দেশের অন্যতম নামজাদা কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খড়গপুর আইআইটি’র সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস। ক্যাম্পাসের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে একখণ্ড ইতিহাস৷ ব্রিটিশ আমলে তৈরি হয়েছিল হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্প৷ যেখানে স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত লোকজনদের আটকে রাখা হত। খড়গপুর শহরের হিজলিতে অবস্থিত এই ডিটেনশন ক্যাম্পটি। যেখানে, ১৯৫১ সালে ড. বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে পথচলা শুরু করেছিল আইআইটি-খড়গপুর।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৩০ সালে হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হয়েছিল। এই ডিটেনশন ক্যাম্পেই ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ইংরেজ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন সন্তোষকুমার মিত্র ও তারকেশ্বর সেনগুপ্ত নামে দুই স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁদের মৃতদেহ সংগ্রহ করতে হিজলিতে এসেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। এই গুলি চালানোর ঘটনার প্রতিবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ বিশিষ্ট দেশনায়করা।
ক্যাম্পের সেই ভবন এখন শহিদ ভবন নামে পরিচিত। সেখানে নেহরু মিউজিয়াম অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি তৈরি হয়েছে৷ আর ভবনের উল্টো দিকে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে হিজলি প্রিজন সেল৷ লোহার গারদের পিছনে ছোট্ট ছোট্ট খুপরি ঘর৷ সেখানে বন্দি থেকেছেন ক্ষুদিরাম বসু থেকে মাতঙ্গিনী হাজরার মত স্বাধীনতা সংগ্রামীরা।
প্রতি স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের আয়োজনটা এই ক্যাম্পেই করে থাকেন আইআইটি কর্তৃপক্ষ৷ আইআইটি খড়গপুরের প্রতিষ্ঠা দিবস স্বাধীনতা দিবসের তিন দিন পরেই, ১৮ অগাস্ট৷ দেশজোড়া স্বাধীনতা আন্দোলনে এত বেশি মানুষ জড়িয়ে পড়েন যে, জেলগুলিতে আর স্থান সঙ্কুলান হচ্ছিল না৷ তখনই কয়েকটি ডিটেনশন ক্যাম্প গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার৷ বক্সার পরে হিজলিতে দ্বিতীয় ক্যাম্পটি তৈরি হয়৷ কোনও ডিটেনশন ক্যাম্পকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত করে তোলার উদ্যোগ বিরল৷ তবে বিধানচন্দ্র রায়ের প্রস্তাব মেনে দেশের প্রথম আইআইটি খড়গপুরের কাছে হিজলিতে ওই ক্যাম্পেই শুরু করে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার৷
ইতিহাসকে যে তারা সযত্নে রাখতে চান, আইআইটি-র মূল প্রশাসনিক ভবনে ঢোকার মুখেই তার প্রমাণ মেলে৷ ১৯৫৬ সালে প্রথম সমাবর্তনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বক্তব্য জ্বলজ্বল করছে৷ হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্পে দেশের অন্যতম সেরা এই প্রতিষ্ঠানের পথচলাকে তিনি অতীত ও অনাগত ভবিষ্যতের মধ্যে ফারাক হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন৷
ক্যাম্পাসে শহিদ ভবনের উল্টোদিকে যেখানে সার দিয়ে প্রিজন সেল, তার সামনে প্রচুর গাছপালা৷ প্রতিটি সেলের দরজা আটকানোর ছিটকিনি পাশের দেওয়ালে একটা চৌখুপির মধ্যে তৈরি আঙটায় ঢুকিয়ে তালা লাগানো৷ আট বাই দশ ফুটের বেশি সেগুলির মাপ নয়৷ প্রতিটি সেলে ছোট ছোট সাইনবোর্ডে ঐতিহাসিক তথ্য৷ সামনে প্ল্যাকাডে লেখা ‘বন্ডেজ টু ফ্রিডম, দ্য নেশন’স জার্নি’৷ আজ স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তির ঐতিহাসিক মুহূর্তে বিস্মিত হই, ইতিহাসের এই অতীত মূর্ছনার সামনে দাঁড়িয়ে।