Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

খেলা হচ্ছে

ওই তো! লেখার শিরোনাম দেখেই ‘উফফ, আবার পলিটিক্যাল কচকচানি’ বলে ধর্মতলার ফুটপাথে ‘১00-য় দেবে তো দাও, না হলে তোমার জিনিস তোমার কাছেই রাখো’ মার্কা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন?

এই এক জ্বালা! যতই জানেন যে দিল্লির মাথার ওপর বসে ছড়ি-ঘোরানো দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা গ্যাসের দাম থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ভর্তুকি সবটাই ঠিক করেন, তবুও রাজনীতি নামটা শুনলেই দশহাত দূর দিয়ে পালান! আর পরে ফিশফ্রাই সহযোগে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে ‘ছ্যাঃ ছ্যাঃ, দেশের কী হাল, পলিটিক্সে একটাও শিক্ষিত মানুষ নেই গা’ বলে ঈষৎ হা-হুতাশ করেন! আরে মশাই, জানি জানি। খাবার পাতে গরম ফিশফিঙ্গার স্বর্গীয় মনে হলেও, বাজারে গিয়ে আঁশটে গন্ধ সয়ে মাছ কেনার হ্যাপা অনেক! তার থেকে সবটাই ‘হোম ডেলিভারি’ হলেই লাইফ সর্টেড, মিডলক্লাসের মত ‘নিজেরটা নিজে খুঁটে খাও’ জীবন কে যেচে চায়!

তবে ভাবছেন এইরকম আখাম্বা শিরোনাম কেন?

সামনের পঞ্চায়েত ইলেকশনও ঢের দেরি, ইডি-সিবিআইও নতুন করে কোনও কেউকেটার বাড়ি থেকে বস্তা-বস্তা টাকার বান্ডিল বের করেনি! তবে?

আরে মশাই, খেলা হচ্ছে! তবে কিনা নিরামিষ ফুটবল! গত সপ্তাহান্ত থেকেই হইহই করে মধ্যপ্রাচ্যের কাতারে লোক জমা হয়েছে কাতার-কাতারে, ফিফা আয়োজিত ২২তম ফুটবল বিশ্বকাপের জন্য।

যদিও এবার একটু অসময়েই শুরু হয়েছে। মানুষের উন্মাদনা, বিক্রেতাদের শতব্যস্ততা, বিজনেসম্যানদের মুনাফা লোটার ধান্দা, ফিফার ‘হেঁহেঁ, আপনারা সবাই কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে চলে আসুন’-সুলভ শান্তিপুরী আতিথেয়তা, মারকাটারি থিম সং— কিছুরই অভাব নেই! তবু যেন কোথাও তাল কাটছে! ওই অনেকটা ‘বসন্তও আসিল, বাগানে ফুলও ফুটিল, কিন্তু টাইমটা syncronize করল না’ গোছের ব্যাপার আর কী! তাল কাটার বেশ কিছু কারণও আছে। প্রথম, বছরের এই অসময়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন। অন্যান্যবার সাধারণত খেলাটা হয় বছরের গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময়। ফলত মানুষজন আরামকেদারায় গা এলিয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে বা উৎসাহ বেশি থাকলে আয়োজক দেশে ছুটে যায় তাদের নিজেদের দেশের জাতীয় দলকে উৎসাহ দিতে। এবার তার জো নেই। সামনেই ক্রিসমাসের ছুটি, তার আগে কাজ গোটাতে মানুষজনের হিমশিম খাবার যোগাড়। ঘাবড়ে যাবেন না, বাইরের অধিকাংশ দেশেই ভারতের মহান ‘আসি যাই মাইনে পাই, কাজ করাতে চাইলে বোনাস চাই’— মতবাদে বিশেষ ভরসা রাখে না! উপরন্তু এখন গরমের ফুরফুরে আবহাওয়া নেই। পুরো স্টেডিয়ামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’-র আপ্রাণ চেষ্টা করলেও সঙ্গত প্রশ্ন থেকেই যায়— চলতি রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে প্রায় সারা পাশ্চাত্য জুড়ে যে আশু জ্বালানি সংকট দেখা দিতে চলেছে, তাতে এনার্জি নিয়ে এইরকম বাড়াবাড়ি অপচয়টা ন্যায্য কিনা। এরই মধ্যে নানান স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্টেডিয়াম নির্মাণে যুক্ত শ্রমিকদের ওপর অমানবিক ব্যবহার-সংক্রান্ত যা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তা রীতিমত চমকে ওঠার মত ব্যাপার। বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ, এই স্টেডিয়ামগুলি নির্মাণকালে অন্তত ৬,৫০০ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন! যদিও এই সংখ্যাটা আনুমানিক, আসল তথ্য আম-পাব্লিকের নাগালের বাইরে! আর সবশেষে আছে জাত-ধর্ম-যৌন অভিযোজন নিয়ে কাতারের বাড়াবাড়ি রকমের ছুঁচিবাইগ্রস্ততা! জনসমক্ষে বিয়ারপান নিষিদ্ধ, সমকামিতা ক্রিমিনাল অফেন্স, পোশাকের ক্ষেত্রেও বাড়াবাড়ি রকমের মৌলবাদী চোখরাঙানি! সারা বিশ্ব জুড়ে বিদ্বজ্জনরা এইরকম সঙ্কীর্ণতা নিয়ে (সঙ্গতভাবেই) সমালোচনা করলেও কাতারের থোড়াই কেয়ার! ‘তেলের টাকায় চলছি, আমি আল হাবিবি বলছি’ গোছের হামবড়াই ভাব নিয়ে তার চলা। শেষে ফিফার বিস্তর হাত কচলানো আর হেঁহেঁ-র পর তেনারা নিমরাজি হয়ে কিছু কিছু জিনিসে ছাড় দিয়েছেন, তবে ‘বেলেল্লাপনা দেখলেই সোজা ফাঁসিতে চড়াব’ গোছের চোখরাঙানি সর্বত্রই চোখের সামনে ঝুলিয়ে রেখেছেন বাবাজীবনরা।

তা যাক, খেলা হচ্ছে, ভয়ংকর খেলাই হচ্ছে। হেভিওয়েট কিছু টিম ইতিমধ্যেই অনামী টিমগুলোর কাছে নাকানিচোবানি খেয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছে! তবে কিনা খেলা হচ্ছে সারা বিশ্বের ফুটবল-খেলিয়ে দেশগুলোর মধ্যে সেরা ৩২টা দলের মধ্যে। ভারতের বাবা ওইরকম হ্যাপা নেই, ওই গুঁতোগুঁতি করে প্রথম ৩২-এ জায়গা করে নেবার কোনও হুজ্জুত নেই! শান্ত ছেলের মত র‍্যাঙ্কিং দিব্বি একশোর ওধারে খালি এপাশ-ওপাশ করে। প্রতিবার ওয়ার্ল্ড কাপ আসে, আর একদল পাব্লিক চায়ের দোকানে, বাজারে-হাটে আর এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ফুটবলে ভারতটা আর কিসসু করতে পারল না, কোনও ফিউচারই নেই’ বলে ঢেঁকুর তুলে যথারীতি আবার ক্রিকেটে মশগুল হয়ে যান।

এগুলো সবই ঠিক! তাহলে আপনি জিজ্ঞেস করতেই পারেন— ‘ওহে বাপু, তাহলে খামোকা এই বাগাড়ম্বর লেখা ফেঁদেছ কেন?’

আসলে ভারত খেলুক চাই না খেলুক, এই ফুটবল বিশ্বকাপ এলেই ভারতবাসী তথা বাঙালিদের একটা অকৃত্রিম ‘মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি’ গোছের ভাবের উদয় হয়!

যে সময়টায় তখনও যখন সোশ্যাল মিডিয়ার দাপাদাপি হয়নি, বা মুহুর্মুহু পাব্লিক ‘ভাইরাল’ বা ‘হ্যানো ফিভার-ত্যানো ফিভারে’ কাহিল হবার ব্যারাম ছিল না, তখন এই ফুটবল বিশ্বকাপ এলেই বাঙালি এক অদ্ভুত ফুটবল-জ্বরে কাবু হয়ে যেত।

এই রে, ভাবলেন বুঝি এইবার মারাদোনার ড্রিবল, পেলের গোলে শট বা বেকেনবাওয়ার, পাওলো রোসি-দের গপ্পো ফাঁদব? না না মশাই, আমি এসব স্বচক্ষে দেখিনি, এমনকি টিভির পর্দাতেও তাদের খেলা দেখিনি। ৮৬-র মেক্সিকো বিশ্বকাপে যখন বছর পঁচিশের একটা বেঁটেখাটো দামাল ছেলে, একমাথা ঝাঁকড়া চুল, একটা ফুটবল নিয়ে বাঁ-পায়ের জাদুতে অলীক সম্মোহন সৃষ্টি করছে, তখন আমি জন্মাইনি, তবে বাপ-কাকার মুখ থেকে শুনেছি। তবে কিনা দেখিনি তো অনেক কিছুই! উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ার দেখিনি, সুনীল গাভাসকারের ব্যাটিং দেখিনি, চুনী গোস্বামীর পায়ের জাদু দেখিনি, ৭০-এর অশান্ত রাজনৈতিক পরিবেশ আঁচ করিনি, লাইভ কনসার্টে রবিশঙ্করের সেতার বাজানো শুনিনি। না একেবারেই দেখিনি, শুনিনি বললে অতিনাটকীয়তা হবে! দেখেছি, ইউটিউবের পরিসরে, বিজ্ঞাপনের বিরতির ফাঁকে ফাঁকে। তবে বাঁধা পশুকে শিকার করে বা বাঁধাধরা ছুটি কাটিয়ে যেমন স্বস্তি থাকলেও উত্তেজনা নেই, মাংসে তেল ঝাল ঠিক হলেও নুন কম হলে যেমন পানসে লাগে, তেমনই এসব ফুটবলারের পায়ের জাদু ইউটিউবের পরিসরে দেখলে ঠিক মন ভরে না, মনে হয়— ‘ইসস, আর যদি ১০-১৫টা বছর আগে জন্মাতাম!’

ফুটবল বিশ্বকাপ এলেই তখন মফস্বল বা শহরের পাড়ায়-পাড়ায়, ক্লাবে-ক্লাবে সাজো-সাজো রব পড়ে যেত। মূলত দুটো দেশের সাপোর্টার বেশি দেখা যেত তখন, ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা। মাঝে-সাঝে ‘বনলতা সেন’-এর মত কিছু ইতালির বা জার্মানির সাপোর্টার মিলত। ফ্রান্স বা স্পেনের সাপোর্টার দূরবিন দিয়ে দেখলেও দূরদূরান্তেও নজরে আসত না। যে পাড়ায় বা ক্লাবে ব্রাজিল সমর্থকদের পাল্লা ভারি সেখানে হলুদ ফ্ল্যাগ আর যে পাড়ায় আর্জেন্টিনা সমর্থকদের পাল্লা ভারি সেখানে নীল-সাদা ফ্ল্যাগের সমারোহ। নাহ, তখনও ‘নীল-সাদা’ শব্দবন্ধটা এখনের মত অনুপ্রেরণা-পুষ্ট জাতীয় খিল্লির পর্যায়ে যায়নি, একটা সম্ভ্রম-মেশানো পবিত্রতার ছোঁয়া ছিল। বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগে-আগেই বাচ্চা-ধেড়ে নির্বিশেষে সবাই আগে খবরের কাগজের ওপর ডাইভ দিত বিশ্বকাপের টাইমটেবিল বাগানোর তালে, কাঁচি দিয়ে যত্ন করে কেটে পড়ার টেবিলের ওপর ভাল করে সেঁটে দিয়ে তবে শান্তি। সান্ধ্যকালীন পড়াশুনায় তখন খানিকটা ছাড় মিলত। দুপুরে ঘুমিয়ে, সন্ধেবেলায় সিঁড়িভাঙা অঙ্ক বা ট্রেনের মুখোমুখি যাবার জটিল পাটিগণিতীয় বিভীষিকা কোনওমতে উদ্ধার করে সোজা টিভির সামনে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা। পছন্দের দল জিতলে বাড়তি উচ্ছ্বাস, হেরে গেলে খানিক মনখারাপ সঙ্গী করে রাতে ঘুমোতে যাওয়া। পরদিন স্কুলে টিফিনবেলায় সেই আগের দিনের খেলা নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে উত্তাল আলোচনা, বাগবিতণ্ডা, কথা কাটাকাটি। তখন ইন্টারনেট সহজলভ্য ছিল না, তাই খেলার হাইলাইট দেখাও ছিল দূরঅস্ত। তাই ‘সবেধন নীলমণি’ ভরসা সেই খবরের কাগজের ওপরই। পছন্দের স্ট্রাইকারের পাঁচজনকে হেলায় কাটিয়ে গোল করা বা পছন্দের গোলকিপারের চিলের মত ঝাঁপিয়ে গোল আটকানো— পছন্দের রঙিন ছবি খবরের কাগজে দেখলেই সেগুলো কেটে দেওয়ালে বা খাতায় সাঁটানো ছিল তখন রোজকার রুটিন। পরের বিশ্বকাপ না আসা অব্দি সেগুলো অম্লানবদনে শোভা পেত বাড়ির দেওয়ালে, পড়ার টেবিলের মাথায়। আর ছিল খবরের কাগজে অমল দত্ত, চুনি গোস্বামী বা পি কে বাড়ুজ্জেদের ম্যাচ রিপোর্ট। সাতসকালে কাগজ এলেই পড়াশুনা ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেগুলো গোগ্রাসে পড়ে তবে শান্তি। সঙ্গে ফাউ হিসেবে জেনারেল নলেজের ভাণ্ডার ভর্তি— এবারের বিশ্বকাপের ফুটবলের নাম কী, ম্যাসকট কে এইসব।

বিশ্বকাপের বাজারে দু’ধরনের ব্যবসায়ীদের পোয়া-বারো হত। এক, টিভি-বিক্রেতা আর দুই মুরগি বা খাসির মাংসের দোকানি। খবরের কাগজে বা পাড়ার মোড়ের সামনে ‘অমুক দোকানে টিভি কিনলে তমুক পারসেন্ট ছাড় পাওয়া যাচ্ছে’— বিজ্ঞাপনের বাড়াবাড়ি উপস্থিতি চোখে পড়লেই বোঝা যেত বিশ্বকাপ আসন্ন। তখন মধ্যবিত্ত বাঙালি বিশ্বকাপের সময়ই নতুন টিভি কিনত; কেউ নতুন কালার টিভি আবার কেউবা বাড়ির সাদা-কালো টিভিকে বিদেয় করে নতুন কালার টিভি। সঙ্গে ফাউ হিসেবে চেনা মধ্যবিত্ত পিএনপিসি— ‘গিন্নি দেখেছ, পাশেরবাড়ির দত্তবাবু ইয়া বড় কালার টিভি নামিয়েছে, নির্ঘাত অফিসে ভালই বাঁ-হাতে কামাই সারছে!’ অনেক ক্লাবেও তখন টিভি কেনা হত, তবে কিনা সেটা সবার থেকে চাঁদা তুলে, দরহালে সরকারি অনুপ্রেরণার বালাই ছিল না। যাদের নিজেদের বাড়িতে টিভি নেই, তারা ভিড় করত পাড়ার ক্লাবে বা প্রতিবেশীর বাড়িতে। আর কোয়ার্টার-ফাইনাল থেকে সব খেলাই বাচ্চা-বুড়ো দলবেঁধে দেখত পাড়ার ক্লাবে। মুহুর্মুহু ধেয়ে আসত ‘ওরে বাঁদিকের প্লেয়ারটা ফাঁকা দাঁড়িয়ে আছে, বলটা বাড়া’ বা ‘ডিফেন্ডারগুলো কি ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে নাকি! সামনে দিয়ে বলটা নিয়ে চলে যাচ্ছে, আর শালাগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে’ মার্কা নিষ্ফল আস্ফালন!

সপ্তাহান্তে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার খেলা থাকলেই পাড়ায়-পাড়ায় পিকনিক লেগে যেত। তখন কিটি পার্টি বা গেট-ট্যুগেদার এসবের এত চল ছিল না। তাই ফুটবলকে উপলক্ষ করেই সারা পাড়ার লোক একজোট হত। যে পাড়ায় মালদার পার্টি বেশি তাদের মেনুতে ভাত আর খাসির মাংসের ঝোল আর যাদের বাজেট কম তাদের বরাতে মুরগি। সেসময় মাংসের দোকানদাররা রোজ সকালে দোকান খুলে ঠাকুরের ছবিতে ধূপ দেখাতে দেখাতে একটাই প্রার্থনা করত— ‘ঠাকুর, কিচ্ছু চাইনি আমি/ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সেমিফাইনালে ছাড়া…’।

সেবার ৯৮-এর বিশ্বকাপ ফাইনাল। সুপার-ফেবারিট ব্রাজিল ফাইনাল খেলছে। জ্ঞানত আমার দেখা প্রথম বিশ্বকাপ। ফাইনালের দিন সন্ধের মধ্যেই রাস্তাঘাট শুনশান, দোকানপাট সব বন্ধ। পাড়ার ক্লাবে-ক্লাবে মাংস-ভাতের পিকনিক। যা উত্তেজনা চারিদিকে, তাতে বোঝা ভার যে ব্রাজিল ফাইনাল খেলছে নাকি ভারত ফাইনাল খেলছে। শেষমেশ ব্রাজিল হেরে গেল। যেন জাতীয় শোক নেমে এলো চারিদিকে। কেউ কেউ প্রতিজ্ঞা করেই বসল— ‘দূর শালা, আর কোনওদিন মাংস-ভাতই খাব না শালা খেলার দেখার আগে!’

বিশ্বকাপ থেকে মূলত দু’ধরনের পাওনা হত আমাদের। এক, পছন্দের খেলোয়াড়দের চুলের স্টাইল। বাপ-জ্যাঠাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কেউ কেউ সেইরকম চুলের ছাঁট বাগাত। বিশ্বকাপের পরপরই ফুটবল টুর্নামেন্ট হত মফস্বলের পাড়ার ক্লাবে, এন্ট্রি ফি— কোনটায় ১০১, আবার কোনটায় ১৫১! ফাইনালে জিতলে পুরস্কারমূল্যের সঙ্গে একহাঁড়ি রসগোল্লা। নতুন চুলের ছাঁট বাগিয়ে পাড়া-বেপাড়ার ‘স্টার’ খেলোয়াড়রা মাঠে নামত। কোনও ছোকরা বাঁ-পায়ের ড্রিবলে ২-৩ জনকে কুপোকাত করে বিপক্ষের গোলের দিকে শনশনিয়ে এগোলে দর্শকদের মধ্যে থেকে আওয়াজ উঠত— ‘উফফ, মারাদোনা, মারাদোনা’।

আর দুই, থিম সং! তখন ইন্টারনেট-ইউটিউবের বাড়বাড়ন্ত ছিল না, তাই ভরসা ওই লাইভ দেখা আর কী। ৯৮-এর রিকি মার্টিনের ‘কাপ অফ লাইফ’ গান আর সম্মোহনী চাহনি বঙ্গললনাদের হৃদয় কতটা উথালপাথাল করেছিল জানি না, তবে শাকিরার ‘Hips don’t lie’ বেশ বড়মাপের শোরগোল ফেলেছিল। মফস্বলের বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রদের কাছে ‘শাকিরা’ খায় না মাথায় দেয়, স্পষ্ট ছিল না! শেষে স্কুলে এক ডেঁপো দাদা বুঝিয়ে বলল বেলি ডান্স কী আর শাকিরাই বা কে! তাই শুনে ফাইনালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমাদের মত কচিকাঁচাদের কী উদগ্র আগ্রহ! কাকা-জ্যাঠারাও দেখল, তবে আড়চোখে! রক্ষণশীল জ্যাঠাদের দল যথারীতি ঠোঁট বেঁকিয়ে আওয়াজ ছাড়ল— ‘ম্যাগো, ও কী পাছা দুলিয়ে নাচ! এর থেকে বেঁচে থাক বাবা আমাদের ভরতনাট্যম, কথাকলি আর মাধুরী’।

যাক গে! বিশ্বকাপ আসে, আবার বিশ্বকাপ চলে যায়। আমরা ওই ৭০-এর এশিয়াডে শ্যাম থাপার বাইসাইকেল কিক নিয়ে জাবর কাটতেই থাকি। একটা বিশ্বকাপ জন্ম দেয় বেশ কিছু স্টার-এর, আবার কেউ কেউ স্টার থেকে উত্তীর্ণ হয় সুপারস্টারে। আবার কোনও কোনও স্টার/ সুপারস্টার হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। পড়ে থাকে কিছু ভাল লাগার মুহূর্ত, মনের মণিকোঠায় ফ্রেমবন্দি হয়ে। ভাঙে কিছু রেকর্ড, গড়েও কিছু রেকর্ড। আগামী দিন ত্রিশ হাঁ করে তাকিয়ে থাকা তেমনই কিছু মুহূর্তের আশায়… চরৈবেতি, চরৈবেতি।

চিত্রণ: গুগল
4 4 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
শুভ্র মুখোপাধ্যায়
শুভ্র মুখোপাধ্যায়
2 years ago

বাঃ, চমৎকার লেখা। চলুক এমন স্যাট্যায়ার।

Recent Posts

রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সোমেন চন্দ: এক বহ্নিময় কথাকার

মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন, যদিও তা অসমাপ্ত থাকে। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘বন্যা’। পরবর্তীকালে উপন্যাসটি অসমাপ্ত-ই থেকে যায়। আরও দুঃখের বিষয়, এর বৃহদংশ হারিয়েও গেছে। আজ যে সোমেন চন্দের লেখককৃতির জন্য আমরা তাঁকে স্মরণ করি, তা হল তাঁর বেশ কিছু অসামান্য ছোটগল্প। সংখ্যায় খুব বেশি নয়, মাত্র চব্বিশটি। আরও কিছু গল্প লিখলেও তা কালের ধুলোয় হারিয়ে গেছে। গল্পের সংখ্যা সামান্য, তবে অসামান্যতা রয়েছে সেগুলির রচনার পারিপাট্যে, বিষয়বস্তু চয়নে, শিল্পিত প্রকাশে ও লেখনীর মুনশিয়ানায়। এছাড়া তিনি দুটি নাটিকাও লেখেন, ‘বিপ্লব’ ও ‘প্রস্তাবনা’। লেখেন কিছু প্রবন্ধ। তাঁর ছোটগল্পগুলি এতটাই শিল্পোত্তীর্ণ ছিল যে, তাঁর জীবিতকালেই একাধিক ভাষায় তা অনূদিত হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »