোভো মুখ তুলে হিসেব করে দেখল মহিলা এর মধ্যেই চলে গেছে। ওই লোকগুলোও শুঁড়িখানা থেকে বেরিয়ে গেছে। তারা আশপাশের কাঁচা বাড়িগুলোর দেওয়াল-ঘেঁষে যাওয়ার সময় চালার বাইরে গরম ভাপের মধ্যে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে বারবার হোঁচট খাচ্ছে। রাস্তায় মহিলাটি অনেকটা এগিয়ে গেছে। ওমোভো দৌড়ে নিচে নেমে গেল, লোকগুলোর পিছু নিল। ওদের একজন উত্তেজনায় অস্থির হয়ে পড়েছে। সামনের এক্সপ্রেস সড়ক পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গিয়ে ওরা মহিলাকে ধাওয়া করল। ওদের পেছনে ওমোভো। ফৌজিদের একজন গায়ের ইউনিফর্মের জামা খুলে ফেলেছে। তার পেছনের লোকটার পাছাটা এত বড় যে, তার প্যান্টের খানিকটা ফেঁসে গেছে। ওমোভোও তাদের পিছু নিয়ে এক্সপ্রেস সড়ক পেরিয়ে এগোতে লাগল। এবার জঙ্গলে এসে পড়ে ওরা মহিলাকে আর ধাওয়া না-করে অন্য রাস্তা ধরল। ওরা হিসেব করেই কাজটা করেছিল বলে মনে হল। শুধু ওই মহিলার দিকেই নজর রেখে ওমোভো পা-চালিয়ে এগোতে লাগল।

ঘন ঝোপজঙ্গলের মধ্যেও সে একইভাবে এগোতে লাগল। মহিলার গায়ে রংচটা কালো আলখাল্লা আর একটা ছাইরঙা আলোয়ান, মাথায় মুখ-ঢেকে-রাখা কালো ঘোমটা। তার মাথায় চাপানো একটা লাল ঝুড়ি। মহিলার কোনও ছায়া কোথাও পড়ছে কিনা, কিংবা তার পা মাটিতে আদৌ পড়ল কিনা সেটা খেয়াল করতে ওমোভো পুরোপুরি ভুলে গেল।

হাঁটতে হাঁটতে ওমোভো কিছু বাড়িঘর পেরিয়ে গেল। সেগুলো অসম্পূর্ণ হয়ে পড়ে আছে। সাইনবোর্ডে আর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ভাঙা পাঁচিলে বড়বড় কথা লেখা ছিল। সে একটা সিমেন্টের কারখানা পার হয়ে গেল, সেটাও জনশূন্য— ভেঙেপড়া ব্লকগুলো ধুলোর পাঁজা হয়ে পড়ে আছে, কর্মীদের শেডে কেউ নেই। একটা বিশাল বেড়ের বাওবাব গাছও পেরিয়ে গেল। সেই গাছের নিচে বড় কোনও জানোয়ারের আস্ত একটা কঙ্কাল পড়ে আছে। একটা সাপ ডাল থেকে পড়ে সরসর করে মাটির নিচে চলে গেল। দূরে উঁচু পাহাড়ের খাড়াইয়ের কিনারা থেকে ভেসে আসছিল জোরালো গানের আওয়াজ— কারা যেন লড়াইয়ের স্লোগানে সুর লাগিয়ে গলা ছেড়ে গাইছে।

ওমোভো মহিলার পিছু নিয়ে এগোতে এগোতে নিচে ন্যাড়া জমিতে কোনওরকমে দাঁড়িয়ে-থাকা একটা ছাউনিমত দেখতে পেল। সেখানে গুহার আবছা আলোয় কিছু ছায়ামূর্তি এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল। মহিলা ওদের দিকেই এগিয়ে গেল। তারা ওকে ঘিরে জড়ো হল, আদর করে ওর গা ছুঁল, তারপর ওকে গুহার মধ্যে নিয়ে গেল। ওমোভো শুনতে পেল, হয়রান অবসন্ন গলায় তারা মহিলাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। ওমোভো মহিলাকে এবার যখন আবার দেখতে পেল, কিন্তু মাথার ঝুড়িটা তখন আর নেই। পুষ্টি না-পাওয়া কোউয়াশিওকও রোগে-ভোগা পেটমোটা-হাড়ডিগডিগে হাড্ডিসার বাচ্চাগুলো আর ছেঁড়া ন্যাকড়া গায়ে-জড়ানো মেয়েরা ওকে উপরের পাহাড়ে যাওয়ার অর্ধেক রাস্তা অব্দি এগিয়ে দিল নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে। তারা এমনভাবে ওকে ছুঁয়ে ছিল যেন মনে হল, তাদের ভয় তারা ওকে আর হয়তো দেখতে পাবে না। তারা ফিরে গেল।

মহিলাকে অনুসরণ করতে করতে ওমোভো এবার একটা কাদা আর ঘোলাজলে-ভরা নদীর ধারে এসে পড়ল। মহিলার চলা দেখে মনে হচ্ছিল যেন তাকে গুঁড়িয়ে ধুলোয় উড়িয়ে দেওয়ার জন্যে কোনও ভয়ানক অদৃশ্য শক্তি তার পিছু নিয়েছে। সে দেখল, নদীতে কিছু উল্টে যাওয়া ডিঙি নৌকো, কিছু জামাকাপড় কিনারার গাঢ় কালচে জলে আটকে আছে। আরও কিছু ভাসন্ত জিনিস সে দেখতে পেল: পলিথিনের মোড়কে পাঁউরুটি, মানতে বিসর্জন দেওয়া লাউ-কুমড়ো-শশা ইত্যাদি; কোকাকোলা-র ক্যানও সেখানে ভাসছিল। ফের একবার ওমোভো ডিঙিগুলোর দিকে চোখ ফেরাতে দেখল, সেগুলো বদলে গিয়ে ঢোল হয়ে ফুলে যাওয়া মৃত পশুদের মত আকার নিয়েছে। নদীর পাড়ে এখানে-ওখানে পড়ে রয়েছে বেশ কিছু অচল নোট। জায়গাটা অসহ্য দুর্গন্ধে ভরে আছে। সে ঠিক এইসময় তার পেছন থেকে আসা ভারি নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল। কেউ একজন কাশছে আর থুতু ফেলছে। সে বুঝতে পারল, আওয়াজটা সেই ফৌজিদের একজনের— লোকটা অন্যদের আরও তাড়াতাড়ি এগোনোর বুদ্ধি দিচ্ছিল। ওমোভো ভয় পেল, সে সন্তর্পণে গুটিসুটি মেরে একটা গাছের ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। ফৌজির দলটা লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোতে থাকল। কিছু পরেই সে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পেল। মহিলা এখন ওদের নাগালে। ওরা তাকে ঘিরে ফেলল সবদিক থেকে।

‘বাকিরা কোথায়?’ ওদের একজন খেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

মহিলা চুপচাপ।

‘তাহলে তুইই সেই ডাইনি! মরার শখ হয়েছে, তাই না? এবার বল, বাকিরা কোথায়?’

সে চুপ করে রইল, মাথা নুইয়ে। এক ফৌজি খানিক কেশে নদীর দিকে ফিরে থুতু ফেলল।

‘বল! বলে ফ্যাল!’ তাকে একটা চড় মেরে ফৌজি বলল।

মোটা ফৌজিটা তার মুখ-ঢাকার ঘোমটার কাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলল, তারপর মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিল। সে নিচু হয়ে সেটা তুলতে গিয়ে থেমে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, তখনও সে মাথাটা নুইয়ে রেখেছিল। তার মাথা নেড়া, বিকৃত গভীর খাঁজের ক্ষতচিহ্নে ভরা। গালে নীল কালশিটে-পড়া বড় বড় দাগ। যে ফৌজিটা বুক খুলে রেখেছিল, সে তাকে ধাক্কা দিতেই সে মুখ থুবড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সেভাবেই স্থির হয়ে রইল। তখন জঙ্গলের আলো বদলে যেতে যেতে ফিকে হয়ে আসছে। এই প্রথম ওমোভো দেখতে পেল, আসলে নদীতে সেই মরা পশুগুলো ছিল পূর্ণবয়স্ক মানুষদের লাশ— নদীর জলের আগাছায় জড়িয়ে গিয়েছে, চোখগুলো ফুলে-ওঠা। মনে কী প্রতিক্রিয়া হল তা বোঝার আগেই সে শুনতে পেল আর-একটা আর্তনাদ। ঘোমটার কাপড়টা কোনওরকমে হাতে নিয়ে মহিলা উঠে দাঁড়ানোর জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করল। একসময় সে উঠে একেবারে সিধে ঘুরে দাঁড়িয়ে মোটা ফৌজির মুখে থুতু দিল। উদ্বেগে অস্থিরমনে সে ওড়নাটা হাওয়ায় নাড়াতে নাড়াতে চিৎকার করতে লাগল। বাকি দুই ফৌজি খানিক দূরে সরে গেল। মোটা ফৌজি মুখ মুছে নিল, বন্দুক তুলে নিয়ে ঠিক তার পেটে তাক করল। গুলির শব্দ তার কানে আসার ঠিক আগের মুহূর্তে ওমোভোর লুকোনোর জায়গার ঠিক মাথায় একটা জোরালো পাখা ঝাপটানোর শব্দ হল। ওমোভো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চিৎকার করে উঠল, সে ছুটতে শুরু করল। ফৌজিরা বড় বড় পা ফেলে তাকে ধাওয়া করল। পাহাড়গুলো থেকে উঠে আসা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে সে ছুটছিল। এমন সময় সে দেখল, শামিয়ানার মত জঙ্গলের পাতা ঢাকা আড়াল থেকে একটা পেঁচা তার দিকেই চেয়ে আছে। একটা বড় গাছের শেকড়ে হোঁচট খেয়ে ওমোভো মাটিতে পড়ে গেল। তার মাথায় লাগল— ক্ষণিকের জন্যে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

জ্ঞান ফিরে এলে ওমোভো দেখল চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মুখের সামনে আঙুল নাড়িয়ে চেষ্টা করেও সে কিছু দেখতে পেল না। সে ধরে নিল, হয়তো সে অন্ধ হয়ে গেছে। সে ভয় পেয়ে গিয়ে চিৎকার করতে লাগল, খ্যাপা পাগলের মত অস্থির হয়ে হাত-পা ছুড়তে লাগল; একসময় ছুটে গিয়ে একটা দরজায় ঢুকে পড়ল। শেষ অব্দি ধাক্কাটা সামলে নেওয়ার পর ওমোভো বাইরে কিছু মানুষের গলার আওয়াজ শুনতে পেল। রেডিয়োটা তখন তারস্বরে যুদ্ধের খবর দিয়ে চলেছে। ব্যালকনির রাস্তা সে পেয়ে গিয়েছে— অবাক বিস্ময়ে দেখল, তার দৃষ্টি ফিরে এসেছে। কিন্তু সেখান এসে সে একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়ে দেখল, দেবে-যাওয়া বেতের চেয়ারটায় তার বাবা বসে আছে, আর সেই তিন ফৌজিও তার সঙ্গে বসে তালমদ সেবন করছে। ওমোভো ক্ষিপ্তভাবে বাবার কাছে ছুটে গিয়ে ওই তিনজনকে দেখিয়ে দিল।

‘তুই ওদের ধন্যবাদ দে’, ওর বাবা বলল, ‘ওরা তোকে জঙ্গল থেকে ফিরিয়ে এনেছে।’

ওই প্রলাপের বিভ্রম কাটিয়ে উঠে ওমোভো এবার ওর বাবাকে বলতে শুরু করল আসলে সে কী দেখেছে। কিন্তু দোষকুণ্ঠিত বাবা ফৌজিদের দিকে তাকিয়ে হাসল, ছেলেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

***

লেখক পরিচিতি

আফ্রিকার স্বনামধন্য লেখক বেন ওক্‌রির জন্ম ১৯৫৯ সালে নাইজেরিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের নাইজার তীরবর্তী মিন্না শহরের এক সচ্ছল পরিবারে। ১৯৬১ সালে তাঁদের পরিবার লন্ডনে চলে যায়। ১৯৬৮ সালে তাঁরা আবার দেশে ফিরে আসেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল বিজ্ঞানী হওয়ার। কিন্তু বাবার লাইব্রেরির সাহিত্যের বইপত্র পড়তে পড়তে তাঁর জীবনের লক্ষ্য বদলে যায়, ঠিক করেন তিনি লেখক হবেন। মাত্র বারো বছর বয়েস থেকে তিনি লিখতে শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে পুনরায় লন্ডনে ফিরে এসে অনতিদূরের এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের পাঠ নেন। দেশে ঘটে যাওয়া মারাত্মক হিংসাশ্রয়ী গৃহযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামাজিক ডামাডোলে টালমাটাল বিধ্বস্ত দেশের দুর্দশাপীড়িত প্রান্তিক মানুষের কথা তাঁর লেখার প্রতিবিম্বিত হয়। মূলত কবি উপন্যাসকার ছোটগল্পকার হিসেবে তিনি সুপরিচিত। প্রাবন্ধিক চিত্রনাট্যলেখক হিসেবেও সমাদৃত। ১৯৯১ সালে মাত্র বত্রিশ বছর বয়েসে তিনি বিশ্বখ্যাত সাহিত্য সম্মান বুকার পুরস্কার লাভ করেন।
তাঁর লেখা উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ফ্লাওয়ার্স অ্যান্ড স্যাডোজ’ (১৯৮০), ‘আস্টনিশিং দ্য গডস’ (১৯৯৫), ‘ডেঞ্জারাস লাভ’ (১৯৯৬), ‘ইনফিনিট রিচেস’ (১৯৯৮), ‘ইন আরক্যাডিয়া’ (২০০২), ‘স্টারবুক’ (২০০৭), ‘দ্য এইজ অফ ম্যাজিক’ (২০১৪) এবং ‘দ্য ফ্রিডম আর্টিস্ট’ (২০১৯)। কবিতাসংকলনগ্রন্থ: ‘আন আফ্রিকান এলিজি’ (১৯৯২), ‘মেন্টাল ফাইট’ (১৯৯৯), ‘ওয়াইল্ড’ (২০১২), ‘রাইজ লাইক লায়ন: পোয়েট্রি ফর দ্য মেনি’ (২০১৯), ‘আ ফায়ার ইন মাই হেড: পোয়েমস ফর দ্য ডন’ (২০২১) এবং শিশু-রূপকথা ‘এভরি লিফ্‌ আ হালেলুহইয়া’ (২০২২)। ছোটগল্প সংকলনগুলির মধ্যে ‘ইন্সিডেন্টস অ্যাট দ্য শ্রাইন’ (১৯৮৬), ‘স্টারস অফ দ্য কারফিউ’ (১৯৮৮), ‘টেলস অফ দ্য ফ্রিডম’ (২০০৯) প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

ভূতের একটি বাজে গল্প

দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিতেই প্রথমে যেটি চোখে পড়ল, সেটি সেই লাল-হলুদ মাফলার, খাটের পাশে ঝোলানো। তাহলে সিড়িঙ্গেবাবু নিশ্চয়ই এই ঘরেই অধিষ্ঠান করেন, তালা দিয়ে কোথাও বেরিয়েছেন। হঠাৎ আমি ভূতগ্রস্তের মত করিডর ধরে হাঁটছি আর এক-একটা করে ঘরের দরজা ঠেলে ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছি। কী আশ্চর্য, প্রতিটি ঘরেই কোথাও না কোথাও দেখছি একটা করে ওই লাল-হলুদ মাফলার ঝুলছে। যত দ্রুত পারি দোতলায় ঘরগুলোর দরজা ঠেলে উঁকি দিলাম। সবখানেই এক ছবি।

Read More »
সুজিত বসু

কবিতা: জীবনের নানা দিক

ট্রেনের জানালা থেকে চোখে পড়ে ঘাসের গালিচা/ কোমল রোদের স্নেহে ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চল শান্তির নিদ্রায়/ সমুদ্রে দ্বীপের মতো ছোট ছোট বাড়িগুলি ঘাসের শয্যায়/ অতি দ্রুত বদলে যায় দৃশ্যাবলি, ট্রেন থামে ব্রাসেলস স্টেশনে/ বেলজিয়ামের মোহ দূরে রেখে ট্রেন চলে স্থির নিশানায়/ অভ্রান্ত লক্ষ্যের দিকে, আমস্টারডাম ডাকে কুহকী মায়ায়/ নগরে পৌঁছেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য, সুন্দরী ট্রামেরা/ হাতছানি দিয়ে ডাকে, বহু বহুদিন পরে প্রিয় বাহনের/ ডাকে সাড়া দিয়ে আমি পৌঁছে যাই মহার্ঘ নিবাসে

Read More »
নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | প্রথম পর্ব

আমাদের খেলা করা দরকার, তাই আমাদের কয়েকজন ছেলে মিলে ক্লাব তৈরি করতে হবে। কোথায় করা যায়? — অমুক জায়গায় — ওই জায়গাটা পড়ে আছে, তা যাদের জায়গা তারা বললেন, “ওই তো ওখানে জঙ্গল হয়ে আছে, তা যদি তোমরা জঙ্গল-টঙ্গল পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে ক্লাব তৈরি করতে পার তো করো।” আমাদের আর পায় কে — আমরা মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলে। উদ্ধার করলাম। উদ্ধার-টুদ্ধার করে এর বাড়ি থকে চারটে বাঁশ, ওর বাড়ি থেকে তিনটে হোগলা এভাবে যোগাড়-যন্ত্র করে-টরে একটা চালাঘর তৈরি করা হলো। সেই চালাঘরকেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে আমাদের নতুন লাইব্রেরী তৈরি হলো। ক্লাবের নাম হলো ‘সেনহাটি অ্যাথলেটিক ক্লাব’।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বাঘেশ্বরীদেবীর পুজো! সেই থেকেই ‘বাগনান’!

ছোট্ট ওই ভূখণ্ডটি বাঘের উপস্থিতির জন্যই তখন ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয় বলে প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরার অভিমত। এই বিষয়ে তিনি আরও জানান, আরবি ভাষা অনুযায়ী ‘নান’ কথার অর্থ হল ‘চরভূমি’। ‘নান’ শব্দের আরও একটি অর্থ হল ‘ছাউনি’। তখন কাছারিপাড়া ছাড়াও নদী সংলগ্ন বেশ কয়েকটি এলাকায় ইংরেজ সেনাদের ছাউনি ছিল বলে জানা যায়। যার মধ্যে খাদিনান, পাতিনান, খাজুরনান, বাইনান, চিৎনান, মাছিনান ইত্যাদি জনপদগুলি উল্লেখযোগ্য। যেহেতু নদীর চরে বাঘেশ্বরী দেবীর পুজো হত, সেই জন্য প্রাথমিকভাবে এলাকাটি ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ‘বাঘনান’ অপভ্রংশ হয়ে ‘বাগনান’-এ পরিণত হয়েছে।

Read More »
আবদুল্লাহ আল আমিন

কবিগান: সমাজবাস্তবতা, বিষয়বৈভব ও রূপবৈচিত্র্য

এমন লোকপ্রিয় বিষয় বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা ভাষা, সঙ্গীত ও সাহিত্যে কবিগান ও কবিয়ালদের অবদানের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগান সংগ্রহ এবং এ বিষয় পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে কবিয়ালদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান কিংবা কবিগানকে সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক এ গানকে সংরক্ষণ করার সুপারিশ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই গানের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে লোকায়ত বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা দিক যার অধিকাংশই অনালোচিত ও অনালোকিত রয়েছে অদ্যাবধি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার: মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভা

সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন, এবং জাতীয় কংগ্রেসে নিয়মিত যোগ দিতেন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ববর্তী বছরের জাতক এবং প্রখর প্রজ্ঞাবান অশ্বিনীকুমার ১৮৯৭-এর কংগ্রেসের অমরাবতী অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে একে ‘Threedays’ mockery’,— ‘তিনদিনের তামাশা’ বলে উল্লেখ করেন। দুর্ভাগ্য দেশের, তাঁর কথা অনুধাবন করলেও কেউ গুরুত্ব দেননি। সে-অধিবেশনের সভাপতি চেট্টুর শঙ্করণ নায়ারকে নিয়ে অক্ষয়কুমার-অনন্যা পাণ্ডে অভিনীত বায়োপিক তৈরি হয়েছে। অথচ সারা উপমহাদেশ-কাঁপানো অশ্বিনীকুমারের মূল্যায়ন আজ-ও অপেক্ষিত।

Read More »