Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ছোটগল্প: হাওয়ার দুর্গ

দী প  শে খ র  চ ক্র ব র্তী

এ কথা ভাবলে নিজের ওপরে প্রবল ঘৃণা হয় যে, এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য একসময় স্বপ্ন দেখেছি। বাবার ওপরেও এক অস্বাভাবিকরকম রাগ হয়। স্কুলে ভর্তির জন্য কতরকম পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে আমাকে নিয়ে গেছিলেন বাবা। নিজেও কতরকম পরীক্ষার ভেতর দিয়ে গেছেন। অবশেষে সবার সমস্ত চিন্তা এবং উদ্বেগ মিটিয়ে সসম্মানে ভর্তি হলাম স্কুলে। বাবা নিশ্চিন্ত হলেন। জেলার মধ্যে অন্যতম নামকরা স্কুল, ফলে বাবার নিশ্চিন্ত না হওয়ার কোনও কারণই ছিল না। একগুচ্ছ প্রতিযোগী নিয়ে স্কুলে ভর্তি হলাম। প্রতিযোগী। তারা কেউ বন্ধু নয়। শুধু ন’জনকে তাদের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলাম, যারা বন্ধু। এই ন’জনের নাম এখানে বলা প্রয়োজন।

এক, অনিকেত চক্রবর্তী। বাড়ি নবপল্লি। বাবা কবিতা লেখেন। মাথায় ছিট আছে।

দুই, সাম্য বণিক। বাড়ি মধ্যমগ্রাম। বাবা জাহাজের তলা রং করেন। মাথার চুল পাটকাঠির মতো।

তিন, জিশান আলি। বাড়ি কাজিপাড়া। বাবা শীতকালে প্যাকেটজাত রোদ বিক্রি করেন। ছোটবেলাতে একটাই গালাগাল জানত, চোদনা।

চার, সৌরভ মিত্র। বাড়ি বনমালিপুর। মা বাবাকে রোজ ঠ্যাঙায়। সবসময় প্যান্টের চেন খোলা থাকে (ইচ্ছাকৃত)। ওই-টা বেরিয়ে থাকে।

পাঁচ, ক্রিস্তোফার সন্দীপ। বাড়ি নবপল্লি। নামের কোনও মাথামুণ্ডু নেই। মা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করেন। বড় হয়ে পাতা খাবে।

ছয়, বিশু রায়। বাড়ি কালিকাপুর। বাবা ছাট নকশাল। মায়ের অন্য সম্পর্ক আছে। অনিকেতের দলের লোক।

সাত, সুপ্রিয় সরকার। বাড়ি মধ্যমগ্রাম। মা শিক্ষিকা। দাঁতটা উঁচুমতো। বাড়িতে স্নানের বালতিতে নানা জাতের মাছ পোষে।

আট, নাজবুল আলম। বাড়ি ত্রিকোণ পার্ক। ‘নাচ মেরি বুলবুল’ গান গাইলেই অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গিতে নাচতে শুরু করে। আমাদের সন্দেহ হয় যে, বিষয়টা জাদুর মতো।

নয়, জ্যোতির্ময় দত্ত। বাড়ি চাঁপাডালি। তখন থেকেই প্রেমিক। দাদু কিছুদিন আগেই মারা গেছেন। ঈগলের পায়খানা সংগ্রহ করা ওর এক নেশা।

এবং শেষ,

দীপ শেখর চক্রবর্তী। বাবা সিপিএম। ফাঁকিবিদ্যা ও পালানোতে তখন থেকেই চৌকস। শান্ত, তবে ভেতরে ভেতরে ভয়ানক (এমন ওর নিজের মনে হয়)।

তাহলে মোট আমরা হলাম দশজন।

স্কুলে ঢুকেই বিষয়টা আমাদের অসহ্য লাগতে শুরু করেছিল। অন্যান্য ছেলেরা চোখমুখ বুজে নেমে পড়েছিল প্রতিযোগিতায়, শুধু আমরাই পারিনি। কেন পারিনি, তা খুঁজতে যাওয়া বৃথা। তবে মনে হয়, আমরা সকলেই কোনও না কোনওভাবে ছিলাম বিপন্ন। এই বিপন্নতা আমাদের প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিল।

আমাদের স্কুলটি ছিল একটি সিমেন্টের বড় উঠোনের চারিদিকে, তিনতলা বিল্ডিং। ভেতরেই ছাত্রদের থাকার জায়গা। গোটা স্কুলটির অদ্ভুত কালো রং। তিনতলার ওপরে এক প্রান্তে শিক্ষকদের বসবার ঘর। কোনও এক গুপ্ত সিঁড়ির মাধ্যমে তা শিক্ষকদের বসবাস করার ঘরগুলোর সঙ্গে যুক্ত। বসবার ঘরে ছাত্রদের প্রবেশ নিষেধ। গোটা ঘরটিতে একটিই দরজা, কোনও জানালা নেই। গোটা স্কুলটি উঁচু পাঁচিলের ওপর কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। ছাত্রদের বাইরে বেরোতে চাওয়া ঘোরতর অপরাধ। একবার স্কুলে প্রবেশ করার পর সর্বশেষ পরীক্ষায় পাশ করা না অবধি, বাইরের জগতের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখা নিষিদ্ধ। এছাড়া এই স্কুলবাড়ির মধ্যে এমন একটি গুপ্ত ঘর আছে, যেটি প্রধানশিক্ষকের। সেই ঘর কোনও ছাত্র কোনওদিন দেখতে পায় না। প্রধানশিক্ষকের কণ্ঠস্বর শোনা ছাড়া নিজেদের চোখে তাকে দেখার অনুমতি ছিল না ছাত্রদের। তাও সেই কণ্ঠস্বর শোনা যেত লাউডস্পিকারে। ভারী, ফ্যাঁসফ্যাঁসে, যেন এক যন্ত্রমানুষের কণ্ঠ। শিক্ষকদের মধ্যে একমাত্র সহকারী প্রধানশিক্ষক ছাড়া কেউই তাকে দেখতে পেতেন না। মাঝে মাঝে মনে হত, প্রধানশিক্ষক কোনও মানুষ নন, একটি ধারণামাত্র। সিমেন্টের উঠোনের একদিকে ছিল দারোয়ানদের সারিবদ্ধ ঘরগুলো। তার পাশে বিরাট প্রস্রাবখানা। উঠোনটির মাঝখানে এক উঁচু মূর্তি। এত উঁচু যে, তার মুখ ঠিকঠাকমতো দেখতে পাওয়া যায় না। তার ঠিক পাশেই একটা ফাঁসিকাঠ। যে সকল ছাত্ররা স্কুলের এই নিয়মতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, তাদের ঝোলানো হবে ওখানে। গোটা স্কুলচত্বরে একটুও মাটি পাওয়া যায় না। গাছপালা কিছুই নেই। এমনকী, কিছু বছরের মধ্যেই আকাশটাকে ঢেকে ফেলার একটা ব্যবস্থা করা হচ্ছে। টাকা বরাদ্দ হয়েছে, কাজ শুরু হওয়ার অপেক্ষায়। উঠোনটির এক ধার ঘেঁষে এক মঞ্চ। ভোরবেলা সেখানে প্রার্থনায় বসতে হয়। প্রার্থনাসঙ্গীত আর কিছুই নয়, দেশের শাসকের স্তুতিমূলক এক গান। সেখানে শাসকের অলৌকিক সমস্ত ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। বিশেষভাবে যেটা বলা হয়েছে—

প্রত্যেক নাগরিকের উচিত দেশপ্রেমিক হওয়া। দেশপ্রেমিক অর্থাৎ, দেশের শাসকের প্রতি নির্বিবাদ আস্থা জানানো। ছাত্রজীবন থেকেই এই সু-নাগরিক হওয়ার অভ্যেস করে যেতে হবে।

এসবে আমাদের কিচ্ছু যায়-আসত না। আমরা হয়তো কোনও না কোনওভাবে জাদুগ্রস্ত ছিলাম। ভেতরে ভেতরে কেউ আমাদের বারবার বলে উঠছিল— মুক্তি। আমরা, এই দশজন, আকাশটা সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলার আগেই পালিয়ে যেতে চাইছিলাম এখান থেকে।

আমরা দশজন।

প্রথমে পালানোটা আমাদের কাছে তেমন কঠিন মনে হয়নি। তখন পঞ্চম শ্রেণি। অভিজ্ঞতা কম, ফলে এর ফলাফল কী হতে পারে, কিছুই বুঝতে পারিনি আমরা। প্রস্রাবখানার ছাদের ওপরে কিছুটা কাঁটাতার সরিয়ে, সেখান থেকে পালানোর পরিকল্পনা করা হল। এত সহজেই পালানো যেতে পারে, সে কথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করিনি। আমার মতোই বিষয়টিকে সন্দেহ করেছিল অনিকেত, সুপ্রিয় এবং জিশান। তবে বাকি সকলের উৎসাহে পরিকল্পনাটি গ্রহণ করা হল। এক শনিবার দুপুরে আমরা এক হলাম প্রস্রাবখানার সামনেটায়। এদিক-ওদিক দেখে নিশ্চিন্ত হতে চাইলাম যে, কেউ আমাদের দেখছে না। তারপর একটা বড় করাত নিয়ে ছাদের ওপর উঠে গেল অনিকেত এবং সাম্য। নীচে আমরা চারিদিকে নজর রাখছি। ক্লাস চলছে তখন, বাইরে প্রায় কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। সমস্ত স্কুলটা বিরাট এক কালো জন্তুর মতো ঘুমোচ্ছে দাঁত নখ গুটিয়ে। ঠিক যখনই ওরা কাঁটাতারের ওপর করাত ঠেকাল, আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বিপদঘণ্টিটা বেজে উঠল। আমাদের কান ফেটে গেল যেন। একটা অসহ্য বিপদঘণ্টি বাজছে, কী ভয়ানক সেই শব্দ! আমরা কান চেপে ধরে একে একে বসে পড়লাম মাটিতে।

যুদ্ধটা এখানেই শুরু হয়ে গেল।

স্কুলের ভেতরে যে এমন আশ্চর্য এক বিচারালয় আছে, তা আমরা এই প্রথম জানতে পারলাম। বিচারক আর কেউ নয়, একটি লাউডস্পিকার। সেখান থেকে ভেসে আসছে প্রধানশিক্ষকের ভারী অথচ ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলাটি। বিচারে আমাদের দশজনের মৃত্যুদণ্ড হতে পারত, তবে তেমন পরিকল্পনা ওদের ছিল না। ওরা শোধরানোর সুযোগ দিতে চায়। ওদের প্রধান শাস্তি হল ভয় দেখানো।

সোমবার স্কুল শুরুর মুহূর্তে দেখা গেল, ফাঁসিকাঠে ঝুলে আছে অনিকেত এবং সাম্যের দেহদুটি। নিষ্প্রাণ। অল্প অল্প দুলছে। রোদ এসে পড়ছে ওদের শরীরে। বাকি ছাত্ররা কেউ ওদিকে তাকাচ্ছে না। তাদের হাবভাবে মনে হচ্ছে, ওদের দুটি দেহ অদৃশ্য। যেন ফাঁসিকাঠটাকেও অস্বীকার করতে চাইছে তারা। বিকেলের আগেই দেহদুটো তুলে দেওয়া হল পরিবারের লোকেদের হাতে। তাদের নির্বিকার মুখ আমাদের ভেতরটা ছারখার করে দিল। আমরা, বাকি আটজন যারা, রয়ে গেলাম।

||২||

দুটো বছর পেরিয়ে গেল। ইতিমধ্যে আমরা পঞ্চম শ্রেণি থেকে সপ্তমে উঠেছি। এই দুবছরে আমরা নানারকম পরিকল্পনা করে একটিকেও বিশ্বাস করতে পারিনি। অবশেষে, শেষ এক বছরে, সুড়ঙ্গ খোঁড়াকেই একমাত্র উপায় বলে ভেবেছি। একটি সুড়ঙ্গ, যা ছাত্রদের আবাসনের পাশ থেকে খুঁড়ে আমরা নিয়ে যাব কলোনির মোড় অবধি। এক বছর ধরে খুব সাবধানে আমরা একে একে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে চলেছি। প্রথমত, একটা শাবল যোগাড় করাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক্ষেত্রে কাজে লেগে যায় আমাদের লম্বা টিনের স্কেলগুলো। এক বছর ধরে খুঁড়ে আমরা সুড়ঙ্গটা বহুদূর নিয়ে যেতে সক্ষম হই। অন্যসময় যাতে কারও চোখে না পড়ে, তার ওপরে একটা চাদর পেতে শুকোতে দিই আমাদের প্রতিদিনের শীতের জামাকাপড়গুলো।

ঠিক হল, মঙ্গলবারদিন বেশি রাতে আমরা আটজন এই সুড়ঙ্গে প্রবেশ করব। সেইমতো প্রস্তুত হলাম। প্রার্থনার জন্য যে ছোট ছোট মোমবাতিগুলো আমরা পেতাম, তা সুড়ঙ্গটি আলো করার জন্য কাজে লাগবে। শীতের রাত, চাদর জড়িয়ে আমরা সুড়ঙ্গটির সামনে দাঁড়ালাম। তারপর চাদর সরিয়ে একে একে প্রবেশ করলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর বুঝলাম, আমরা আটজন নই, সুড়ঙ্গের ভেতর রয়েছে আরও একজন।

সেই শীতের রাতেই আমাদের বিচারসভা বসল এবং এবারও ওরা আমাদের একটা সুযোগ দিলেন। পরেরদিন সমস্ত ছাত্রদের গোল করে দাঁড় করানো হল সিমেন্টের উঠোনটার মাঝখানে। দুটো কাঠের গুঁড়ি এনে বেঁধে ফেলা হল জিশান এবং সৌরভকে। জিশান চিৎকার করে সেই একটাই গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে, যা সে ছোটবেলায় জানত। এদিকে সৌরভের প্যান্টের চেন খোলা, ওই-টা বেরিয়ে আছে। দুলছে, ঝুলছে, সেই বয়সে, যখন সত্যিই ওই-টা নিয়ে খেলা করবার ওর বয়েস হয়েছে। তবে কিছুক্ষণ। তারপর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে ওটি। হতে পারবে না জিশানের গালাগালটা কারণ, সৌরভের ওই-টার মত তো কোনও মাংসল বস্তু নয়।

শীতের সকালটা কয়েকবার বিকট শব্দে কেঁপে উঠল। তারপর সমস্ত চুপচাপ। আমরা আর ছয়জন মাত্র পড়ে রইলাম।

||৩||

আমরা নবম শ্রেণিতে উঠলাম। মাঝে আরও দুটি বছর। যুদ্ধটা আরও কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। আমরা আরও গভীর এবং বেপরোয়াভাবে ভাবতে শুরু করেছি, যুদ্ধটা কীভাবে জেতা যেতে পারে। ইতিমধ্যে এই চার বছরে সবচেয়ে বড় যে যুদ্ধটা লড়তে হয়েছে তা হল, নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। একেক সময় মনে হয়েছে এসব অহেতুক আত্মহত্যার মতো। যদি মেনে নিতে পারি, তাহলে কোনও ক্ষতিই তো নেই। বরং সম্মান, আদর এবং আরও নানাকিছু। তবে আগেই বলেছি, আমাদের মধ্যে এমন কিছু একটা অস্বাভাবিক ছিল, যা কিছুতেই পথ থেকে সরে আসতে দেয়নি। অনেকেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ফিরে এসেছি আরও প্রবলভাবে।

তবে ইস্কুল আমাদের কোনও বিশেষ শাস্তি দেয়নি, নজরবন্দি করেনি। বরং, অন্যান্য ছাত্রদের মতোই আমাদের সঙ্গে ব্যবহার করেছে। শিক্ষকদের বিশেষ কোনও নির্দেশ দেয়নি, যাতে করে তারা আমাদের সঙ্গে অন্য আচরণ করে। ওরা আমাদের খোলা রেখেছিল, ফলে আমাদের পক্ষে বিষয়টা আরও মুশকিল হয়ে উঠল। এক-এক সময় মনে হত, সকলেই বিশ্বাসঘাতক, সকলেই ওদের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করে চলেছে। কখন কীভাবে যে ওরা খোঁজ পেয়ে যাচ্ছে, তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শুধু এইটুকু বুঝেছিলাম, এবার পালানোর জন্য আরও পোক্ত পরিকল্পনা চাই।

ছাদ দিয়ে আকাশটা ঢেকে ফেলার আগে আমরা সেটাকে ব্যবহার করতে চাইছিলাম। এই বিষয়ে আমরা অবশ্যই জ্যোতির্ময়ের সাহায্য নিতে পারি। ঈগলের পায়খানা সংগ্রহ করতে করতে তাদের কারও কারও সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। ঈগলেরা আমাদের সাহায্য করতে রাজি হয়েছিল। তবে বিষয়টি অতটা সহজ ছিল না। কারণ, অবশিষ্ট আকাশটায় কোনওদিন কোনও পাখি ওড়েনি। ওইটুকু ছিল পাখিদের জন্য নিষিদ্ধ আকাশ। এমনকী, কোনও পাখি যদি ভুল করেও ওই আকাশে চলে আসে তাহলে গুলি করে নামানো হবে, এই ছিল নির্দেশ। ফলে ঈগলদের পক্ষে কাজটা সহজ ছিল না। পরিকল্পনা করা হল, খুব ভোরেই কাজটা আমাদের সেরে ফেলতে হবে।

রবিবারের দিন আমরা এই কাজটি করতে চেয়েছি। পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি, একমাত্র রবিবারেই শাসনব্যবস্থা কিছুটা শিথিল থাকে। জ্যোতির্ময়ের নির্দেশমতো, ঈগলেরা ভোর পাঁচটায় আসার জন্য প্রস্তুত হল। এবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আমরা বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেছিলাম। যাতে আমাদের ছ’জনের বাইরে কেউই এর বিন্দুমাত্র টের না পায়, সেদিকে আমাদের বিশেষ নজর ছিল। ঠিক ভোর চারটের সময় আমরা ছ’জন উঠে পড়লাম। নিজেদের যথাসম্ভব প্রস্তুত করে চলে গেলাম বিরাট মূর্তিটার পাদদেশে। ঠিক পাঁচটার সময় ঈগলের দল আমাদের নিয়ে যাবে।

আমাদের বুকের ভেতর আরও গভীরভাবে উত্তেজনাটা বাজতে লাগল। পা এমন কাঁপতে লাগল যে, দাঁড়িয়ে থাকাই সমস্যার হচ্ছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ঈগলদের আসার সময়টা। ছ’টা বাজল ঘড়িতে আর দূর আকাশে দেখা গেল ঈগলের দলটাকে। ধীরে ধীরে আরও স্পষ্ট হচ্ছে। আরও বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠছে আমাদের মুক্তির সম্ভাবনাটা।

তখনই, ঠিক ছ’টা অব্যর্থ বন্দুকের শব্দ কানে তালা লাগিয়ে দিল। ঈগলের দেহগুলো এসে পড়ল আমাদের পাশে আর রক্তে ভরে গেল সিমেন্টের উঠোনটা। কিছুক্ষণ ছটফট করে প্রত্যেকটি দেহ স্থির হয়ে গেল, একটুও নড়ল না।

এবার পালা ক্রিস্তোফার সন্দীপ এবং বিশু রায়ের। এবং সেই সূত্রেই জানা গেল, আমাদের এই ইস্কুলের ভেতরেই বিশাল এক খাঁচায় আছে হিংস্র কালো চিতাবাঘটি। আমাদের শাস্তি দেওয়া হল না কোনও, শুধুমাত্র নিমন্ত্রণ করা হল এই সুন্দর খেলাটি দেখার জন্য। চিতাবাঘটি ছিন্নভিন্ন করার আগে কিছুক্ষণ খেলল ক্রিস্তোফার সন্দীপ এবং বিশু রায়কে নিয়ে। তারপর বসে আরাম করে খেল। পড়ে রইল, সন্দীপের একটা বাক্স। এই বাক্স থেকেই আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, সন্দীপের চোখ সবসময় কেন লাল।

বাকি রইলাম আমরা চারজন—

সুপ্রিয় সরকার, নাজবুল আলম, জ্যোতির্ময় দত্ত এবং দীপ শেখর চক্রবর্তী।

||৪||

ইতিমধ্যে আরও দুটো বছর আমরা কাটিয়ে ফেলেছি ইস্কুলে। আদবকায়দা আমাদের ভেতরেও কিছু কিছু পচিয়ে ফেলেছে। আমরা কিছুটা হলেও এখন স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক। একদিন দল বেঁধে মুক্তির যে চেষ্টাটা শুরু করেছিলাম আমরা, তা এখন একটা দলের ভাবনা নয়। ব্যক্তিমুক্তিভাবনা এসে আছন্ন করেছে তাকে। যে কোনও উপায়েই আমরা মুক্তি পেতে চাই এই স্কুল থেকে, তা একজন হলে একজনই। তবে, কিছুটা চক্ষুলজ্জার কারণেই হয়তো চারজন দল বেঁধে আছি এখনও। এগারো ক্লাসে ওঠা এবং অনেকটা সুগঠিত শরীরের অধিকারী হওয়ার সুবিধাটা এখন আমরা নিতে চাইছিলাম। সুপ্রিয়র সুন্দর চেহারার চেষ্টাতেই এটা সম্ভব হয়েছিল। সে পটিয়ে ফেলেছিল দারোয়ানের কুৎসিত বউটাকে। সে-ই অবশেষে আমাদের সাহায্য করতে রাজি হয়েছিল। তবে কোনও সাহায্যই কেউ বিনামূল্যে করতে রাজি হয় না। বদলে আমাদের চারজনের কাছ থেকে ও চেয়েছিল সেই সুখ, যা ওর দারোয়ান বর কখনও দিতে পারেনি ওকে।

রবিবারের ওপরে আমরা আর ভরসা করতে পারছিলাম না। বেছে নিলাম বৃহস্পতিবারের দিনটি। সন্ধের পর দারোয়ানের বউ গেটের চাবিটা ঠিক হাতিয়ে নেবে বরের কাছ থেকে। সেই চাবি নিয়ে আমরা রাত অবধি অপেক্ষা করব। তারপর যখন সবদিক ফাঁকা হয়ে যায়, তখন গেট খুলে বেরিয়ে যাব বাইরে। চাবিটি নিজেদের কাছে রাখা নিয়ে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ভাবি, কী শিক্ষাই না আমাদের দিয়েছে স্কুলটি!

পরিকল্পনা অনুসারে দারোয়ানের বউয়ের কাছ থেকে চাবি নিয়ে আমরা লুকিয়ে রাখলাম নির্দিষ্ট একটা জায়গায়। তারপর রাত হলে বেরিয়ে পড়লাম বড় দরজাটার উদ্দেশে। আশেপাশে একজন দারোয়ানও নেই। তবে এরকম ফাঁকা অবস্থার প্রতি আমরা আর বিশ্বাস রাখতে পারি না। জানি, যে কোনও সময়েই ওরা আমাদের ধরে ফেলতে পারে।

চাবিটা ঘুরিয়ে দরজার বাইরে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম, কিছুদূর পর আরও একটা দরজা। সেই দরজাও একই চাবিতে খোলে। খুলে বেরোতেই আরও একটা একইরকম দরজা। আবার চাবি ঘোরালাম, খুলে গেল। আরও একটি একই দরজা। খুলছি আর সামনে একইরকম একটা দরজা এসে দাঁড়াচ্ছে। কিছুতেই বাইরে বেরোতে পারছি না। কোনও দরজাই বাইরে অবধি নিয়ে যাচ্ছে না আমাদের। বুঝলাম দারোয়ানের বউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আমাদের সঙ্গে। নিজেদের ঘৃণা করলাম, তবে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করলাম সদ্য শক্তিশালী হয়ে ওঠা আমাদের পুরুষাঙ্গগুলোকে।

বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল সুপ্রিয় এবং নাজবুলকে। নিজেদের ঘরে ওদের ঝুলে পড়তে হবে পাখাতে দড়ি বেঁধে— এই নির্দেশ। নইলে ওদের বাবা মাকে নিয়ে এসে চোখের সামনে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। সারাজীবন গালাগাল করে যাওয়া নাজবুলের মনে যে বাবার জন্য এতটা ভালবাসা ছিল, কে জানত! দুজনের মৃতদেহ যখন ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হল, তখন আমাদের ভেতর ঠিক ততটা প্রতিক্রিয়া হল না। বুঝলাম, এই দুঃখ আর তত বড় দুঃখ নয়।

নিজেদের ভেতরের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম। ধীরে ধীরে স্কুলটি আমাদের বানিয়ে তুলতে পেরেছে। যতই প্রতিরোধ করি না কেন, আমরা ওর শিক্ষায় কিছুটা হলেও শিক্ষিত হয়ে উঠতে পেরেছি। নির্মমতাই আমাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে এখন।

বাকি রইলাম আমরা দুজন। নয়, জ্যোতির্ময় দত্ত। বাড়ি চাঁপাডালি। তখন থেকেই প্রেমিক। দাদু কিছুদিন আগেই মারা গেছেন। ঈগলের বিষ্ঠা সংগ্রহ করা ওর এক নেশা।

এবং শেষ,

দীপ শেখর চক্রবর্তী। বাবা সিপিএম। ফাঁকিবিদ্যা ও পালানো টালানোতে তখন থেকেই চৌকস। শান্ত, তবে ভেতরে ভেতরে ভয়ানক।

||৫||

কিছুদিন শান্তভাবে কেটে গেল। হেমন্তকালের কমলালেবুর মতো রোদ আমাদের স্কুলের ভেতরে ঢোকে না। ছাদটা প্রায় পুরোপুরি হয়ে গেছে। আকাশটা অল্প দেখা যায় এখন। সেই আকাশ এখন আর আমাদের আকর্ষণ করে না। নিজের ভেতরে বদ্ধতার যন্ত্রণা আর অনুভব করি না। মুক্তির স্বাদ কি এখনও তেমন মিষ্টি? এত বছর এত বন্ধুকে হারিয়ে এখন অবশিষ্ট পড়ে আছি আমি এবং জ্যোতির্ময়।

একদিন দুপুরে আমাদের নিতে এলেন একজন শিক্ষক। দুজনের চোখে কালো কাপড় বেঁধে নিয়ে যাওয়া হল এক আশ্চর্য ঘরে। প্রধানশিক্ষকের ঘর। কোনও জানালা নেই, দরজা নেই। কোথা থেকে প্রবেশ করলাম, তার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারলাম না। শুধু বিরাট এক কালো পর্দা টাঙানো আছে চোখের সামনে। তার পেছন থেকে সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর। গম্ভীর, ফ্যাঁসফ্যাঁসে, যান্ত্রিক।

—এত বছর ধরে এখান থেকে মুক্তি চেয়েছ তোমরা। এত বন্ধুকে হারিয়েছ। তবুও দমে যাওনি। তার পুরস্কার যদি না দিই, তবে তোমাদের প্রতি অন্যায় করা হয়।

(কিছুক্ষণ থেমে)

—আজ তোমাদের পুরস্কার আমি দেব। তবে দুজনকে আমি পুরস্কার দিতে পারি না। দুজনের পুরস্কার হয় না। পুরস্কার একটি। যে অর্জন করতে পারবে, তারই পুরস্কার। আমি শিক্ষকবাবুকে অনুরোধ করছি, যাতে ওদের হাতে ওদের পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।

শিক্ষক, যিনি আমাদের নিয়ে গেছিলেন, আমাদের দুজনের হাতে একটা করে পিস্তল তুলে দিলেন। পুনরায় প্রধানশিক্ষকের কণ্ঠস্বর,

—পিস্তলদুটি খালি। এই স্কুলের ভেতরে একটিমাত্র গুলি তোমাদের জন্য রাখা আছে। যে প্রথমে তা খুঁজে পাবে এবং অপরের বুকে তা বিঁধিয়ে দিতে পারবে, মুক্তি তার জন্য। আমি নিজের হাতে তার মুক্তিপত্রে সই করে দেব। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুক।

||৬||

শুক্রবার, আমি এবং জ্যোতির্ময়, দুজনে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছি দুদিকের দুটি খাটে। পরস্পরকে আমরা একটুও বিশ্বাস করি না আর। আমি জানি, জ্যোতির্ময়ও সারাদিন তন্নতন্ন করে খুঁজেছে সেই একটিমাত্র গুলি। এই মুহূর্তে ও আমার বন্ধু নয়, প্রতিযোগী মাত্র। আমরা দুজনেই জানি, যে কোনও মুহূর্তে গুলিটা আমরা খুঁজে পেয়ে যেতে পারি। তারপর এতবছরের জয় আমাদের হাতের মুঠোয়।

অথবা এমনও হতে পারে, গুলিটা আদতে কোথাও নেই। আমাদের বুকের ভেতরে দুটো বন্দুক রেখে শেষতম শাস্তিটা আমাদের দিয়েছে এই কালো বিরাট জন্তুটা। আমরা এবার ওর খাদ্য। সারাজীবন ধরে দুটো বন্দুক বুকের মধ্যে নিয়ে আমরা খুঁজে চলব সেই অন্তিম বুলেটটা, যা আমাদের মুক্তির দলিল হতে পারে।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
4 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

সুজিত বসু

সুজিত বসুর দুটি কবিতা

তারার আলো লাগে না ভাল, বিজলীবাতি ঘরে/ জ্বালাই তাই অন্তহীন, একলা দিন কাটে/ চেতনা সব হয় নীরব, বেদনা ঝরে পড়ে/ যজ্ঞবেদী সাজানো থাকে, জ্বলে না তাতে ধূপ/ রাখে না পদচিহ্ন কেউ ঘরের চৌকাঠে/ শরীরে ভয়, নারীরা নয় এখন অপরূপ/ তারারা সব নিঝুম ঘুমে, চাঁদের নেই দেখা/ অর্ধমৃত, কাটাই শীত ও গ্রীষ্ম একা একা

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বিশ্বকর্মার ব্রতকথা

বিশ্বকর্মা পুজোতেও কেউ কেউ বিশ্বকর্মার ব্রত পালন করে থাকেন। এমনিতে বিশ্বকর্মা যেহেতু স্থাপত্য ও কারিগরির দেবতা, তাই কলকারখানাতেই এই দেবতার পুজো হয়ে থাকে। সেখানে ব্রতকথার স্থান নেই। আবার কোন অলৌকিক কারণে এবং কবে থেকে যে এদিন ঘুড়িখেলার চল হয়েছে জানা নেই। তবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন শহর ও গ্রামের আকাশ ছেয়ে যায় নানা রঙের ও নানা আকৃতির ঘুড়িতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার কখনও বাংলাদেশে পা রাখেননি!

ভাবতে অবাক লাগে, ‘৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ উত্তমকুমারকে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। টালিগঞ্জের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করেছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে। অন্যদিকে ববিতা, অলিভিয়া ও আরও কেউ কেউ টলিউডের ছবিতে কাজ করেছেন। ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার ও পরে গৌতম ঘোষ ছবি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশে এসে, কিন্তু উত্তমকুমারকে আহ্বান করার অবকাশ হয়নি এখানকার ছবি-করিয়েদের।

Read More »
নন্দিনী কর চন্দ

স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্দরমহলে: কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি

বিস্মৃতির অতলে প্রায় তলিয়ে যাওয়া এমন কয়েকজন মহিলা কবির কথা আলোচনা করব, যাঁরা তাঁদের কাব্যপ্রতিভার দ্যুতিতে বাংলা কাব্যের ধারাকে উজ্জ্বল ও বেগবান করে তুলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃষ্ণকামিনী দাসী, মোক্ষদায়িনী দেবী, প্রসন্নময়ী দেবী, লজ্জাবতী বসু, জগন্মোহিনী দেবী, গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী, হিরণ্ময়ী দেবী, অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্ত, সুরবালা ঘোষ প্রমুখ।

Read More »
মোহাম্মদ কাজী মামুন

বালকেরা অচেনা থাকে : এক অবিস্মরণীয় পাঠ অভিজ্ঞতা

ঘাসফুল নদী থেকে প্রকাশিত ‘বালকেরা অচেনা থাকে’ গল্পগ্রন্থটি যতই এগোনো হয়, একটা অনুতাপ ভর করতে থাকে পাঠকের মনে— কেন আগে সন্ধান পায়নি এই অমূল্য রত্নসম্ভারের! হ্যাঁ, রত্নসম্ভারই, কারণ একটা-দুটো নয়, প্রায় দশটি রত্ন, তাও নানা জাতের— লুকিয়ে ছিল গল্পগ্রন্থটির অনাবিষ্কৃত খনিতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাইশে শ্রাবণ ও বৃক্ষরোপণ উৎসবের শতবর্ষ

কবির প্রয়াণের পরের বছর থেকেই আশ্রমবাসী বাইশে শ্রাবণকে বৃক্ষরোপণ উৎসব বলে স্থির করেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই দিনটিই এ-উৎসবের স্থায়ী তারিখ। বাইশের ভোর থেকেই প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় উৎসব। সকালে কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা বিচিত্রভাবে একটি পালকি চিত্রিত করেন ছবি এঁকে, ফুল, লতাপাতায়। মঙ্গলধ্বনি দিতে দিতে এর পর পালকির ভিতরে টবের মধ্যে একটি চারাগাছকে স্থাপন করা হয়। অতঃপর শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গীত-পরিবেশন-সহ আশ্রম-পরিক্রমা।

Read More »