Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ধান ভানতে শিবের গীত

শু ভ্র  মু খো পা ধ্যা য়

জিম করবেট কম-বেশি একুশ বছর কাটিয়েছেন মোকামাঘাটে। তিনি তাঁর ‘My India’ বইটির শেষ অধ্যায়ে উনিশ শতকের শেষ আর বিশ শতকের গোড়ায় তাঁর মোকামাঘাটের জীবন নিয়ে লিখেছেন। রেলপথে অনেকবারই এই মোকামা স্টেশনটির ওপর দিয়ে যাতায়াত করেছি। যখনই মোকামা আসে, আমার মনে করবেট সাহেবের মোকামাঘাট রেলস্টেশনের কোয়ার্টারে তাঁর দিনাতিপাতের ছবি ভাসতে থাকে। ১৯৫৯-এ গঙ্গার ওপর রাজেন্দ্র সেতু তৈরির পরেই এই ঘাট স্টেশনটি তার কৌলিন্য হারিয়ে এখন ইতিহাস। পরে জেনেছি আমার বন্ধু ও গবেষণা-সহযোগী অধ্যাপক বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়কেও গত শতকের শেষভাগে বেশ কয়েক বছর কাটাতে হয়েছে ওই মোকামাঘাটে। কিন্তু সেই জায়গাটি কখনওই আমার নিজের মোকাম হয়নি। আমার মোকামাঘাটের জীবন স্রেফ তিন রাত চার দিনের। সময়টা ১৯৯৯-এর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হবে।

বিগত প্রায় পঁচিশ বছর আমরা পূর্ব কলকাতার জলাভূমি, এখন যেটিকে রামসার-জলাভূমি-১২০৮ নামে পৃথিবী চেনে, সেখানে গুরুতর গবেষণার কাজ করি। ‘গুরুতর গবেষণা’ বললে খানিক ভারিক্কি শোনায় তাই বললাম; আসলে ময়লা জল ঘেঁটে তখন জানতে চাইছিলাম কী করে প্রায় শত-খানেক বছর ধরে কলকাতার পুবদিকের বিস্তর ট্যানারির বিশ্রী গন্ধের ময়লা জল এই জলাভূমি তার নিজস্ব ম্যাজিকে পরিষ্কার করে তোলে, এক্কেবারে নিখরচায়। সেই জলে চাষ করা শস্য-সবজি, মাছ, খাস কলকাতা আর শহরতলির মানুষ বছরের পর বছর খেয়ে দিব্য আছে। কেউ কেউ ‘মৃদু অক্টেভে’ কিছু প্রশ্ন তুললেও সেসব ওজর-আপত্তি কখনওই আর্সেনিক কিংবা ফ্লুরাইড দূষণের হামলা নিয়ে বৈজ্ঞানিক চিল-চিৎকারের ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি। উল্টে এই পুব কলকাতার জলাভূমি দিয়ে বয়ে যাওয়া ময়লা জল আজও কমপক্ষে এক-দেড় লক্ষ মানুষের প্রত্যক্ষ কী পরোক্ষ রোজগারের রাস্তা দেখাচ্ছে; সেই রাস্তা কিছু না হলেও গত সাত-আট দশকের পুরনো রাস্তা। চলতি কথায় যাকে বলে টাইম টেস্টেড। গত শতকের প্রায় শুরুতেই ময়লাজলে নতুন প্রাণের রসদ খুঁজে রোজগারের এই আশ্চর্য পথ যাঁরা আবিষ্কার করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন নিতান্তই সাধারণ মানুষ। যাঁরা শস্য কী মাছচাষি, তাঁরাই নিজেরা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর অধ্যবসায়ে এই নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন। গত শতকের তিনের দশকেই। তাঁদের আবিষ্কৃত ময়লা জলে চাষের সুস্থায়ী সুবন্দোবস্ত সারা বিশ্বের পরিবেশ ও কৃষিবিজ্ঞানীদের অবাক করেছে। আর গোটা কলকাতার ময়লা জল-আবর্জনা থেকে অর্থকরী সম্পদ তৈরির এই অসামান্য কাজের হদিশ দুনিয়ার দরবারে সারা জীবন ধরে নিরলস পৌঁছে দিয়েছেন যে মানুষটি, তিনি ড. ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ। পরিবেশরক্ষায় সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক সম্মান UN Global 500 Laureate সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। তবুও কলকাতার মানুষ এই পুব কলকাতার জলাভূমিকে যোগ্য সম্মানই দিল না, সেই আক্ষেপ নিয়েই গত হয়েছেন ডক্টর ঘোষ।

পুব কলকাতার জলাভূমি।

কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকেই কিন্তু পুব কলকাতার জলা দুয়োরানি। সাড়ে তিনশো বছর আগের সেই কলকাতা সেসময়ের ঢাকা কিংবা মুর্শিদাবাদের তুলনায় একেবারেই গণ্ডগ্রাম। বেচারা সাহেবগুলোর জীবন ম্যালেরিয়ায় কাবু। সমস্ত দোষ গিয়ে পড়ল ওই পুবের জলার ঘাড়ের ওপর। ১৭৬৪-তেই কোম্পানির কর্মচারী আর রয়াল ইন্ডিয়ান সৈন্যদলের স্বাস্থ্যব্যবস্থা দেখভালের জন্যে তৈরি হল বাংলার নতুন দপ্তর। কিন্তু ম্যালেরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ পাকা করতে গড়িয়েছে আরও দেড়শো বছর। অগণিত রাজকর্মচারী সেই সময়ে ম্যালেরিয়ায় ইহলোক ছেড়েছেন। ১৮৮০ নাগাদ এক ফরাসী সেনাপ্রধান, আলফানসো লাভেরান ম্যালেরিয়ার গায়ে ‘জলার জ্বর’ তকমা পাকাপাকি লাগিয়ে দিলেন। জলার ওপর দিয়ে বয়ে আসা বদ (mal) বাতাস (aria) ম্যালেরিয়ার কারণ হয়ে গেল। এরপর আরও বিশ বছর লেগেছে স্যার রোনাল্ড রসের গবেষণায় মশা আর ম্যালেরিয়ার যোগসূত্র চিনতে। তাই কলকাতার জন্মলগ্ন থেকেই পুবের জলা ব্রাত্য।

অধ্যাপক বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায় একজন নামী চর্মপ্রযুক্তিবিদ। তাঁর সঙ্গে যুক্তি করলাম এবার ট্যানারির ময়লা জল শোধনের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থার কার্যকারিতার সঙ্গে জলাভূমির নিখরচায় শোধন ব্যবস্থার একটা তুলনা করে দেখা দরকার। বুদ্ধদেব তৎক্ষণাৎ যে জায়গার নামটি করেছিলেন সেটি মোকামাঘাট। আমি তো একেবারে লাফিয়ে উঠলাম। মোকামাঘাট! প্রফুল্ল চাকীর মোকামাঘাট! ১৯০৮! মজফফরপুরে মিসেস কেনেডি আর তাঁর মেয়ে মারা গেলেন বোমার ঘায়ে। এই মোকামাঘাটেই পুলিশের সন্ধানী নজর এড়াতে পারেননি অভিযুক্ত প্রফুল্ল চাকী। আর এই মোকামাঘাট করবেট সাহেবের বিশবছরের বেশি কর্মজীবনের সাক্ষী মোকামাঘাট! আমার মনে নানান ছবিতে তখন ভাসছে জিম করবেটের ‘Life in Mokamaghat’ অধ্যায়টি।

বুদ্ধদেব জানালেন, গঙ্গার ধারে বাটা কোম্পানির সবচেয়ে বড় ট্যানারিটি আছে মোকামাঘাটে আর ময়লা জল শোধনের সেইসময়ের প্রযুক্তিতে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা তাদের শোধন ব্যবস্থাটি। সুতরাং এবং কাজেকাজেই আমরা যাবতীয় টেস্টিং কিট, এমনকি একটা আস্ত মাইক্রোস্কোপ, বেঁধেছেঁদে কনকনে শীতের অন্ধকার ভোররাত্রে মোকামা স্টেশনে নামলাম। বুদ্ধদেব, আমি আর অসিতাভ, আমাদের এক তরুণ ছাত্রবন্ধু। বাটা কোম্পানির গাড়ি আমাদের ভোঁ-দৌড়ে নিয়ে এল কোম্পানির ঝাঁ-চকচকে গেস্টহাউসে। তখন সবে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ব্যাগগুলো রেখেই আমরা সেই ঊষালগ্নে গঙ্গার ধারটিতে পৌঁছে গেলাম। শীতের কুয়াশার হালকা চাদরে ঢাকা গঙ্গা। দু-একটা জেলে ডিঙি, চলছে না থেমে আছে ঠিক বোঝা যায় না; ডানদিকে দূরে কুয়াশার মধ্যে রেল-কাম-রাজপথের রাজেন্দ্র সেতুটি অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। স্পষ্ট গুমগুম শব্দ হচ্ছে; নিশ্চয়ই কোনও ট্রেন যাচ্ছে।

চারটে দিন দারুণ ব্যস্ততায় কেটেছে। বিভিন্ন রকম নমুনা সংগ্রহ। অকুস্থলে যে সব পরীক্ষা সম্ভব, সেগুলো সেরে ফেলা। আর সেই সব কিছুর মাঝেই আমার ছবি খোঁজার, ছবি মেলানোর আপ্রাণ চেষ্টা। করবেটের সময়ের মাইল দেড়েক লম্বা গুডস শেড এখন পরিত্যক্ত, আগাছার জঙ্গলে ঢাকা। স্টাফ কোয়ার্টারগুলো কঙ্কালসার। তবে তখনকার স্টেশনমাস্টার, রাম সরম, যাঁর একার প্রচেষ্টায় তিল তিল করে গড়ে উঠেছিল স্কুল; জিম করবেট তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। আজ থেকে আশি বছরেরও বেশি সময় আগে গঙ্গার এপারে মোকামা আর ওপারে সিমারিয়া-ঘাট অঞ্চলের অনগ্রসর, শিক্ষার আলো থেকে শত হাত দূরে থাকা বিহারের মালবাহক কুলি-কামিন, মাঝি-মাল্লার শিশুদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে উদ্যোগী পুরুষটি অবশ্য প্রাতঃস্মরণীয়। করবেট দেখে গেছেন রাম সরম ‘রায় সাহেব’ খেতাব পেয়েছেন। স্কুলটিও মিডল স্কুলে পরিণত হয়ে সরকারি সাহায্যপুষ্ট হয়েছে। আর এখন সে ছবি আরও পরিণত হয়ে ‘রাম সরম মেমোরিয়াল রেলওয়ে এডেড হাইস্কুল’। আছে, আছে; কিছু কিছু ছবি এমন থেকেই যায়। ‘কালের কপোল তলে…।‘

বাটা কোম্পানির গেস্টহাউসটি যেমন চমৎকার তেমনি তার ব্যবস্থাপনা। সন্ধে হতেই গেস্টহাউসের হাতায় ব্যাডমিনটন কোর্টে আলো জ্বলে উঠল; কে বা কারা যেন নেট লাগিয়ে খেলার সব ব্যবস্থা গুছিয়ে রেখে গেল। শুধু উৎসাহীদের আসার অপেক্ষা। চলল ন’টা-সাড়ে ন’টা অবধি আমাদের তুমুল খেলাধুলো। তারপর গিজারের গরমজলে আরামের স্নান। বিশাল বাথরুম। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই পষ্ট দেখছি— দশ-বাই-ছ’ফুটের ঘন অন্ধকার স্নানঘরে একটা মাত্র কেরোসিন কুপি জ্বলছে; ডিমের আকারের কাঠের বাথটাব, কাঠের বাথম্যাট। আধো-আলোয় বন্ধ স্নানঘরের মধ্যে ফণা তোলা কেউটে সাপ দেখে তড়িঘড়ি বাথটাব থেকে উঠতে গিয়ে করবেট সাহেব নিভিয়ে ফেললেন সেই কুপিটি, একমাত্র আলোর উৎস। মিশকালো অন্ধকারে বন্ধ ছোট্ট বাথরুমে করবেট আর কেউটে। তাঁর উদ্ধার পাবার রূদ্ধশ্বাস চলচ্ছবি এখন আমার এই আলোকিত স্নানঘরে।

সময় লেখে যত মোছে তার বেশি। করবেট সাহেবের বর্ণনায় সন্ধের মুখে শত সহস্র পরিযায়ী বার-হেডেড আর গ্রেল্যাগ গুজের দল আকাশ জুড়ে উড়ে আসে। সারাদিন তারা গঙ্গার জেগে ওঠা চরগুলোয় ঘোরে-ফেরে, বিশ্রাম নেয় আর সন্ধে হলে খাবারে সন্ধানে উড়ে আসে মোকামার চাষের খেত আর চারপাশের জলা-খালবিলে। পরিযায়ী পাখিদের জন্যে আদর্শ এই শীতের মাসে একটিও সন্ধেয় কেন তাদের দেখা মিলল না! মোকামাঘাটেই জীবনে প্রথম লোহার মই বেয়ে, অনেকটা ‘শোলে’-র ‘বীরু’-র কায়দায় এক উত্তুঙ্গ বিশাল মাপের জলট্যাঙ্কের ওপর উঠেছিলাম। না, না, কোনও ‘বাসন্তী’-র আকাঙ্ক্ষায় ঝাঁপ দেবার জন্য নয়; ওই উঁচু জায়গা থেকে গোটা ফ্যাক্টরি এলাকার ভাল ছবি পাওয়া যাবে; আর আমার নিকন বাইনোক্যুলারে দূরে শীতের গঙ্গায় ইতিউতি জেগে থাকা চরগুলোয় পাখির সন্ধানটাও করে নেওয়া যাবে! কারখানাটির বার্ডস-আই-ভিউ চমৎকার ছবি তোলার সুযোগ করে দিলেও, করবেট সাহেবের হাজার হাজার পরিযায়ী পাখিরা আর এ তল্লাটে কেউ নেই।

আমাদের নমুনা সংগ্রহ আর বাকি সব নিরীক্ষার কাজ শেষ। সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়ার গেল। সংগ্রহ করা অশোধিত, শোধিত নানান নমুনার জন্যেই একটা ব্যাগ ভরে গেল। সেই ব্যাগে এখন সব অমূল্য সম্পদ, ল্যাবরেটরিতে তাদের বিস্তর পরীক্ষা বাকি। ফিরতি পথে রাতের ট্রেনে উঠে পড়েছি। কিছু পরেই হঠাৎ খেয়াল হল একটা ব্যাগ যেন গুনতিতে কম! এসেছিলাম পাঁচটা ব্যাগ নিয়ে, কিন্তু ফেরার সময় তো নমুনার ব্যাগটা বেড়ে সেই সংখ্যা ছয়! কোম্পানির যে গাড়িটি আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দিতে এসেছিল, নির্ঘাত সেই গাড়িতেই পড়ে আছে একটা ব্যাগ। কী ভাগ্যি, সেটি ছিল টেস্টিং কিটের ব্যাগটি; ফিরেই আমাদের ল্যাবের কাজকে এই ব্যাগ-বিরহ বিশেষ কাবু করতে পারবে না। আর গাড়িতে যখন ব্যাগটা থেকে গেছে, সেটি ফেরত পাওয়া যাবে নিশ্চিত, না হয় ক’দিন দেরি হবে। কী ভাগ্যি, ব্যাগটা প্ল্যাটফর্মে ফেলে আসিনি! তাহলে রেল কোম্পানির মালখানার হাজার বাক্সের মধ্যে থেকে কে আর সেই ব্যাগ খুঁজে এনে দিত! আমরা তো আর কেউ নেপাল-রাজের প্রধানমন্ত্রী নই। করবেটের লেখায় আছে এক ব্যাগ উদ্ধারের সাতকাহন। কলকাতায় তখনকার বিখ্যাত হ্যামিলটন অ্যান্ড কোম্পানির গহনার দোকান থেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বেড়াতে আসা বাড়ির মেয়েরা ব্যাগভর্তি দেড় লক্ষ টাকার গহনা ট্রেনের কামরায় ফেলে রেখে স্টিমারে গঙ্গা পার করে ওপারে সিমারিয়া থেকে আবার ট্রেনে চেপে রওনা দিলেন। অনেক পরে খেয়াল হল গয়নার ব্যাগ কোথায়! করবেট সাহেব মোকামাঘাটের মালখানা থেকে নিতান্ত ভাগ্যক্রমে সেই ব্যাগ উদ্ধারের টানটান গল্প আমাদের শুনিয়েছেন।

ল্যাবে ফিরে আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল কাজের উৎসাহ একশো গুণ বাড়িয়ে তুলল। অবাক কাণ্ড। বহু অর্থ ব্যয়ে বিজ্ঞানসম্মত শোধন ব্যবস্থার কার্যকারিতার চেয়ে নিখরচায় জলাভূমির শোধন ক্ষমতা কিছু অংশে কম তো নয়ই, বরং অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে। কলকাতার প্রতিদিনের ৩০০০ টন আবর্জনা আর ৭০ হাজার কিলোলিটার বর্জ্য ময়লা জল শোধন করার খরচ এতকাল এই ব্রাত্য জলাভূমিটি বাঁচিয়ে দিয়েছে। সে কিছু কম নয়; বছরে কমবেশি ৫০০ কোটি টাকা। এই জলাভূমি কলকাতার প্রায় দেড়-দু কোটি বাসিন্দার জন্য প্রতিবছর প্রায় তিন লক্ষ টন অক্সিজেন জুগিয়ে চলেছে। ময়লা জল-আবর্জনার কার্বনের ৬০% কার্বন জমা করে রাখে এই অবাক জলাভূমি। হিসেব বলে, প্রতিদিন শ্বাসকাজ, যানবাহন আর শহর-সন্নিহিত ছোট আর মাঝারি শিল্পের মোট বর্জ্য কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ প্রায় ৩৫০০ টন। তার বিপুল অংশ জলার গাছপালা ধরে রাখে; বছরে প্রতি বর্গমিটার পিছু প্রায় দুই কিলোগ্রাম কার্বন। এই জলাভূমি না থাকলে আরও কত বেশি কার্বন আবহাওয়া উষ্ণ করে তোলার কাজে হাত মেলাত বেশ বোঝা যায়। হিসেব বলে, ৩০ থেকে ৪০ মিটার পুরু পলি-স্তরের ওপরে আমাদের কলকাতা দাঁড়িয়ে। সাড়ে বারো হাজার হেক্টর জলাভূমিটি জলের সমস্ত ময়লা এই পলিস্তরে আটকে রেখে মাটির নিচে স্বাদু পেয় জল জমিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করে।

তবুও উন্নয়ন বড় বালাই। তাই নানান উন্নতির আগ্রাসী হাঁ-মুখ এই কাজের জলাভূমিটিকেই গত পঞ্চাশ বছরে প্রায় চল্লিশ শতাংশ গ্রাস করেছে। এই সংকোচনে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে দুশো কোটি টাকার মতো; শুধুমাত্র কৃষিজ উৎপাদন, জীবন-জীবিকা আর ময়লা শোধনের সংকোচনের নিরিখে। নিত্যনতুন কৌশলে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে সবজি চাষ, মাছ চাষ। জমির চরিত্র পাল্টে ফেলার নানান কুশলী বন্দোবস্ত পূর্ব কলকাতার জলাভূমির গলা টিপে ধরেছে। কলকাতার পাশেই এতটা জায়গা, এত উন্নয়নের হাতছানি উপেক্ষা করে কতদিন আর বেঁচে থাকবে এই রামসার সাইট! ডিনোটিফিকেশন হল বলে! পুরুষানুক্রমে ময়লা জলে চাষের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা কাজ হারিয়ে আজ অন্য পেশার সন্ধানে। অথচ জলাভূমির মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া ময়লা জলকে কাজে লাগিয়ে সম্পদ তৈরির দেশজ পদ্ধতি ও অর্থকরী ব্যবস্থাটিকে সম্মান জানাতেই পূর্ব কলকাতার জলাভূমি রামসার সাইটের মতো আন্তর্জাতিক তকমাটি পেয়েছিল। আজ উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয় যখন কারখানার বর্জ্য জল শোধনের জন্য কৃত্রিম জলাভূমি তৈরি করছে, আমরা তখন আমাদের জলাভূমিকে নষ্ট করে চলেছি। শুধু ট্যানারির ময়লা জল নয়, এই জলাভূমি গোটা কলকাতা শহরের ময়লা জল আর তার সঙ্গে হাজার-হাজার ছোট-মাঝারি শিল্পের ময়লা জলকেও প্রায় একশো বছর শোধন করে দিয়েছে। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় কলকাতার মতো জনবহুল মেট্রোপলিটন শহরের ময়লা জল শোধনের একমাত্র ব্যবস্থা ছিল এই পুবের জলাভূমি। এতকাল এই কাজ হয়েছে নিখরচায়। এখন প্রায় শ্বাসরুদ্ধ কোমায় আচ্ছন্ন জলাভূমিটি উধাও হল বলে। মোকামাঘাটের পরিযায়ী পাখিদের মতোই।

চিত্র: গুগল
4.5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
JYOTIRINDRANARAYAN LAHIRI
JYOTIRINDRANARAYAN LAHIRI
10 months ago

অসাধারণ একটি লেখা৷ খুব ভাল লাগল৷

Recent Posts

সুজিত বসু

সুজিত বসুর দুটি কবিতা

তারার আলো লাগে না ভাল, বিজলীবাতি ঘরে/ জ্বালাই তাই অন্তহীন, একলা দিন কাটে/ চেতনা সব হয় নীরব, বেদনা ঝরে পড়ে/ যজ্ঞবেদী সাজানো থাকে, জ্বলে না তাতে ধূপ/ রাখে না পদচিহ্ন কেউ ঘরের চৌকাঠে/ শরীরে ভয়, নারীরা নয় এখন অপরূপ/ তারারা সব নিঝুম ঘুমে, চাঁদের নেই দেখা/ অর্ধমৃত, কাটাই শীত ও গ্রীষ্ম একা একা

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বিশ্বকর্মার ব্রতকথা

বিশ্বকর্মা পুজোতেও কেউ কেউ বিশ্বকর্মার ব্রত পালন করে থাকেন। এমনিতে বিশ্বকর্মা যেহেতু স্থাপত্য ও কারিগরির দেবতা, তাই কলকারখানাতেই এই দেবতার পুজো হয়ে থাকে। সেখানে ব্রতকথার স্থান নেই। আবার কোন অলৌকিক কারণে এবং কবে থেকে যে এদিন ঘুড়িখেলার চল হয়েছে জানা নেই। তবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন শহর ও গ্রামের আকাশ ছেয়ে যায় নানা রঙের ও নানা আকৃতির ঘুড়িতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার কখনও বাংলাদেশে পা রাখেননি!

ভাবতে অবাক লাগে, ‘৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ উত্তমকুমারকে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। টালিগঞ্জের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করেছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে। অন্যদিকে ববিতা, অলিভিয়া ও আরও কেউ কেউ টলিউডের ছবিতে কাজ করেছেন। ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার ও পরে গৌতম ঘোষ ছবি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশে এসে, কিন্তু উত্তমকুমারকে আহ্বান করার অবকাশ হয়নি এখানকার ছবি-করিয়েদের।

Read More »
নন্দিনী কর চন্দ

স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্দরমহলে: কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি

বিস্মৃতির অতলে প্রায় তলিয়ে যাওয়া এমন কয়েকজন মহিলা কবির কথা আলোচনা করব, যাঁরা তাঁদের কাব্যপ্রতিভার দ্যুতিতে বাংলা কাব্যের ধারাকে উজ্জ্বল ও বেগবান করে তুলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃষ্ণকামিনী দাসী, মোক্ষদায়িনী দেবী, প্রসন্নময়ী দেবী, লজ্জাবতী বসু, জগন্মোহিনী দেবী, গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী, হিরণ্ময়ী দেবী, অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্ত, সুরবালা ঘোষ প্রমুখ।

Read More »
মোহাম্মদ কাজী মামুন

বালকেরা অচেনা থাকে : এক অবিস্মরণীয় পাঠ অভিজ্ঞতা

ঘাসফুল নদী থেকে প্রকাশিত ‘বালকেরা অচেনা থাকে’ গল্পগ্রন্থটি যতই এগোনো হয়, একটা অনুতাপ ভর করতে থাকে পাঠকের মনে— কেন আগে সন্ধান পায়নি এই অমূল্য রত্নসম্ভারের! হ্যাঁ, রত্নসম্ভারই, কারণ একটা-দুটো নয়, প্রায় দশটি রত্ন, তাও নানা জাতের— লুকিয়ে ছিল গল্পগ্রন্থটির অনাবিষ্কৃত খনিতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাইশে শ্রাবণ ও বৃক্ষরোপণ উৎসবের শতবর্ষ

কবির প্রয়াণের পরের বছর থেকেই আশ্রমবাসী বাইশে শ্রাবণকে বৃক্ষরোপণ উৎসব বলে স্থির করেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই দিনটিই এ-উৎসবের স্থায়ী তারিখ। বাইশের ভোর থেকেই প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় উৎসব। সকালে কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা বিচিত্রভাবে একটি পালকি চিত্রিত করেন ছবি এঁকে, ফুল, লতাপাতায়। মঙ্গলধ্বনি দিতে দিতে এর পর পালকির ভিতরে টবের মধ্যে একটি চারাগাছকে স্থাপন করা হয়। অতঃপর শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গীত-পরিবেশন-সহ আশ্রম-পরিক্রমা।

Read More »