উইচেতা পর্বতমালা অঞ্চল পেছনে ফেলে ধীরে ধীরে সামনে আসছে বিস্তীর্ণ খোলা তৃণভূমি, আবাদের মাঠ। শোঁ শোঁ করে কতক্ষণ পর পর গাড়িগুলো চলে যাচ্ছে নিজের গন্তব্যে। ফিকে হয়ে আসছে সূর্যের তেজ। যতদূর চোখ যায় প্রসারিত, বিস্তৃতি সবুজের গেঁয়ো অঞ্চল। একঘেয়েমি লেগে আসে, চোখ জ্বালা করে ওঠে। তারপর একসময় শুষ্ক ভূখণ্ড আর বিস্তীর্ণ তৃণভূমির দীর্ঘক্ষণের নীরসতা ভেঙে হাইওয়ের দুইদিকে ভুসভুস করে পাশ কেটে পেছনে চলে যায় ছোট ছোট বন উপবন। বেলা পড়ে আসা আলোয় বাতাসে মৃদু দুলতে থাকা লম্বা গাছগুলো দেখে তখন কিছু সময়ের জন্য চোখে সতেজতা ফিরে আসে।
ওরা মাউন্ট স্কট ছেড়ে ল্যটন থেকে স্টিলওয়াটারে ফিরছে। ওকলাহোমার রাস্তায় গাড়ির সামনে এত জীবজন্তু আসে বলার মত না। কাঠবিড়ালি, হরিণ, র্যাকুন, হাঁস, খরগোশ আরও কত কী যে রাস্তায় মরে পড়ে থাকে। ওদের গাড়িটার সামনে কী একটা আসল, মনে হল র্যাকুন, কিন্তু র্যাকুন তো আস্তেধীরে নড়ে, র্যাকুনের মতই মনে হল, অথচ কাঠবিড়ালির মত দ্রুততা, শেষমুহূর্তে টের পেয়েছিল হয়তো বড় ভুল হয়ে গেছে তাই এই দ্রুততা, কিন্তু রক্ষা আর হল না শেষ পর্যন্ত। র্যাকুন বেচারি ফিরছিল হয়তো পরিবারের কাছে, খাবারের খোঁজে বেরিয়েছিল হয়তো, ঘরে কি কোনও ক্ষুধার্ত শিশু অপেক্ষায় ছিল তার ফিরে আসার?
কয়েক মিলিসেকেন্ড, ঠিকই বুঝতে পারল ও, ওরই গাড়ির চাকার নিচে পড়তে যাচ্ছে জীবটি। গাড়িতে সামান্য একটু ঝাঁকুনি, টায়ারে খুব সামান্য একটা ভোঁতা ধাক্কা, ওই কয়েক মিলিসেকেন্ডের জন্য সেই ধাক্কা নিজের শরীরেও টের পেল ও। বাকি পথ স্বামী-স্ত্রীতে আর তেমন কোনও কথা এগোল না।
খোলা আকাশ, দূরের পর্বতাঞ্চল আর ওকলাহোমার সুবিস্তীর্ণ তৃণভূমির মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া এইসব হাইওয়েতে কত নিষ্প্রাণ জীবই তো পড়ে থাকতে দেখেছে ও কতবার। কত সময় চলতি পথে চোখ পড়েছে ওদের দুমড়েমুচড়ে যাওয়া শরীরের ওপর। কিন্তু আগে বোঝেনি হৃদয়ে এমন কাঁপনও লাগে। একটা দুঃখ, একটা অপরাধবোধে মনটা ছেয়ে থাকল বাকি পথ। স্বামী-স্ত্রীতে আর তেমন কোনও কথাই হল না বাকি রাস্তাটুকু। মন বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে, রাতের হাইওয়েতে মনোযোগ রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
হতচ্ছাড়া র্যাকুন আর কাজই পেলি না, তোকে ওই মুহূর্তেই আসতে হল সামনে, একটু সাবধান হতেও শিখিসনি, এত কাল ধরে তোরা এইসব বিশাল তৃণভূমিতে জলাভূমিতে আছিস, রাস্তা দিয়ে কত গাড়ি যেতে-আসতে দেখিস, আর-্একটু সাবধানতাও তো শিখতে পারতি, এই মহাকালে কত জীবনের আনাগোনায়, কত পার্মুটেশন-কম্বিনেশনের যোগাযোগ যাতায়াতে, ওর হাতেই ছিল সেই র্যাকুনের মরণ, যত্তসব…
তারপর জীবনে আর যত জীবের নিঃসাড় শরীর দেখেছে রাস্তায়, ওই র্যাকুনটার কথা বিদ্যুৎ চমকের মত মনে পড়েছে ওর; কী একটা অসহায়ত্ব, কী একটু অনুশোচনা। একটা ক্ষুদ্র অজানা জীব রাতের অন্ধকারে যাকে দেখাই গেল না বলতে গেলে, তবু তার শরীরের ওজনের সমান ছোট্ট একটা কাঁপন গাড়ির শরীর হয়ে ওর নিজের শরীরেও এসে মিশেছিল। যেন এক অজানা তরঙ্গ বয়ে আসে জীবন থেকে আর-এক জীবনে, সময় থেকে আর-এক সময়ে। বিশ্বপ্রকৃতির এ কেমন বন্ধন, এ কেমন শক্তি…
কত বছর পর অস্ট্রেলিয়ায় একবার বাচ্চার স্কুলে, স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতর একবার ও দেখল, বালক-বালিকার একটা দল প্লাস্টিকের বাক্সে করে ইকোসিস্টেমের একটা ডেমো তৈরি করছে সায়েন্স প্রোজেক্টের জন্য। বাক্সে মাটি নিয়েছে, লতাপাতা নিয়েছে, ডালপালা দিয়ে বনবাদাড় বানিয়েছে, পাখি বানিয়েছে। ওরই মধ্যে এক অতিউৎসাহী বালক ফেন্সের ঝোপঝোড় থেকে অনায়াসে ছোট্ট একটা গিরগিটির বাচ্চা তুলে এনে বাক্সে পুরল। মুক্তির প্রবল আশায় গিরগিটি-শিশুর কী সে তিড়িংবিড়িং ধড়ফড়ানি। ডিম ফুটে বের হওয়ার পর যে গিরগিটি-শিশুর তার মাকে আর লাগেই না, সেই গিরগিটি-শিশু কি মানবশিশুর হাত থেকে মুক্তির জন্য সাহায্য চেয়েছিল মায়ের, ডেকেছিল, মা মা মা…
বালক-বালিকারা হয়তো সায়েন্স প্রজেক্ট শেষে আবার গিরগিটির বাচ্চাটাকে যথাস্থানে ফেরত দিয়েও যাবে, হয়তো দেবে না, হয়তো নিজেদের বাগানে ছেড়ে দেবে, হয়তো ইকোসিস্টমের ডেমোতে অভিনয় করতে গিয়ে গিরগিটি-শিশু তার প্রাণটাই হারাবে…
এইসব ভাবতে ভাবতে, দক্ষিণ গোলার্ধের এক ক্ষুদ্র গিরগিটির অস্থির ছটফটানি বহু বছর আগের উত্তর গোলার্ধের কোনও এক হাইওয়েতে ফেলে রেখে আসা সেই র্যাকুনের ছোট শরীরের ওজনের সমান কাঁপন চকিতে ওকে আবার মনে করিয়ে দিল যেন। জীবন, মৃত্যু, আনন্দ, বেদনা অতিক্রম করে করে বছরের পর বছর চলে গেছে। ও কত মানুষের নাম ভুলে গেছে, কত আত্মীয় ওর জীবন থেকে আপনাআপনি সরে গেছে, কত অনাত্মীয় আবার বন্ধু হয়ে উঠেছে, দেশের কত বন্ধু ওকে ভুলে গেছে, কত সময় চলে গেছে, কত স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে, কিন্তু সেই হাইওয়েতে রাতের নিস্তব্ধতায়, এক ঝলকায় যে প্রাণ একদিন হারিয়ে গেছে ওরই হাতে, আজ বহু বছর পরও চপল চঞ্চল সেই প্রাণীটির সাথে ক্ষণিকের দেখা, ছোট প্রাণের সেই বেদনার্ত ভয়, সেই সংক্ষিপ্ত মুহূর্ত বিনিময় এখনও কত প্রবল, কত জ্যান্ত হয়ে ফিরে আসে।
কী অসামান্য ছোট্র এই লেখাটি, ঐ রেকুন বা গিরগিটিটির মত আমায়ও কাঁপিয়ে দিয়ে গেল, টায়ারের শরীর বেয়ে সেই ধাক্কা উঠে এল আমার শরীরেও। কিন্তু ‘এই মহাকালে কত জীবনের আনাগোনায়, কত পার্মুটেশান-কম্বিনেশানের যোগাযোগ যাতায়াতে, ওর হাতেই ছিল সেই রেকুনের মরণ..’ তবু ‘ যেন এক অজানা তরঙ্গ বয়ে আসে জীবন থেকে আর এক জীবনে , সময় থেকে আর এক সময়ে, বিশ্বপ্রকৃতির এ কেমন বন্ধন, কেমন শক্তি…”
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, পড়ার ও মন্তব্যের জন্য! ভাল থাকবেন।