Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

নাইজেরিয়ার গল্প: যুদ্ধের ছায়ায়

বেন ওক্‌রি

অনুবাদ: মানব সাধন বিশ্বাস

সেদিন বিকেলে গাঁয়ে এল তিনজন ফৌজি। তারা গাঁয়ের ছাগল আর মুরগিগুলোকে একেবারে ছোড়ভঙ্গ করে ছাড়ল। তালপাতার বেড়া-দেওয়া শুঁড়িখানায় ঢুকে তারা লাউয়ের ভাঁড়ের তালকীর অর্ডার দিল। তারপর মাছি-ভনভন ঘরে তালকী গিলতে লাগল।

ওমোভো জানলা দিয়ে ওদের দেখছিল। ওর বাবার এখন কাজে বেরিয়ে যাওয়ার সময়, সে এখন তার অপেক্ষায় আছে। দুজনই রেডিয়োর খবর শুনছিল। যুদ্ধ যখন শুরু হল, শহরের একটি পরিবার দেশ ছাড়ার সময় ওর বাবার কাছে জলের দরে বেচেছিল গ্রুন্ডিগ কোম্পানির ওই পুরনো রেডিয়ো। সাদা কাপড়ে পরিপাটি করে রেডিয়োটা ঢেকে রাখা বাস্তুদেবতা-সম খাতিরে। দেশের অন্দরে শত্রুপক্ষের যত্রতত্র বোমাবাজির খবর, আচমকা বিমান-হামলার খবর ইত্যাদি তারা কান পেতে শোনে। ওর বাবা গুছিয়ে চুল আঁচড়ে তৈরি হয়ে নিল। দাড়ি কামানোর বালাই নেই, স্রেফ গালে-মুখে লোশন লাগিয়ে, আঁটোসাঁটো পুরোনো ছেঁড়া কোটখানা কসরত করে গায়ে চাপিয়ে নিল।

ওমোভো জানলার বাইরে তাকিয়ে রইল। বাবার ওপর সে বেশ রেগে আছে। আজ নিয়ে পরপর সাতদিন হল, ঢোলা-জামা আর কালো কাপড়ের ঘোমটায় মাথা-মুখ ঢেকে সেই অদ্ভুত মহিলা ঠিক ওই সময়েই ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া-আসা করছে। গাঁয়ের পথ দিয়ে সোজা এগিয়ে এক্সপ্রেস সড়ক পার হয়ে সে জঙ্গলে মিলিয়ে যায়। ওমোভো তাকে দেখার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে।

রেডিয়োয় বড় খবর তখন শেষ হয়েছে। ঘোষক রাতে এক্‌লিপ্সের পূর্বাভাস দিল। মুখে জমে-ওঠা ঘাম হাতের তালুয় মুছে এক্‌লিপ্স নিয়ে ওমোভোর বাবা বেজার মুখে বলল, ‘মনে হচ্ছে যেন এই একটা যুদ্ধটা থামিয়ে দেবে।’

‘এক্‌লিপ্স কী?’ ওমোভো জিজ্ঞেস করল।

‘ওটা হল— যখন পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যায়, তখন অদ্ভুত অদ্ভুত সব ব্যাপার-স্যাপার চলতে থাকে।’

‘কীরকম ব্যাপার-স্যাপার?’

ওর বাবা একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘তখন মরে-যাওয়া লোকজন ফের উঠে পড়ে, আর হাঁটাহাঁটি শুরু করে। তুই কিন্তু বেশি রাত জাগিস না, বুঝলি!’

ওমোভো মাথা নাড়ল।

‘হেক্‌লিপ্সরা বাচ্চাদের একদম দেখতে পারে না, বাচ্চাদের ধরে খায়।’

বাবার কথায় ওমোভোর ভরসা হল না। বাবা মুচকি হেসে হাতখরচার দশটা কোবো হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘রেডিয়ো বন্ধ করে দে। বাচ্চাদের এতসব যুদ্ধের খবর শোনা একদম ঠিক না।’

ওমোভো রেডিয়ো বন্ধ করে দিল। নিয়ম মেনে ওর বাবা আঁজলা করে দোরগোড়ায় কয়েক ফোঁটা তালমদ ছিটিয়ে বাপ-ঠাকুর্দাদের উদ্দেশে প্রার্থনা সেরে নিল। ওমোভো দেখল তার বাবা ব্রিফকেসটা নিয়ে পা-চালিয়ে বড় রাস্তার ভিড় ঠেলেঠুলে বাসস্টপে পৌঁছে গেল। একটা ড্যানফো বাস এসে দাঁড়াতেই সে বাসে উঠে পড়ল। ওমোভো এবার ফের রেডিয়োটা চালিয়ে দিয়ে জানলায় বসে সেই মহিলাকে দেখার জন্যে জানলায় গিয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। শেষের বার সে দেখেছিল, হলদে রঙের কুঁচি দেওয়া ঢিলে জামা পরে সেই মহিলা রাস্তা দিয়ে যেন খ্যাপা হাওয়ার মত উড়ে চলেছে। বাইরে রাস্তার বাচ্চাগুলো হকচকিয়ে গিয়ে খেলা থামিয়ে হাঁ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারা বলছিল, রাস্তায় মহিলার কোনও ছায়া পড়েনি, তার পা মাটিও ছোঁয়নি। মহিলা বাচ্চাদের পার হয়ে যেতেই বাচ্চারা তার দিকে যা-পায়-তাই ছুড়তে শুরু করল। মহিলা কিন্তু একটুও না-থেমে, পেছনে একটিবারের জন্যেও না-ফিরে, চলার গতি না-বাড়িয়ে একইভাবে আগের মতই চলতে লাগল।

হাঁসফাঁস-করা গরম তখন। হৈহট্টগোলের দাপট বেশ খানিকটা কমে এসেছে। রোজকার হরেকরকম কাজ সামলাতে গাঁয়ের লোকেদের একেবারে নাজেহাল দশা— সব তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। মনে হল তারা সব যেন ঘুমের মধ্যে খেই হারিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটছে। ফৌজি তিনজন তালকী খেয়ে ড্রাফ্‌ট খেলতে বসে গেল। বাইরের ঝাঁঝাঁ রোদ্দুরের চোখ-ধাঁধানো হলকার মধ্যেই তারা খেলতে বসে গিয়েছে। ওমোভো লক্ষ করল, বাচ্চারা শুঁড়িখানার ধারপাশ দিয়ে গেলেই ওরা তাদের কাছে ডেকে নিচ্ছে, তাদের সঙ্গে কথা বলছে আর কিছু পয়সা হাতে গুঁজে দিচ্ছে। সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে শুঁড়িখানা পেরিয়ে খানিকটা যেতেই ফৌজিদের নজরে পড়ে গেল। ঘরে ফিরে আসার পথে একজন ফৌজি তাকে ডাকল।

‘নাম কী তোর?’

সে দোটানায় ছিল, তবু দুষ্টু হাসি হেসে বলে দিল, ‘হেক্‌লিপ্স।’

ফৌজি হেসে ফেলল। তার থুথু ছিটকে এসে পড়ল ওমোভোর মুখে। লোকটার মুখের শিরাগুলো যেন সব বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। মনে হল ওকে নিয়ে ফৌজির স্যাঙাৎদের তেমন আগ্রহ নেই— মাঝে মাঝে ঝটকা মেরে মাছি তাড়াচ্ছে, তাদের মন খেলার দিকে। বন্দুকগুলো টেবিলে রাখা। ওমোভো নজর করে দেখল, বন্দুকগুলোতে নম্বর দেওয়া আছে। লোকটা বলল, ‘পেল্লায় ঠোঁটের জন্যেই বুঝি এরকম একটা নাম দিয়েছে তোর বাপ?’

এবার স্যাঙাতেরা ওমোভোর দিকে ফিরে তাকিয়ে একসঙ্গে হেসে উঠল। ওমোভো ঘাড় নেড়ে সায় দিল।

‘এই তো খাসা ছেলে!’ খানিক থেমে ফৌজিটা এবার একটু অন্যরকম গলায় প্রশ্ন করল।

‘কালো কাপড়ে মুখ-ঢাকা মহিলাকে তুই দেখেছিস?’

‘না।’

লোকটা ওমোভোর হাতে দশ কোবো দিয়ে বলল:

‘ও কিন্তু চর, আমাদের দুশমনদের মদত করে, ওকে দেখতে পেলেই আমাদের খবর দিবি কিন্তু, বুঝেছিস?’

ওমোভো পয়সাটা ফিরিয়ে দিল, সটান ওপরতলায় ওদের ঘরে ফিরে গিয়ে আবার জানলায় বসে পড়ল। ফৌজিগুলো মাঝে মাঝে ওকে দেখছিল। গরমের দাপটে কাহিল হয়ে ওমোভোর চোখ বুজে এল, বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়ল একসময়। সন্ধের দিকে বেজার হয়ে নিতান্ত অনিচ্ছায় মোরগগুলো ডেকে উঠতে ওমোভোর ঘুম ভেঙে গেল। সে বেশ বুঝতে পারছে, গরমের তেজ বিকেল থেকে খানিকটা করে মিইয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে সন্ধের দিকে যাচ্ছে। ফৌজিগুলো শুঁড়িখানায় বসে বসে ঝিমোচ্ছিল। প্রতি ঘণ্টায় যে খবর হয়, ওমোভো শুনছিল সে খবর, কিন্তু ক’জন মারা গেল আর ক’জন জখম হল, বোঝা গেল না। ঘোষক ওই হতবুদ্ধিকর অবস্থায় মুষড়ে পড়েছে, হাই তুলে বারবার মাফ চেয়ে নিয়ে লড়াইয়ের আরও কিছু খুঁটিনাটি খবর দিচ্ছিল।

ওমোভো মুখ তুলে হিসেব করে দেখল মহিলা এর মধ্যেই চলে গেছে। ওই লোকগুলোও শুঁড়িখানা থেকে বেরিয়ে গেছে। তারা আশপাশের কাঁচা বাড়িগুলোর দেওয়াল-ঘেঁষে যাওয়ার সময় চালার বাইরে গরম ভাপের মধ্যে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে বারবার হোঁচট খাচ্ছে। রাস্তায় মহিলাটি অনেকটা এগিয়ে গেছে। ওমোভো দৌড়ে নিচে নেমে গেল, লোকগুলোর পিছু নিল। ওদের একজন উত্তেজনায় অস্থির হয়ে পড়েছে। সামনের এক্সপ্রেস সড়ক পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গিয়ে ওরা মহিলাকে ধাওয়া করল। ওদের পেছনে ওমোভো। ফৌজিদের একজন গায়ের ইউনিফর্মের জামা খুলে ফেলেছে। তার পেছনের লোকটার পাছাটা এত বড় যে, তার প্যান্টের খানিকটা ফেঁসে গেছে। ওমোভোও তাদের পিছু নিয়ে এক্সপ্রেস সড়ক পেরিয়ে এগোতে লাগল। এবার জঙ্গলে এসে পড়ে ওরা মহিলাকে আর ধাওয়া না-করে অন্য রাস্তা ধরল। ওরা হিসেব করেই কাজটা করেছিল বলে মনে হল। শুধু ওই মহিলার দিকেই নজর রেখে ওমোভো পা-চালিয়ে এগোতে লাগল।

ঘন ঝোপজঙ্গলের মধ্যেও সে একইভাবে এগোতে লাগল। মহিলার গায়ে রংচটা কালো আলখাল্লা আর একটা ছাইরঙা আলোয়ান, মাথায় মুখ-ঢেকে-রাখা কালো ঘোমটা। তার মাথায় চাপানো একটা লাল ঝুড়ি। মহিলার কোনও ছায়া কোথাও পড়ছে কিনা, কিংবা তার পা মাটিতে আদৌ পড়ল কিনা সেটা খেয়াল করতে ওমোভো পুরোপুরি ভুলে গেল।

হাঁটতে হাঁটতে ওমোভো কিছু বাড়িঘর পেরিয়ে গেল। সেগুলো অসম্পূর্ণ হয়ে পড়ে আছে। সাইনবোর্ডে আর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ভাঙা পাঁচিলে বড়বড় কথা লেখা ছিল। সে একটা সিমেন্টের কারখানা পার হয়ে গেল, সেটাও জনশূন্য— ভেঙেপড়া ব্লকগুলো ধুলোর পাঁজা হয়ে পড়ে আছে, কর্মীদের শেডে কেউ নেই। একটা বিশাল বেড়ের বাওবাব গাছও পেরিয়ে গেল। সেই গাছের নিচে বড় কোনও জানোয়ারের আস্ত একটা কঙ্কাল পড়ে আছে। একটা সাপ ডাল থেকে পড়ে সরসর করে মাটির নিচে চলে গেল। দূরে উঁচু পাহাড়ের খাড়াইয়ের কিনারা থেকে ভেসে আসছিল জোরালো গানের আওয়াজ— কারা যেন লড়াইয়ের স্লোগানে সুর লাগিয়ে গলা ছেড়ে গাইছে।

ওমোভো মহিলার পিছু নিয়ে এগোতে এগোতে নিচে ন্যাড়া জমিতে কোনওরকমে দাঁড়িয়ে-থাকা একটা ছাউনিমত দেখতে পেল। সেখানে গুহার আবছা আলোয় কিছু ছায়ামূর্তি এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল। মহিলা ওদের দিকেই এগিয়ে গেল। তারা ওকে ঘিরে জড়ো হল, আদর করে ওর গা ছুঁল, তারপর ওকে গুহার মধ্যে নিয়ে গেল। ওমোভো শুনতে পেল, হয়রান অবসন্ন গলায় তারা মহিলাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। ওমোভো মহিলাকে এবার যখন আবার দেখতে পেল, কিন্তু মাথার ঝুড়িটা তখন আর নেই। পুষ্টি না-পাওয়া কোউয়াশিওকও রোগে-ভোগা পেটমোটা-হাড়ডিগডিগে হাড্ডিসার বাচ্চাগুলো আর ছেঁড়া ন্যাকড়া গায়ে-জড়ানো মেয়েরা ওকে উপরের পাহাড়ে যাওয়ার অর্ধেক রাস্তা অব্দি এগিয়ে দিল নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে। তারা এমনভাবে ওকে ছুঁয়ে ছিল যেন মনে হল, তাদের ভয় তারা ওকে আর হয়তো দেখতে পাবে না। তারা ফিরে গেল।

মহিলাকে অনুসরণ করতে করতে ওমোভো এবার একটা কাদা আর ঘোলাজলে-ভরা নদীর ধারে এসে পড়ল। মহিলার চলা দেখে মনে হচ্ছিল যেন তাকে গুঁড়িয়ে ধুলোয় উড়িয়ে দেওয়ার জন্যে কোনও ভয়ানক অদৃশ্য শক্তি তার পিছু নিয়েছে। সে দেখল, নদীতে কিছু উল্টে যাওয়া ডিঙি নৌকো, কিছু জামাকাপড় কিনারার গাঢ় কালচে জলে আটকে আছে। আরও কিছু ভাসন্ত জিনিস সে দেখতে পেল: পলিথিনের মোড়কে পাঁউরুটি, মানতে বিসর্জন দেওয়া লাউ-কুমড়ো-শশা ইত্যাদি; কোকাকোলা-র ক্যানও সেখানে ভাসছিল। ফের একবার ওমোভো ডিঙিগুলোর দিকে চোখ ফেরাতে দেখল, সেগুলো বদলে গিয়ে ঢোল হয়ে ফুলে যাওয়া মৃত পশুদের মত আকার নিয়েছে। নদীর পাড়ে এখানে-ওখানে পড়ে রয়েছে বেশ কিছু অচল নোট। জায়গাটা অসহ্য দুর্গন্ধে ভরে আছে। সে ঠিক এইসময় তার পেছন থেকে আসা ভারি নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল। কেউ একজন কাশছে আর থুতু ফেলছে। সে বুঝতে পারল, আওয়াজটা সেই ফৌজিদের একজনের— লোকটা অন্যদের আরও তাড়াতাড়ি এগোনোর বুদ্ধি দিচ্ছিল। ওমোভো ভয় পেল, সে সন্তর্পণে গুটিসুটি মেরে একটা গাছের ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। ফৌজির দলটা লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোতে থাকল। কিছু পরেই সে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পেল। মহিলা এখন ওদের নাগালে। ওরা তাকে ঘিরে ফেলল সবদিক থেকে।

‘বাকিরা কোথায়?’ ওদের একজন খেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

মহিলা চুপচাপ।

‘তাহলে তুইই সেই ডাইনি! মরার শখ হয়েছে, তাই না? এবার বল, বাকিরা কোথায়?’

সে চুপ করে রইল, মাথা নুইয়ে। এক ফৌজি খানিক কেশে নদীর দিকে ফিরে থুতু ফেলল।

‘বল! বলে ফ্যাল!’ তাকে একটা চড় মেরে ফৌজি বলল।

মোটা ফৌজিটা তার মুখ-ঢাকার ঘোমটার কাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলল, তারপর মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিল। সে নিচু হয়ে সেটা তুলতে গিয়ে থেমে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, তখনও সে মাথাটা নুইয়ে রেখেছিল। তার মাথা নেড়া, বিকৃত গভীর খাঁজের ক্ষতচিহ্নে ভরা। গালে নীল কালশিটে-পড়া বড় বড় দাগ। যে ফৌজিটা বুক খুলে রেখেছিল, সে তাকে ধাক্কা দিতেই সে মুখ থুবড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সেভাবেই স্থির হয়ে রইল। তখন জঙ্গলের আলো বদলে যেতে যেতে ফিকে হয়ে আসছে। এই প্রথম ওমোভো দেখতে পেল, আসলে নদীতে সেই মরা পশুগুলো ছিল পূর্ণবয়স্ক মানুষদের লাশ— নদীর জলের আগাছায় জড়িয়ে গিয়েছে, চোখগুলো ফুলে-ওঠা। মনে কী প্রতিক্রিয়া হল তা বোঝার আগেই সে শুনতে পেল আর-একটা আর্তনাদ। ঘোমটার কাপড়টা কোনওরকমে হাতে নিয়ে মহিলা উঠে দাঁড়ানোর জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করল। একসময় সে উঠে একেবারে সিধে ঘুরে দাঁড়িয়ে মোটা ফৌজির মুখে থুতু দিল। উদ্বেগে অস্থিরমনে সে ওড়নাটা হাওয়ায় নাড়াতে নাড়াতে চিৎকার করতে লাগল। বাকি দুই ফৌজি খানিক দূরে সরে গেল। মোটা ফৌজি মুখ মুছে নিল, বন্দুক তুলে নিয়ে ঠিক তার পেটে তাক করল। গুলির শব্দ তার কানে আসার ঠিক আগের মুহূর্তে ওমোভোর লুকোনোর জায়গার ঠিক মাথায় একটা জোরালো পাখা ঝাপটানোর শব্দ হল। ওমোভো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চিৎকার করে উঠল, সে ছুটতে শুরু করল। ফৌজিরা বড় বড় পা ফেলে তাকে ধাওয়া করল। পাহাড়গুলো থেকে উঠে আসা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে সে ছুটছিল। এমন সময় সে দেখল, শামিয়ানার মত জঙ্গলের পাতা ঢাকা আড়াল থেকে একটা পেঁচা তার দিকেই চেয়ে আছে। একটা বড় গাছের শেকড়ে হোঁচট খেয়ে ওমোভো মাটিতে পড়ে গেল। তার মাথায় লাগল— ক্ষণিকের জন্যে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

জ্ঞান ফিরে এলে ওমোভো দেখল চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মুখের সামনে আঙুল নাড়িয়ে চেষ্টা করেও সে কিছু দেখতে পেল না। সে ধরে নিল, হয়তো সে অন্ধ হয়ে গেছে। সে ভয় পেয়ে গিয়ে চিৎকার করতে লাগল, খ্যাপা পাগলের মত অস্থির হয়ে হাত-পা ছুড়তে লাগল; একসময় ছুটে গিয়ে একটা দরজায় ঢুকে পড়ল। শেষ অব্দি ধাক্কাটা সামলে নেওয়ার পর ওমোভো বাইরে কিছু মানুষের গলার আওয়াজ শুনতে পেল। রেডিয়োটা তখন তারস্বরে যুদ্ধের খবর দিয়ে চলেছে। ব্যালকনির রাস্তা সে পেয়ে গিয়েছে— অবাক বিস্ময়ে দেখল, তার দৃষ্টি ফিরে এসেছে। কিন্তু সেখান এসে সে একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়ে দেখল, দেবে-যাওয়া বেতের চেয়ারটায় তার বাবা বসে আছে, আর সেই তিন ফৌজিও তার সঙ্গে বসে তালমদ সেবন করছে। ওমোভো ক্ষিপ্তভাবে বাবার কাছে ছুটে গিয়ে ওই তিনজনকে দেখিয়ে দিল।

‘তুই ওদের ধন্যবাদ দে’, ওর বাবা বলল, ‘ওরা তোকে জঙ্গল থেকে ফিরিয়ে এনেছে।’

ওই প্রলাপের বিভ্রম কাটিয়ে উঠে ওমোভো এবার ওর বাবাকে বলতে শুরু করল আসলে সে কী দেখেছে। কিন্তু দোষকুণ্ঠিত বাবা ফৌজিদের দিকে তাকিয়ে হাসল, ছেলেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

***

লেখক পরিচিতি

আফ্রিকার স্বনামধন্য লেখক বেন ওক্‌রির জন্ম ১৯৫৯ সালে নাইজেরিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের নাইজার তীরবর্তী মিন্না শহরের এক সচ্ছল পরিবারে। ১৯৬১ সালে তাঁদের পরিবার লন্ডনে চলে যায়। ১৯৬৮ সালে তাঁরা আবার দেশে ফিরে আসেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল বিজ্ঞানী হওয়ার। কিন্তু বাবার লাইব্রেরির সাহিত্যের বইপত্র পড়তে পড়তে তাঁর জীবনের লক্ষ্য বদলে যায়, ঠিক করেন তিনি লেখক হবেন। মাত্র বারো বছর বয়েস থেকে তিনি লিখতে শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে পুনরায় লন্ডনে ফিরে এসে অনতিদূরের এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের পাঠ নেন। দেশে ঘটে যাওয়া মারাত্মক হিংসাশ্রয়ী গৃহযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামাজিক ডামাডোলে টালমাটাল বিধ্বস্ত দেশের দুর্দশাপীড়িত প্রান্তিক মানুষের কথা তাঁর লেখার প্রতিবিম্বিত হয়। মূলত কবি উপন্যাসকার ছোটগল্পকার হিসেবে তিনি সুপরিচিত। প্রাবন্ধিক চিত্রনাট্যলেখক হিসেবেও সমাদৃত। ১৯৯১ সালে মাত্র বত্রিশ বছর বয়েসে তিনি বিশ্বখ্যাত সাহিত্য সম্মান বুকার পুরস্কার লাভ করেন।
তাঁর লেখা উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ফ্লাওয়ার্স অ্যান্ড স্যাডোজ’ (১৯৮০), ‘আস্টনিশিং দ্য গডস’ (১৯৯৫), ‘ডেঞ্জারাস লাভ’ (১৯৯৬), ‘ইনফিনিট রিচেস’ (১৯৯৮), ‘ইন আরক্যাডিয়া’ (২০০২), ‘স্টারবুক’ (২০০৭), ‘দ্য এইজ অফ ম্যাজিক’ (২০১৪) এবং ‘দ্য ফ্রিডম আর্টিস্ট’ (২০১৯)। কবিতাসংকলনগ্রন্থ: ‘আন আফ্রিকান এলিজি’ (১৯৯২), ‘মেন্টাল ফাইট’ (১৯৯৯), ‘ওয়াইল্ড’ (২০১২), ‘রাইজ লাইক লায়ন: পোয়েট্রি ফর দ্য মেনি’ (২০১৯), ‘আ ফায়ার ইন মাই হেড: পোয়েমস ফর দ্য ডন’ (২০২১) এবং শিশু-রূপকথা ‘এভরি লিফ্‌ আ হালেলুহইয়া’ (২০২২)। ছোটগল্প সংকলনগুলির মধ্যে ‘ইন্সিডেন্টস অ্যাট দ্য শ্রাইন’ (১৯৮৬), ‘স্টারস অফ দ্য কারফিউ’ (১৯৮৮), ‘টেলস অফ দ্য ফ্রিডম’ (২০০৯) প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »