শিরোনামে পাশাপাশি দুটো শব্দ কি খুব বেমানান লাগছে? হ্যাঁ, লাগারই কথা। কারণ পরাগমিলন শব্দটার সঙ্গে মৌমাছি, ভীমরুল, বোলতা, প্রজাপতি, পাখি এদের কথাই অবধারিতভাবে এসে যায়। সেখানে পাখিও না, পতঙ্গও না। একেবারে টিকটিকি? দেখা যাক, আপাতবিরোধী এই দুই শব্দের মেলবন্ধন ঘটানো যায় কিনা।
সময়টা ২০১৭ সালের শেষের দিক। রুথ কাজিয়েন (Ruth Cozien) ও টিমো ভ্যান ডার নিয়েট (Timo van der Niet) নামের এক গবেষক দম্পতি দক্ষিণ আফ্রিকার ড্রাকেন্সবার্গ পাহাড়ের ওপরে আয়োজিত Citizen Science Workshop-এ যোগ দিতে গিয়েছিলেন। এই ওয়ার্কশপের কাজের তালিকায় ছিল ওই পাহাড় অঞ্চলের নানা ধরনের গাছপালার অনুসন্ধান ও সেই সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ। পরিকল্পনামাফিক ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে তাঁরা পাহাড়ের বিভিন্ন দিকে অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন। এই সময় একদিন নিয়েট দম্পতি ও তাঁদের দলের অন্য সদস্যরা আবিষ্কার করেন এক অদ্ভুত ধরনের সবুজ রঙের ফুল, পাতার আড়ালে আর খুব নীচে (মাটির খুব কাছাকাছি), তীব্র গন্ধযুক্ত আর প্রচুর মধুপূর্ণ।

গ্রুপের অন্য সদস্যরা এই নতুন ধরনের ফুলগুলো দেখলেন, প্রশংসা করলেন, নতুন সংগ্রহের তালিকায় যুক্তও করলেন। তবে ওই পর্যন্তই। এরপর আর ওই ফুলগুলো সম্পর্কে বিশেষ মনোযোগ দিলেন না। তবে নিয়েট দম্পতি কিন্তু ওই ফুলগুলো সম্পর্কে কৌতূহলী হলেন।
প্রায় বেশিরভাগ গাছের ফুলই সাধারণত হয় উজ্জ্বল রঙের আর এই উজ্জ্বল রংই তো পাখি-পতঙ্গদের আকর্ষণ করে পরাগমিলন ঘটায়। কিন্তু এই বিশেষ ধরনের সবুজ ফুলগুলো বেশ অন্য রকম, যেন ছদ্মবেশধারী (camouflaged) আর খুব নীচের দিকে পাতার আড়ালে মাটির খুব কাছাকাছি নিজেদেরকে লুকিয়ে রেখেছে। তাই পাখি বা পতঙ্গের দ্বারা এদের পরাগমিলন সম্ভব হওয়ার কথা নয়। তাহলে প্রশ্ন হল, এই শ্রেণির ফুলের পরাগমিলন হয় কীভাবে?

প্রাথমিক অনুসন্ধান করে নিয়েট দম্পতি দেখলেন, বহু আগে ১৮৭৬ সালে এই ফুলের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হলেও এই ফুল বা এই গাছের বাস্তুসংস্থান (ecology) নিয়ে এযাবৎ আর কোনও গবেষণা হয়নি। নিয়েট দম্পতি কিন্তু এই গাছ ও ফুলগুলো সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ অনুভব করলেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন অনুসন্ধান পর্ব আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন তাঁদের নিজেদের মত করে।
এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নিয়েট দম্পতি আবার যাত্রা করলেন ওই ড্রাকেন্সবার্গ পাহাড়ে। এবার তাদের সঙ্গী হলেন আরও দুজন। তাঁদের দুই অধ্যাপক বন্ধু, যাঁরা দুজনেই উদ্ভিদ বিজ্ঞানের গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। এক সপ্তাহান্তে যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে এই চারজনের দল আবার রওনা হল ড্রাকেন্সবার্গ পাহাড়ের উদ্দেশে।

শুরু হল দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুসন্ধান পর্ব। তাঁরা প্রতিদিন ভোর ছ’টায় বেরিয়ে পড়তেন, টানা ১২-১৪ ঘণ্টা পাহাড়ের আনাচেকানাচে ঘুরে ঘুরে সন্ধানপর্ব চালাতেন মোশন ট্রিগার ক্যামেরা বসিয়ে, হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াতেন কোন সে প্রাণী যারা এই পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা মাটির সঙ্গে প্রায় মিশে থাকা ফুলগুলোর পরাগমিলন ঘটায়?
কাজটা খুব সহজসাধ্য ছিল না। প্রায় মাটির কাছাকাছি সবুজ পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা সবুজ রঙের ফুলগুলোকে ক্যামেরাবন্দি করা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। প্রথমদিকে তারা ধরেই নিয়েছিলেন রাতচরা ইঁদুর বা ওই জাতীয় (noctoral rodents) কোনও প্রাণী এই প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে থাকা ফুলগুলোর পরাগমিলন ঘটায়। আর সেইমত অনুসন্ধানও চালাচ্ছিলেন, কনকনে ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশাঘেরা রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্যামেরা ফিট করে বসে থাকতেন। কিন্তু অবশেষে তাদের ভুল ভাঙল।

অসীম ধৈর্য্য সহকারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিডিও ফুটেজ নিয়ে অবশেষে নিশ্চিত প্রমাণ পেলেন, না, কোনও পাখি, পতঙ্গ বা কোনও স্তন্যপায়ী জীব নয়, এই ফুলের পরাগমিলন ঘটায় টিকটিকি। ওই পাহাড়ি অঞ্চলের দুই বিশেষ প্রজাতির টিকটিকি Pseudocordylus melanotus ও Tropidosaura gularis।
এই টিকটিকিরা দীর্ঘ সময় ধরে ফুলে ফুলে বিচরণ করে যথেচ্ছ মধু পান করে। আর এই মধু পানের সময় তাদের মুখের চারপাশে অজস্র পরাগরেণু আটকে যায়। আর এভাবেই ফুলে ফুলে পরাগরেণু ছড়িয়ে দেয় এক ফুল থেকে অন্য ফুলে মধু আহরণের মাধ্যমে। সুদীর্ঘ ভিডিও ফুটেজ থেকে আরও এক চমকপ্রদ পর্যবেক্ষণ হল, মধুপানের সময় এই টিকটিকির দল শুধু যে প্রচুর পরিমাণে পরাগরেণু বহন করে তাই নয়, এই পরাগরেণু এরপর একদম যথাস্থানে অর্থাৎ সুনির্দ্দিষ্টভাবে ফুলের স্টিগমাতে নিয়ে প্রতিস্থাপিত করে। এইরকম নিয়মানুগ আচরণ কিন্তু পাখি, প্রজাপতি বা অন্যান্য শ্রেণির পরাগমিলনকারীদের মধ্যে দেখা যায় না।

ইঁদুর বা ওই জাতীয় কোনও প্রাণীর দ্বারা যে এই ফুলের পরাগমিলন হয় না, তার সপক্ষে আরও এক যুক্তি হল, তীব্র গন্ধযুক্ত এই ফুলের গন্ধের কারণ হল স্যাফ্রান্যাল (safranal) নামক এক রাসায়নিক যৌগের উপস্থিতি। তীব্র গন্ধের এই যৌগের স্বাদও অত্যন্ত তিক্ত। তাই একথা ধরে নেওয়াই যায় যে, এই তিক্ত স্বাদ ইঁদুর শ্রেণির প্রতিরোধক হিসেবেই কাজ করে। অপরদিকে এই গবেষক দল পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, তিক্ত স্বাদ ওই টিকটিকিদের মোটেও বিকর্ষণ করে না।
পরিশেষে প্রকৃতির আরও এক বিস্ময়কর সৃষ্টির কথা বলি। এই ফুলগুলোর সবুজ রং আর তার ওপরে কমলা রঙের গ্রন্থি (glands), প্রায় ঠিক ওই দু’রকম রঙেরই সংযোজন (color combination) কিন্ত উপরোক্ত শ্রেণির মধ্যে এক শ্রেণির টিকটিকির (pseudocordylus menangis) দেহে বর্তমান (চিত্রে দ্রষ্টব্য)। প্রকৃতির বুকে এরকম আরও কতই যে বিস্ময় লুকিয়ে আছে তার কতটুকুই বা আমরা জানি!
তথ্যসূত্র:
www.indefenseofplants.com>blog
www.fs.ed.us>pollinators>animals
www.bbc.com> earth> story> 201…
সত্যিই অবাক করা। পরাগ সংযোগকারী আরও এক খেলোয়ার যে টিকটিকি তা অজানা ছিল। খুব ভালো উপস্থাপনা।