পাখিদের বাসা বেঁধে দেওয়ার কাজ যখন শুরু করেছিলেন, তখন জুটেছিল উপহাস। কিন্তু দীর্ঘ দু’দশক পর সেই ব্যক্তিই হয়ে উঠেছেন ভারতের ‘নেস্ট ম্যান’। পাখি বাঁচানোর লক্ষ্যে দিল্লির অশোক বিহারের বাসিন্দা রাকেশ খাত্রী এখনও পর্যন্ত তৈরি করে ফেলেছেন প্রায় আড়াই লক্ষেরও বেশি বাসা। সেই সঙ্গে লক্ষাধিক মানুষকে শিখিয়েছেন বাসা তৈরি করতে। তাঁদের জলবায়ু পরিবর্তন এবং ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহার সম্পর্কেও শিক্ষা দিয়ে থাকেন তিনি।
কীভাবে পাখির নীড় বানানো শুরু করলেন তিনি? রাকেশ খাত্রীর বয়ান তুলে দেওয়া যাক। ‘‘পুরোনো দিল্লিতে থাকতাম আমরা। তখন ঘুলঘুলিতে, শীতকালে পাখার উপর পাখি বাসা বাঁধত। আমরা অনেক পাখির জন্ম, বড় হওয়া ও উড়ে যাওয়া দেখেছি। পাখিদের যত্ন করা, তাদের দিকে নজর রাখার কাজ আমাদের দিয়েছিলেন বড়রা। পরে আমরা দিল্লির অশোক বিহারে চলে আসি। এখানে দেখি পাখিদের কাকলি একদমই নেই। কারণ মানুষের বাড়িতে আর ঘুলঘুলি নেই। বড় গাছ নেই। পক্ষীরা কোথায় বাসা বাঁধবে এই চিন্তা আমার মাথার মধ্যে ঘুরতে শুরু করে। সেই সময় আমি নারকেলের মালা দিয়ে বাসা তৈরি করা শুরু করি। সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় টাঙিয়ে দিই এই অসহায় যে পাখিরা এতে বাসা বাঁধবে। কিন্তু আমি এই কাজে ব্যর্থ হই। কিছুদিন পরে গিয়ে দেখি নারকেলের মালা শুকিয়ে গিয়েছে। কোনও পাখি আসেনি। লোকজন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল। সবাই বলছিল পাখি নিজেই বাসা বাঁধে, তোমার বাসায় কেন আসবে সে? কিন্তু আমি জানতাম একদিন আমার চেষ্টা সফল হবেই।’’
হাল ছাড়তে নারাজ রাকেশ কীভাবে পাখিদের জন্য উপযোগী বাসা তৈরি করা যায় তা নিয়ে পরীক্ষা চালাতে থাকেন। অবশেষে বাঁশের কঞ্চি, পাটের সুতো এবং ভুষি দিয়ে প্রায় ২০টির মত বাসা তৈরি করেন আর সেগুলোকে অশোক বিহার ও তাঁর আশেপাশের এলাকায় ঝুলিয়ে দেন। কিছুদিন পর গিয়ে দেখেন ৪টিতে চড়াই পাখি বাসা বেঁধেছে। যা তাঁকে নতুন করে উৎসাহ দেয়।
নিজের এই ‘অদ্ভুত’ কাজের জন্য রাকেশ খাত্রী বিশ্বের সেরা পাঁচটি পুরস্কার পেয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে সর্বাধিক সংখ্যক হাতে তৈরি বাসা এবং কর্মশালার জন্য লিমকা বুক অফ রেকর্ডস, চড়ুই সংরক্ষণের অন্যতম সেরা পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য হাউস অফ কমন্স, লন্ডন থেকে পাওয়া ইন্টারন্যাশনাল গ্রিন অ্যাপল অ্যাওয়ার্ডস এবং অন্যান্য বেশ কিছু পুরস্কার।
পাখিদের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার টানে কয়েক লক্ষ কৃত্রিম পাখির বাসা বেঁধেছেন তিনি। পেয়েছেন স্বীকৃতিও। তাঁর অন্যান্য স্বীকৃতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ১২টি ভাষায় ১,১২,০০০ শিক্ষার্থীকে নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর থিয়েটারের জন্য লিমকা বুক অফ রেকর্ডস, ওয়াশিংটন ডিসি কর্তৃক ঘোষিত ‘আর্থ ডে স্টার’ উপাধি আর ২০২২ সালে ICSC বোর্ডের চতুর্থ শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে তাঁর নামের একটি বিশেষ অধ্যায়। শিশুদেরকে তিনি নানা নয়া শৈলী শিখিয়েছেন, একই সঙ্গে নিজেদের ঐতিহ্যকেও রক্ষা করতে শিখিয়েছেন। তাঁর এই কাজের স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। পাট এবং টেট্রা প্যাক দিয়ে ১,২৫,০০০ বাসা তৈরির জন্য তাঁর নাম উঠেছে ওয়ার্ল্ড বুক অফ রেকর্ডসেও।
চলমান মহামারী পর্বে তিনি অনেক ওয়েবিনারের আয়োজন করেছেন, যেখানে তিনি শিখিয়েছেন কীভাবে পাট, প্লাস্টিক, ঘাস, কাঠ ইত্যাদি ব্যবহার করে বাসা তৈরি করতে হয়। নিজের এই কাজ প্রসঙ্গে ৬০ বছর বয়সি রাকেশ খাত্রীর বক্তব্য, ‘‘কাউকে একটি বাড়ি দিতে পারার মত অনুভূতি সম্ভবত ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমি চাই এই পৃথিবীতে পাখির কলতান থাকুক। তাই আমৃত্যু এই কাজ করে যেতে চাই।’’