একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদ দিবস। ১৯৫২-র ওই দিনটিতে সালাম জব্বার রফিক বরকত শফিউর ভাষার জন্য শহিদ হয়েছিলেন। দীর্ঘ সংগ্রামশেষে, যার সূচনা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে, চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল ওইদিন। একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আমাদের জানাটা অসম্পূর্ণ, কেন না একুশের রক্তরাঙা তারিখটিতে পাঁচজনের বেশি লোকের মৃত্যু হয়েছিল। নানান সূত্র থেকে শহিদের সংখ্যার তারতম্য দেখতে পাই। সঠিকভাবে এখন আর প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা না গেলেও তা পাঁচজনের বেশি একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
সমসাময়িক পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, সেদিন সাতজনের মৃত্যু হয় এবং আহত হয়েছিলেন তিন শতাধিক। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৩-এ ফেব্রুয়ারি লেখা হয়েছিল ন’জনের মৃত্যুর খবর। বাহান্ন নিয়ে প্রথম কবিতা লেখেন চট্টগ্রামের লেখক-বুদ্ধিজীবী, মাসিক ‘সীমান্ত’ পত্রিকার সম্পাদক (পরবর্তীকালে তিনি ‘দৈনিক স্বাধীনতা’ পত্রিকা-ও সম্পাদনা করেন দীর্ঘ দশবছর) মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী। শরীরে জলবসন্তের অসুস্থতা নিয়ে একুশ তারিখেই রাত জেগে তিনি ভাষাশহিদদের নিয়ে যে কবিতাটি লিখেছিলেন (অসুস্থতাজনিত কারণে তিনি নিজের হাতে কবিতাটি লিখতে পারেননি। তিনি মুখে মুখে বলে গেছেন, বন্ধু ননী ধর তার শ্রুতিলিখন করেন), তার শিরোনাম ছিল ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। দু’দিন পরে ২৩/২-তে চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে প্রতিবাদসভায় কবিতাটি পাঠ করেছিলেন চৌধুরী হারুণ-উর রশীদ। কবিতার এক জায়গায় আছে, ‘চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর/ অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে/ আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত/ রামেশ্বর, আবদুস সালামের কচি বুকের রক্ত’। কবিতাটির আর-এক জায়গায় লিখছেন মাহবুব, ‘পাকিস্তানের প্রথম শহীদ/ এই চল্লিশটি রত্ন,/ দেশের চল্লিশ জন সেরা ছেলে—’।
চল্লিশ সংখ্যাটি হয়তো অতিকথন, দেশব্যাপী উৎকণ্ঠা-উদ্বেগের মধ্যে সাধারণত যা হয়ে থাকে। তবে ২৪-এ ফেব্রুয়ারিতে সর্বদলীয় কর্মপরিষদের পক্ষেও কিন্তু ৩৯ জন শহিদ হওয়ার কথা বলা হয়েছিল। একুশের অন্যতম ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক তাঁর ‘একুশ থেকে একাত্তর’ বইতে আরও তিনজন শহিদের নামোল্লেখ করেছেন,— আবদুল আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ এবং সিরাজুদ্দিন। অন্য এক বিখ্যাত ভাষাসৈনিক অলি আহাদ জানিয়েছেন আর-একটি তথ্য। বাইশে ফেব্রুয়ারি ভিক্টোরিয়া পার্ক, নবাবপুর ও বঙশালে নাকি পুলিশের গুলিতে অনেকে শহিদ হন।
লাল খান ছিলেন পাকিস্তানের এক নির্বাসিত রাজনৈতিক জননেতা। পেশায় চিকিৎসক এই মানুষটি আজীবন প্রতিবাদী আন্দোলন করে গিয়েছেন। বাহান্নো নিয়ে তাঁর লেখা রয়েছে ‘Pakistan’s Other Story : The 1968-69 Revolution’ নামে তৎপ্রণীত গ্রন্থে। এখানে তিনি উল্লেখ করেছেন ছাব্বিশজন শহিদের কথা। তবে সকলের নাম দেননি, এবং উৎস-ও জানাননি তথ্যের। তাছাড়া তিনি লেখেন, আন্দোলনে যোগদানকারী চার শতাধিক ব্যক্তি সেসময় আহত হন। একটি কৌতূহলকর তথ্য, পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলনে সংবেদনশীল লাল খান মারা-ও গিয়েছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারি (২০২০), তেষট্টি বছর বয়সে, ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে।
এসব তথ্যের মধ্য দিয়ে একটি সত্য অন্তত উঠে আসছে যে, ভাষা আন্দোলনে শহিদের সংখ্যা অবশ্যই পাঁচজনের বেশি। অবিসংবাদিতভাবে যে সাতজনের নাম পাই আমরা, তাঁদের সম্পর্কে কিছু তথ্য দেওয়া যাক।
১. রফিকউদ্দীন আহমদ। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে জন্ম, ৩০. ১০. ১৯২৬-এ। মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্রনাথ কলেজে বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। বাহান্নোর প্রথম শহিদ। ২০০০ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়া হয়।
২. আবদুল জব্বার। ময়মনসিংহের পাঁচুয়ায় জন্ম, ১৩. ০৮. ১৯১৯-এ। বিবাহিত ছিলেন। স্ত্রীর নাম আমেনা খাতুন। পনেরো মাসের একটি শিশুপুত্র ছিল, নাম নূরুল ইসলাম বাদল।
৩. আবদুস সালাম। ফেণির লক্ষ্মণপুরে ২৭. ১১. ১৯২৫-এ জন্মেছেন। চাকরি করতেন ডাইরেক্টর অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-এ, রেকর্ড কিপারের পদে। ২১-এ গুলিবিদ্ধ হলেও প্রায় দেড়মাস মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মারা যান উনিশশো বাহান্নোর সাতই এপ্রিল।
৪. শফিউর রহমান। ২৪. ০১. ১৯১৮-তে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলিতে জন্ম। তিনি ছিলেন শহিদদের মধ্যে সবচেয়ে বর্ষীয়ান। বিবাহিত ছিলেন। স্ত্রী আকিলা খাতুন। এক ছেলে ও এক মেয়ে, যথাক্রমে শফিকুল ও আসফিয়া। ১৯৯০-তে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
৫. আবুল বরকত। জন্ম ১৬. ০৬. ১৯২৭, (মতান্তরে ১৩. ০৬. ১৯২৭) বাবলা, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে এমএ পড়তেন। ১৯৬৩-তে যখন শহিদ মিনার নির্মিত হয় (একাধিকবার মিনারটির ভাঙাগড়ার ইতিহাস আছে, আমরা পরে দেখব), বরকতের মা হাসিনা বেগমকে দিয়ে মিনারটির উদ্বোধন হয়েছিল। ২০১২-তে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অর্থসাহায্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘বায়ান্নর মিছিলে’ নামে একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তাঁর জীবনী অবলম্বনে। নির্মাতা রোকেয়া প্রাচী। উল্লেখ্য, বায়ান্নর ভাষা-শহিদদের মধ্য একমাত্র আবুল বরকত-ই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
৬. আবদুল আউয়াল। ইনি একজন রিকশাচালক। জন্ম ১১. ০৩. ১৯৩৪, ঢাকার গেন্ডারিয়ায় থাকতেন। শহিদ হন বাইশে ফেব্রুয়ারিতে।
৭. মো. অহিউল্লাহ। ইনিও বাইশে ফেব্রুয়ারি শহিদ হয়েছিলেন। এঁর মৃতদেহ পুলিশ অপহরণ করে। আনুমানিক জন্মতারিখ ১১. ০৯. ১৯৪১। মাত্র এগারো বছরের বালক।
৮. অজ্ঞাত এক বালকের শহিদ হওয়ার কথা জানা যায় ২২. ০২-তে।
অন্তত এ-ক’জনের নাম নির্দিষ্টভাবে জানা গিয়েছে। বাকিরা সম্ভবত চিরকালের মতোই হারিয়ে গেছেন। বহু প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, অনেক মৃতদেহ পুলিশের হস্তক্ষেপে গায়েব হয়েছে।
বায়ান্নর ভাষা-শহিদদের মধ্যে দু’জন পশ্চিমবঙ্গের ভূমিপুত্র,— শফিউর ও বরকত। ১৯৬১-তে শিলচরের ভাষা আন্দোলনে যে এগারোজন শহিদ হন, সেখানকার একজন বাদে (সুকোমল পুরকায়স্থ। তাঁর জন্ম করিমগঞ্জে। পরে ডিব্রুগড়ে বাস করেন ব্যবসাসূত্রে) সবাই পূর্ববঙ্গের লোক। কেমন আশ্চর্য মনে হয় না? দেশভাগ একবার তাঁদের বাস্তুচ্যুত করল, আর মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম তাঁদের দেশত্যাগেই পরিসমাপ্ত হল না, প্রাণ নিয়ে ছাড়ল!
কেন্দ্রীয় শহিদমিনার
একুশের পরপর-ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে তুমল উদ্দীপনা জাগে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাপ্রকাশের। পুলিশের ধড়পাকড়, কারফিউ ও ওই টানটান উত্তেজনার মুহূর্তেও তাঁরা মিনার গড়ার সংকল্প নেন, এবং অবিলম্বে তার বাস্তবায়ন ঘটান। তেইশে ফেব্রুয়ারিতেই শুরু হয়ে যায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ, এবং রাতের মধ্যেই শেষ হয় দশফুট উচ্চতা ও ছ’ফুট প্রস্থের শহিদমিনার। তদারকিতে ছিলেন এঞ্জিনিয়ার জি এস শরফউদ্দীন, আর এর নকশাটি ছিল বদরুল আলম-এর। সহযোগীরূপে ছিলেন সাঈদ হায়দার। দু’জন রাজমিস্ত্রির সহায়তায় রাতারাতি তৈরি হল মিনার, আর পরদিন-ই, অর্থাৎ চব্বিশে ফেব্রুয়ারি শহিদ শফিউরের পিতাকে দিয়ে অনানুষ্ঠিকভাবে উদ্বোধন করা হয় শহিদমিনারের। দু’দিন পরে ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারিতে— ‘দৈনিক আজাদ’-এর সম্পাদক আবুল কালাম শামসউদ্দীন আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেন। পাকিস্তানি পুলিশ ওই দিন-ই শহিদমিনারটি ভেঙে ফেলে। ইতিমধ্যে ঢাকা কলেজেও একটি শহিদমিনার নির্মিত হয়েছিল। সেটির নিয়তিও আগেরটির মতো ঘটে।
১৯৫৬-তে শেরে বাংলা ফজলুল হকের ও আওয়ামী লীগের উৎসাহ-উদ্দীপনায় একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয়। শহিদমিনারের কাজ পুনরায় শুরু হয়। মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে শহিদ রিকশাচালক আওয়ালের সাতবছরের কন্যা বসিরন। কিন্তু ১৯৫৮-তে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন শুরু হলে মিনারের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে ১৯৫৬-তেই কিন্তু উর্দুর সঙ্গে বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয় পাকিস্তান সরকার।
১৯৬৩-তে পুনরায় মিনারের কাজ শুরু হয়। স্থপতি হামিদুর রহমান। ১৯৫৬-র কাজ এইভাবে শেষ হতে হতে ১৯৬৩ গড়িয়ে গিয়েছিল। হামিদুরকে সহায়তা দেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি নভেরা আহমেদ। নভেরাকৃত দু’টি ম্যুরাল মিনারে স্থান পাওয়ার কথা থাকলেও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা, তা স্থান পায়নি। তাছাড়া হামিদুর-পরিকল্পিত স্তম্ভগুলির মাপ পরিবর্তন করেন তৎকালীন পাকিস্তানের স্থাপত্যবিষয়ক উপদেষ্টা জাঁ দেলোরা। হামিদুর-পরিকল্পিত স্তম্ভের উচ্চতা ছেচল্লিশ ফুট বা চৌদ্দ মিটার ঠিক-ই থাকে।
একাত্তরে আবার নিহত হল শহিদমিনার। গড়ে উঠল আবার ১৯৭২-এ, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মলাভের পর। শহিদমিনার যেন এক আগুনপাখি, বারবার ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির মতো জেগে ওঠে।
ভাষা-আন্দোলনের আলোচনাপ্রসঙ্গ হামিদুর রহমান এবং নভেরা আহমেদের পরিচয়প্রদান ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। আমরা এখন সেটা জানব।
হামিদুর রহমান (১৯২৮-১৯. ১১. ১৯৮৮) বাংলাদেশের স্বনামখ্যাত চিত্রশিল্পী। প্রাথমিক শিল্পশিক্ষা ঢাকা আর্টস স্কুলে, এখন যা চারুকলা ইনস্টিটিউট। চিত্রশিল্পের জন্য বাংলাদেশের প্রথম বিদেশগামী শিক্ষার্থী তিনি। প্যারিস ও লন্ডনে শিল্পশিক্ষা, যথাক্রমে ইকোল দ্য বোজ আর্টস এবং সেন্ট্রাল স্কুল অফ আর্টস অ্যান্ড ডিজাইন-এ। পরে গবেষণার্থে যান পেনসিলভেনিয়া একাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ। তাঁর মতো গুণী চিত্রশিল্পীর দায়িত্ব ছিল শহিদ মিনার নির্মাণের। প্রসঙ্গত, তাঁর অপর দুই ভাই-ও স্বনামখ্যাত। এক ভাই সাঈদ আহমেদ ছয়ের দশকে ইংরেজিতে ‘The Thing’ নামে অ্যাবসার্ড নাটক লেখেন। নাট্যকার ও সঙ্গীতশিল্পী। আমেরিকায় রবিশঙ্করের দলে সেতার বাজিয়েছেন। অপর ভাই নাজির আহমেদ ছিলেন চলচ্চিত্রনির্মাতা ও বিখ্যাত বেতারব্যক্তিত্ব, বিবিসি-র প্রথম বাঙালি কর্মী।
নভেরা আহমেদ (২৯. ০৩. ১৯৩৯-০৬. ০৫. ২০১৫) প্রতিভাময়ী ভাস্কর। পড়াশোনা কলকাতার লোরেটো। পরে ভাস্কর্যের পাঠ নেন প্যারিস, লন্ডন ও ফ্লোরেন্স-এ। বিমূর্ত নারীমূর্তির ভাস্কর্য তাঁকে বিশিষ্ট করেছে। শহিদমিনারে তাঁর করা ম্যুরাল স্থান পাবে কথা ছিল। দুর্ভাগ্য, শেষপর্যন্ত তা হয়নি, যদিও এ-জন্য তাঁর শিল্পীখ্যাতি ম্লান হয়নি। তাঁকে নিয়ে ১৯৯৫-তে হাসনাত আবদুল হাই ‘নভেরা’ নাম দিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। ‘ন হন্যতে’ নামে ১৯৯৯-তে তাঁর জীবনীভিত্তিক প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। পূর্ববঙ্গে প্রথম তাঁর একক প্রদর্শনী হয়,— এটিও স্মরণীয়। একুশে পদক পান ১৯৯৭-তে। জাতীয় জাদুঘরের একটি হল তাঁর নামে। বাংলা একাডেমির একটি হলের নাম ‘নভেরা হল’। কেবল শহিদমিনারের ক্ষেত্রেই তিনি কাব্যে উপেক্ষিতা হয়ে রইলেন!
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো
একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে আবদুল গাফফার চৌধুরীর (১২. ১২. ১৯৩৩-১৮. ০৫. ২০২২) লেখা এই গানটি ওতপ্রোত হয়ে আছে। গানটি রচনার সময় তিনি ঢাকা কলেজের ছাত্র। ইন্টারমিডিয়েট পড়ছিলেন। বয়স উনিশ মাত্র। তাই বলা যায়,— ‘বালক বীরের বেশে তুমি করলে বিশ্ব জয়’। বিশ্ব জয়-ই তো বটে, কেননা আজ সারা বিশ্বের যত বাঙালি, এ-গান সকলের কণ্ঠস্থ। পৃথিবীর বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে গানটি। বিবিসি-র এক জরিপে শ্রেষ্ঠ কুড়িটি বাংলা গানের তালিকায় এ-গানটির স্থান তৃতীয়। প্রথমটি ‘আমার সোনার বাংলা’।
আগেই জানিয়েছি, ঢাকা কলেজেও তৈরি হয়েছিল শহিদমিনার। সেখানকার ছাত্ররা মিনার ঘিরে গানটি গেয়েছিলেন। এ-গানটিতে প্রথমে সুর দেন আবদুল লতিফ। পুরো গানটি বেশ বড়। আপেল মাহমুদ ও সহশিল্পীদের কণ্ঠে পুরো গানটির রেকর্ড বেরিয়েছিল। বর্তমানে সংক্ষেপিত আকারে পরিবেশিত হচ্ছে গানটি। গানটি এখন যে সুরে গাওয়া হয়, তার সুরকার আলতাফ মাহমুদ। ১৯৫৪-তে তিনি গানটিতে নতুন করে সুর দেন। একাত্তরে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকসৈন্যরা।
এ-গানটি গাইবার অপরাধে ঢাকা কলেজের এগারোজন ছাত্র বহিষ্কৃত হন।
আবদুল গাফফার চৌধুরী উপমহাদেশের নমস্য সাংবাদিক। সারাজীবন ধরে কত দৈনিক-সাপ্তাহিক-মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করে গেছেন, তা হাতে গুনে বলা দুরূহ। ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদী-সহ অনেক। আবার একাত্তরে যখন তিনি কলকাতায়, আনন্দবাজার ও যুগান্তরে কলাম লিখতেন। জীবনের শেষপর্বে দীর্ঘদিন লন্ডনে বাস করার সময় বাংলাদেশের বহু দৈনিকে লিখেছেন, কলকাতা থেকে তখন সদ্য-প্রকাশিত ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’ (বাংলা)-এও লিখেছেন অক্লান্ত। ১৯৭৪ থেকে তাঁর বিলেতবাসপর্বে তিনি সম্পাদনা করে গেছেন ‘বাংলার ডাক’ (১৯৭৬, সাপ্তাহিক), সাপ্তাহিক ‘জাগরণ’ (এখানে চাকরি করতেন তিনি), ‘নতুন দিন’ (১৯৮৭), ‘নতুন দেশ’ (১৯৯০), ‘পূর্বদেশ’ (১৯৯১)। একদা গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, গান লেখেননি আদৌ। মাত্র একটি গানের দৌলতেই বিখ্যাত হয়ে আছেন তিনি আপামর বাঙালির হৃদয়ে।
একুশ ও বাংলা কবিতার জোয়ার
একুশের অলৌকিক ভোর কী সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া নিয়েই না এসেছিল! একুশকে নিয়ে গান রচিত হল, তাৎক্ষণিকভাবে লেখা হল কবিতার পর কবিতা, হাসান হাফিজুর রহমান ১৯৫৩-তে বের করলেন একুশের গদ্যপদ্য সংকলন। আর মুনীর চৌধুরী ভাষা-আন্দোলনে জেলবাসের অবকাশে লিখলেন ভাষাশহিদদের নিয়ে নাটক ‘কবর’। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাহানারা আক্তার তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘বাংলাদেশের নাট্যপ্রবাহ : স্মরণীয় পদক্ষেপ’-এ জানান, অন্য কারাবন্দি রণেশ দাশগুপ্ত চেয়েছিলেন, ১৯৫৩-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে তাঁরা কারাগারে অভিনয় করবেন ভাষাশহিদদের নিয়ে একটি নাটক। তিনি মুনীর চৌধুরীকে বলেন একটি নাটক লিখতে। রামেন্দু মজুমদার জানিয়েছেন, সতেরোই জানুয়ারির মধ্যে লেখা হয়ে গেল নাটক। ফণী চক্রবর্তীর পরিচালনায় হ্যারিকেনের আলোয় কারাগারেই অভিনীত হল ‘কবর’।
একুশের প্রথম নাটক কিন্তু লেখা হয় চট্টগ্রামে। যেমন মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী একুশের সর্বপ্রথম কবিতার রচয়িতা, তেমনি চট্টগ্রামের আজিজুর রহমান, ‘ভাষা আজিজ’ নামেই যিনি সমধিক পরিচিত, নাটক লেখেন ‘ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা’ নামে, মুনীর চৌধুরীর-ও আগে। এবং তা ওখানকার জে এম সেন হলে মঞ্চস্থ হয়। ১৯৫১-তে আসকার ইবনে শাইখ-এর ‘দুর্যোগ’ নাটকে ভাষা আন্দোলনের ইঙ্গিত আছে, আর তাঁর চুয়ান্নতে লেখা ‘যাত্রা’ নাটক তো ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেই লেখা। মিলন চৌধুরীর পথনাটক ‘যায় ফাগুনের দিন’ মনে পড়বে আমাদের।
একুশ নিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে অনেক পরে। জহির রায়হান চেয়েছিলেন একুশে নিয়ে ছবি বানাতে। পারেননি। তবে তাঁর ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রটিতে একুশের যথেষ্টই ছোঁয়া আছে। তাঁর একুশ নিয়ে উপন্যাস আছে। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ এবং ‘আরেক ফাল্গুন’। আবু রুশদ-এর ‘নোঙর’, সেলিনা হোসেনের ‘যাপিত জীবন’, আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’ অনবদ্য! রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘একুশের গল্প’ প্রতিনিধিত্বের দাবি রাখে।
রশীদ-মহিউদ্দীনের সংকলনে আনিসুজ্জামান দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি ও আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা’। গল্প রয়েছে গাজীউল হক এবং ফারুক মোজাম্মেলের। গান আছে তোফাজ্জল হোসেনের, ‘শহীদী খুন ডাক দিয়েছে/ আজকে ঘুমের ঘোরে/ আজ রক্তপথের যাত্রী মোরা,/ নতুন আলোর ভোরে/ ভেঙ্গে ঘুমের স্বপ্ননীল/ এক মিছিলে হও সামিল/ এগিয়ে চলেই হানবো আঘাত/ নতুন যুগের দোরে’। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তারিক সুজাত তোফাজ্জল হোসেনের পুত্র।
তবে কবিতার জোয়ার নামে একুশকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি, যার স্রোত এত বছর পরে আজ-ও অব্যাহত। হাজার হাজার কবিতা লেখা হয়েছে একুশ নিয়ে, মনে হয় লক্ষাধিক। নিতান্ত সংক্ষেপে কয়েকজন কবি ও তাঁদের একটি করে কবিতার নাম করা যাক।
১. শামসুর রাহমান : অভিশাপ দিচ্ছি,
২. আল মাহমুদ : একুশের কবিতা,
৩. শহীদ কাদরী : একুশের স্বীকারোক্তি,
৪. আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্ : কোনো এক মাকে,
৫. সৈয়দ শামসুল হক : একুশের কবিতা,
৬. রফিক আজিদ : পঞ্চানন কর্মকার,
৭. আলাউদ্দীন আল আজাদ : স্মৃতিস্তম্ভ,
৮. নির্মলেন্দু গুণ : আমাকে কী মূল্য দেবে দাও,
৯. মহাদেব সাহা : একুশের কবিতা,
১০. হুমায়ূন আজাদ : বাংলাভাষা।
প্রতিবছর একুশে পদক দেওয়া হয় দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুণী মানুষদের এবং নানা প্রতিষ্ঠানকে। ২০২৩-এ উনিশজন পেলেন এই পদক, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন ড. মণিরুজ্জামান, শিমূল ইউসুফ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, কনকচাঁপা চাকমা প্রমুখ।
একুশ নিয়ে সংকলনগ্রন্থ বেরিয়েছে এ পর্যন্ত দু-হাজারের ওপর। ভাবা যায়!
‘যেখানে তোমরা প্রাণ দিয়েছো/ সেখানে হাজার বছর পরেও/ সেই মাটি থেকে তোমাদের রক্তাক্ত চিহ্ন/ মুছে দিতে পারবে না সভ্যতার কোনো পদক্ষেপ’। হ্যাঁ, কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর মতো আমরাও তা বিশ্বাস করি।
বাহান্ন, স্বাধীনতা, বিজয়দিবস ও অন্যান্য
আজকের বাংলাদেশ বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনের শুদ্ধ ও অন্তিম ফসল। বিলকুল ভুল হয়ে গিয়েছিল পূর্ববঙ্গের মুসলিম নেতাদের, ১৯৩৭-এর লাহোর প্রস্তাবকে কূটনৈতিকভাবে যখন মুসলমানদের জন্য আলাদা দু’টি রাষ্ট্রের পরিবর্তে একটি রাষ্ট্র বানিয়ে ফেললেন জিন্নাহ্। জন্ম থেকেই পূর্ব-পাকিস্তান বলিপ্রদত্ত হয়ে রইল পশ্চিম-পাকিস্তানের কাছে। পশ্চিম-পাকিস্তান নির্মম শোষণ শুরু করল গোড়া থেকেই। রাষ্ট্রভাষা চাপাতে চাইলেন জিন্নাহ্। মুহূর্তেই প্রতিবাদ। ১৯৪৮ থেকে ৫২ পর্যন্ত মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম বাহান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারির জন্ম দিল।
এর আগে থেকেই বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষাপ্রীতির নজির আছে ১৯৩৭-এ। অবিভক্ত বাংলায় যখন বিধানসভা গঠিত হল, ইংরেজির পরিবর্তে বাংলাতেই পরিচালিত হত সেখানকার কার্যক্রম। হ্যাঁ, মুসলিম বিধায়কদের অনেকেই ইংরেজি জানতেন না বলেই হতে পেরেছিল সেটা। কিন্তু হতে তো পেরেছিল।
বাহান্নর ভাষা আন্দোলন দেখিয়ে দিল, লড়াই যদি গভীরপ্রোথিত হয়, জয় তাতে সুনিশ্চিত। এত অল্প প্রাণদানের বিনিময়ে এমন যুগান্তকারী সাফল্য পৃথিবীতে নজিরবিহীন।
এর-ই গতিজাড্যে বছরের পর বছর লাগাতার, অনিঃশেষ ও মরিয়া মনোভাব স্বাধীনতা আন্দোলনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিল বাংলাদেশের মানুষকে। অবশ্য তার পেছনে রয়েছে সূর্যসনাথ এক প্রোজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের প্রভা ও ম্যাজিক রিয়ালিটি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ম্যাজিক রিয়ালিটি ছাড়া আর কী-ই বা বলা যাবে একে, বঙ্গবন্ধুর অলৌকিক নেতৃত্ব আর দেশপ্রেমকে? তিনি ডাক দিলেন যার যা কিছু আছে সব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে, আর অমনি, হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা যেন তিনি, সকলে ঢালতরোয়ালহীন লাফিয়ে পড়লেন সংগ্রামে! মোজেজা ছাড়া আর কী? দেশনেতার প্রতি সার্বিক আনুগত্য ছাড়া আর কী?
প্রতিবছর মার্চ মাসের সাত তারিখ ঘিরে যে উত্তেজনা, পঁচিশ ও ছাব্বিশে মার্চ নিয়ে বা ষোলোই ডিসেম্বর নিয়ে, তা দেখার সুযোগ হয়েছে অনেকবার। মনে হয়েছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পঞ্চাশ বছর পার হল, এখনও উত্তেজনা-উন্মাদনা-উৎসবানুষ্ঠান কেন দেশজুড়ে? মনে আছে, ভারত স্বাধীন হওয়ার পঁচিশ বছর পূর্তিতে শেষবারের মতো দেশবাসী আনন্দে মেতেছিল। ১৯৭২-এ সারারাত ট্রামবাস চলেছিল রাস্তায়, যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার স্বাদ তারপর উল্লেখযোগ্যভাবে আর পাইনি। বাংলাদেশের মানুষ পঞ্চাশ বছর স্বাধীনতা ভোগ করেও এই উদযাপনের কৌলিন্য ধরে রাখে কী করে? রাখে, তার কারণ এ যে তার এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা! তাই ‘সদা ভয় হয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে’! ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রেও কম মানুষকে রক্তাক্ত দক্ষিণা দিতে হয়নি, কিন্তু তা হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। ন’মাসে তিরিশ লক্ষ লোকের মৃত্যু ও দু’লক্ষ নারীর সম্ভ্রমহানির মতো অভিঘাত নিয়ে আসেনি তাই।
কেবল যে ঐতিহাসিক দিনগুলোকে স্মরণ করে বাংলাদেশ, তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশের মানুষের ঐতিহ্য-সচেতনতা বহু ব্যাপক। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ তো বটেই, বিখ্যাত কোনও বাঙালির জন্মদিন পালিত হয় সোৎসাহে কোনও না কোনও তরফে। খবরের কাগজ পড়ে জানতে পারি, আজ জয়নুল আবেদিন বা সৈয়দ আবুল মকসুদের জন্মদিন, বা জহির রায়হান, শওকত ওসমান, বেগম সুফিয়া কামাল বা আনোয়ার পাশার মৃত্যুদিন। এমন বাঙালি, যিনি পশ্চিমবঙ্গের, তাঁদের জন্মদিন-মৃত্যুদিন পর্যন্ত খবরের কাগজে উল্লিখিত হয়, তাঁদের নিয়ে লেখা বেরোয়, যা পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক পত্রিকাতেও থাকে না। এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশের মানসে শিকড়সন্ধান কতটা ব্যাপ্ত ও গভীর। যেসব বাঙালি পূর্ববঙ্গে জন্মে পরে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হয়েছেন, তাঁদের নিয়ে অহংকার করতে ছাড়েন না তারা। ঋতুপর্ণ ঘোষ, শাঁওলী মিত্র, এমনকি মৃণাল বসু চৌধুরীর মৃত্যুসংবাদ-ও এখানকার জাতীয় দৈনিকে গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়।
বাঙালি ও মুসলমান, এই দুইয়ের সাজুয্যে এখানকার মানুষ ইতিহাসচেতনা পেয়েছেন। উপমহাদেশের মানুষের ইতিহাস-সচেতনতা ছিল না। ভারতে মুসলিমদের আগমনের পর ইতিহাস রচিত হতে থাকে। তার আগে ও সমসাময়িককালে গ্রিক বা চিনাদের হাতে রচিত হয়েছে ভারতবর্ষের ইতিহাস। লিখেছেন খাওয়ারিজমের (উজবেকিস্তান) আল বেরুণী, লিখেছেন মরক্কোবাসী ইবন বতুতা, ভেনিসের মার্কো পোলো, তিব্বতী তারনাথ। ভারতীয়দের রচিত ইতিহাস কিংবদন্তি ও অতিশয়োক্তিবহুল।
মুসলমানদের মধ্যে যে ইতিহাসবোধ, তা গড়ে উঠেছিল ইসলামের প্রবর্তক হজরত মহম্মদ (স.) থেকেই। সাহাবারা অনুপুঙ্খ যত্ন নিতেন ইতিহাসরচনা ও তা সংরক্ষণের। এর-ই ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করি বাগদাদকে কেন্দ্র করে জ্ঞানচর্চা শুরু মাধ্যমে। এটা ছিল বাগদাদী রেনেসাঁর যুগ। মোঙ্গল নেতা হালাকুর হাতে বাগদাদের পতন হলে মিশর হয়ে ওঠে আব্বাসীয় শাসনের কেন্দ্রবিন্দু। জ্ঞানচর্চা বৃদ্ধি পায় এখানকার আজহার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে।
আব্বাসীয় সুবর্ণযুগ দর্শন বিজ্ঞান সাহিত্যে যেমন, ঠিক তেমন-ই ইতিহাসরচনাতেও অভিনবত্ব দেখিয়েছে। তার-ই পরিণতি ইবনে খলদুন। বাগদাদ রেনেসাঁর অনুপুঙ্খ ইতিহাস লিখে রেখে গেছেন যেমন আবু নওয়াজ, তেমনি পরবর্তীকালে খলদুনের সাহসী প্রকল্প ছিল বিশ্বইতিহাস রচনা। চতুর্দশ শতকে বসে তিনি আত্মজীবনী লিখছেন, ভাবা যায়!
ঐতিহাসিকদের মধ্যে বালাদুরি, হালাদান, মাসুরি বা তাবারির ভূমিকাও অশেষ। এই ইতিহাসচেতনা-ই সুলতানি আমলে ও মুঘলযুগে ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুসলিম ঐতিহ্য, পরম্পরা। মুঘল-পাঠান আমলে, সুলতানি আমলে যে আমীর খসরু, বদায়ুনি, আবুল ফজল-সহ অসংখ্য ঐতিহাসিকদের পাই, তা এই পরম্পরাবাহিত। তাই বাবর, জাহাঙ্গীর বা জাহানারার আত্মজীবনীরচনা আকস্মিক নয়। আজ যে বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারি জুড়ে ভাষার মাস, বা গোটা মার্চ, আগস্ট ও ডিসেম্বর ধরে যথাক্রমে স্বাধীনতা, শোক ও বিজয়ের মাস, তা পালনের যথার্থতা এখানেই। আগস্ট জুড়ে বঙ্গবন্ধুর জন্য শোক, হবে না? বাঙালি তাঁর নিহত হওয়ার বেদনায় যে আজীবন-ই অশ্রুভারাতুর! যিশুহত্যার বেদনা ঠিক যেমন একজন খ্রিস্টানের আমৃত্যু।
পরিশিষ্টবচন
বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে নারী।
একুশের ভাষা আন্দোলনে নারীদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল, যদিও তা বিশেষভাবে আলোচনায় আসে না। উপেক্ষিত এই দিকটি নিয়ে আলোকপাত করা যাক। আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল নিম্নরূপ:
১. পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে প্রথমে মেয়েরাই ব্যারিকেড ভাঙেন, একথা আগেই বলা হয়েছে। জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসে ঘটনাটির উপস্থাপনা রয়েছে।
২. মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রীদের অনেকেই সেদিন পুলিশের লাঠিচার্জে আহত ছাত্রদের চিকিৎসা করেন।
৩. ছাত্রীরা বহু ছাত্রকে পুলিশের তাড়া খাওয়া থেকে বাঁচাতে লুকিয়ে রাখার দায়িত্ব নেন।
৪. ছাত্রীদের আরও মহনীয়তা হল, আন্দোলন পরিচালনার অর্থ যোগান দিতে কেউ কেউ তাঁদের অলঙ্কার খুলে দিয়েছিলেন।
৫. ছাত্রদের মতোই ছাত্রীরাও জেল খাটেন। ঢাকায় ও অন্য জেলায়।
৬. মিছিল, মিটিং, পোস্টারিং, পুলিশের নির্যাতন সহ্য করার মধ্য দিয়ে ছাত্রীরাও একুশে ফেব্রুয়ারিতে নিজেদের অবদান কম রাখেননি।
৭. ভাষা আন্দোলন বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলেও এর সূচনা ১৯৪৭-এ। নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষাসম্মেলনে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষারূপে ব্যবহারসহ প্রচারমাধ্যম ও কলেজ-বিদ্যালয়ে একমাত্র উর্দুকেই ব্যবহার করার প্রস্তাব আনা হয়। মুদ্রা ও ডাকটিকিট থেকে প্রত্যাহৃত হয় বাংলা লিপি। এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯৪৭-এর আটই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের যে বিশাল সমাবেশ হয়েছিল, তাতে ছাত্রীদের যোগদান-ও ছিল ব্যাপক। এ ঘটনার কিছু আগে ১৯৪৭-এর ১৭ নভেম্বর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার অনুরোধ নিয়ে যে স্মারকলিপি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের কাছে পেশ করা হয়, সেখানে সই করেছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল, ‘জয়শ্রী’ পত্রিকার সম্পাদক লীলা নাগ, আনোয়ারা চৌধুরী প্রমুখ। ছিলেন অধ্যাপক হালিমা খাতুন, প্রতিভা মুৎসুদ্দী, শিক্ষাবিদ রওশন আরা বাচ্চু।
৮. ১৯৪৮-এর একত্রিশে জানুয়ারি। ঢাকার বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় সভা। সেখানে ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন বক্তৃতা দিতে গিয়ে এমন কথা বলেন যা কোনও পুরুষকণ্ঠ-ও উচ্চারণের সাহস দেখাননি, ‘বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি স্বীকার করিয়ে নেবার জন্য প্রয়োজন হলে মেয়েরা তাদের রক্ত বিসর্জন দেবে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তেও এর সমর্থন মেলে। ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ ছাত্রকর্মীরা ইডেন ভবন ও অন্যান্য স্থানে পিকেটিং-এর সময় পুলিশ যে লাঠিচার্জ করে, তাতে বাধা দিতে গিয়ে ছাত্রীদের-ও আহত হতে হয়। বঙ্গবন্ধু লিখছেন— ‘যে পাঁচদিন আমরা জেলে ছিলাম, সকাল দশটায় স্কুলের মেয়েরা (মুসলিম গার্লস স্কুল) ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হত না’।
৯. ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে এসে এক অসামান্য ট্র্যাজেডি নেমে এসেছিল নারায়ণগঞ্জের মমতাজ বেগমের। তাঁর স্বামী তাঁকে এজন্য তালাক দেন। মমতাজ বেগমের ছাত্রী ইলা বক্সী, বেণু কর, শাবানাকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করে। অন্যদিকে সিলেটের এক গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী সালেহা বেগম ভাষাশহিদদের স্মরণে (১৯৫২) স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলন করলে জেলাপ্রশাসক তাকে তিন বছরের জন্য স্কুল থেকে বহিষ্কার করেন।
অনুরূপভাবে গাইবান্ধার বেগম দৌলতুন্নেছা, যশোরের হামিদা রহমান, সিলেটের জোবেদা খাতুন, চট্টগ্রামের তৌহফাতুন্নেছা আজিম, সৈয়দা হালিমা, সুলতানা বেগম, খুলনার আনোয়ারা বেগম, রংপুরের নিলুফা আহমেদ, বেগম মালেকা আশরাফ, আফতারুন্নেছা, রাজশাহীতে ড. জাহানারা বেগম বেণু, মনোয়ারা বেগম বেণু, ড. মহসীনা বেগম ও আরও অনেকে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। বায়ান্ন-পরবর্তী পর্যায়ে, ১৯৫৫-তে একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করে লায়লা নূর, প্রতিভা মুৎসুদ্দী প্রমুখ গ্রেপ্তার হন।
সংক্ষেপে মাতৃভাষা আন্দোলনে যেটুকু বলা হল, তাতে ওই আন্দোলনে মেয়েদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই।
তথ্যসমৃদ্ধ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিবেদন। ভালো লেগেছে বেশ 🌿
এতাবৎ জানা একুশের শরীরে এতগুলো পরত জুড়ে গেল যে লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞ না হয়ে পারছি না। আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।