Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

লাভরভের আফ্রিকা ভ্রমণ: বিশ্বকূটনীতিতে নতুন ইঙ্গিত?

আগুনটা ধিকিধিকি জ্বলছিলই। তাকে আর-একটু উসকে দিলেন রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ।

ঔপনিবেশিকতার নাগপাশ থেকে আফ্রিকার দেশগুলির মুক্তি ঘটতে শুরু করে গত শতকের পাঁচের দশকের প্রথম থেকেই। ১৯৫১ সালে। ওই বছর স্বাধীনতা লাভ করে লিবিয়া। আর ছয়ের দশক থেকেই আমরা দেখতে পাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটচাল। প্রথম বলি হন কঙ্গোর জননায়ক প্যাট্রিস লুমুম্বা। মূলত এঁর নেতৃত্বেই বেলজিয়ান উপনিবেশবাদীদের সরিয়ে ১৯৬০ সালের জুন মাসে স্বাধীনতা লাভ করে কঙ্গো। প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। কিন্তু দেখা যায় তাঁর আরোহণের সঙ্গে সঙ্গেই দেশে শুরু হয়ে যায় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। এই আন্দোলন দমন করার জন্য লুলুম্বা আমেরিকা ও রাষ্ট্রসংঘের কাছে আবেদন করে বিফল হন। অবশেষে আমেরিকা ও বেলজিয়ামের সমর্থনপুষ্ট সেনাপ্রধান মোবুটু লুমুম্বাকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন এবং লুমুম্বাকে খুন করা হয়।

এই কৌশল আমেরিকা চালিয়ে এসেছে সেদিন থেকেই। এবং এখনও চালাচ্ছে। সরাসরি কোনও যুদ্ধ নয়। যে রাষ্ট্রপ্রধান সার্বভৌমত্বের কথা বলবেন, প্যান আফ্রিকানিজমের কথা বলবেন, আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের কাছে মাথা বিকিয়ে দেবেন না, তাঁর বিরুদ্ধে শুরু হয়ে যাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী বা অন্য ধরনের তৎপরতা। অথবা সেনাবাহিনীতে বিক্ষোভ। ঠান্ডাযুদ্ধের অবসানের পরও এই কৌশলের পরিসমাপ্তি হয়নি। লিবিয়ার গদ্দাফিকে কীভাবে খুন করা হল তা আমরা সকলেই জানি। এই কায়দায় এখনও খুন করা চলছে। দেড় বছরও হয়নি সিআইএ-র অন্তর্ঘাতের কারণে খুন হয়েছেন চাদের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ইদ্রিস দিবাই।

দিবাই ছিলেন গাদ্দাফির অনুসারী। এই লিবীয় নেতার মতই অর্থনীতি ছিল তাঁরও। যা মনপসন্দ ছিল না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। অথচ নিজের দেশে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন এই চাদ নেতা। ৯০ সালে স্বৈরাচারী হিসিঁ হেব্রেকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন তিনি। তারপর তিনি ছ’-ছ’বার পুনর্নির্বাচিত হন। সিআইএ-র কারসাজিতে তাঁর মত এক জনপ্রিয় নেতা খুন হন। এইরকম একের পর এক জনপ্রিয় নেতাদের খুনের কারণে গোটা আফ্রিকাই মার্কিন-বিরোধী হয়ে ওঠে। যার সঙ্গে যুক্ত হয় খাদ্যসংকট জনিত বিক্ষোভ। খাদ্যসংকট আফ্রিকায় নতুন কোনও কথা নয়। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে এই সংকট আজ এক ভয়ংকর মাত্রায় পৌঁছেছে। আইসিআরসি (ইনটারন্যাশনাল কমিটি অব রেড ক্রস) জানাচ্ছে, আফ্রিকার ৩৪ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ আজ খাদ্য অসুরক্ষার সম্মুখীন। অর্থাৎ, মহাদেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষের খাদ্যের নিশ্চয়তা নেই। এইসব কারণে তাদের আমেরিকার বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে। যার সদ্ব্যবহার করতে কোনও খামতি রাখেননি রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ।

গত ২৩ থেকে ২৫ জুলাই আফ্রিকার চার দেশ— মিশর, ইথিওপিয়া, উগান্ডা ও কঙ্গো ঘুরে গেলেন রাশিয়ার ৭২ বছর বয়স্ক বিদেশমন্ত্রী। প্রতিটি জায়গাতেই তাঁর গলাতে ছিল সেই একই সুর। আফ্রিকার দেশগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সম্মান করে রাশিয়া। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য আফ্রিকার খাদ্য-পরিস্থিতি খারাপ হলেও রাশিয়া তার প্রতিজ্ঞা পূরণে বদ্ধপরিকর। এই কথাই বারবার বলে গিয়েছেন লাভরভ। তিনি ভালই জানেন যে, এই মহাদেশের নেতারা আজ আর আগের মত মার্কিন-প্রেমী নন। সম্প্রতি রাষ্ট্রসংঘ কর্তৃক রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা নিন্দাপ্রস্তাবে ভোট দেয়নি ১৭টি আফ্রিকার দেশ। যার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার মত প্রভাবশালী দেশ। নাইজেরিয়ার মত অর্থনৈতিকভাবে পুষ্ট দেশ আমেরিকা ও ব্রিটেনের এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেও অন্য একটি পশ্চিম ঘনিষ্ঠ দেশ যে এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়নি, সেটিও উল্লেখযোগ্য। দেশটি হল উগান্ডা। ১৯৮৬ সাল থেকে যে দেশের প্রেসিডেন্ট পদে পশ্চিম-ঘনিষ্ঠ ইয়োএরি মুসেভেনি। রাষ্ট্রসংঘ অধিবেশনে ভোটদানে বিরত থাকে এই দেশ।

উল্লেখ্য, লাভরভ যে চারটি আফ্রিকার দেশে গিয়েছিলেন, তার অন্যতম হল উগান্ডা। মুসেভেনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন রুশ বিদেশমন্ত্রী। আর তারপরেই যেন মধু ঝরে পড়ে সাড়ে তিন দশকের প্রেসিডেন্টের গলায়। ‘যদি রাশিয়া ভুল করে, আমরা বলব। কিন্তু যেখানে তাদের ভুল নেই, আমরা তাদের বিরুদ্ধে যেতে পারি না।’

শুধু এখানেই শেষ নয়। লাভরভের সঙ্গে সাক্ষাতের পর মুসেভেনি বলেন, ‘শুধু নিরাপত্তা ক্ষেত্রেই এই দুই দেশ (রাশিয়া ও উগান্ডা)-এর সহযোগিতা আটকে থাকতে পারে না।’ কৃষি, পরমাণু প্রযুক্তি, মহাকাশ বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য রাশিয়া ও উগান্ডা চুক্তি স্বাক্ষর করে।

এসবের ইঙ্গিত ভালই বোঝেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতির জন্য কূটনীতিবিদ লিন্ডা টমাস-গ্রিনফিল্ডকে উগান্ডায় পাঠান তিনি। গত ৪ আগস্ট মুসেভেনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন লিন্ডা। ড্যামেজ কন্ট্রোলে খামতি রাখেননি তিনি। জোর দেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উগান্ডার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর।

কিন্তু তার পরেও মুসেভেনি বলেন, ‘কারও শত্রু মানে আমাদের শত্রু, এমন তত্ত্বে বিশ্বাস করি না আমরা।’ তিনি আরও স্পষ্টভাষায় বলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে আমরা বাণিজ্য করতে চাই। পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গেই বাণিজ্য করতে চাই আমরা।’

স্পষ্ট ইঙ্গিত মুসেভেনির। এইখানেই প্রশ্ন উঠছে, আফ্রিকার কূটনীতিতে কি তাহলে পরিবর্তন আসতে চলেছে?

চিত্র: গুগল
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শতবর্ষে মহানায়ক উত্তমকুমার

‘মহা’ শব্দটি মহান আর বিশাল, এই দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ‘মহাকাব্য’ বা ‘মহারাজ’। কাব্য আর রাজার চেয়ে তার মাত্রা ভিন্ন, মহিমা অনেক বেশি তাৎপর্যময়। উত্তম বাংলা চলচ্চিত্রের সেই তাৎপর্যময়তার একমাত্র উদাহরণ। যাঁকে শ্রদ্ধাভরে আমরা ‘কিংবদন্তি’-ও বলে থাকি। তাই সত্যজিৎ রায়ের মতো আরেক কিংবদন্তি তাঁকে নিয়ে চিত্রনাট্য লেখেন, ছবি বানান, আর সে ছবির ‘নায়ক’ হন উত্তমকুমার।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সুকান্ত ভট্টাচার্য: ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার সহোদর এক কবি

‘–ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে’, সুকান্ত লিখেছেন নিজের সম্পর্কে। বলেছেন, ‘আমি এক অঙ্কুরিত বীজ’। এই বীজ মহীরুহে পরিণত হতে পারল না, বাংলা সাহিত্যের পরম দুর্ভাগ্য এটা। কিন্তু তাঁর একুশ বছরের জীবনে তিনি আভাস দিয়ে গেছেন, তাঁর সম্ভাবনা কতদূর প্রসারিত হতে পারত। সুকান্ত মানে একজন কবিমাত্র নন, তার চেয়েও আরও অধিক কিছু।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাইশে শ্রাবণ ও প্রসঙ্গত

প্রয়াণের আগে, সব হিসেব বাদ দিয়ে যদি তাঁর জীবনের শেষ পাঁচ বছরের কথা-ই ধরি, দেখব, কত প্রিয়জনের মৃত্যুশোক বহন করতে হয়েছে তাঁকে। যেহেতু তিনি ছিলেন মানুষের সান্নিধ্যপ্রিয়, তাই অন্যের চেয়ে ঢের ঢের বেশি মৃত্যুবেদনা সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। এসব মৃত্যু তাঁকে বেদনার্ত করলেও নিজের মনোবলের জোরে সে-অরুন্তুদ বিষাদকে কাটিয়েও উঠেছেন। পাশাপাশি মৃত্যু নিয়ে তাঁর দর্শন গড়ে উঠতেও তা ভূমিকা রেখেছে। তাই তিনি বলতে পারেন, তিনি-ই বলতে পারেন, ‘দুদিন দিয়ে ঘেরা ঘরে/ তাইতে যদি এতই ধরে/ চিরদিনের আবাসখানা সেই কি শূন্যময়?’ কেন পারেন?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার: অন্য ও অনন্য

তাঁর জন্মদিনের চেয়েও মৃত্যুদিনটিকে অধিকভাবে স্মরণ করা হয়, এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। তাছাড়া বাংলা চলচ্চিত্র-জগতে তো কম খ্যাতিমান ব্যক্তির আবির্ভাব হয়নি, সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল, ছবি বিশ্বাস-কানন দেবী-সুচিত্রা-সৌমিত্র, তবু তাঁর মতো, ঠিক তাঁর মতো স্মরণযোগ্য হয়ে রইলেন না কেউ। শ্রাবণের অনুষঙ্গে নয়, উত্তমকুমারের প্রয়াণদিবসটি চিহ্নিত চব্বিশে জুলাই তারিখটির বিধুরতায়। ১৯৮০-র এই দিনটিতে বাংলা চলচ্চিত্র-জগতের এই দিকপাল প্রতিভার জীবনাবসান ঘটে। আজ তাঁর মৃত্যুর পঁয়তাল্লিশ বছর পূর্তিতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করে উত্তম সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্যের ডালি।

Read More »
শৌনক দত্ত

রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী

নাটকটির নাম প্রথমে রেখেছিলেন যক্ষপুরী, তারপর নন্দিনী এবং পরিশেষে রক্তকরবী নামে থিতু হয়। শিলং-এ ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে যে নাটক লেখা শুরু হয়েছিল তার দশম খসড়া প্রকাশিত হয় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রায় দেড় বছর পর আশ্বিন ১৩৩১ বঙ্গাব্দে—১৯২৪ সালে। প্রকাশিত হবার পরেও, একাদশতম খসড়া প্রস্তুত করার কথা ভাবেন নাট্যকার। অনেকেই বলেছেন, এটি নাট্যকারের হৃদয়ে লালন করা কোনও স্বপ্ন। কেউ কেউ এই নাটকের মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম চেতনার ছায়া খুঁজেছেন। নানা প্রশ্ন, নানা যুক্তি নিয়ে নাটকটি রচনার পর থেকে সমসাময়িক সময় পর্যন্ত দারুণ আলোচিত ও জনপ্রিয়। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত নাটকটি নিয়ে বহু আলোচনা। শতবর্ষে এসে দাঁড়ানো সেই রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নানামাত্রায় বিবেচনাযোগ্য একটি নাটক; বহুমাত্রিক এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ।

Read More »
নুশান জান্নাত চৌধুরী

নুশান জান্নাত চৌধুরীর কবিতাগুচ্ছ

কিছুকাল ঘুমিয়ে, কিছুকাল লুকিয়ে,/ কিছু শহর, কিছু মানুষের ভিড়ে হারিয়ে/ আমি দেখি—// কোনও এক/ পথহারা দেবদূতের বিষণ্ণ ডানার পাশে/ আমি বুক পেতে দিয়েছি// চুলের ভেতর জন্ম নিয়েছে/ ঘাসফুল থোকা থোকা, বুকের মাঝখানে একটা প্রাচীন পেরেক,// ঝরাপাতার রাজ্যপাটে/ আমার বাম হাঁটুতে গেঁথে আছে—/ আগামী বছরের প্রথম সন্ধ্যা;

Read More »