Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু: ভারতভাগ্যবিধাতা

১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র বসু হরিপুরা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সভাপতি হিসাবে সুভাষচন্দ্র বসু সর্বদা গান্ধিজি এবং তাঁর অনুগত কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন। তাই বলে তিনি তাঁর নিজের লক্ষ্য থেকে কখনও বিচ্যুত ছিলেন না। সেই লক্ষ্য হল, আসন্ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সুযোগে ব্রিটিশ সরকারকে ছয় মাসের চরমপত্র দেওয়া, এবং ব্রিটিশ সরকার সেটি প্রত্যাখ্যান করলে তাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আন্দোলন শুরু করা। সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়াই ছিল তাঁর লক্ষ্য। তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকেও এই নীতি গ্রহণ করার অনুরোধ জানান। কিন্তু গান্ধিজি এবং তাঁর অনুগত দক্ষিণপন্থী কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ এই নীতির বিপক্ষে ছিলেন।

গান্ধিজি এবং দক্ষিণপন্থী কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ সুভাষচন্দ্রের দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হওয়া একেবারেই পছন্দ করেননি। ১৯৩৮ সালের শেষের দিকে তাঁদের এ-ব্যাপারটি আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তা সত্ত্বেও দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বার্থে সুভাষচন্দ্র ১৯৩৯ সালের ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি পদে প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে দাঁড়ান।

কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি বারদৌলিতে এক ‘ঘরোয়া’ আলোচনায় ডা. পট্টভি সীতারামাইয়াকে গান্ধিজি এবং তাঁর অনুগত দক্ষিণপন্থী কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের প্রতিনিধি হিসাবে ঠিক করে, এবং ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি পদে নির্বাচন-প্রার্থী করে। এ ব্যাপারে সভাপতি সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে সামান্য পরামর্শ করার প্রয়োজনীয়তাও তাঁরা অনুভব করেন না। বারদৌলির ‘ঘরোয়া’ আলোচনায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা হলেন মহাত্মা গান্ধি, জওহরলাল নেহরু, রাজেন্দ্র প্রসাদ, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, বল্লভভাই প্যাটেল, আচার্য কৃপালনী, ভুলাভাই দেশাই প্রমুখ দক্ষিণপন্থী কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ।

১৯৩৯ সালের ২৯ জানুয়ারি। ঐতিহাসিক ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি পদের নির্বাচনের দিন। সুভাষচন্দ্র বসু ডা. পট্টভি সীতারামাইয়াকে ১৫৮০-১৩৭৫ ভোটে পরাজিত করে পুনরায় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ সালের ৩১ জানুয়ারি গান্ধিজি ঘোষণা করেন— ‘সীতারামাইয়ার পরাজয় আমারই বেশি, তাঁর নয়।’ The defeat is more mine than ‘his’.

গান্ধিজি এবং তাঁর অনুগত দক্ষিণপন্থী কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ সুভাষচন্দ্রকে একটা উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তার প্রমাণ পাওয়া গেল কয়েক দিন পরে। ১৯৩৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। এদিন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির পনেরো জন সদস্যের মধ্যে বারো জন সদস্য পদত্যাগ করেন। এই বারো জন সদস্যের পদত্যাগে নেতৃত্ব দান করেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এবং ডা. রাজেন্দ্র প্রসাদ। ‘ওয়ার্কিং কমিটির আর একজন বিশিষ্ট এবং প্রধান সদস্য, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, রীতিসম্মতভাবে পদত্যাগ না করলেও একটি বিবৃতি দেন, যার ফলে সকলের ধারণা হয়, তিনিও পদত্যাগ করেছেন।’ এর প্রধান কারণ, ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্রের আপসহীন নীতি, এবং ‘The Indian Struggle’ বইটিতে গান্ধিজি এবং তাঁর অনুগত সৈনিকদের সম্বন্ধে তাঁর কঠোর সমালোচনা।

ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে গোবিন্দবল্লভ পন্থ একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন, সেটিই ‘পন্থ-প্রস্তাব’ নামে খ্যাত। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্রকে গান্ধিজির পছন্দের মানুষদের নিয়ে নতুন ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করার অনুরোধ জানানো হয়। সুভাষচন্দ্রও ‘পন্থ-প্রস্তাব’ মেনে নিয়ে গান্ধিজিকে ওয়ার্কিং কমিটির নতুন সদস্যদের নাম ঘোষণা করার জন্য অনুরোধ জানান। গান্ধিজি সেই প্রস্তাবেও সম্পূর্ণ অসম্মত হন। পরিশেষে, পরিস্থিতির চাপে সুভাষচন্দ্রকে ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতির পদ থেকে সরে যেতে হয়। কলকাতায় অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সভায় সুভাষচন্দ্র পদত্যাগ করেন। সেই ঐতিহাসিক দিনটি ছিল, ১৯৩৯ সালের ২৯ এপ্রিল।

১৯৩৯ সালের ৩ মে সুভাষচন্দ্র বসু ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামে একটি দল গঠন করেন। ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এর সভাপতি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু নিজে। সহ-সভাপতি ছিলেন শার্দুল সিং কবিশের এবং লালা শঙ্কর লাল। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কে. এফ. নরিম্যান, সত্যরঞ্জন বক্সী এবং পণ্ডিত বিশ্বম্ভর দয়াল ত্রিপাঠী। এ-ছাড়াও ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এ ছিলেন এইচ. ভি. কামাথ, অন্নপূর্ণাইয়া, সেনাপতি বাপাত প্রমুখ বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ। ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এর একটি সাপ্তাহিক পত্রিকাও ছিল। পত্রিকাটির নামও ছিল ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’। পত্রিকাটি সম্পাদনার সঙ্গে কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষ বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের নাম সত্যরঞ্জন বক্সী, বিনয় ঘোষ, শ্রীপ্রসাদ উপাধ্যায় এবং গোপাল হালদার।

‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সারা ভারত পরিভ্রমণ করার একটি ব্রতও সুভাষচন্দ্র গ্রহণ করেছিলেন। ভারতের সব জায়গাতেই তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সময়ে তিনি এক হাজারের কাছাকাছি জনসভায় বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য সমগ্র ভারতবাসী মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল।

‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এর সৃষ্টি এবং সুভাষচন্দ্রের এই ধরনের কর্মকাণ্ড গান্ধিজির সম্পূর্ণ অপছন্দ ছিল। দক্ষিণপন্থী কংগ্রেস নেতৃবৃন্দও এর সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। তাঁরা একযোগে এর বিরুদ্ধে কঠোর আঘাত হানার চেষ্টা করছিলেন। সেই আঘাত শেষপর্যন্ত তাঁরা হেনেছিলেনও। ‘কংগ্রেস হাইকমান্ড’ সুভাষচন্দ্ৰ বসুকে বাংলা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে বহিষ্কার করেন। তিন বছর পর্যন্ত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস-এর কোনও কমিটিতে তিনি নির্বাচিত হতে পারবেন না— এই মর্মে আদেশ জারি করে। তার পরের ঘটনা আমরা সবাই জানি, সমগ্র ভারতবাসী, সমগ্র বিশ্ববাসী জানেন। সুভাষচন্দ্র বসুকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস থেকে সম্পূর্ণরূপে বহিষ্কার করা হয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এটি একটি বিশেষ দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা।

১৯৩৯ সালের ১৯ আগস্ট। সুভাষচন্দ্র বসুর পরিকল্পিত ‘মহাজাতি সদন’-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হল। সুভাষচন্দ্রের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।

১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল। জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমেই এই বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল।

১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। ব্রিটেন এবং ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে। ঠিক ওই সময়ে সুভাষচন্দ্র মাদ্রাজে এক জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। ভাষণের মাঝখানেই তিনি যুদ্ধের সংবাদটি পান। এই সংবাদের জন্যই তিনি অপেক্ষা করে ছিলেন। তাঁর ভাষায়— ‘সেই বহুপ্রতীক্ষিত সঙ্কট সমাগত— ভারতের এই সুবর্ণসুযোগ।’ সুভাষচন্দ্রের স্বপ্ন ছিল, বিশ্বযুদ্ধের সুযোগে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করা, এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে নেওয়া।

১৯৪০ সালের মার্চ মাস। বিহারের রামগড়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে সভাপতির আসন অলংকৃত করেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। ঠিক একই সময়ে রামগড়ে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সম্মেলনের স্থানটিও ছিল কংগ্রেস সম্মেলনের খুবই কাছে। ফরওয়ার্ড ব্লক এবং কিষাণ সভার উদ্যোগেই এই সম্মেলনটি আয়োজিত হয়েছিল। এর নাম ‘সারা ভারত আপস-বিরোধী সম্মেলন’। ১৯৪০ সালের ১৯ মার্চ এই সম্মেলনের সভাপতি হিসাবে সুভাষচন্দ্র বসু বক্তৃতা দিয়েছিলেন।

১৯৪০ সালের এপ্রিল মাস। সুভাষচন্দ্র তাঁর সৃষ্ট ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-কে আইন অমান্য আন্দোলনের পথে পরিচালিত করলেন। ৬ এপ্রিল থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এর অনেক নেতা এবং কর্মী আইন অমান্য করে গ্রেপ্তার বরণ করলেন। সারা ভারত-ব্যাপী এই কর্মকাণ্ড চলতে লাগল। স্বাধীনতা সংগ্রামের সে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

এর পরেই এল সেই ঐতিহাসিক দিন। ১৯৪০ সালের ২৫ এপ্রিল। চাতরার জনসভায় আমরা দেখতে পেলাম সুভাষচন্দ্র বসুকে।

***

১৯৪০ সালের ২৬ এপ্রিলের Hindustan Standard পত্রিকাতে আমরা একটি ‘বিজ্ঞপ্তি’ দেখতে পাই। ‘বিজ্ঞপ্তি’-টি নিম্নরূপ—

PUBLIC MEETING
Sj. Subhas Bose To
Address
Place — Sraddhananda Park
Date — Friday, the 26th April.
Time — 6-30 P.M.
Speaker — Sj. Subhas C. Bose
Subject — Corporation Affairs.
Rajendra Chandra
President, B.P.C.C.

‘বিজ্ঞপ্তি’-টি থেকে সহজেই বোঝা যায়, ১৯৪০ সালের ২৬ এপ্রিল শ্রদ্ধানন্দ পার্কে একটি জনসভা আয়োজিত হয়েছিল। ওই জনসভার প্রধান বক্তা ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে সুভাষচন্দ্র সেদিন একটি সুন্দর কথা বলেছিলেন। সেটি হল— ‘‘আজ এই মুহূর্তে যদি ইংরেজ এদেশ ছেড়ে চলে যায়, তবে ‘হরির-লুট’ দিয়ে সবাইকে আমি বাতাসা খাওয়াব।’’

১৯৪০ সালের ১৮ জুন। অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লকের দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় নাগপুর শহরে। এই অধিবেশনের সভাপতি হিসাবে সুভাষচন্দ্র বসু বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্রের ভাষায়— ‘ভারতবাসীকে অস্থায়ী জাতীয় সরকারের মাধ্যমে এখনই ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করতে হবে।’ তিনি তাঁর বক্তৃতার শেষে বলেছিলেন— ‘আসুন, আবার আমরা ঘোষণা করি— সমস্ত ক্ষমতা ভারতবাসীর হাতে চাই, আজই, এখনই।’

অন্তর্ধানের আগে, ভারতের মাটিতে শেষ যে জনসভায় সুভাষচন্দ্র বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা আয়োজিত হয়েছিল দেশপ্রিয় পার্কে। দেশপ্রিয় পার্কের জনসভায় সুভাষচন্দ্র দেশবাসীকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন—

‘বন্ধুগণ, আর হয়তো আমি থাকব না। এই উন্মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আপনাদের কাছে কিছু বলার মতো সুযোগ আর হয়তো কোনওদিনই আমি পাব না। তার আগেই হয়তো শত্রুপক্ষ আমার কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেবে দীর্ঘকালের মতো। তাই শেষবারের মতো আজ আপনাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি যে, এ সুযোগ আপনারা হারাবেন না। সবাই এগিয়ে চলুন। এগিয়ে চলুন। জয় আমাদের হবেই।’

১৯৪০ সালের ৩ জুলাই সুভাষচন্দ্র কলকাতায় আর একটি আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। সেই আন্দোলনটি হল, ডালহৌসি স্কোয়ারে অবস্থিত ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’-এর অপসারণ। ‘ডালহৌসি স্কোয়ার’ বর্তমানে ‘বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ’ নামে পরিচিত। এই উপলক্ষ্যে সুভাষচন্দ্র ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ পত্রিকার ১৯৪০ সালের ২৯ জুন সংখ্যায় প্রকাশিত ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’ নিবন্ধে লিখেছিলেন— ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক অধিবেশন যে আদেশ দিয়েছে, হলওয়েল মনুমেন্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন, অবিলম্বে তা আরম্ভ করতে হবে। ৩ জুলাই ১৯৪০ বঙ্গদেশে সিরাজদৌল্লা দিবস হিসাবে পালন করতে হবে, বঙ্গদেশের শেষ স্বাধীন নৃপতির সম্মানে। হলওয়েল মনুমেন্ট শুধু যে সেই নবাবের স্মৃতিতে একটা অকারণ কলঙ্ক লেপন তাই নয়, গত ১৫০ বছর সেটা কলকাতার কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে আছে দাসত্ব ও অপমানের প্রতীক হয়ে। সেই মনুমেন্টকে বিদায় করতে হবে। আগামী ৩ জুলাই হলওয়েল মনুমেন্টের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন আরম্ভ হবে, এবং এই লেখক স্থির করেছেন, সেদিন স্বেচ্ছাসেবকদের প্রথম দলের পদযাত্রায় নেতৃত্ব দেবেন।’

হলওয়েল মনুমেন্ট আন্দোলনের এক দিন আগে, ১৯৪০ সালের ২ জুলাই সুভাষচন্দ্র বসুকে গ্রেপ্তার করা হল। ভারত-রক্ষা আইনের ১২৯ ধারা মতে সুভাষচন্দ্রকে গ্রেপ্তার করলেন ডেপুটি কমিশনার মি. জানভ্রিন।

১৯৪০ সালের ২ জুলাই থেকে ১৯৪০ সালের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময় সুভাষচন্দ্র কাটালেন কারা-প্রাচীরের অন্তরালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘন কালো ধোঁয়ায় যখন সারা পৃথিবীর আকাশ-বাতাস সমাচ্ছন্ন, যখন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক ‘সুবর্ণসুযোগ’, সেই সময়টা সুভাষচন্দ্রের কেটে গেল কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে।

অস্থির হয়ে উঠলেন সুভাষচন্দ্র। আর কিছুতেই কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নয়। মুক্তি তাঁকে পেতেই হবে। রচনা করতে হবে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ অধ্যায়। শুরু করলেন আমৃত্যু অনশন। ১৯৪০ সালের ৫ ডিসেম্বর সুভাষচন্দ্র মুক্তি পেলেন।

***

১৯৪০ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে ১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র বসু তাঁদের কলকাতার ৩৮/২ এলগিন রোডের বাড়িতে ছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে সাদাপোশাকের পুলিশ এবং গোয়েন্দা বাড়ির বাইরে পাহারায় নিযুক্ত ছিল। সুভাষচন্দ্র বসু তখন ‘বন্দিও নন, জামিনপ্রাপ্তও নন’। তাঁর অবস্থাটা তখন এরকম— বর্তমানে তাঁকে বন্দিজীবন থেকে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়েছে, আবার তাঁকে গ্রেফতার করা হবে। এরকম অবস্থায় ১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারি, রাত ১টা ৩৫ মিনিটে তিনি গৃহত্যাগ করে বিহারের গোমো স্টেশনের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। যাত্রা করেছিলেন একটি জার্মান ওয়ানডারার গাড়িতে। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র শিশিরকুমার বসুই গাড়ি চালিয়ে তাঁকে সেখানে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

শিশিরকুমার বসু লিখেছেন— ‘‘’আমি চললাম, তোমরা ফিরে যাও’— বিদায়-মুহূর্তে এই ছিল তাঁর শেষ কথা। আমি কেমন যেন নির্বাক ও নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে রইলাম, প্রণাম করার কথাও মনে এল না। রাত্রের গোমো স্টেশনের নির্জন ওভারব্রিজ দিয়ে রাঙাকাকাবাবু তাঁর স্বভাবসিদ্ধ দৃপ্ত অথচ ধীর ভঙ্গিতে হেঁটে চলে যাচ্ছেন, আগে আগে চলেছে কুলি মাথায় মালপত্র নিয়ে— চিরদিনের মত এই ছবিটি আমার মনে মুদ্রিত হয়ে রইল। ওপারের সিঁড়ি দিয়ে রাঙাকাকাবাবু প্ল্যাটফর্মের দিকে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন।
ততক্ষণে মেল ট্রেনের গুমগুম ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আমরা গাড়ি নিয়ে একটু দূরে এসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। হুসহুস শব্দে ট্রেন এসে থামল ও আবার ছেড়ে দিল। আমরা কান পেতে ট্রেনের আওয়াজ শুনতে লাগলাম। তারপর ট্রেনের চাকার ছন্দময় ঝংকারের সঙ্গে অন্ধকারের বুকে একটা আলোর মালা দুলে দুলে দূরে চলে গেল দেখতে পেলাম।”

গোমো স্টেশন থেকে দিল্লি-কালকা মেল ট্রেন ধরে তিনি পেশোয়ারে যান। পেশোয়ার থেকে পায়ে হেঁটে ভারতের সীমানা অতিক্রম করে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল, এবং কাবুল থেকে তিনি রাশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ সুভাষচন্দ্র মস্কো থেকে জার্মানির বার্লিন শহরে গিয়ে পৌঁছলেন।

***

আজাদ হিন্দ রেডিও, বার্লিন থেকে প্রচারিত হল সুভাষের সেই উদাত্ত কণ্ঠস্বর— ‘আমি সুভাষ বলছি। …অক্ষশক্তির আক্রমণ থেকে নিজেদের সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য যদি ব্রিটেন আজ আমেরিকার দ্বারস্থ হতে লজ্জা না পায়, তাহলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অপর কোন জাতির সাহায্যপ্রার্থী হওয়া আমার পক্ষে অন্যায়ও নয়, অপরাধও হতে পারে না।’

১৯৪৩ সালের ১৩ জুন সুভাষচন্দ্র এক জার্মান সাবমেরিনে চেপে জাপানে এসে পৌঁছান। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু পরিণত হলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুতে। ১৯৪৩ সালের ২৫ আগস্ট নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কের পদ অলংকৃত করেন। ২১ অক্টোবর, ১৯৪৩, নেতাজি আজাদ হিন্দ সরকার বা স্বাধীন ভারত সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। ২৩ অক্টোবর, ১৯৪৩, আজাদ হিন্দ সরকার কর্তৃক ব্রিটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষিত হয়। ১৯৪৪ সালের মার্চ মাসে আজাদ হিন্দ ফৌজ মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল অধিকার করে, এবং ইম্ফলে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। নেতাজির নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের প্রায় দেড়শত মাইল ভিতরে প্রবেশ করেছিল। তাই একথা বললে অতিশয়োক্তি হবে না যে, নেতাজিই একা হাতে ভারত-ইতিহাসের গতিপথ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। তাই আপামর দেশবাসী তাঁকেই ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’ মানেন। তাই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নেতাজি আর আজাদ হিন্দ ফৌজের অবদান চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

চিত্র : গুগল

চাতরায় নেতাজি: সমস্বরে ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’, ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি

চাতরায় নেতাজি: ‘হিন্দু-মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দ’ সম্ভাষণেই মোহিত জনতা

চাতরায় নেতাজি: সংবাদ শীর্ষক, ‘অহিংস সংগ্রামে আত্মনিয়োগের আহ্বান’

4.7 3 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
J.Ghosh
J.Ghosh
3 years ago

খুব ভালো ?

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »