দেশভাগ। যন্ত্রণা। লিখছেন কিশোর। লেখাও যন্ত্রণার কৈশোরীচাল। সেই লেখা যুবক হল, যুবক হল বালক।
শরদাকাশ, ১৯৫৬। ‘এস রায় এন্ড কোম্পানি’-র হাত ধরে প্রথম প্রকাশিত হয়— ‘দিনগুলি রাতগুলি’ (প্রচ্ছদ : পূর্ণেন্দু পত্রী)। তবে ততদিনে আলোক সরকার (উতল নির্জন, ১৯৫০); অরবিন্দ গুহ (দক্ষিণ নায়ক, ১৯৫৪); আনন্দ বাগচী (স্বগত সন্ধ্যা, ১৯৫৩) প্রমুখ কবির কাব্যগ্ৰন্থ প্রকাশ পেয়েছে। চল্লিশের সমর কিংবা সুভাষের মত উচ্চস্বর এঁদের কবিতায় নেই। এঁরা প্রথম থেকেই নির্জন, নিঃসঙ্গ ও একাকী। গলার স্বর চাপা, অথচ অন্যমনস্কতার লেশমাত্র নেই। সেই দেশভাগ আবহে ‘দিনগুলি রাতগুলি’-র সঙ্গে এলেন শঙ্খ ঘোষ। হিমেল গলায় ছুড়ে দিলেন দেশভাগ যন্ত্রণা, কাঁটাতার অভিমান। চল্লিশ যেখানে সামাজিক অবক্ষয়ের দায় নিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে প্রতিটি ছন্দ ও কল্পনা সেখানে পঞ্চাশের হয়ে এই দায়ের উত্তারাধিকার প্রথম বহন করলেন শঙ্খ ঘোষ। কিন্তু একটি পার্থক্য বজায় থাকল, ‘অত্যন্ত মৃদুতা ও প্রশ্নচিহ্ন’। যা তাঁকে পূর্ববর্তী, সমকালীন ও পরর্বতী দশকের থেকে পুরো আলাদা করে রাখে।
‘‘অন্তহীন অন্তহীন অন্ধকারে বিসর্জন ক’রে
কী লাভ? কী লাভ?’’
(ইভাকে/দিনগুলি রাতগুলি)
প্রথম এই কবিতাতেই মৃদু প্রশ্ন ছুড়লেন নিজেকে। রক্তাক্ত করলেন কল্পনা।
ততদিন পর্যন্ত পঞ্চাশের প্রধান বৈশিষ্ট্য বলতে ধরা পড়েছিল একাকী এবং প্রকৃতিকে ভর করে প্রবল অস্তিত্ববাদী কল্পনা। শঙ্খ ঘোষ বারবার তাঁর কবিতায় মেলে ধরেছেন ঝঞ্ঝাটময় প্রকৃতি, মূর্ছনাকে না ভেঙে। মনে হয়, এই অস্তিত্ববাদকে প্রবল অস্তিত্ববাদ করে তোলায় তাঁর সামাজিক দায় এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সুরের কম্পন প্রতিবার তাঁকে প্রশ্ন করতে শেখায়। তাই প্রশ্নও করেন নিজের স্বরে, সামাজিক দায় স্বীকার করে। অথচ আশ্চর্য তিনি নির্জনী! পরস্পর সংযুক্ত রেখে বিদগ্ধ মন কবিতা হয়ে উঠেছিল।
(ভাঙছি… ভাঙছি… ভাঙছি…
ফিরব। ফিরব। ফিরব। এগারো বছর পর…)
জুন, ১৯৬৭। বিদ্যা প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নিহিত পাতালছায়া’, শিল্পী পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রচ্ছদে। খেলা এখানেই শুরু! নিজেকে এগারো বছর ধরে ভেঙে নির্জনী শব্দের সমার্থক আজ তিনি নিজেই। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের সঙ্গে প্রথম কাব্যগ্রন্থের বিস্তর ফারাক। এই কাব্যগ্রন্থে প্রতিটি কবিতা মূল্যবোধের চেহারায় অতিকায়, নাগরিক দায়, পবিত্রতা ও সত্তাকে প্রশ্ন।
‘‘আর কত ছোটো হব ঈশ্বর
ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে।
আমি কি নিত্য, আমারও সমান
সদরে, বাজারে, আড়ালে?’’
(ভিড়/নিহিত পাতালছায়া)‘‘এখন আমি আর কি নারী তোমার মুখে তাকাতে পারি?
কিংবা ওরা আমার মুখের গমক-গমক আঁচে?’’
(প্রতিশ্রুতি/নিহিত পাতালছায়া)
অথবা,
‘‘সব আজ কলকাতায়, কিন্তু আমি দোষ দেব কাকে?’’
(বাস্তু/নিহিত পাতালছায়া)
কবিতায় আরশি এনেছেন তিনি। সত্তাকে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করবেন সম্মুখে। এবং লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তাঁর রাবীন্দ্রিক সত্তাও বারবার ফুটে উঠেছে বিভিন্ন কবিতায়। ‘নিহিত পাতালছায়া’-য় তো বটেই। কেননা— ‘চোখ’ শব্দের ব্যবহার যতবার এসেছে ততবার স্পষ্ট হয়ে গেছে মন। এইখানে বসে নিজের স্বরে করেছেন প্রশ্ন। ‘দিনগুলি রাতগুলি’-র কবিতা ও ‘নিহিত পাতালছায়া’-র কবিতার পার্থক্য এখানেই। কবি নিজেকে পরিণত করেছেন এটা বলার চেয়ে বলা ভাল, তিনি তাঁর সত্তাকে পরিণত করেছেন। আত্মা ও সত্তার দ্বন্দ্ব মুখোমুখি কথোপকথন ছাড়া শঙ্খ ঘোষকে অন্বেষণ অত্যন্ত জটিল।
শঙ্খ ঘোষ শিখিয়েছিলেন— মাঝে মাঝে নিজের কাছে স্বীকারোক্তি দিতে হয়। আয়নায় দাঁড়িয়ে দাবার ঘুঁটি সাজাতে দেওয়া উচিত আত্মা ও সত্তাকে। সামাজিক চেহারাকে দণ্ডমুণ্ড করবার আগে বিবেকের কোর্টে বল ছুড়তে হয়। আত্মা আর সত্তা মুখোমুখি দাঁড়ালে তবেই সম্ভব প্রকৃত কবিতা, প্রকৃত স্বীকারোক্তি।
শঙ্খ ঘোষ বলতেই ভেসে ওঠে দুর্দান্ত খেলা। খেলা মনুষ্যত্ব ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের…