Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

দেবী সরস্বতী

হিন্দুরা বহুদেববাদী। তারা শক্তির আরাধনা করে কালীপুজোর মধ‍্য দিয়ে, লক্ষ্মীর আরাধনা করে ধনলাভের জন‍্য। আর বিদ‍্যালাভের জন‍্য পুজো করে দেবী সরস্বতীর। এছাড়া হিন্দুদের প্রধান দেবদেবীর মধ‍্যে আছেন দুর্গা, শিব, গণেশ, কৃষ্ণ, রামচন্দ্র প্রমুখ।

মাঘমাসের কৃষ্ণা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতীপুজো অনুষ্ঠিত হয়। প্রত‍্যেক দেবতাকে পুজো করতে আলাদা আলাদা ফুল লাগে। সরস্বতীপুজোয় পলাশফুল প্রশস্ত। তাছাড়া শীতকালীন ফুল গাঁদাও দেবীকে নিবেদন করা হয়। উল্লেখ‍্য, অন‍্যান‍্য পুজোয় নানান বাজনা ও আরতি আর বাজি ফোটানোর আয়োজন থাকলেও সরস্বতীপুজোয় এসমস্ত কিছুই একেবারে পরিত‍্যাজ‍্য।

যেকোনও হিন্দুর আরাধ‍্যা এই বিদ‍্যার দেবী। তবে ছাত্রছাত্রীদের কাছে সমধিক আরাধ‍্য। পুজোর দিনটিতে ভক্তরা সর্ষের তেল-মিশ্রিত কাঁচা হলুদ মেখে স্নান করে। তারপর পুজোয় অঞ্জলি দেয়। মেয়েরা এইদিন সাধারণত হলুদরঙা শাড়ি পরে। অঞ্জলি না দিয়ে কিছু খায় না। প্রায় সবার বাড়িতেই এ-পুজো অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়া পাড়ার ক্লাব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতেও। মাটির মূর্তিতে পুজো পান দেবী।

দেবী দ্বিভুজা। হাতে বীণা এবং পুস্তক। বাংলার বাইরে চতুর্ভুজা সরস্বতীমূর্তিও আছে। বৈদিক যুগ থেকে এ দেবীর উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে তাকে বাগদেবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

কেবল হিন্দুদের কাছেই নয়, বৌদ্ধ এবং জৈনদের কাছেও সরস্বতী আরাধ‍্যা। বৌদ্ধদের কাছে এই দেবী প্রজ্ঞাপারমিতা নামে খ‍্যাত। ভারত ছাড়িয়ে চীন জাপান তিব্বত মায়ানমার থাইল‍্যান্ড ও কম্বোডিয়াতেও নানান রূপে ও নামে এই দেবীর পুজো হয়। ইন্দোনেশিয়ায় সরস্বতীর অসাধারণ মন্দির আছে। উরুদ নামক স্থানে এটি অবস্থিত। আরও উল্লেখ করার মতো ব‍্যাপার আছে। ইন্দোনেশিয়া নির্মাণ করেছে সবচেয়ে লম্বা ষোল ফিটের সরস্বতীমূর্তি। দণ্ডায়মান এই শ্বেতশুভ্র সরস্বতীমূর্তিটি স্থাপিত হয়েছে আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসির এমব‍্যাসি রো-তে তাদের দূতাবাসের সামনে।

বিদ‍্যার দেবী।

সরস্বতী বিদ‍্যার দেবী বলে পুজোর দিন বহু ছেলেমেয়ের হাতেখড়ি হয় দিনটিতে। পুরোহিতের হাত ধরে নতুন অক্ষর রচনা করে শিক্ষার্থী। ভারতের তেলেঙ্গানায় জ্ঞানসরস্বতী মন্দিরে এইদিন হাতেখড়ির বিশাল পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ‍্য, এখানকার দেবীমূর্তি হরিদ্রাভ। আর দেবীর বাহন রাজহাঁসের স্থলে ময়ূর। এখানকার সরস্বতীমন্দিরে শ্রীপঞ্চমীর দিন ছাড়াও আষাঢ়ের গুরুপঞ্চমী ও শ্রাবণ পঞ্চমীর দিনেও হাতেখড়ি তথা অক্ষরভ‍্যাসম্ হয়ে থাকে। এখানকার সরস্বতীমন্দির ভারতবিখ‍্যাত।

তেমনই আছে আরও এক বিখ‍্যাত সরস্বতীমন্দির। এখন তা বিধ্বস্ত হলেও ঐতিহাসিক বিলহন ও আলবেরুনির লেখায় মন্দিরটির কথা বিশদ আলোচিত। আবুল ফজলের লেখাতেও আছে বর্তমানে পাক কাশ্মীরের অন্তর্গত হরমুখ পর্বতের নীচে নীলম উপত‍্যকার এই সরস্বতীমন্দিরটির কথা। কাছেই ছিল শারদা বিশ্ববিদ্যালয়। কথিত আছে, আদি শঙ্করাচার্য এখানেই শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন।

তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরস্বতীপুজো। পৃথিবীতে দ্বিতীয়রহিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সামনের মাঠে সমস্ত বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের উদ‍্যোগে প্রায় আশিটি মণ্ডপে আশিটি বা তার বেশি মূর্তি ও পূজা। অকল্পনীয়। পুজোতে অংশ নেন ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকবৃন্দ। বিতরিত হয় প্রসাদ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় রাতে।

গ্রীকদেবী আথেনাও ছিলেন বিদ‍্যার দেবী। সভ‍্যতা, আইন, ন‍্যায়বিচারের দেবীরূপেও কল্পিতা হতেন তিনি। এথেনস নগরীটি এই দেবীর নামেই নামাঙ্কিত। আর রোমে এই বিদ‍্যাদাত্রী দেবীর নাম মিনার্ভা। আথেনা কিন্তু যুদ্ধের দেবতাও। আবার দেবী সরস্বতীর মতো আথেনা অবিবাহিতা, অতএব সন্তানরহিতা। কোনও কোনও পুরাণ অবশ‍্য সরস্বতীকে বিবাহিতা বলে থাকে।

সরস্বতীকে নিয়ে কম কিংবদন্তি গড়ে ওঠেনি। তার মধ‍্যে একটি হচ্ছে, মূর্খ কালিদাস দেবী সরস্বতীর বরেই কবিত্বশক্তি লাভ করেন এবং বিশ্ববিখ‍্যাত কবিরূপে জগতে খ‍্যাত হন। আবার, সরস্বতীপুজোর দিন নাকি বইপড়া নিষেধ। সেদিন কেবল দেবীকে আরাধনার দিন। সরস্বতীপুজোর আগে কুল খাওয়ার ওপরেও নিষেধাজ্ঞা আছে। সম্ভবত ছোট ছেলেমেয়েরা এই টক ফলটি অতিরিক্ত আহার করে কাশিতে ভোগে, এজন‍্যই এই নিদান।

আজকের নেটশাসিত যুগে এই পুজোর সঙ্গে মিশেছে ভ‍্যালেন্টাইন পরব। বসন্ত ঋতুকে বলা হয় মধুমাস। এই ঋতু যৌবনের। বসন্তের সবচেয়ে বড় উদযাপন হল দোল বা বসন্তোৎসব। রাধাকৃষ্ণের অনুষঙ্গে তরুণতরুণীদের পরস্পরকে আবীরে রাঙানোর প্রহর। তার-ই রকমফের এই ভ‍্যালেন্টাইন ডে। সবার রঙে রং লাগানোর মহালগন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে এর প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন।

সবশেষে বলি, জ্ঞানের দেবী আমাদের পথ দেখাক অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের।

চিত্র: গুগল
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »