Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

খেলা হচ্ছে

ওই তো! লেখার শিরোনাম দেখেই ‘উফফ, আবার পলিটিক্যাল কচকচানি’ বলে ধর্মতলার ফুটপাথে ‘১00-য় দেবে তো দাও, না হলে তোমার জিনিস তোমার কাছেই রাখো’ মার্কা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন?

এই এক জ্বালা! যতই জানেন যে দিল্লির মাথার ওপর বসে ছড়ি-ঘোরানো দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা গ্যাসের দাম থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ভর্তুকি সবটাই ঠিক করেন, তবুও রাজনীতি নামটা শুনলেই দশহাত দূর দিয়ে পালান! আর পরে ফিশফ্রাই সহযোগে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে ‘ছ্যাঃ ছ্যাঃ, দেশের কী হাল, পলিটিক্সে একটাও শিক্ষিত মানুষ নেই গা’ বলে ঈষৎ হা-হুতাশ করেন! আরে মশাই, জানি জানি। খাবার পাতে গরম ফিশফিঙ্গার স্বর্গীয় মনে হলেও, বাজারে গিয়ে আঁশটে গন্ধ সয়ে মাছ কেনার হ্যাপা অনেক! তার থেকে সবটাই ‘হোম ডেলিভারি’ হলেই লাইফ সর্টেড, মিডলক্লাসের মত ‘নিজেরটা নিজে খুঁটে খাও’ জীবন কে যেচে চায়!

তবে ভাবছেন এইরকম আখাম্বা শিরোনাম কেন?

সামনের পঞ্চায়েত ইলেকশনও ঢের দেরি, ইডি-সিবিআইও নতুন করে কোনও কেউকেটার বাড়ি থেকে বস্তা-বস্তা টাকার বান্ডিল বের করেনি! তবে?

আরে মশাই, খেলা হচ্ছে! তবে কিনা নিরামিষ ফুটবল! গত সপ্তাহান্ত থেকেই হইহই করে মধ্যপ্রাচ্যের কাতারে লোক জমা হয়েছে কাতার-কাতারে, ফিফা আয়োজিত ২২তম ফুটবল বিশ্বকাপের জন্য।

যদিও এবার একটু অসময়েই শুরু হয়েছে। মানুষের উন্মাদনা, বিক্রেতাদের শতব্যস্ততা, বিজনেসম্যানদের মুনাফা লোটার ধান্দা, ফিফার ‘হেঁহেঁ, আপনারা সবাই কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে চলে আসুন’-সুলভ শান্তিপুরী আতিথেয়তা, মারকাটারি থিম সং— কিছুরই অভাব নেই! তবু যেন কোথাও তাল কাটছে! ওই অনেকটা ‘বসন্তও আসিল, বাগানে ফুলও ফুটিল, কিন্তু টাইমটা syncronize করল না’ গোছের ব্যাপার আর কী! তাল কাটার বেশ কিছু কারণও আছে। প্রথম, বছরের এই অসময়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন। অন্যান্যবার সাধারণত খেলাটা হয় বছরের গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময়। ফলত মানুষজন আরামকেদারায় গা এলিয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে বা উৎসাহ বেশি থাকলে আয়োজক দেশে ছুটে যায় তাদের নিজেদের দেশের জাতীয় দলকে উৎসাহ দিতে। এবার তার জো নেই। সামনেই ক্রিসমাসের ছুটি, তার আগে কাজ গোটাতে মানুষজনের হিমশিম খাবার যোগাড়। ঘাবড়ে যাবেন না, বাইরের অধিকাংশ দেশেই ভারতের মহান ‘আসি যাই মাইনে পাই, কাজ করাতে চাইলে বোনাস চাই’— মতবাদে বিশেষ ভরসা রাখে না! উপরন্তু এখন গরমের ফুরফুরে আবহাওয়া নেই। পুরো স্টেডিয়ামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’-র আপ্রাণ চেষ্টা করলেও সঙ্গত প্রশ্ন থেকেই যায়— চলতি রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে প্রায় সারা পাশ্চাত্য জুড়ে যে আশু জ্বালানি সংকট দেখা দিতে চলেছে, তাতে এনার্জি নিয়ে এইরকম বাড়াবাড়ি অপচয়টা ন্যায্য কিনা। এরই মধ্যে নানান স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্টেডিয়াম নির্মাণে যুক্ত শ্রমিকদের ওপর অমানবিক ব্যবহার-সংক্রান্ত যা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তা রীতিমত চমকে ওঠার মত ব্যাপার। বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ, এই স্টেডিয়ামগুলি নির্মাণকালে অন্তত ৬,৫০০ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন! যদিও এই সংখ্যাটা আনুমানিক, আসল তথ্য আম-পাব্লিকের নাগালের বাইরে! আর সবশেষে আছে জাত-ধর্ম-যৌন অভিযোজন নিয়ে কাতারের বাড়াবাড়ি রকমের ছুঁচিবাইগ্রস্ততা! জনসমক্ষে বিয়ারপান নিষিদ্ধ, সমকামিতা ক্রিমিনাল অফেন্স, পোশাকের ক্ষেত্রেও বাড়াবাড়ি রকমের মৌলবাদী চোখরাঙানি! সারা বিশ্ব জুড়ে বিদ্বজ্জনরা এইরকম সঙ্কীর্ণতা নিয়ে (সঙ্গতভাবেই) সমালোচনা করলেও কাতারের থোড়াই কেয়ার! ‘তেলের টাকায় চলছি, আমি আল হাবিবি বলছি’ গোছের হামবড়াই ভাব নিয়ে তার চলা। শেষে ফিফার বিস্তর হাত কচলানো আর হেঁহেঁ-র পর তেনারা নিমরাজি হয়ে কিছু কিছু জিনিসে ছাড় দিয়েছেন, তবে ‘বেলেল্লাপনা দেখলেই সোজা ফাঁসিতে চড়াব’ গোছের চোখরাঙানি সর্বত্রই চোখের সামনে ঝুলিয়ে রেখেছেন বাবাজীবনরা।

তা যাক, খেলা হচ্ছে, ভয়ংকর খেলাই হচ্ছে। হেভিওয়েট কিছু টিম ইতিমধ্যেই অনামী টিমগুলোর কাছে নাকানিচোবানি খেয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছে! তবে কিনা খেলা হচ্ছে সারা বিশ্বের ফুটবল-খেলিয়ে দেশগুলোর মধ্যে সেরা ৩২টা দলের মধ্যে। ভারতের বাবা ওইরকম হ্যাপা নেই, ওই গুঁতোগুঁতি করে প্রথম ৩২-এ জায়গা করে নেবার কোনও হুজ্জুত নেই! শান্ত ছেলের মত র‍্যাঙ্কিং দিব্বি একশোর ওধারে খালি এপাশ-ওপাশ করে। প্রতিবার ওয়ার্ল্ড কাপ আসে, আর একদল পাব্লিক চায়ের দোকানে, বাজারে-হাটে আর এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ফুটবলে ভারতটা আর কিসসু করতে পারল না, কোনও ফিউচারই নেই’ বলে ঢেঁকুর তুলে যথারীতি আবার ক্রিকেটে মশগুল হয়ে যান।

এগুলো সবই ঠিক! তাহলে আপনি জিজ্ঞেস করতেই পারেন— ‘ওহে বাপু, তাহলে খামোকা এই বাগাড়ম্বর লেখা ফেঁদেছ কেন?’

আসলে ভারত খেলুক চাই না খেলুক, এই ফুটবল বিশ্বকাপ এলেই ভারতবাসী তথা বাঙালিদের একটা অকৃত্রিম ‘মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি’ গোছের ভাবের উদয় হয়!

যে সময়টায় তখনও যখন সোশ্যাল মিডিয়ার দাপাদাপি হয়নি, বা মুহুর্মুহু পাব্লিক ‘ভাইরাল’ বা ‘হ্যানো ফিভার-ত্যানো ফিভারে’ কাহিল হবার ব্যারাম ছিল না, তখন এই ফুটবল বিশ্বকাপ এলেই বাঙালি এক অদ্ভুত ফুটবল-জ্বরে কাবু হয়ে যেত।

এই রে, ভাবলেন বুঝি এইবার মারাদোনার ড্রিবল, পেলের গোলে শট বা বেকেনবাওয়ার, পাওলো রোসি-দের গপ্পো ফাঁদব? না না মশাই, আমি এসব স্বচক্ষে দেখিনি, এমনকি টিভির পর্দাতেও তাদের খেলা দেখিনি। ৮৬-র মেক্সিকো বিশ্বকাপে যখন বছর পঁচিশের একটা বেঁটেখাটো দামাল ছেলে, একমাথা ঝাঁকড়া চুল, একটা ফুটবল নিয়ে বাঁ-পায়ের জাদুতে অলীক সম্মোহন সৃষ্টি করছে, তখন আমি জন্মাইনি, তবে বাপ-কাকার মুখ থেকে শুনেছি। তবে কিনা দেখিনি তো অনেক কিছুই! উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ার দেখিনি, সুনীল গাভাসকারের ব্যাটিং দেখিনি, চুনী গোস্বামীর পায়ের জাদু দেখিনি, ৭০-এর অশান্ত রাজনৈতিক পরিবেশ আঁচ করিনি, লাইভ কনসার্টে রবিশঙ্করের সেতার বাজানো শুনিনি। না একেবারেই দেখিনি, শুনিনি বললে অতিনাটকীয়তা হবে! দেখেছি, ইউটিউবের পরিসরে, বিজ্ঞাপনের বিরতির ফাঁকে ফাঁকে। তবে বাঁধা পশুকে শিকার করে বা বাঁধাধরা ছুটি কাটিয়ে যেমন স্বস্তি থাকলেও উত্তেজনা নেই, মাংসে তেল ঝাল ঠিক হলেও নুন কম হলে যেমন পানসে লাগে, তেমনই এসব ফুটবলারের পায়ের জাদু ইউটিউবের পরিসরে দেখলে ঠিক মন ভরে না, মনে হয়— ‘ইসস, আর যদি ১০-১৫টা বছর আগে জন্মাতাম!’

ফুটবল বিশ্বকাপ এলেই তখন মফস্বল বা শহরের পাড়ায়-পাড়ায়, ক্লাবে-ক্লাবে সাজো-সাজো রব পড়ে যেত। মূলত দুটো দেশের সাপোর্টার বেশি দেখা যেত তখন, ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা। মাঝে-সাঝে ‘বনলতা সেন’-এর মত কিছু ইতালির বা জার্মানির সাপোর্টার মিলত। ফ্রান্স বা স্পেনের সাপোর্টার দূরবিন দিয়ে দেখলেও দূরদূরান্তেও নজরে আসত না। যে পাড়ায় বা ক্লাবে ব্রাজিল সমর্থকদের পাল্লা ভারি সেখানে হলুদ ফ্ল্যাগ আর যে পাড়ায় আর্জেন্টিনা সমর্থকদের পাল্লা ভারি সেখানে নীল-সাদা ফ্ল্যাগের সমারোহ। নাহ, তখনও ‘নীল-সাদা’ শব্দবন্ধটা এখনের মত অনুপ্রেরণা-পুষ্ট জাতীয় খিল্লির পর্যায়ে যায়নি, একটা সম্ভ্রম-মেশানো পবিত্রতার ছোঁয়া ছিল। বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগে-আগেই বাচ্চা-ধেড়ে নির্বিশেষে সবাই আগে খবরের কাগজের ওপর ডাইভ দিত বিশ্বকাপের টাইমটেবিল বাগানোর তালে, কাঁচি দিয়ে যত্ন করে কেটে পড়ার টেবিলের ওপর ভাল করে সেঁটে দিয়ে তবে শান্তি। সান্ধ্যকালীন পড়াশুনায় তখন খানিকটা ছাড় মিলত। দুপুরে ঘুমিয়ে, সন্ধেবেলায় সিঁড়িভাঙা অঙ্ক বা ট্রেনের মুখোমুখি যাবার জটিল পাটিগণিতীয় বিভীষিকা কোনওমতে উদ্ধার করে সোজা টিভির সামনে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা। পছন্দের দল জিতলে বাড়তি উচ্ছ্বাস, হেরে গেলে খানিক মনখারাপ সঙ্গী করে রাতে ঘুমোতে যাওয়া। পরদিন স্কুলে টিফিনবেলায় সেই আগের দিনের খেলা নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে উত্তাল আলোচনা, বাগবিতণ্ডা, কথা কাটাকাটি। তখন ইন্টারনেট সহজলভ্য ছিল না, তাই খেলার হাইলাইট দেখাও ছিল দূরঅস্ত। তাই ‘সবেধন নীলমণি’ ভরসা সেই খবরের কাগজের ওপরই। পছন্দের স্ট্রাইকারের পাঁচজনকে হেলায় কাটিয়ে গোল করা বা পছন্দের গোলকিপারের চিলের মত ঝাঁপিয়ে গোল আটকানো— পছন্দের রঙিন ছবি খবরের কাগজে দেখলেই সেগুলো কেটে দেওয়ালে বা খাতায় সাঁটানো ছিল তখন রোজকার রুটিন। পরের বিশ্বকাপ না আসা অব্দি সেগুলো অম্লানবদনে শোভা পেত বাড়ির দেওয়ালে, পড়ার টেবিলের মাথায়। আর ছিল খবরের কাগজে অমল দত্ত, চুনি গোস্বামী বা পি কে বাড়ুজ্জেদের ম্যাচ রিপোর্ট। সাতসকালে কাগজ এলেই পড়াশুনা ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেগুলো গোগ্রাসে পড়ে তবে শান্তি। সঙ্গে ফাউ হিসেবে জেনারেল নলেজের ভাণ্ডার ভর্তি— এবারের বিশ্বকাপের ফুটবলের নাম কী, ম্যাসকট কে এইসব।

বিশ্বকাপের বাজারে দু’ধরনের ব্যবসায়ীদের পোয়া-বারো হত। এক, টিভি-বিক্রেতা আর দুই মুরগি বা খাসির মাংসের দোকানি। খবরের কাগজে বা পাড়ার মোড়ের সামনে ‘অমুক দোকানে টিভি কিনলে তমুক পারসেন্ট ছাড় পাওয়া যাচ্ছে’— বিজ্ঞাপনের বাড়াবাড়ি উপস্থিতি চোখে পড়লেই বোঝা যেত বিশ্বকাপ আসন্ন। তখন মধ্যবিত্ত বাঙালি বিশ্বকাপের সময়ই নতুন টিভি কিনত; কেউ নতুন কালার টিভি আবার কেউবা বাড়ির সাদা-কালো টিভিকে বিদেয় করে নতুন কালার টিভি। সঙ্গে ফাউ হিসেবে চেনা মধ্যবিত্ত পিএনপিসি— ‘গিন্নি দেখেছ, পাশেরবাড়ির দত্তবাবু ইয়া বড় কালার টিভি নামিয়েছে, নির্ঘাত অফিসে ভালই বাঁ-হাতে কামাই সারছে!’ অনেক ক্লাবেও তখন টিভি কেনা হত, তবে কিনা সেটা সবার থেকে চাঁদা তুলে, দরহালে সরকারি অনুপ্রেরণার বালাই ছিল না। যাদের নিজেদের বাড়িতে টিভি নেই, তারা ভিড় করত পাড়ার ক্লাবে বা প্রতিবেশীর বাড়িতে। আর কোয়ার্টার-ফাইনাল থেকে সব খেলাই বাচ্চা-বুড়ো দলবেঁধে দেখত পাড়ার ক্লাবে। মুহুর্মুহু ধেয়ে আসত ‘ওরে বাঁদিকের প্লেয়ারটা ফাঁকা দাঁড়িয়ে আছে, বলটা বাড়া’ বা ‘ডিফেন্ডারগুলো কি ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে নাকি! সামনে দিয়ে বলটা নিয়ে চলে যাচ্ছে, আর শালাগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে’ মার্কা নিষ্ফল আস্ফালন!

সপ্তাহান্তে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার খেলা থাকলেই পাড়ায়-পাড়ায় পিকনিক লেগে যেত। তখন কিটি পার্টি বা গেট-ট্যুগেদার এসবের এত চল ছিল না। তাই ফুটবলকে উপলক্ষ করেই সারা পাড়ার লোক একজোট হত। যে পাড়ায় মালদার পার্টি বেশি তাদের মেনুতে ভাত আর খাসির মাংসের ঝোল আর যাদের বাজেট কম তাদের বরাতে মুরগি। সেসময় মাংসের দোকানদাররা রোজ সকালে দোকান খুলে ঠাকুরের ছবিতে ধূপ দেখাতে দেখাতে একটাই প্রার্থনা করত— ‘ঠাকুর, কিচ্ছু চাইনি আমি/ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সেমিফাইনালে ছাড়া…’।

সেবার ৯৮-এর বিশ্বকাপ ফাইনাল। সুপার-ফেবারিট ব্রাজিল ফাইনাল খেলছে। জ্ঞানত আমার দেখা প্রথম বিশ্বকাপ। ফাইনালের দিন সন্ধের মধ্যেই রাস্তাঘাট শুনশান, দোকানপাট সব বন্ধ। পাড়ার ক্লাবে-ক্লাবে মাংস-ভাতের পিকনিক। যা উত্তেজনা চারিদিকে, তাতে বোঝা ভার যে ব্রাজিল ফাইনাল খেলছে নাকি ভারত ফাইনাল খেলছে। শেষমেশ ব্রাজিল হেরে গেল। যেন জাতীয় শোক নেমে এলো চারিদিকে। কেউ কেউ প্রতিজ্ঞা করেই বসল— ‘দূর শালা, আর কোনওদিন মাংস-ভাতই খাব না শালা খেলার দেখার আগে!’

বিশ্বকাপ থেকে মূলত দু’ধরনের পাওনা হত আমাদের। এক, পছন্দের খেলোয়াড়দের চুলের স্টাইল। বাপ-জ্যাঠাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কেউ কেউ সেইরকম চুলের ছাঁট বাগাত। বিশ্বকাপের পরপরই ফুটবল টুর্নামেন্ট হত মফস্বলের পাড়ার ক্লাবে, এন্ট্রি ফি— কোনটায় ১০১, আবার কোনটায় ১৫১! ফাইনালে জিতলে পুরস্কারমূল্যের সঙ্গে একহাঁড়ি রসগোল্লা। নতুন চুলের ছাঁট বাগিয়ে পাড়া-বেপাড়ার ‘স্টার’ খেলোয়াড়রা মাঠে নামত। কোনও ছোকরা বাঁ-পায়ের ড্রিবলে ২-৩ জনকে কুপোকাত করে বিপক্ষের গোলের দিকে শনশনিয়ে এগোলে দর্শকদের মধ্যে থেকে আওয়াজ উঠত— ‘উফফ, মারাদোনা, মারাদোনা’।

আর দুই, থিম সং! তখন ইন্টারনেট-ইউটিউবের বাড়বাড়ন্ত ছিল না, তাই ভরসা ওই লাইভ দেখা আর কী। ৯৮-এর রিকি মার্টিনের ‘কাপ অফ লাইফ’ গান আর সম্মোহনী চাহনি বঙ্গললনাদের হৃদয় কতটা উথালপাথাল করেছিল জানি না, তবে শাকিরার ‘Hips don’t lie’ বেশ বড়মাপের শোরগোল ফেলেছিল। মফস্বলের বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রদের কাছে ‘শাকিরা’ খায় না মাথায় দেয়, স্পষ্ট ছিল না! শেষে স্কুলে এক ডেঁপো দাদা বুঝিয়ে বলল বেলি ডান্স কী আর শাকিরাই বা কে! তাই শুনে ফাইনালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমাদের মত কচিকাঁচাদের কী উদগ্র আগ্রহ! কাকা-জ্যাঠারাও দেখল, তবে আড়চোখে! রক্ষণশীল জ্যাঠাদের দল যথারীতি ঠোঁট বেঁকিয়ে আওয়াজ ছাড়ল— ‘ম্যাগো, ও কী পাছা দুলিয়ে নাচ! এর থেকে বেঁচে থাক বাবা আমাদের ভরতনাট্যম, কথাকলি আর মাধুরী’।

যাক গে! বিশ্বকাপ আসে, আবার বিশ্বকাপ চলে যায়। আমরা ওই ৭০-এর এশিয়াডে শ্যাম থাপার বাইসাইকেল কিক নিয়ে জাবর কাটতেই থাকি। একটা বিশ্বকাপ জন্ম দেয় বেশ কিছু স্টার-এর, আবার কেউ কেউ স্টার থেকে উত্তীর্ণ হয় সুপারস্টারে। আবার কোনও কোনও স্টার/ সুপারস্টার হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। পড়ে থাকে কিছু ভাল লাগার মুহূর্ত, মনের মণিকোঠায় ফ্রেমবন্দি হয়ে। ভাঙে কিছু রেকর্ড, গড়েও কিছু রেকর্ড। আগামী দিন ত্রিশ হাঁ করে তাকিয়ে থাকা তেমনই কিছু মুহূর্তের আশায়… চরৈবেতি, চরৈবেতি।

চিত্রণ: গুগল
4 4 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
শুভ্র মুখোপাধ্যায়
শুভ্র মুখোপাধ্যায়
2 years ago

বাঃ, চমৎকার লেখা। চলুক এমন স্যাট্যায়ার।

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »