Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

স্ব-সত্তাকে প্রশ্ন করে স্বীকারোক্তি দেওয়ার নামই শঙ্খ ঘোষ

দেশভাগ। যন্ত্রণা। লিখছেন কিশোর। লেখাও যন্ত্রণার কৈশোরীচাল। সেই লেখা যুবক হল, যুবক হল বালক।

শরদাকাশ, ১৯৫৬। ‘এস রায় এন্ড কোম্পানি’-র হাত ধরে প্রথম প্রকাশিত হয়— ‘দিনগুলি রাতগুলি’ (প্রচ্ছদ : পূর্ণেন্দু পত্রী)। তবে ততদিনে আলোক সরকার (উতল নির্জন, ১৯৫০); অরবিন্দ গুহ (দক্ষিণ নায়ক, ১৯৫৪); আনন্দ বাগচী (স্বগত সন্ধ্যা, ১৯৫৩) প্রমুখ কবির কাব্যগ্ৰন্থ প্রকাশ পেয়েছে। চল্লিশের সমর কিংবা সুভাষের মত উচ্চস্বর এঁদের কবিতায় নেই। এঁরা প্রথম থেকেই নির্জন, নিঃসঙ্গ ও একাকী। গলার স্বর চাপা, অথচ অন্যমনস্কতার লেশমাত্র নেই। সেই দেশভাগ আবহে ‘দিনগুলি রাতগুলি’-র সঙ্গে এলেন শঙ্খ ঘোষ। হিমেল গলায় ছুড়ে দিলেন দেশভাগ যন্ত্রণা, কাঁটাতার অভিমান। চল্লিশ যেখানে সামাজিক অবক্ষয়ের দায় নিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে প্রতিটি ছন্দ ও কল্পনা সেখানে পঞ্চাশের হয়ে এই দায়ের উত্তারাধিকার প্রথম বহন করলেন শঙ্খ ঘোষ। কিন্তু একটি পার্থক্য বজায় থাকল, ‘অত্যন্ত মৃদুতা ও প্রশ্নচিহ্ন’। যা তাঁকে পূর্ববর্তী, সমকালীন ও পরর্বতী দশকের থেকে পুরো আলাদা করে রাখে।

‘‘অন্তহীন অন্তহীন অন্ধকারে বিসর্জন ক’রে
কী লাভ? কী লাভ?’’
(ইভাকে/দিনগুলি রাতগুলি)

প্রথম এই কবিতাতেই মৃদু প্রশ্ন ছুড়লেন নিজেকে। রক্তাক্ত করলেন কল্পনা।

ততদিন পর্যন্ত পঞ্চাশের প্রধান বৈশিষ্ট্য বলতে ধরা পড়েছিল একাকী এবং প্রকৃতিকে ভর করে প্রবল অস্তিত্ববাদী কল্পনা। শঙ্খ ঘোষ বারবার তাঁর কবিতায় মেলে ধরেছেন ঝঞ্ঝাটময় প্রকৃতি, মূর্ছনাকে না ভেঙে। মনে হয়, এই অস্তিত্ববাদকে প্রবল অস্তিত্ববাদ করে তোলায় তাঁর সামাজিক দায় এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সুরের কম্পন প্রতিবার তাঁকে প্রশ্ন করতে শেখায়। তাই প্রশ্নও করেন নিজের স্বরে, সামাজিক দায় স্বীকার করে। অথচ আশ্চর্য তিনি নির্জনী! পরস্পর সংযুক্ত রেখে বিদগ্ধ মন কবিতা হয়ে উঠেছিল।

(ভাঙছি… ভাঙছি… ভাঙছি…
ফিরব। ফিরব। ফিরব। এগারো বছর পর…)

জুন, ১৯৬৭। বিদ্যা প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নিহিত পাতালছায়া’, শিল্পী পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রচ্ছদে। খেলা এখানেই শুরু! নিজেকে এগারো বছর ধরে ভেঙে নির্জনী শব্দের সমার্থক আজ তিনি নিজেই। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের সঙ্গে প্রথম কাব্যগ্রন্থের বিস্তর ফারাক। এই কাব্যগ্রন্থে প্রতিটি কবিতা মূল্যবোধের চেহারায় অতিকায়, নাগরিক দায়, পবিত্রতা ও সত্তাকে প্রশ্ন।

‘‘আর কত ছোটো হব ঈশ্বর
ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে।
আমি কি নিত্য, আমারও সমান
সদরে, বাজারে, আড়ালে?’’
(ভিড়/নিহিত পাতালছায়া)

‘‘এখন আমি আর কি নারী তোমার মুখে তাকাতে পারি?
কিংবা ওরা আমার মুখের গমক-গমক আঁচে?’’
(প্রতিশ্রুতি/নিহিত পাতালছায়া)

অথবা,

‘‘সব আজ কলকাতায়, কিন্তু আমি দোষ দেব কাকে?’’
(বাস্তু/নিহিত পাতালছায়া)

কবিতায় আরশি এনেছেন তিনি। সত্তাকে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করবেন সম্মুখে। এবং লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তাঁর রাবীন্দ্রিক সত্তাও বারবার ফুটে উঠেছে বিভিন্ন কবিতায়। ‘নিহিত পাতালছায়া’-য় তো বটেই। কেননা— ‘চোখ’ শব্দের ব্যবহার যতবার এসেছে ততবার স্পষ্ট হয়ে গেছে মন। এইখানে বসে নিজের স্বরে করেছেন প্রশ্ন। ‘দিনগুলি রাতগুলি’-র কবিতা ও ‘নিহিত পাতালছায়া’-র কবিতার পার্থক্য এখানেই। কবি নিজেকে পরিণত করেছেন এটা বলার চেয়ে বলা ভাল, তিনি তাঁর সত্তাকে পরিণত করেছেন। আত্মা ও সত্তার দ্বন্দ্ব মুখোমুখি কথোপকথন ছাড়া শঙ্খ ঘোষকে অন্বেষণ অত্যন্ত জটিল।

শঙ্খ ঘোষ শিখিয়েছিলেন— মাঝে মাঝে নিজের কাছে স্বীকারোক্তি দিতে হয়। আয়নায় দাঁড়িয়ে দাবার ঘুঁটি সাজাতে দেওয়া উচিত আত্মা ও সত্তাকে। সামাজিক চেহারাকে দণ্ডমুণ্ড করবার আগে বিবেকের কোর্টে বল ছুড়তে হয়। আত্মা আর সত্তা মুখোমুখি দাঁড়ালে তবেই সম্ভব প্রকৃত কবিতা, প্রকৃত স্বীকারোক্তি।

শঙ্খ ঘোষ বলতেই ভেসে ওঠে দুর্দান্ত খেলা। খেলা মনুষ্যত্ব ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের…

চিত্র : গুগল
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

সন্দীপ মজুমদার

মামলায় জয়ী হয়ে থোড় কুঁচি দিয়ে কালীর আরাধনা করেন জমিদার-গিন্নি

রূপনারায়ণ মজুমদারের হাত ধরেই মা মহাকালীপুজো শুরু হয়। যেহেতু জমিদার-গিন্নি পুজোর উপকরণ হিসাবে কলা-থোড় কুঁচোর কথা মুখে এনেছিলেন, তাই পুজোর অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে সেদিন দেবীকে থোড় কুঁচোও উৎসর্গ করা হয়েছিল। আজ ১৬৯ বছর পরেও সেই রীতির কোনও পরিবর্তন হয়নি। এখনও মজুমদার বাড়ির কালী পুজোয় অন্যান্য সকল উপকরণের সঙ্গে মা মহাকালীকে থোড় কুঁচানো দেওয়া হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বরিশাল শ্মশান-দীপালি

সমগ্র উপমহাদেশে বরিশাল শ্মশান একটি বিশেষ কারণে অনন্য। এই শ্মশানের বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিবছর কার্তিকী অমাবস্যায়, (যাকে শাস্ত্রে ‘অশ্বযুজা’ মাস বলে) সেখানকার এই শ্মশানে যে কালীপুজো হয়, সেখানকার পুজোর আগের দিন ভূতচতুর্দশীর রাতে লক্ষ লোকের সমাবেশ হয়। উদ্দেশ্য, ওখানে যাঁদের দাহ করা হয়েছে, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। সমগ্র শ্মশান জুড়ে কয়েক হাজার মঠ বা স্মৃতিসৌধ আছে, মুসলমানদের যেমন আছে বনানী বা অন্য বহু গোরস্তানে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বৌদ্ধসম্প্রদায়ের প্রবারণা ও কঠিন চীবরদান উৎসব

বিশ্বের বহু দেশেই এই উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়। স্পেন ও ফ্রান্স-সহ ইয়োরোপীয় দেশে চীনা, জাপানি, বাঙালি বৌদ্ধরা পালন করেন যেমন, তেমনই বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি থেকে কুয়াকাটা-কলাপাড়া এই উৎসবে মেতে ওঠে। ইওরোপীয়দের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েকবছর আগে দালাই লামা যেবার শিলিগুড়িতে তাঁর বার্ষিক অনুষ্ঠান করলেন, সেবার প্যারিস থেকে আগত বেশ কিছু ফরাসির সঙ্গে আলাপ হয়, যাঁরা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত। তাঁদের কাছেই শুনেছিলাম, ফ্রান্সে বহু মানুষ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিচ্ছেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপুজো: অতীত দিনের স্মৃতি

মহালয়া দিয়ে হত পুজোর প্রকৃত সূচনা। শরতের ভোররাতে আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত এই অনুষ্ঠানটির শ্রোতা অন্তহীন, এবং এখনও তা সমান জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও অনুষ্ঠানটির শ্রোতা অগণিত। আমাদের শৈশবে বাড়ি বাড়ি রেডিও ছিল না, টিভি তো আসেইনি। বাড়ির পাশে মাঠে মাইক থাকত, আর প্রায় তিনশো গজ দূরের এক বাড়িতে মাউথপিস রাখা থাকত। সেখান থেকে ভেসে আসত মহালয়ার গান, ভাষ্য।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপূজা, মূর্তিপূজা: দেশে দেশে

আসলে বাঙালি নিরন্তর এক অনুসন্ধানী, ব্যতিক্রমী, অভিনব-চিন্তক, ক্রমবিকাশপ্রিয় ও অন্তিমে রহস্যময় জাতি। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমান আস্তিক নাস্তিকে মিলিত এই জাতি সঙ্ঘারাম আর মিনার, ধ্বজা ও ওংকার, জগমোহন-মিরহাব-স্তূপ-ভস্মাচ্ছাদিত এক জাতি, নিজ মুদ্রাদোষে নয়, মু্দ্রাগুণে আলাদা।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শারদোৎসব: বাংলাদেশে

দুর্গাপুজো কেবল ভক্তের জন্য-ই নয়, ভাল লাগাদের জন্যও। যে ভাল লাগা থেকে ভাই গিরীশচন্দ্র সেন কোরানশরীফ বাংলায় অনুবাদ করেন, অদ্বৈত আচার্য যবন হরিদাসের উচ্ছিষ্ট নিজহাতে পরিষ্কার করেন, স্বামী বিবেকানন্দ মুসলিম-তনয়াকে কুমারীপুজো করেন! দুর্গা বাঙালির কাছে, ধর্মনির্বিশেষে আগ্রহের, যেহেতু এই দেবী পরিবারসহ আসেন, আর সঙ্গে নিয়ে আসেন কাশফুল আর শিউলি। তাই তো সনাতন রামপ্রসাদ, খ্রিস্টান মাইকেল, ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ এবং মুসলমান কাজী নজরুল দুর্গাকে নিয়ে কলম না ধরে পারেননি!

Read More »