মাছি মারতে হয়েছিল ৫ দিন! সত্যি সত্যিই মাছি মেরেছিলাম। কী করব? একবার মুখে বসছে তাড়াচ্ছি, তারপর উড়ে গিয়ে কানে, কান থেকে তাড়ালে সোজা নাকে! উফঃ, তিতিবিরক্ত করে মারছিল প্রতিটা মুহূর্ত। রাতের বেলাতেও নিস্তার নেই। সব সময় ভনভন চলছে তো চলছেই। হবেই তো! ঘিঞ্জি ঘিঞ্জি ঘরবাড়ি, পাশাপাশি লেগে আছে। আলো ঢোকে না ভাল করে। সব সময় স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে চারপাশ। তার ওপর নোংরা। এজন্যই এত মাছির উপদ্রব।
গাড়োয়াল হিমালয়ের ছোট্ট গ্রাম সুতল। দূর থেকে দেখলে ছবির মত লাগে। কিন্তু ভিতরে ঢুকলে আর ছবি তোলার ইচ্ছে থাকে না। ১৪৩ পরিবার নিয়ে একটা ছোট্ট গ্রাম। নন্দাঘুন্টি অভিযানের বেসক্যাম্প থেকে অসুস্থ শিপ্রাকে নিয়ে নেমে এসেছি এখানে। একটা গাড়োয়ালি পোর্টারের পরিবারে আশ্রয় জুটেছে। তাদের বাড়িতেই কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে ৫ দিনের ঠাঁই। সারাদিন চেঁচামেচি আর সোরগোলের মধ্যে যাহোক করে একটা দিন কাটল।
দু’দিনের দিন মনে হল যেন জেলখানার কয়েদি জীবন কাটাচ্ছি। কোনও কাজ নেই। সারাদিন শুয়েবসে থাকা আর মাছিমারা ছাড়া! অতিষ্ঠ লাগছে। কিছুতেই টাইম কাটতে চায় না। নেট নেই, মোবাইলের নেটওয়ার্কটাও তিন মাস ধরে এখানে বন্ধ। কোনও কমিউনিকেশন নেই। বাজার নেই, দোকান নেই, হাট নেই। কী নিদারুণ বন্দিজীবন। মাঝে মাঝে ঘর ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছি। এর বাড়ি একবার, তারপর পাশের বাড়ি। গোটা গ্রামটা ঘুরেছি এই করে।
তাদের দৈনন্দিন জীবন, তাদের সুখ দুঃখ, তাদের সামাজিক জীবন আর তার রীতিনীতি, তাদের প্রেম-ভালবাসা ব্যথা-বেদনা সবটা নিজের মধ্যে একাত্ম করেছি। তাদের গ্রামের ছোট্ট মন্দিরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পুজোও করেছি। সবাই যেন বন্ধু। আমার ঘরেই রাতের আড্ডা জমছে। বয়োজ্যেষ্ঠরা আসছেন, গ্রামপ্রধান আসছেন। ক্যামেরায় তাদের ইন্টারভিউ চলছে। আমি ওদের কাছে তখন একজন সম্মানীয় ‘প্রেসওয়ালা’। আর শিপ্রা ‘বহেনজি’।
একদিন আমাদের পাশের বাড়ি ছাদঢালাই চলছে। সেদিন গোটা গ্রামের নিমন্ত্রণ। সবাই এসেছেন আর সবাই যেন রাজমিস্ত্রি। যে যার মত কাজ করছেন, কেউ মশলা মাখছেন, কেউ এগিয়ে দিচ্ছেন, কেউ পেটাই করছেন, কেউ কেউ রান্নার কাজে অংশ নিয়েছেন, আবার কেউ দর্শকের ভূমিকায়। সব শেষে খাওয়াদাওয়ার পালা। গোটা গ্রাম একসঙ্গে বসে খেলো সেদিন। সঙ্গে আমিও। কী দারুণ আতিথেয়তা আর আন্তরিকতা। কী সহজ-সরল জীবন ওদের।
একদিন সন্ধেবেলা পুনুর বাবার চায়ের দোকানে চা খাচ্ছি। হঠাৎ গুন্ডা গোছের একজন ঢুকল। ইয়া বড় বড় মাসল। সারা গায়ে ট্যাটু। হাতে মোটা চেন আর বালা। গলায় একটা ছোট্ট ভোজালির লকেট। হঠাৎ দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। আমার পাশে এসে বসল। তারপর লোকটা চরস বানিয়ে চুপচাপ খেতে থাকল। আমি ওকে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম। হঠাৎ চোখে চোখ পড়তেই একবার মুচকি হাসল, তারপর আধপোড়া সিগারেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘স্যার পিজিয়ে’! আমিও সুযোগটা হাতছাড়া না করে দু’টান চড়িয়ে দিলাম।
এটা না করলে লোকটাকে জানতেই পারতাম না। আমিও একদিন সাংবাদিকতা করেছি, কাজেই এসব কাজ কিছু ব্যাপার না। ক্রমেই কথায় কথায় লোকটার ভিতরে ঢুকতে থাকলাম। যখন সবটা জানলাম তখন রাত সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছে। গ্রাম নিশুতি হয়েছে। আমার চোখদুটো ছলছল করে উঠল। গায়ে কাঁটা দিল। আমি যার পাশে বসে আছি সে দশ বছরের জেলখাটা আসামি। ওর জীবনের ওপর দিয়ে তীব্র আগুনের দাবানল বয়ে গিয়েছে যেন। আজও সে জেলের ভাত খাওয়া আসামি।
ওর বাবা-মা ওকে অনেক অল্পবয়সে বিয়ে দেন। মেয়েটি মানসিক রোগগ্রস্থ ছিল ওর কথায়। হঠাৎ একদিন একটা ছোট্ট মনোমালিন্যে লাটাকোপরির জঙ্গলে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে বসে। তারপর মেয়ের বাড়ির লোক ছেলেটিকে খুনের মামলা দিয়ে জেলে পাঠান। ১০ বছর শ্রীনগর জেলে কারাবাস করার পর জামিন পেয়ে গ্রামে আসে। সারা গ্রাম তাকে একঘরে করে দেয়। পাহাড়ের ঢালে গ্রামের প্রান্তে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই বানায়। সারা দিন চরস খায় আর কাঠের গায়ে খোদাই করে।
আমি পরদিন ওর ওয়ার্কশপে গিয়েছি। ও একজন শিল্পী, কাঠ কেটে মূর্তি বানায়। কী অসম্ভব সুন্দর কাজ, আমি দেখেছি। ওর নাম প্রেম। অন্তরের সবটুকু প্রেম দিয়ে সে তার স্ত্রীকে ভালবাসত। সে চলে গেছে স্বেচ্ছায়, আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে ওর স্বপ্নময় জীবনটা ভেঙে চুরমার করে দিয়ে গেছে। তাই প্রেম তাকে ঘৃণা করে। এখন পাশের গ্রামের একটি মেয়েকে ভালবাসে। আবার নতুন করে বাঁচতে চায় তাকে নিয়ে। প্রবল শীতের অলস দুপুরগুলোয় সে ছবি আঁকেন। সাদা কাগজের ওপর রংবেরঙের কলমের খোঁচায় ফুটিয়ে তোলে তার প্রেমিকার অবয়ব।
কী পাগল করা প্রেম আমি দেখেছি তার চোখে। নিজের লম্বা চুল কেটে লাগিয়েছে হাতে আঁকা প্রেমিকার ছবির মাথায়। কত হৃদয়বিদারী কান্নাময় কবিতা শুনিয়েছে আমাকে। তার লেখা প্রেমের সায়েরিতে আমি মোহিত হয়ে গিয়েছি। আমাকে তার কুটিরে নিয়ে গেছে। আলমারি খুলে থালা ভর্তি লাখ টাকার কিড়াজরি দেখিয়েছে, দিনের পর দিন কষ্ট করে পাহাড় থেকে তুলেছে ওগুলো। আবার দু-একটা দিয়েওছে আমাকে। যার এক-একটার দাম বর্তমান বাজারে অন্তত আটশো টাকা। ওদের একজন পোর্টারের একদিনের রোজ।
কিড়াজরি (Keerajari) হল একধরনের পরজীবী ছত্রাক সংক্রমিত হিমালয়ান ব্যাট মথের শুঁয়োপোকার মমিকৃত দেহ। কিড়াজরি সাধারণত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মিটার এবং তার বেশি উচ্চতায় মেলে। অদ্ভুত প্রজাতির এই শুঁয়োপোকা ছত্রাক কামশক্তি বৃদ্ধির ক্ষমতার জন্য হিমালয়ান ভায়াগ্রা নামে পরিচিত। আন্তর্জাতিক বাজারে বহুমূল্য এই ভেষজে আছে গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান ক্যালসিয়াম ও সেলেনিয়াম এবং এটি ক্যানসারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও কার্যকরী। উৎকর্ষের ওপর নির্ভর করে এর দাম। স্থানীয়ভাবে ২ থেকে ৩ লক্ষ টাকা প্রতিকেজি হিসেবে বিক্রি হয়। সর্বোচ্চ ১৫ লক্ষ টাকা কেজিতেও বিকোয়।
একদিন রাতে গ্রামের সবাই মিলে আমাকে ট্রিট দিলেন। ৩২ কিলোমিটার দূরে নিচের বাজার থেকে চিকেন আনিয়েছেন ওরা। শিপ্রা রান্নাও করেছে জমিয়ে। রাতে যাওয়ার সময় প্রেমকে ডেকে আমার দামি হেড টর্চটা গিফ্ট করলাম। ধরা ধরা গলায় বললাম, ভাই, ইয়ে রাত কো যব ঘর যাতে হো তব কাম আয়েগা, রাখ লো… অর যব মেরেকো ইয়াদ আয়েগা বাস একবার ‘লাভলি’ বোলকে চিল্লানা আসমান পে…। হেড টর্চটা মাথায় লাগিয়ে প্রেম একবার জড়িয়ে ধরল আষ্টেপৃষ্ঠে। এছাড়া আর কিছুই বলার ক্ষমতা ছিল না তার। শুধু ছলছল চোখে এক পা এক পা করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।