Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে

আ মরি বাংলা ভাষা! পৃথিবীতে প্রায় পঁয়ত্রিশ কোটি মানুষ যে-ভাষায় কথা বলেন, প্রতিদিন যে-ভাষায় লিখিত হয়ে চলেছে পদ‍্যগদ‍্যপ্রবন্ধ, যে জাতির মেধাতালিকা বারোশো বছর ধরে ব‍্যাপ্ত ও ক্রমবর্ধমান, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত‍্যপুরস্কারে অভিনন্দিত হয়েছেন যে-ভাষার কবি, সেই বাংলাভাষাকে নমস্কার। বারোশো বছর ধরে অসংখ‍্য মনীষী ও সাধারণ মানুষের আন্তর পরিচর্যা ও নিবিড় যত্নকৃত সেবায় গড়ে উঠেছে এ-ভাষার রূপ আর ভঙ্গি। আর এ-ভাষা যারা ব‍্যবহার করেন দৈনন্দিন কাজে, সাহিত‍্যে আর বিশ্রম্ভালাপে, সেই বাঙালি জাতি নিজ মুদ্রাগুণে গড়ে তুলেছে তার নিজের সংস্কৃতি, ঐতিহ‍্য আর ইতিহাস, যা উত্তরাধিকারসূত্রে বহু শতক জুড়ে পরম্পরাবাহিত। বাংলাভাষা বাঙালিমাত্রের-ই অলংকার, অহঙ্কার, অক্ষয় কবচকুণ্ডল।

মাতৃভাষাকে রবীন্দ্রনাথ মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আর সে-ভাষাকে বাঁচিয়ে তুলতে যদি রুধির, অশ্রু ও ঘামের প্রয়োজন হয়, দরকার হয় মানুষের রক্তাক্ত দক্ষিণা প্রদানের, তাহলে সে-মাতৃভাষা তো পরমান্নের-ও অধিক, তা যে অমৃত! বাংলাভাষা আমাদের কাছে তাই মাতৃদুগ্ধের অধিক। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন ১৯৯৯-তে এসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মোহনায় এসে মিশল, আমাদের মাতৃভাষার এমন উজ্জ্বল বিভা সমগ্র বিশ্বে আমাদের মুখোজ্জ্বল করেছে; সেইসঙ্গে বঙ্গভাষার-ও। মোহনা এখন সমুদ্রগামী।

বাংলাভাষা নিয়ে সত‍্যিসত‍্যি গর্ব করার মতো কী আছে বাঙালির? না এ কেবল অযথা ঢক্কানিনাদ? আছে, অতি অবশ‍্যই আছে। চর্যাপদ থেকে আজকের সময় পর্যন্ত এ-ভাষায় যত কিছু লেখা হয়েছে, তার দিকে সামান্য তাকালেই টের পাব, বাংলাভাষা কতখানি সমৃদ্ধ। আরাকান থেকে গৌড়, সমতট, অনুত্তরবঙ্গ (একদা দক্ষিণবঙ্গকে এই নামে ডাকা হত), বাঙালির মেধাতালিকার কি শেষ আছে? বর্ধমানের মুকুন্দরাম চক্রবর্তী উত্তরাধিকার দিয়ে যান হাসান আজিজুল হককে, বরিশালের বিজয়গুপ্ত জীবনানন্দ-বেগম সুফিয়া কামাল-হেনরি স্বপনকে, কী আশ্চর্য মোজেজা! আর আজ তো বঙ্গভাষার লেখক বিশ্বজুড়ে। বাংলা যাঁদের মাতৃভাষা নয়, এমন ভারতীয়ের হাতেও সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলাভাষা, যেমন সখারাম গণেশ দেউসকর, আবু সঈদ আইয়ুব, গুলজার। বেশ কয়েকজন বিদেশির হাতেও পরমযত্নে লালিত হয়েছে বাংলাভাষা। তাঁদের কয়েকজনের নাম হানা ক‍্যাথেরিন ম‍্যালেনস, উইলিয়াম কেরি, ডেভিড ম‍্যাককাচ্চিয়ন, মার্টিন কেম্পশেন, দানিলচুক, ফাদার দ‍্যতিয়েন, কাজুও আজুমা, উইলিয়াম রাদিচে, ক্লিন্টন বি সিলি প্রমুখ। ডিরোজিও সম্ভবত বাংলায় কিছু লেখেননি, তবে উনিশ শতকে তাঁর হাত দিয়েই শাণিত কিছু ইস্পাত গড়ে উঠেছিল, ইয়ং বেঙ্গল নামে পরিচিত ছিলেন যাঁরা,— বাঙালির যুক্তিবাদী চিন্তা ও চেতনার অগ্রদূত। পরের শতকে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের-ও কি নয়?

একটি ভাষা অন‍্য ভাষা থেকে যত বেশি শব্দ আহরণ করে নিজের ভাষায় প্রচলন ঘটাতে পারবে, সেই ভাষাটি ততটাই জোরালো হবে। এইজন্যই ইংরেজি ভাষা প্রবল শক্তিশালী। বাংলাভাষাও অন‍্য বহু ভাষা থেকে শব্দ নিয়েছে। সংস্কৃতভাষা থেকে সবচাইতে বেশি, যাকে বলে তৎসম শব্দ। সে-ভাষা থেকে প্রচুর শব্দ গ্রহণ করলেও মনে রাখতে হবে, বাংলা ভাষার গঠনরীতি কিন্তু তার নিজস্ব, ব‍্যাকরণ নিজস্ব। অন‍্যদিকে ব‍্যাকরণের তুমুল শাসন সংস্কৃত ভাষাকে জনপ্রিয় আর লোকভাষা হতে দেয়নি, যদিও এ-ভাষা অনন্ত ঐশ্বর্যে পূর্ণ এক ধ্রুপদী ভাষা। সংস্কৃত শব্দঋণ অতি অবশ‍্যই বাংলাভাষাকে শ্রুতিমধুর ও বলশালী করেছে। তার সঙ্গে ক্ষতিও করেছে অনেক। বাংলাভাষা যে নিজের শব্দের জোরে দাঁড়াতে পারে, তার বহুতর পরীক্ষা বাকি রয়ে গেছে, সংস্কৃত শব্দকাতরতা এবং আশ্রয় খাঁটি বাংলাভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে বেশ খানিকটা বাধা। বহু লেখক আবার এই বাধা কাটিয়ে ওঠায় সচেষ্ট। রবীন্দ্রনাথ যখন ‘চুলা’ বা ‘জউ’ (যতু অর্থে), বা নজরুল ‘খুন’ লেখেন ‘রক্ত’-এর সমার্থক শব্দ হিসেবে, তখন এর প্রমাণ পাই। কালীপ্রসন্ন সিংহ, স্বামী বিবেকানন্দ, প্রমথ চৌধুরী, সৈয়দ মুজতবা আলী, পরবর্তীকালে আল মাহমুদ (‘সোনালী কাবিন’- সহ বহু কবিতাগ্রন্থে), সৈয়দ শামসুল হক (‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটক, ‘পরাণের গহীন ভিতর’ কাব‍্য ও অন‍্যত্র) বাংলার প্রাণভোমরা দেশি শব্দকে তাঁদের লেখায় প্রয়োগ করে বাংলাভাষাকে প্রকৃত বাংলাভাষা করায় অবদান রেখেছেন। এ কাজ অনবরত চালিয়ে যেতে হবে আমাদের। অর্থাৎ একদিকে অন‍্য ভাষা থেকে শব্দ এনে অলংকার করে আমার ভাষাকে পরাব, অন‍্যদিকে বাংলার হাটে মাঠে গঞ্জে মজলিশে যে চলমান ভাষা, তাকেও স্বাঙ্গীকৃত করে আমাদের ভাষায় ব‍্যবহার করে তাকে সমৃদ্ধ করব।

অন‍্যভাষার কাছ থেকে আমাদের নেওয়া শুরু হয়েছে সুদূর ইন্দো-ইরানিয়ান যুগ থেকে। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা ও ইরানীয় ভাষার মিল ছিল প্রচুর। ‘মিহির’ বা ‘মিত্র’ এরকম দুটি শব্দ, যা আজ-ও বাংলায় দিব্বি ব‍্যবহার করা হয়। প্রাচীন ইরানী থেকে যেমন, দীর্ঘ পাঁচশো বছর পাঠান ও মুঘল শাসনামলে ফার্সি রাজভাষা থাকায় দ্বিতীয় দফায় ফার্সি ও সেইসঙ্গে আরবি ভাষা থেকেও বহু শব্দ বাংলায় এসেছে। প্রাচীন কালে যেমন বাঙালির মধ‍্যে তামিল, অস্ট্রিক, ভোট-চীনীয় রক্তের মিশ্রণ ঘটেছে, তেমনি ঘটেছে শব্দের-ও মিশ্রণ। আর ঔপনিবেশিক আমলে বহুতর ইংরেজি ও সামান‍্য কিছু পর্তুগিজ, ফরাসি শব্দ-ও যুক্ত হয়েছে। এই নিয়ে আজকের বাংলাভাষা।

এখানে একটা মজার ব‍্যাপার আছে। মধুসূদন ‘শবদে শবদে বিয়া’ (বিয়া! সে-ও তো বাংলাভাষার অপূর্ব শব্দ! এই মধুসূদন-ই আবার লেখেন, ‘যাদঃপতি রোধঃ যথা চলোর্ম্মি আঘাতে!’ বাপ রে বাপ!) দেওয়া কবির কাজ, লিখেছিলেন। কিন্তু এক-ই শব্দ দুই ভাষা থেকে এসে দুটি অর্থে ব‍্যবহৃত হয়, এ কি তিনি জানতেন? ‘ভর্তা’ সংস্কৃত শব্দ, অর্থ ‘স্বামী’। আর সেই শব্দটিই আবার অন‍্য ভাষা থেকে বাংলাভাষায় এসে ‘সেদ্ধ’-র প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে! তেমনি ‘রবি’, কিনা সূর্য। আর আরবি ‘রবি’ মানে ‘শীত’ (তু. রবিশস‍্য)! মজা নয়?

একটি ভাষা একটি জাতির গর্ব। আর তা যদি হয় একটি জাতির ভাষা, অর্থাৎ সমগ্র জাতির, একটি দেশের মানুষের মাতৃভাষা তা, সে তো স্বপ্নরাজ‍্য, স্বর্গরাজ‍্য! প্রাচীন ব্রিটনরা যেমন বলত, ‘Ma yezh eo ma bro’, অর্থাৎ ‘My language is my country’, বাংলাদেশ সে-কথা বলতে পারে আজ। আরও। ‘ধ্রবতারাকে পিছনে রেখে ধূমকেতুকে চলেছে লখি’ আজ বাংলাভাষা। রাষ্ট্রসঙ্ঘে ব‍্যবহৃত ভাষাসমূহের অন্তর্গত হওয়ার উদ্দেশে চলেছে সে। ইংরেজি, ফরাসি ও স্প‍্যানিশের পাশাপাশি বাংলাভাষাতেও রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাজকর্ম পরিচালনার দিন আগত সামনে।

সে পদবিতে পৌঁছনোর যোগ‍্যতা আছে বাংলাভাষার। একটি ভাষা গড়ে ওঠার পেছনে স্তম্ভ হয়ে কাজ করে তার সার্বিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ‍্য ও সেইসঙ্গে সে-ভাষার লেখককুল, তাঁদের মেধার নান্দনিক স্বাক্ষর। বাঙালি হাজার বছর ধরে অবিরাম এই উভয়ক্ষেত্রে নিজের বৈভব প্রদর্শন করে চলেছে। একটি ভাষার চরম উৎকর্ষ নির্ভর করে সে-ভাষায় কী পরিমাণ গভীর কথা এবং শ্রবণযোগ‍্য পঙ্‌ক্তি,— Quotable quotes রচিত হয়েছে, তার ওপর। সেই চর্যাপদের ঊষালগ্ন থেকেই তো তা হয়ে এসেছে, ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’। অথবা বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, কী শাশ্বত পঙ্‌ক্তি ও গাঢ় অনুভূতি রাধার,— ‘বাঁশীর শবদে মোর আউলাইলো রান্ধন’! তার পর থেকে যদি এ-ভাষার বিপুল লেখকদের মধ‍্য থেকে মাত্র কয়েকজনের ধ্রুবপদ সাজাই, তাহলে দেখব, বাংলাভাষার কী মণিময় সম্ভার!

১. সবার উপরে মানুষ সত‍্য, তাহার উপরে নাই।— চণ্ডীদাস।
২. জনকজননী বন্দম শিরের ভূষণ/ যাহার কৃপায় দেখি এ তিন ভুবন— বিজয়গুপ্ত।
৩. যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।— আবদুল হাকিম।
৪. নানান দেশের নানান ভাষা।/ বিনে স্বদেশী ভাষা/ পুরে কি আশা?— রামনিধি গুপ্ত।
৫. বন‍্যরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।— সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

একটি স্থাপত‍্য নির্মিত হয় একদিকে যেমন প্রযুক্তিগত ভাবনাকে মাথায় রেখে, অন‍্যদিকে তেমনি তার মিনার ও জগমোহন, চৈত‍্য ও তোরণ তাই কত কথা বলে, কত নন্দনের বার্তা দেয়। ভাষা-ও অনেক সময় ভাস্কর্য হয়ে দেখা দেয়। ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর, শূন‍্য মন্দির মোর’ (বিদ‍্যাপতি), ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কমনে আসে যায়’ (লালন শাহ্), বা ‘সে কহে বিস্তর মিছা, যে কহে বিস্তর’ ( ভারতচন্দ্র), এসব সদুক্তি বাংলাভাষাকে রঞ্জিত করে রাখবে যাবচ্চন্দ্রদিবাকর। আর রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দের ভাবনার ভাস্কর্যের উদাহরণ দিতে গেলে তো একটি গ্রন্থ-ই লেগে যাবে। আছে কতই না প্রবাদ-প্রবচন! জেমস লং বা ড. সুশীল দে-র সম্পাদনায় জলধিপ্রতিম তা। ‘তারা ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে’ (দ্বিজেন্দ্রলাল), বা ‘ছোট্ট নেবুর ফুল গো আমার, ছোট্ট নেবুর ফুল,/ স্বর্ণ ঊষার কর্ণভূষার বর্ণতুষার দুল’ (যতীন্দ্রমোহন বাগচী), অথবা ‘কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’ (জীবনানন্দ)। আর ‘প্রলয়সৃষ্টি তব পুতুলখেলা, আনমনে’ (নজরুল)।

কী যে জাদু বাংলাভাষায়! আর ব‍্যাপ্তি। একহাতে সে উপহার দেয় বৈষ্ণবকবিতা, অন‍্যহাতে ময়মনসিংহগীতিকা। আবিশ্বের বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলিতে বাংলাভাষা পড়ানো হচ্ছে,— মেলবোর্ন, লন্ডন, টোকিও, বেইজিং, মন্ট্রিল-সহ একশোটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ব্রিটেন থেকে বেরোয় বারোটি সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা। আছে দৈনিক পাক্ষিক মাসিক পত্রিকাও। বিদেশিদের গবেষণা মাইজভাণ্ডারী দর্শন (হানস হার্ডার, জার্মানি) থেকে অশ্বিনীকুমার দত্ত, চাকমা ভাষা থেকে লালন পর্যন্ত ব‍্যাপ্ত। ব‍্যারি মরিনসন (কানাডা), এলভিয়েতা ওয়ালটার (পোল‍্যান্ড), মারিয়েন ম‍্যাডার্ন (মেলবোর্ন) বাংলাভাষা নিয়ে বিদেশি গবেষকদের সামান‍্য কয়েকটি নাম।

মাতৃভাষার আলোচনা প্রসঙ্গে এটা মনে রাখা জরুরি, যাকে বৈয়াকরণেরা মান‍্য চলিত বাংলা বলেন, তার চেয়েও মানুষের মুখের ভাষা, যা জেলাভেদে, নরনারীভেদে, সামাজিক অবস্থান আর বালক-তরুণ-বৃদ্ধভেদে উচ্চারিত হয়, মাতৃভাষার প্রকৃত দাবিদার কিন্তু সে-ই। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ তার উদাহরণ হয়ে আছে।

এই ভাষায় গর্জে ওঠেন নূরলদীন, ‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়?’ এই ভাষায় নদেরচাঁদ বলে, ‘তুমি হইয়ো গহিন গাঙ, আমি ডুইব‍্যা মরি’, বা কবিতায় মনীষ ঘটকের নায়িকা বলে ওঠে, ‘তরে বুঝি কই নাই, আমিও বান্দুরী?’ আর মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের শশীচরিত্র আর্তকণ্ঠে জানায়, ‘শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?’ আবার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর সে-দেশে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে ঋত্বিক ঘটক ওই যে ঢাকায় এসে তাঁর জন্মস্থান জিন্দাবাহার লেন দেখতে চেয়েছিলেন, মোটর গাড়িতে নয়, ঘোড়ার গাড়ি চড়ে, হ‍্যাঁ, সেটাই মাতৃভাষা। ভার্জিনিয়া উলফ কি সাধে বলেছেন, ‘Language is wine upon the lips?’ মনে রাখতে হবে, ভার্জিনিয়া উলফের দিদিমা ছিলেন ফরাসি, আর দাদু বাঙালি!

যেন ভুলে না যাই, বাহান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারির মতো উনিনশো একষট্টির উনিশে মে-তেও (রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ!) বাংলাভাষার দাবি আদায়ে ভারতের শিলচরে শহিদ হয়েছিলেন এগারোজন। তাঁদের মধ‍্যে কমলা ভট্টাচার্য নামে এক নারীও ছিলেন। যেন ভুলে না যাই, বাংলাভাষার দাবি আদায়ে মানভূমের বাঙালিদের বহুবছর লড়াই করতে হয়েছিল। যেন ভুলে না যাই, ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে সেখানকার মাতৃভাষা তেলুগুর জন‍্য শহিদ হয়েছিলেন পত্তি শ্রীরামালু।

বাংলাভাষাকে ভালবাসব আমরা বাঙালিরা। আর বেদনাহত হব একথা ভেবে, প্রতিদিন পৃথিবী থেকে লুপ্ত হচ্ছে একটি একটি করে ভাষা। যেন এই বিবেচনায় মাতৃভাষাকে আঁকড়ে থাকি আমরা। আর মাতৃভাষা ছাড়াও অন্তত অন‍্য একটি ভাষা যেন শিখি, কেননা নিজ ভাষা সম্পর্কে ধারণা ও বোধ পাকা হবে তাতে। মহাকবি গ‍্যেটে শিখিয়েছেন খুব জরুরি একটি কথা, ‘Wer framde Sprachen nicht kenat, weiz nichts von seiner eigenen.’ অর্থাৎ, ‘Those who know no foreign language, know nothing of their mother tongue.’
ভাষাশিক্ষাটা যেন হরিনাথ দে-র মতো না হয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো হয়, পরিবেশিত হয়ে আনন্দ দেয় পাঠককে।

বাংলাভাষার জন‍্য প্রাণ দিয়েছেন খণ্ডিত এই উপমহাদেশের দুই অংশের বাঙালি। ভাষাভাই আমরা। রাজনীতি যতই বিচ্ছেদ ঘটাক, মহান বার্নার্ড শ মাথায় থাকুন আমাদের, যিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভাষায় লিখেছিলেন, ‘England and America are two countries divided by a common language.’

বড্ড জানতে ইচ্ছে করে, পাকিস্তানে কি পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি?

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শতবর্ষে মহানায়ক উত্তমকুমার

‘মহা’ শব্দটি মহান আর বিশাল, এই দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ‘মহাকাব্য’ বা ‘মহারাজ’। কাব্য আর রাজার চেয়ে তার মাত্রা ভিন্ন, মহিমা অনেক বেশি তাৎপর্যময়। উত্তম বাংলা চলচ্চিত্রের সেই তাৎপর্যময়তার একমাত্র উদাহরণ। যাঁকে শ্রদ্ধাভরে আমরা ‘কিংবদন্তি’-ও বলে থাকি। তাই সত্যজিৎ রায়ের মতো আরেক কিংবদন্তি তাঁকে নিয়ে চিত্রনাট্য লেখেন, ছবি বানান, আর সে ছবির ‘নায়ক’ হন উত্তমকুমার।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সুকান্ত ভট্টাচার্য: ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার সহোদর এক কবি

‘–ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে’, সুকান্ত লিখেছেন নিজের সম্পর্কে। বলেছেন, ‘আমি এক অঙ্কুরিত বীজ’। এই বীজ মহীরুহে পরিণত হতে পারল না, বাংলা সাহিত্যের পরম দুর্ভাগ্য এটা। কিন্তু তাঁর একুশ বছরের জীবনে তিনি আভাস দিয়ে গেছেন, তাঁর সম্ভাবনা কতদূর প্রসারিত হতে পারত। সুকান্ত মানে একজন কবিমাত্র নন, তার চেয়েও আরও অধিক কিছু।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাইশে শ্রাবণ ও প্রসঙ্গত

প্রয়াণের আগে, সব হিসেব বাদ দিয়ে যদি তাঁর জীবনের শেষ পাঁচ বছরের কথা-ই ধরি, দেখব, কত প্রিয়জনের মৃত্যুশোক বহন করতে হয়েছে তাঁকে। যেহেতু তিনি ছিলেন মানুষের সান্নিধ্যপ্রিয়, তাই অন্যের চেয়ে ঢের ঢের বেশি মৃত্যুবেদনা সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। এসব মৃত্যু তাঁকে বেদনার্ত করলেও নিজের মনোবলের জোরে সে-অরুন্তুদ বিষাদকে কাটিয়েও উঠেছেন। পাশাপাশি মৃত্যু নিয়ে তাঁর দর্শন গড়ে উঠতেও তা ভূমিকা রেখেছে। তাই তিনি বলতে পারেন, তিনি-ই বলতে পারেন, ‘দুদিন দিয়ে ঘেরা ঘরে/ তাইতে যদি এতই ধরে/ চিরদিনের আবাসখানা সেই কি শূন্যময়?’ কেন পারেন?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার: অন্য ও অনন্য

তাঁর জন্মদিনের চেয়েও মৃত্যুদিনটিকে অধিকভাবে স্মরণ করা হয়, এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। তাছাড়া বাংলা চলচ্চিত্র-জগতে তো কম খ্যাতিমান ব্যক্তির আবির্ভাব হয়নি, সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল, ছবি বিশ্বাস-কানন দেবী-সুচিত্রা-সৌমিত্র, তবু তাঁর মতো, ঠিক তাঁর মতো স্মরণযোগ্য হয়ে রইলেন না কেউ। শ্রাবণের অনুষঙ্গে নয়, উত্তমকুমারের প্রয়াণদিবসটি চিহ্নিত চব্বিশে জুলাই তারিখটির বিধুরতায়। ১৯৮০-র এই দিনটিতে বাংলা চলচ্চিত্র-জগতের এই দিকপাল প্রতিভার জীবনাবসান ঘটে। আজ তাঁর মৃত্যুর পঁয়তাল্লিশ বছর পূর্তিতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করে উত্তম সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্যের ডালি।

Read More »
শৌনক দত্ত

রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী

নাটকটির নাম প্রথমে রেখেছিলেন যক্ষপুরী, তারপর নন্দিনী এবং পরিশেষে রক্তকরবী নামে থিতু হয়। শিলং-এ ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে যে নাটক লেখা শুরু হয়েছিল তার দশম খসড়া প্রকাশিত হয় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রায় দেড় বছর পর আশ্বিন ১৩৩১ বঙ্গাব্দে—১৯২৪ সালে। প্রকাশিত হবার পরেও, একাদশতম খসড়া প্রস্তুত করার কথা ভাবেন নাট্যকার। অনেকেই বলেছেন, এটি নাট্যকারের হৃদয়ে লালন করা কোনও স্বপ্ন। কেউ কেউ এই নাটকের মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম চেতনার ছায়া খুঁজেছেন। নানা প্রশ্ন, নানা যুক্তি নিয়ে নাটকটি রচনার পর থেকে সমসাময়িক সময় পর্যন্ত দারুণ আলোচিত ও জনপ্রিয়। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত নাটকটি নিয়ে বহু আলোচনা। শতবর্ষে এসে দাঁড়ানো সেই রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নানামাত্রায় বিবেচনাযোগ্য একটি নাটক; বহুমাত্রিক এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ।

Read More »
নুশান জান্নাত চৌধুরী

নুশান জান্নাত চৌধুরীর কবিতাগুচ্ছ

কিছুকাল ঘুমিয়ে, কিছুকাল লুকিয়ে,/ কিছু শহর, কিছু মানুষের ভিড়ে হারিয়ে/ আমি দেখি—// কোনও এক/ পথহারা দেবদূতের বিষণ্ণ ডানার পাশে/ আমি বুক পেতে দিয়েছি// চুলের ভেতর জন্ম নিয়েছে/ ঘাসফুল থোকা থোকা, বুকের মাঝখানে একটা প্রাচীন পেরেক,// ঝরাপাতার রাজ্যপাটে/ আমার বাম হাঁটুতে গেঁথে আছে—/ আগামী বছরের প্রথম সন্ধ্যা;

Read More »