Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বিপ্লবীদের ব্যায়াম শিখিয়েছেন ‘আয়রনম্যান’ নীলমণি দাশ

গোপনে বিপ্লবীদের ব্যায়াম শিক্ষা দিতেন তিনি। পাশাপাশি বাঙালির শরীরচর্চার আদি যুগের পূর্বপুরুষ ‘আয়রনম্যান’ নীলমণি দাশ। তাঁর এই ‘আয়রনম্যান’ উপাধি পাওয়া মালদা থেকেই। বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাসের প্রিয় শিষ্যকে এই উপাধি দিয়েছিলেন মালদারই স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব মোহান্ত বলদেবানন্দ গিরি। গিরিদের হাভেলির সামনের মাঠে নানা সময় নিয়মিত চর্চা হয়েছে লাঠি ও তলোয়ার চালনা। গোপনে চলেছে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের শিক্ষা। লক্ষ্য একটাই: ব্রিটিশ তাড়াতে হবে। সেই ইতিহাসও আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে।

‘‘তোমাকে আমার সঙ্গে মালদা যেতে হবে’’— আমহার্স্ট স্ট্রিটের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঢাকা অনুশীলন সমিতির প্রাণপুরুষ এবং বঙ্গীয় ব্যায়াম সমিতির প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস প্রস্তাবটা সরাসরি ছুড়ে দিয়েছিলেন চব্বিশ বছরের তরতাজা তরুণ নীলমণি দাশের দিকে। বিখ্যাত ব্যায়ামবীর মেজর ফণীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্তর প্রিয় শিষ্য তরুণ নীলমণি দাশের লাঠিখেলার শিক্ষক ছিলেন পুলিনবিহারী। কাজেই এ তাঁর কাছে গুরুর আদেশ। সালটা ১৯৩৫।

যে ব্যায়ামাগারের সঙ্গে আজীবন যুক্ত ছিলেন নীলমণি দাশ, সেই সিমলা ব্যায়ামাগারের প্রবীণ সদস্য অমল বসুর লেখা থেকে জানা যায়, স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ মালদায় ছেলেকে ছাড়তে রাজি হচ্ছিলেন না পিতা নিবারণচন্দ্র দাশ। বিপ্লবী পুলিনবিহারী স্বয়ং দেখা করে দেখা করে অনুমতি আদায় করেন তাঁর থেকে। বলেন, ‘‘মালদায় অনেক কিছু শেখার আছে।’’

বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস।

১৯৩৫-এ হিন্দু প্রাদেশিক মহাসভার সম্মেলন হয় মালদায়। গিরি সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের উদ্যোগে দুদিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানে সূচনা হিসাবে ব্যায়াম এবং লাঠিখেলা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিলো। দু-তিনজন শিষ্যসহ পুলিনবিহারী এবং নীলমণি ওঠেন মালদা কোর্ট স্টেশন সংলগ্ন গিরিদের ধর্মশালায়। সেই ধর্মশালা এখন ভগ্নপ্রায়। তারপর সেখান থেকে জুবিলি রোডের কাছাকাছি আইনজীবী উপেন্দ্রনাথ মৈত্রের বাড়িতে অনুষ্ঠানের দিন সকালে প্রস্তুতির জন্য আসেন তাঁরা। শোনা যায়, জুবিলি রোড সংলগ্ন মাঠকে সে সময়ে বলা হত খোলা মাঠ।

জুবিলি রোডের খোলা মাঠে সেদিন নক্ষত্র সমাবেশ। কে নেই? আচার্য বিনয়কুমার সরকার, বিধুশেখর শাস্ত্রী, ‘শনিবারের চিঠি’-র বিতর্কিত সম্পাদক সজনীকান্ত দাস, সাহিত্যিক আশুতোষ লাহিড়ী এবং সর্বোপরি হিন্দু মহাসভার সভাপতি এবং ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিউ’-এর প্রখ্যাত সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। শোনা যায়, রবীন্দ্র-ঘনিষ্ঠ রামানন্দকে মৌখিক শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সর্বসম্মতিক্রমে মালদার সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত হন গিরি সম্প্রদায়ের প্রধান মোহান্ত বলদেবানন্দ গিরি মহারাজ।

বলদেবানন্দ গিরি।

মালদা থেকে প্রকাশিত ‘গৌড়দূত’ সম্পাদক লালবিহারী মজুমদারের রচনা থেকে জানা যায়, উদ্বোধনের মঞ্চের উপর ঘটে এক অদ্ভুত ঘটনা। ছয় জন বাহকের কাঁধে একটি সুদৃশ্য পালকিতে করে সভাস্থলে আসেন বিশালদেহী সন্ন্যাসী বলদেবানন্দ গিরি মহারাজ। পালকিতে করেই মঞ্চে ওঠার পর পালকির লাঠি দুটি খুলে নিয়ে সিংহাসনের মত করে মঞ্চে বসিয়ে দেয়া হয় তাঁকে। গিরিদের রেওয়াজ অনুসারে ছয়জন বলিষ্ঠ পালকিবাহক সেই লাঠি হাতে ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর ভূমিকায় সারাদিন মঞ্চের ওপর ছিলেন। গবেষক বাণীব্রত চক্রবর্তীর ‘লৌহমানব নীলমনি দাশ’ বইতেও এই ঘটনাটির উল্লেখ আছে।

বিপ্লবী পুলিনবিহারীর পরিচালনায় লাঠিখেলার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। প্রথমে বড় লাঠির খেলা, তারপর দুহাতে দুটি ছোট লাঠি নিয়ে লড়াই। উল্লেখ্য, পুলিনবিহারী এই ছোট লাঠির খেলাতেই প্রায় কিংবদন্তি ছিলেন। তারপর তলোয়ার ও ছোরা খেলা। পরবর্তীকালে পুলিনবিহারী তাঁর বিতর্কিত বই ‘লাঠিখেলা ও অসিশিক্ষা’-য় এই কৌশলগুলি সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে লিখেছেন।

প্রায় এক ঘণ্টা ধরে অস্ত্রের প্রদর্শনীর কৌশল চলে। এইসব প্রদর্শনীর মধ্যেই চলে তরুণ নীলমণির দেহসৌষ্ঠব প্রদর্শনী। উপস্থিত জনতার তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে নীলমণি মঞ্চের উপরেই কাঁধের চাপে রেললাইনের টুকরো বাঁকিয়ে দেখান, দেখান ওয়েটলিফটিং ও বিম ব্যালান্সিং-এর খেলা। মঞ্চের উপর উঁচু লোহার স্ট্যান্ডে রাখা ছিল বেশ কয়েকটি জ্বলন্ত আগুনপূর্ণ লোহার কড়াই। তাদেরকে সুকৌশলে এড়িয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলে এই লাঠি, ছোরা ও শারীরিক কৌশলের প্রদর্শনী। লাঠির আঘাতে দু-একবার আগুন ছিটকে এসে লাগে নীলমণির শরীরে। কিন্তু তিনি ভ্রূক্ষেপহীনভাবে ব্যায়াম কৌশল প্রদর্শন করে যান।

অনুষ্ঠানের শেষে মঞ্চের ওপর নিজের কাছে নীলমণিকে ডেকে নেন বলদেবানন্দ গিরি মহারাজ। আঙুল দিয়ে নীলমণির মাংসপেশিগুলি টিপে দেখে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলে ওঠেন— ‘‘এ তো লোহার তৈরি!’’ তিনি এবং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সর্বসম্মতিক্রমে এই সভা থেকে নীলমণি দাশকে ‘আয়রনম্যান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। যে খেতাবে পরবর্তীকালে সমগ্র বাঙালি জাতি মনে রাখবে এই ব্যায়ামবীরকে।

তরুণ নীলমণি দাশ।

অনুশীলন সমিতি ও সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন বিষয়ক গবেষক অনমিত্র চক্রবর্তী দাবি করেন, এই অনুষ্ঠানের পর পুলিনবিহারী ঢাকায় চলে যান আর নীলমণি নতুন সম্মান নিয়ে ফেরেন কলকাতায়। তবে নীলমণি দাশের সঙ্গে মালদার সঙ্গে একটা যোগাযোগ থেকেই গিয়েছিল। গিরি পরিবারেরই নির্দেশে একবার গোপনে একা মালদায় এসে তাদের হাভেলির উল্টোদিকে ব্যায়াম সমিতির মাঠে তরুণ বিপ্লবীদের ব্যায়াম শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৪০ থেকে ৪২ সালের মাঝামাঝি কোনও একটা সময়ে ঘটেছিল ঘটনাটি। সেই ইতিহাসও আজ হাওয়ায় মিশে গিয়েছে।

চিত্র: লেখক/ গুগল
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

সন্দীপ মজুমদার

মামলায় জয়ী হয়ে থোড় কুঁচি দিয়ে কালীর আরাধনা করেন জমিদার-গিন্নি

রূপনারায়ণ মজুমদারের হাত ধরেই মা মহাকালীপুজো শুরু হয়। যেহেতু জমিদার-গিন্নি পুজোর উপকরণ হিসাবে কলা-থোড় কুঁচোর কথা মুখে এনেছিলেন, তাই পুজোর অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে সেদিন দেবীকে থোড় কুঁচোও উৎসর্গ করা হয়েছিল। আজ ১৬৯ বছর পরেও সেই রীতির কোনও পরিবর্তন হয়নি। এখনও মজুমদার বাড়ির কালী পুজোয় অন্যান্য সকল উপকরণের সঙ্গে মা মহাকালীকে থোড় কুঁচানো দেওয়া হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বরিশাল শ্মশান-দীপালি

সমগ্র উপমহাদেশে বরিশাল শ্মশান একটি বিশেষ কারণে অনন্য। এই শ্মশানের বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিবছর কার্তিকী অমাবস্যায়, (যাকে শাস্ত্রে ‘অশ্বযুজা’ মাস বলে) সেখানকার এই শ্মশানে যে কালীপুজো হয়, সেখানকার পুজোর আগের দিন ভূতচতুর্দশীর রাতে লক্ষ লোকের সমাবেশ হয়। উদ্দেশ্য, ওখানে যাঁদের দাহ করা হয়েছে, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। সমগ্র শ্মশান জুড়ে কয়েক হাজার মঠ বা স্মৃতিসৌধ আছে, মুসলমানদের যেমন আছে বনানী বা অন্য বহু গোরস্তানে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বৌদ্ধসম্প্রদায়ের প্রবারণা ও কঠিন চীবরদান উৎসব

বিশ্বের বহু দেশেই এই উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়। স্পেন ও ফ্রান্স-সহ ইয়োরোপীয় দেশে চীনা, জাপানি, বাঙালি বৌদ্ধরা পালন করেন যেমন, তেমনই বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি থেকে কুয়াকাটা-কলাপাড়া এই উৎসবে মেতে ওঠে। ইওরোপীয়দের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েকবছর আগে দালাই লামা যেবার শিলিগুড়িতে তাঁর বার্ষিক অনুষ্ঠান করলেন, সেবার প্যারিস থেকে আগত বেশ কিছু ফরাসির সঙ্গে আলাপ হয়, যাঁরা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত। তাঁদের কাছেই শুনেছিলাম, ফ্রান্সে বহু মানুষ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিচ্ছেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপুজো: অতীত দিনের স্মৃতি

মহালয়া দিয়ে হত পুজোর প্রকৃত সূচনা। শরতের ভোররাতে আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত এই অনুষ্ঠানটির শ্রোতা অন্তহীন, এবং এখনও তা সমান জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও অনুষ্ঠানটির শ্রোতা অগণিত। আমাদের শৈশবে বাড়ি বাড়ি রেডিও ছিল না, টিভি তো আসেইনি। বাড়ির পাশে মাঠে মাইক থাকত, আর প্রায় তিনশো গজ দূরের এক বাড়িতে মাউথপিস রাখা থাকত। সেখান থেকে ভেসে আসত মহালয়ার গান, ভাষ্য।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপূজা, মূর্তিপূজা: দেশে দেশে

আসলে বাঙালি নিরন্তর এক অনুসন্ধানী, ব্যতিক্রমী, অভিনব-চিন্তক, ক্রমবিকাশপ্রিয় ও অন্তিমে রহস্যময় জাতি। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমান আস্তিক নাস্তিকে মিলিত এই জাতি সঙ্ঘারাম আর মিনার, ধ্বজা ও ওংকার, জগমোহন-মিরহাব-স্তূপ-ভস্মাচ্ছাদিত এক জাতি, নিজ মুদ্রাদোষে নয়, মু্দ্রাগুণে আলাদা।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শারদোৎসব: বাংলাদেশে

দুর্গাপুজো কেবল ভক্তের জন্য-ই নয়, ভাল লাগাদের জন্যও। যে ভাল লাগা থেকে ভাই গিরীশচন্দ্র সেন কোরানশরীফ বাংলায় অনুবাদ করেন, অদ্বৈত আচার্য যবন হরিদাসের উচ্ছিষ্ট নিজহাতে পরিষ্কার করেন, স্বামী বিবেকানন্দ মুসলিম-তনয়াকে কুমারীপুজো করেন! দুর্গা বাঙালির কাছে, ধর্মনির্বিশেষে আগ্রহের, যেহেতু এই দেবী পরিবারসহ আসেন, আর সঙ্গে নিয়ে আসেন কাশফুল আর শিউলি। তাই তো সনাতন রামপ্রসাদ, খ্রিস্টান মাইকেল, ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ এবং মুসলমান কাজী নজরুল দুর্গাকে নিয়ে কলম না ধরে পারেননি!

Read More »