গোপনে বিপ্লবীদের ব্যায়াম শিক্ষা দিতেন তিনি। পাশাপাশি বাঙালির শরীরচর্চার আদি যুগের পূর্বপুরুষ ‘আয়রনম্যান’ নীলমণি দাশ। তাঁর এই ‘আয়রনম্যান’ উপাধি পাওয়া মালদা থেকেই। বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাসের প্রিয় শিষ্যকে এই উপাধি দিয়েছিলেন মালদারই স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব মোহান্ত বলদেবানন্দ গিরি। গিরিদের হাভেলির সামনের মাঠে নানা সময় নিয়মিত চর্চা হয়েছে লাঠি ও তলোয়ার চালনা। গোপনে চলেছে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের শিক্ষা। লক্ষ্য একটাই: ব্রিটিশ তাড়াতে হবে। সেই ইতিহাসও আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে।
‘‘তোমাকে আমার সঙ্গে মালদা যেতে হবে’’— আমহার্স্ট স্ট্রিটের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঢাকা অনুশীলন সমিতির প্রাণপুরুষ এবং বঙ্গীয় ব্যায়াম সমিতির প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস প্রস্তাবটা সরাসরি ছুড়ে দিয়েছিলেন চব্বিশ বছরের তরতাজা তরুণ নীলমণি দাশের দিকে। বিখ্যাত ব্যায়ামবীর মেজর ফণীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্তর প্রিয় শিষ্য তরুণ নীলমণি দাশের লাঠিখেলার শিক্ষক ছিলেন পুলিনবিহারী। কাজেই এ তাঁর কাছে গুরুর আদেশ। সালটা ১৯৩৫।
যে ব্যায়ামাগারের সঙ্গে আজীবন যুক্ত ছিলেন নীলমণি দাশ, সেই সিমলা ব্যায়ামাগারের প্রবীণ সদস্য অমল বসুর লেখা থেকে জানা যায়, স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ মালদায় ছেলেকে ছাড়তে রাজি হচ্ছিলেন না পিতা নিবারণচন্দ্র দাশ। বিপ্লবী পুলিনবিহারী স্বয়ং দেখা করে দেখা করে অনুমতি আদায় করেন তাঁর থেকে। বলেন, ‘‘মালদায় অনেক কিছু শেখার আছে।’’
১৯৩৫-এ হিন্দু প্রাদেশিক মহাসভার সম্মেলন হয় মালদায়। গিরি সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের উদ্যোগে দুদিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানে সূচনা হিসাবে ব্যায়াম এবং লাঠিখেলা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিলো। দু-তিনজন শিষ্যসহ পুলিনবিহারী এবং নীলমণি ওঠেন মালদা কোর্ট স্টেশন সংলগ্ন গিরিদের ধর্মশালায়। সেই ধর্মশালা এখন ভগ্নপ্রায়। তারপর সেখান থেকে জুবিলি রোডের কাছাকাছি আইনজীবী উপেন্দ্রনাথ মৈত্রের বাড়িতে অনুষ্ঠানের দিন সকালে প্রস্তুতির জন্য আসেন তাঁরা। শোনা যায়, জুবিলি রোড সংলগ্ন মাঠকে সে সময়ে বলা হত খোলা মাঠ।
জুবিলি রোডের খোলা মাঠে সেদিন নক্ষত্র সমাবেশ। কে নেই? আচার্য বিনয়কুমার সরকার, বিধুশেখর শাস্ত্রী, ‘শনিবারের চিঠি’-র বিতর্কিত সম্পাদক সজনীকান্ত দাস, সাহিত্যিক আশুতোষ লাহিড়ী এবং সর্বোপরি হিন্দু মহাসভার সভাপতি এবং ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিউ’-এর প্রখ্যাত সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। শোনা যায়, রবীন্দ্র-ঘনিষ্ঠ রামানন্দকে মৌখিক শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সর্বসম্মতিক্রমে মালদার সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত হন গিরি সম্প্রদায়ের প্রধান মোহান্ত বলদেবানন্দ গিরি মহারাজ।
মালদা থেকে প্রকাশিত ‘গৌড়দূত’ সম্পাদক লালবিহারী মজুমদারের রচনা থেকে জানা যায়, উদ্বোধনের মঞ্চের উপর ঘটে এক অদ্ভুত ঘটনা। ছয় জন বাহকের কাঁধে একটি সুদৃশ্য পালকিতে করে সভাস্থলে আসেন বিশালদেহী সন্ন্যাসী বলদেবানন্দ গিরি মহারাজ। পালকিতে করেই মঞ্চে ওঠার পর পালকির লাঠি দুটি খুলে নিয়ে সিংহাসনের মত করে মঞ্চে বসিয়ে দেয়া হয় তাঁকে। গিরিদের রেওয়াজ অনুসারে ছয়জন বলিষ্ঠ পালকিবাহক সেই লাঠি হাতে ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর ভূমিকায় সারাদিন মঞ্চের ওপর ছিলেন। গবেষক বাণীব্রত চক্রবর্তীর ‘লৌহমানব নীলমনি দাশ’ বইতেও এই ঘটনাটির উল্লেখ আছে।
বিপ্লবী পুলিনবিহারীর পরিচালনায় লাঠিখেলার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। প্রথমে বড় লাঠির খেলা, তারপর দুহাতে দুটি ছোট লাঠি নিয়ে লড়াই। উল্লেখ্য, পুলিনবিহারী এই ছোট লাঠির খেলাতেই প্রায় কিংবদন্তি ছিলেন। তারপর তলোয়ার ও ছোরা খেলা। পরবর্তীকালে পুলিনবিহারী তাঁর বিতর্কিত বই ‘লাঠিখেলা ও অসিশিক্ষা’-য় এই কৌশলগুলি সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে লিখেছেন।
প্রায় এক ঘণ্টা ধরে অস্ত্রের প্রদর্শনীর কৌশল চলে। এইসব প্রদর্শনীর মধ্যেই চলে তরুণ নীলমণির দেহসৌষ্ঠব প্রদর্শনী। উপস্থিত জনতার তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে নীলমণি মঞ্চের উপরেই কাঁধের চাপে রেললাইনের টুকরো বাঁকিয়ে দেখান, দেখান ওয়েটলিফটিং ও বিম ব্যালান্সিং-এর খেলা। মঞ্চের উপর উঁচু লোহার স্ট্যান্ডে রাখা ছিল বেশ কয়েকটি জ্বলন্ত আগুনপূর্ণ লোহার কড়াই। তাদেরকে সুকৌশলে এড়িয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলে এই লাঠি, ছোরা ও শারীরিক কৌশলের প্রদর্শনী। লাঠির আঘাতে দু-একবার আগুন ছিটকে এসে লাগে নীলমণির শরীরে। কিন্তু তিনি ভ্রূক্ষেপহীনভাবে ব্যায়াম কৌশল প্রদর্শন করে যান।
অনুষ্ঠানের শেষে মঞ্চের ওপর নিজের কাছে নীলমণিকে ডেকে নেন বলদেবানন্দ গিরি মহারাজ। আঙুল দিয়ে নীলমণির মাংসপেশিগুলি টিপে দেখে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলে ওঠেন— ‘‘এ তো লোহার তৈরি!’’ তিনি এবং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সর্বসম্মতিক্রমে এই সভা থেকে নীলমণি দাশকে ‘আয়রনম্যান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। যে খেতাবে পরবর্তীকালে সমগ্র বাঙালি জাতি মনে রাখবে এই ব্যায়ামবীরকে।
অনুশীলন সমিতি ও সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন বিষয়ক গবেষক অনমিত্র চক্রবর্তী দাবি করেন, এই অনুষ্ঠানের পর পুলিনবিহারী ঢাকায় চলে যান আর নীলমণি নতুন সম্মান নিয়ে ফেরেন কলকাতায়। তবে নীলমণি দাশের সঙ্গে মালদার সঙ্গে একটা যোগাযোগ থেকেই গিয়েছিল। গিরি পরিবারেরই নির্দেশে একবার গোপনে একা মালদায় এসে তাদের হাভেলির উল্টোদিকে ব্যায়াম সমিতির মাঠে তরুণ বিপ্লবীদের ব্যায়াম শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৪০ থেকে ৪২ সালের মাঝামাঝি কোনও একটা সময়ে ঘটেছিল ঘটনাটি। সেই ইতিহাসও আজ হাওয়ায় মিশে গিয়েছে।