Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

গাড়োয়াল হিমালয়ের ছোট্ট গ্রাম সুতল

মাছি মারতে হয়েছিল ৫ দিন! সত্যি সত্যিই মাছি মেরেছিলাম। কী করব? একবার মুখে বসছে তাড়াচ্ছি, তারপর উড়ে গিয়ে কানে, কান থেকে তাড়ালে সোজা নাকে! উফঃ, তিতিবিরক্ত করে মারছিল প্রতিটা মুহূর্ত। রাতের বেলাতেও নিস্তার নেই। সব সময় ভনভন চলছে তো চলছেই। হবেই তো! ঘিঞ্জি ঘিঞ্জি ঘরবাড়ি, পাশাপাশি লেগে আছে। আলো ঢোকে না ভাল করে। সব সময় স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে চারপাশ। তার ওপর নোংরা। এজন্যই এত মাছির উপদ্রব।

সুতল। দূর থেকে দেখলে ছবির মত লাগে।

গাড়োয়াল হিমালয়ের ছোট্ট গ্রাম সুতল। দূর থেকে দেখলে ছবির মত লাগে। কিন্তু ভিতরে ঢুকলে আর ছবি তোলার ইচ্ছে থাকে না। ১৪৩ পরিবার নিয়ে একটা ছোট্ট গ্রাম। নন্দাঘুন্টি অভিযানের বেসক্যাম্প থেকে অসুস্থ শিপ্রাকে নিয়ে নেমে এসেছি এখানে। একটা গাড়োয়ালি পোর্টারের পরিবারে আশ্রয় জুটেছে। তাদের বাড়িতেই কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে ৫ দিনের ঠাঁই। সারাদিন চেঁচামেচি আর সোরগোলের মধ্যে যাহোক করে একটা দিন কাটল।

পাহাড়ের আরু ফল।

দু’দিনের দিন মনে হল যেন জেলখানার কয়েদি জীবন কাটাচ্ছি। কোনও কাজ নেই। সারাদিন শুয়েবসে থাকা আর মাছিমারা ছাড়া! অতিষ্ঠ লাগছে। কিছুতেই টাইম কাটতে চায় না। নেট নেই, মোবাইলের নেটওয়ার্কটাও তিন মাস ধরে এখানে বন্ধ। কোনও কমিউনিকেশন নেই। বাজার নেই, দোকান নেই, হাট নেই। কী নিদারুণ বন্দিজীবন। মাঝে মাঝে ঘর ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছি। এর বাড়ি একবার, তারপর পাশের বাড়ি। গোটা গ্রামটা ঘুরেছি এই করে।

সুতল গ্রামের রাধাকৃষ্ণ মন্দির।

তাদের দৈনন্দিন জীবন, তাদের সুখ দুঃখ, তাদের সামাজিক জীবন আর তার রীতিনীতি, তাদের প্রেম-ভালবাসা ব্যথা-বেদনা সবটা নিজের মধ্যে একাত্ম করেছি। তাদের গ্রামের ছোট্ট মন্দিরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পুজোও করেছি। সবাই যেন বন্ধু। আমার ঘরেই রাতের আড্ডা জমছে। বয়োজ্যেষ্ঠরা আসছেন, গ্রামপ্রধান আসছেন। ক্যামেরায় তাদের ইন্টারভিউ চলছে। আমি ওদের কাছে তখন একজন সম্মানীয় ‘প্রেসওয়ালা’। আর শিপ্রা ‘বহেনজি’।

মন্দিরে শ্বেতপাথরের বিগ্রহ।

একদিন আমাদের পাশের বাড়ি ছাদঢালাই চলছে। সেদিন গোটা গ্রামের নিমন্ত্রণ। সবাই এসেছেন আর সবাই যেন রাজমিস্ত্রি। যে যার মত কাজ করছেন, কেউ মশলা মাখছেন, কেউ এগিয়ে দিচ্ছেন, কেউ পেটাই করছেন, কেউ কেউ রান্নার কাজে অংশ নিয়েছেন, আবার কেউ দর্শকের ভূমিকায়। সব শেষে খাওয়াদাওয়ার পালা। গোটা গ্রাম একসঙ্গে বসে খেলো সেদিন। সঙ্গে আমিও। কী দারুণ আতিথেয়তা আর আন্তরিকতা। কী সহজ-সরল জীবন ওদের।

ছাদঢালাইয়ে হাত লাগিয়েছেন সমবেত গ্রামবাসী।

একদিন সন্ধেবেলা পুনুর বাবার চায়ের দোকানে চা খাচ্ছি। হঠাৎ গুন্ডা গোছের একজন ঢুকল। ইয়া বড় বড় মাসল। সারা গায়ে ট্যাটু। হাতে মোটা চেন আর বালা। গলায় একটা ছোট্ট ভোজালির লকেট। হঠাৎ দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। আমার পাশে এসে বসল। তারপর লোকটা চরস বানিয়ে চুপচাপ খেতে থাকল। আমি ওকে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম। হঠাৎ চোখে চোখ পড়তেই একবার মুচকি হাসল, তারপর আধপোড়া সিগারেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘স্যার পিজিয়ে’! আমিও সুযোগটা হাতছাড়া না করে দু’টান চড়িয়ে দিলাম।

পুনুর বাবার চায়ের দোকানে।

এটা না করলে লোকটাকে জানতেই পারতাম না। আমিও একদিন সাংবাদিকতা করেছি, কাজেই এসব কাজ কিছু ব্যাপার না। ক্রমেই কথায় কথায় লোকটার ভিতরে ঢুকতে থাকলাম। যখন সবটা জানলাম তখন রাত সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছে। গ্রাম নিশুতি হয়েছে। আমার চোখদুটো ছলছল করে উঠল। গায়ে কাঁটা দিল। আমি যার পাশে বসে আছি সে দশ বছরের জেলখাটা আসামি। ওর জীবনের ওপর দিয়ে তীব্র আগুনের দাবানল বয়ে গিয়েছে যেন। আজও সে জেলের ভাত খাওয়া আসামি।

নিজের ওয়ার্কশপে প্রেম (মাঝখানে)।

ওর বাবা-মা ওকে অনেক অল্পবয়সে বিয়ে দেন। মেয়েটি মানসিক রোগগ্রস্থ ছিল ওর কথায়। হঠাৎ একদিন একটা ছোট্ট মনোমালিন্যে লাটাকোপরির জঙ্গলে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে বসে। তারপর মেয়ের বাড়ির লোক ছেলেটিকে খুনের মামলা দিয়ে জেলে পাঠান। ১০ বছর শ্রীনগর জেলে কারাবাস করার পর জামিন পেয়ে গ্রামে আসে। সারা গ্রাম তাকে একঘরে করে দেয়। পাহাড়ের ঢালে গ্রামের প্রান্তে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই বানায়। সারা দিন চরস খায় আর কাঠের গায়ে খোদাই করে।

চলছে কাঠখোদাইয়ের কাজ।

আমি পরদিন ওর ওয়ার্কশপে গিয়েছি। ও একজন শিল্পী, কাঠ কেটে মূর্তি বানায়। কী অসম্ভব সুন্দর কাজ, আমি দেখেছি। ওর নাম প্রেম। অন্তরের সবটুকু প্রেম দিয়ে সে তার স্ত্রীকে ভালবাসত। সে চলে গেছে স্বেচ্ছায়, আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে ওর স্বপ্নময় জীবনটা ভেঙে চুরমার করে দিয়ে গেছে। তাই প্রেম তাকে ঘৃণা করে। এখন পাশের গ্রামের একটি মেয়েকে ভালবাসে। আবার নতুন করে বাঁচতে চায় তাকে নিয়ে। প্রবল শীতের অলস দুপুরগুলোয় সে ছবি আঁকেন। সাদা কাগজের ওপর রংবেরঙের কলমের খোঁচায় ফুটিয়ে তোলে তার প্রেমিকার অবয়ব।

প্রেমের কীর্তি। নিজের লম্বা চুল কেটে লাগিয়েছে হাতে আঁকা প্রেমিকার ছবির মাথায়।

কী পাগল করা প্রেম আমি দেখেছি তার চোখে। নিজের লম্বা চুল কেটে লাগিয়েছে হাতে আঁকা প্রেমিকার ছবির মাথায়। কত হৃদয়বিদারী কান্নাময় কবিতা শুনিয়েছে আমাকে। তার লেখা প্রেমের সায়েরিতে আমি মোহিত হয়ে গিয়েছি। আমাকে তার কুটিরে নিয়ে গেছে। আলমারি খুলে থালা ভর্তি লাখ টাকার কিড়াজরি দেখিয়েছে, দিনের পর দিন কষ্ট করে পাহাড় থেকে তুলেছে ওগুলো। আবার দু-একটা দিয়েওছে আমাকে। যার এক-একটার দাম বর্তমান বাজারে অন্তত আটশো টাকা। ওদের একজন পোর্টারের একদিনের রোজ।

থালা ভর্তি লাখ টাকার কিড়াজরি।

কিড়াজরি (Keerajari) হল একধরনের পরজীবী ছত্রাক সংক্রমিত হিমালয়ান ব্যাট মথের শুঁয়োপোকার মমিকৃত দেহ। কিড়াজরি সাধারণত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মিটার এবং তার বেশি উচ্চতায় মেলে। অদ্ভুত প্রজাতির এই শুঁয়োপোকা ছত্রাক কামশক্তি বৃদ্ধির ক্ষমতার জন্য হিমালয়ান ভায়াগ্রা নামে পরিচিত। আন্তর্জাতিক বাজারে বহুমূল্য এই ভেষজে আছে গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান ক্যালসিয়াম ও সেলেনিয়াম এবং এটি ক্যানসারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও কার্যকরী। উৎকর্ষের ওপর নির্ভর করে এর দাম। স্থানীয়ভাবে ২ থেকে ৩ লক্ষ টাকা প্রতিকেজি হিসেবে বিক্রি হয়। সর্বোচ্চ ১৫ লক্ষ টাকা কেজিতেও বিকোয়।

৩২ কিলোমিটার দূরে নিচের বাজার থেকে চিকেন আনিয়েছেন ওরা।

একদিন রাতে গ্রামের সবাই মিলে আমাকে ট্রিট দিলেন। ৩২ কিলোমিটার দূরে নিচের বাজার থেকে চিকেন আনিয়েছেন ওরা। শিপ্রা রান্নাও করেছে জমিয়ে। রাতে যাওয়ার সময় প্রেমকে ডেকে আমার দামি হেড টর্চটা গিফ্ট করলাম। ধরা ধরা গলায় বললাম, ভাই, ইয়ে রাত কো যব ঘর যাতে হো তব কাম আয়েগা, রাখ লো… অর যব মেরেকো ইয়াদ আয়েগা বাস একবার ‘লাভলি’ বোলকে চিল্লানা আসমান পে…। হেড টর্চটা মাথায় লাগিয়ে প্রেম একবার জড়িয়ে ধরল আষ্টেপৃষ্ঠে। এছাড়া আর কিছুই বলার ক্ষমতা ছিল না তার। শুধু ছলছল চোখে এক পা এক পা করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

চিত্র: লেখক
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

স্বামী বিবেকানন্দ : প্রয়াণদিনে স্মরণ

বিবেকানন্দই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক বাঙালি তথা ভারতীয়। রবীন্দ্রনাথ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ১৯১২-পর্বে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় যাওয়ার পর, এবং তার পরের বছর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে। কিন্তু এর প্রায় কুড়ি বছর পূর্বেই বিবেকানন্দ শিকাগো-বক্তৃতা ও আমেরিকা-ইয়োরোপে এক নাগাড়ে প্রথম দফায় চার বছর থাকার সুবাদে আমেরিকার বিদ্বজ্জনমহলে যেমন, তেমনই জার্মানির মাক্সমুলার, ফ্রান্সের রোমাঁ রোলাঁ, রাশিয়ার টলস্টয় প্রমুখের শ্রদ্ধা এবং মনোযোগ আদায় করেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

প্রফুল্ল রায়: ব্রাত্য সময়ের কথাকার

প্রফুল্ল রায় নাকি অতীশ দীপঙ্করের বংশের। দেশভাগের অভিশাপেই দেশছাড়া হতে হয় তাঁকে, ১৯৫০-এ। একটা বিধুর বিষয় আমরা লক্ষ্য না করে পারি না। দেশভাগ সুনীল-শ্যামল-মহাশ্বেতা-শীর্ষেন্দু-অতীনদের কেবল ভূমিচ্যুত করেই ছাড়ল না, এমনকি তাঁদের কারুবাসনাকেও অন্যতর রূপ দেওয়ালো। দেশভাগ না হলে আমরা সুনীলের হাতে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, শীর্ষেন্দুর ‘দূরবীণ’ বা প্রফুল্ল রায়ের ‘পূর্বপার্বতী’ পেতাম না, যেমন পেতাম না শওকত ওসমানের ‘কর্ণফুলি’ বা হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি।’

Read More »
শৌনক দত্ত

মন্দ মেয়ে ভদ্র অভিনেত্রী: সুকুমারী দত্ত

বিনোদিনী দাসীর বর্ণময় জীবনের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া এই ‘তারকা অভিনেত্রী’-র বহুমাত্রিক জীবনটিও কম রঙিন নয় বরং বিস্মৃত নক্ষত্র এক, যিনি ১২৮২ বঙ্গাব্দের ৩ শ্রাবণ (১৮৭৫ খ্রি., মূল্য ছিল ১ টাকা) ‘অপূর্ব্বসতী’ নাটকটি লিখে বাংলা নাট্যাতিহাসের প্রথম নারী নাট্যকার হিসেবে সুবিদিত হয়ে আছেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস ও কালিদাস

পণ্ডিতেরা তর্ক তুলেছেন, কালিদাস ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ লেখেননি৷ কেননা একেবারে পয়লা আষাঢ়েই যে মেঘ নেমে বৃষ্টি আসবে, তা হয় না। তাঁদের মতে, ওটা আষাঢ়ের শেষদিন, ‘আষাঢ়স্য প্রশম দিবস’ হবে। কিন্তু প্রথম দিবস-ই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এবং তা এতটাই যে, কালিদাসকে নিয়ে ভারত সরকার যে ডাকটিকিট বের করেছে, সেখানে ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ শ্লোকটি উৎকীর্ণ।

Read More »
রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »