দে বা শি স গ ঙ্গো পা ধ্যা য়
পলাশদের আজ একজায়গায় নেমতন্ন। সৌজন্যা ইতিমধ্যে প্রস্তুত। তাকে দু-একবার তাড়া দিয়েছে।
পলাশ সোফায় আরাম করে বসল। ঘড়ির দিকে একবার চোখ মেলে দেখল। এখনও সময় আছে। তবু ট্রেন ধরার ঝক্কি কম নয়। প্রায় দেড়-দুঘণ্টার পথ। তাছাড়া ভিড়-টিড়ে খুব একটা যেতে ইচ্ছে করে না তার। কিন্তু না গেলেই নয়। মাসতুতো দাদার ছেলের বিয়ে। সৌজন্যা ওর জন্য কী নেবে তাই নিয়ে ক’দিন ধরে চিন্তা করছিল। সৌজন্যা হিসেব করতে বসেছিল অশোকদাদের কাছ থেকে তারা কী কী পেয়েছিল!
ও বলেছিল,— ‘বেশিকিছু দিতে পারব না বাবা। অশোকদা-রা আমাদের অনুষ্ঠানে কী দেয় মনে আছে। তোমার বড় ভাইঝির বিয়েতে গুষ্টিসুদ্ধলোক খেয়ে গেল। দিল মোটে একটা থালা!’
পলাশ বিরক্ত হয়েছিল। বড় ভাইঝি কাকলির বিয়ে হয়েছে অনেকদিন। সৌজন্যার কাজ নেই, কর্ম নেই। পুরনো কথা ঠিক মনে রেখেছে। সে বলেছিল,— ‘সে অনেকবছর আগের কথা! ছাড়ো তো। তখন বাজার ছিল অন্যরকম।’
—‘আহা! বাজার ছিল অন্যরকম। কতদিন আগে শুনি, পাঁচ বছর আগেও হবে না।’
—‘না। না। তখন অশোকদার হালহকিকত এমন ছিল নাকি? ওদের বাড়ি গিয়ে দেখেছি তো কী খারাপ অবস্থা। গেলেই মাসিমা সারাক্ষণ দুঃখের কথা বলত।’
সৌজন্যা বলে, ‘মাসিমা বলবে না কেন? তোমার অশোকদা যেই বাড়িঘর করল নিজের দিকটা কেমন সাজাল-গোছাল আর মাসিমার ঘরটা সেই একইরকম। তাতে দুঃখ পাবে না। যে কেউ হলে তাই পাবে।’
সৌজন্যার কথাগুলো ভুল নয়। বছর তিনেক আগে সে যখন শেষবার মাসির বাড়ি গেছিল তার একটু খারাপই লেগেছিল। অশোকদা তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজের বাড়ি দেখাচ্ছিল। পলাশ অবাক হয়ে দেখেছিল। মুখে ভাল বলছিল বটে, তার হিংসে হচ্ছিল তা কী করে অস্বীকার করবে?
বাড়িঘর দেখার পর সে মাসিমার কাছে এসেছিল। মাসিমা এমনিতে চলতে ফিরতে পারেন। কাজও করতে পারেন। তবে মেসো চলে যাবার পর একটু চুপচাপ হয়ে গেছেন। সে মাসিমার ঘরে চোখ বুলিয়েছিল খানিক। বাড়ির একটা অংশে অশোকদা বাড়ি করছে। সে ভেবেছিল এই অংশটাও বোধহয় অশোকদা করে দেবে। কিন্তু করেনি। মাথায় ছাউনিটা অ্যাসবেস্টসের। মেঝেও মেসো থাকাকালীন যেমন ছিল তাই। ইটের ওপর এখনও সিমেন্ট পড়েনি। সুতরাং খারাপ লাগছিল তার।
সৌজন্যা প্রায় রেডি। সে তাড়া দিল। ‘এবার রেডি হও দিকি। অনেকটা পথ। আর আলসেমি কোরো না। তাড়াতাড়ি বেরোলে ফিরতে পারব।’
আজকাল অশোকদারা দেখায়ও বটে। যাতায়াত না থাকলেও ফোন আছে, কথা যতবার না হয় তার চেয়ে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ আসে অনবরত। কোথাও গেলে ছবি পাঠায়।
প্রথম প্রথম বেশ লাগত। সুইৎজারল্যান্ড না কোথায় যেন গেছিল তার প্রায় খান পঞ্চাশ ছবি পাঠিয়েছিল। নানারকম ড্রেসে অশোকদা ও বউদি। জীবন হওয়া উচিত এমন, পলাশ ভেবেছিল তখন। অশোকদার কৃতিত্বের কথাও সে ভেবেছিল।
সৌজন্যা আর একবার তাড়া দিল পলাশকে। একপলক সৌজন্যাকে সে দেখল। তার বিয়ে করা বউ, বিরাট সুন্দরী না হলেও সুন্দরী। কিন্তু পঁচিশ বছরে ঘাড়ে-মুখে-চোখে এমন একটা হালকা নিম্নবিত্তের ছাপ পড়েছে, হাজার কিছু মাখলেও তা যাবে না।
পলাশ উঠল। তার কেনা সবচেয়ে দামি পাঞ্জাবি-পায়জামা বার করে রেখেছে সৌজন্যা। পরার পর আয়নার সামনে সে দাঁড়াল। সব আছে তার, চেহারা, মুখ-চোখ সবকিছু ঠিকঠাক। কিন্তু যেটা নেই, তা জৌলুস। জৌলুস ফুটিয়ে তোলার জন্য সৌজন্যার ব্যবহার করা ক্রিম সে ঘসে ঘসে গালে-মুখে মাখল।
||২||
ছেলে সঙ্গে এল না। আবীর ঠান্ডা গলায় বলেছিল,— ‘আমার যাবার ইচ্ছে নেই। ওখানে কার সাথে কথা বলব? কেই বা চেনে আমাকে? মোস্ট বোরিং মা। তাছাড়া এ ও জিজ্ঞেস করবে কী করো? সেগুলো শুনতে মোটেই ভাল লাগবে না।’
সৌজন্যা তাও আরও অনেকবার বলেছিল। শেষপর্যন্ত পলাশ হস্তক্ষেপ করেছিল। সে বুঝিয়েছিল আবীরের যাবার দরকার নেই। সৌজন্যা রাগের চোখে তাকিয়ে বলেছিল,— ‘যাবে না ভাল কথা! হাতে ধরে প্যাকেট আনতে পারবে তো?’
—‘প্যাকেট?’
—‘কেন? অশোকদারা নিয়ে যায়নি বুঝি? কাকলির বিয়েতে অশোকদা একা এসেছিল। বউদিরা আসেনি। ঠিক প্যাকেট গুছিয়ে নিয়ে গেল।’
পলাশের মনে নেই। অতদিন আগের কথা। তার খেয়ালও থাকে না এসব। সত্যি বলতে কী সে মাথাও ঘামায় না। মেয়েরাই এসব নিয়ে কথা বলে। সৌজন্যাকে এ কথা বলা যাবে না।
এখন ট্রেনে যেতে যেতে সৌজন্যার দিকে এখন একবার তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল— ‘জল খাবে?’
সৌজন্যা বলল,— ‘দাও। আর কতক্ষণ গো?’
—‘দুটো স্টপেজ। এসে গেছি।’
সৌজন্যা বলল,— ‘ইস! একটা জিনিস ভুলে গেলাম!’
পলাশ আশ্চর্য হল না। এমন ভুল ওর হয়। তবু জিজ্ঞেস করল,— ‘কী?’
—‘মাসিমা আমাকে বলেছিল, তুই যখন আসবি আমার জন্য একটা জিনিস আনিস?’
এবার একটু আশ্চর্য হল পলাশ। মাসিমার সাথে আবার কবে কথা বলল সৌজন্যা? সে বলল,— ‘মাসিমা ফোন করেছিল নাকি?’
—না। না। গেল বার বিজয়া দশমীর পর ফোন করে প্রণাম সারলাম, তখন মাসিমা বলল।’
পলাশ অবাক হল। সৌজন্যার পুরনো কথা মনে আছে বেশ। সে বলল,— ‘কী বলেছিল মাসিমা?’
—‘আয়না চেয়েছে।’
হাসি পেয়ে গেল পলাশের। মাসিমার বরাবর অদ্ভুত অদ্ভুত আবদার আছে। সে মাথা নেড়ে বলল,— ‘আরে দুর! কতদিন আগে বলেছে। মাসিমা ভুলে গেছে। বাদ দাও।’
সৌজন্যা গুমস্বরে বলল,— ‘তাই কখনও হয়? গোপনে চেয়েছিল। সেটা দেওয়া কি অন্যায়? দেখো গে তোমার অশোকদা হয়তো মাকে একটা আয়না কিনেও দেয়নি।’
সে বলল,— ‘কী যে বলো না? আয়না যে কোনও জায়গায় পাওয়া যায়। অশোকদা মাকে আয়না কিনে দেবে না? তা কখনও হয়? মাসিমার একটু অবুঝপনা আছে।’
সৌজন্যা বলল,— ‘ওরকম মনে হয়। সামান্য জিনিসই হয়তো অশোকদা খেয়াল করেনি? বড় মাপের লোক কিনা!’
সৌজন্যার কথাটা অবিশ্বাস করতে পারল না পলাশ। সামান্য আয়না। অশোকদা আয়না অপ্রয়োজনীয় ভেবে হয়তো কিনে দেননি। সে তবু বলল,— ‘বাদ দাও। বাদ দাও।’
সৌজন্যা বলল,— ‘আশ্চর্য! একটা আয়না কিনতে পারবে না?’
পলাশ সারেন্ডার করল। সে বলল, ‘আচ্ছা। আগে স্টেশনে নামি। তারপর দেখছি।’
||৩||
স্টেশনে নামতেই অশোকদা ফোন করেছিল। বলেছিল, ‘নেমেছিস তো? এক নম্বর গেট দিয়ে বাইরে পঞ্চানন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে আয়। ওখানে গাড়ি আছে। একদম নতুন গাড়ি।’
গাড়িটা দেখেই পলাশ চিনতে পেরেছিল। সাতদিন আগেই অশোকদা ছবি পাঠিয়েছিল। দুজনে কেমন গাড়িটার ওপর হেলান দিয়ে ছবি তুলেছে। হেবি হ্যান্ডু লাগছিল অশোকদাকে। চোখে সানগ্লাস। চারদিক যেন হেলায় জয় করে ফেলছে।
সৌজন্যা খুব খুশি। এখনও অনেকটা পথ। টোটো বা অটোয় যেতে পারত। তার বদলে গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ায় গলে জল। সে গদগদ গলায় বলল,— ‘যাই বলো। অশোকদা কিন্তু লোক দারুণ। সবার কথা ভাবে। বলো?’
একবার ওর দিকে তাকিয়ে সে বলল,— ‘হুম।’
সৌজন্যা টুকটুক করে নতুন গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। ওর চোখমুখ দেখলেই মনে হয়, সে যেন ভাবতে শুরু করেছে এমন একটা গাড়ি যদি তার থাকত। গাড়ির কাছে এসে সৌজন্যা বলল,— ‘চলো। দেরি হয়ে যাবে।’
—‘আয়নাটা?’
সৌজন্যা একমিনিট থমকায়। তারপর বলে, ‘ছাড়ো! দেরি হয়ে যাবে।’
—‘বাহ! ছাড়ব কেন? তুমিই তো কিনবে বলছিলে।’
সৌজন্যা গাড়ির ভেতর চেপে বসে। তারপর বলে— ‘ও থাক। পরে দেব।’
পলাশ প্রচণ্ড বিরক্ত হল। আশ্চর্য তো সৌজন্যা! গাড়ি পাঠিয়েছে বলে সবকিছু ও ভুলে গেল। মাসিমার ঘরটার কথা ওর মনে নেই! অশোকদার বৈভবের পাশে আয়নাটাই একমাত্র বেমানান জিনিস। যেটা কিনলে পলাশ সান্ত্বনা পাবে। মনে মনে সে বলতে পারবে, ‘অশোকদা, তোমার টাকাপয়সা থাকতে পারে। কিন্তু মাকে বড় অবহেলা করেছ। একটা আয়না পর্যন্ত কিনে দিতে পারোনি!’ সে বলল, ‘না। কিনব। তুমি বসো। আমি আসছি।’
একটু দূরেই এগিয়ে পলাশ একটা প্রসাধনীর দোকান পেল। এখন আর হাত-আয়নার মনে হয় তেমন চল নেই। মোটামুটি একটা হাত-আয়না পছন্দ করল পলাশ।
পলাশ আয়নাটা নিল।
গাড়িতে উঠে সৌজন্যাকে সে বলল,— ‘ধরো। মাসিমাকে দিয়ো।’
সৌজন্যা ধরল। কিন্তু গা করল না।
পলাশ একটু পরে বলল,— ‘এ গাড়িটা একটু ছোট লাগছে না?’
এর তেমন উত্তর সৌজন্যা জানে না। সে কত আর গাড়ি চড়েছে! তবে পলাশ নিশ্চয় চড়েছে। কিন্তু ছোট হোক বড় হোক, রাস্তার জার্নিটা দিব্বি লাগছে। সৌজন্যা মুখ বেঁকিয়ে বলল,— ‘ছোট আর বড়। কার কী মুরোদ জানা আছে!’
পলাশ উত্তর দিল না। দীর্ঘদিনের অভ্যেসে সে বুঝেছে এ কথাগুলোর কোনও মূল্য নেই। এক-একজনের জনের সব মুরোদ থাকে না। যে যা করে তা সবাই করতে পারে না। সুতরাং তুলনা অর্থহীন। কিন্তু সে সান্ত্বনা পেল না। অশোকদার গাড়িতে চড়েই লোকটার ওপর একটা ক্ষোভ হতে লাগল।
—‘অনেকদিন পর মিনু, কুসুম, তুলিকাদের সাথে দেখা হবে বলো?’
পলাশ অন্যমনস্ক হয়ে মাথা নাড়ল। তারপর বলল,— ‘তুলিকার ছেলেটা তো আবীরের বয়সী, না?’
—‘হ্যাঁ। বউদি বলছিল, ক’দিন পর নাকি ও বাইরে চলে যাবে।’
সৌজন্যা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। বলল,— ‘শোনো একটা কথা?’
—‘কী?’
—‘বলছি, অশোকদাকে বলো না আবীরের একটা কাজের জন্য?’
—‘তোমার মাথাখারাপ?’
—‘কেন?’
—‘আরে আজকে এসেছ একটা নেমতন্ন খেতে। আর তার মধ্যে এই কথা বলব? লজ্জা বলে কিছু নেই?’
—‘হ্যাঁ। লজ্জা নিয়েই থাকো। আজ না বললে কবে বলবে তুমি?’
পলাশের মুড অফ হয়ে যাচ্ছে। সে কিছুতেই ছেলের কথা বলবে না অশোকদাকে। তাছাড়া অশোকদার এত বড় ক্ষমতা মানতেও সে রাজি নয়। সে বলল,— ‘হ্যাঁ। অশোকদা চাকরি নিয়ে বসে আছে। ওরকম সব দূর থেকে মনে হয়।’
সৌজন্যা বলল,— ‘তুমি সব জানো।’
পলাশ আর কিছু বলতে যাচ্ছিল। মোড়ের মাথা থেকেই সে দেখতে পেল নহবত নামক অনুষ্ঠানবাড়িটা। অশোকদা বলেছিল, ‘বাড়িতে করছি না। এবার সামনে একটা হল হয়েছে। বুক করলাম। আটমাস আগে বুক করতে হয়। আমি চ্যানেল ধরে ম্যানেজ করে নিয়েছি।’
বেশ সাজিয়েছে। নামতে নামতে পলাশ দেখল।
||৪||
ভাড়া করা অনুষ্ঠানবাড়িতে সুবিধাও আছে অসুবিধাও আছে। সুবিধার ভাগ বেশি। গৃহকর্তার হ্যাপা কম। সবচেয়ে বড় সুবিধা হোটেলের মতো। কারও সঙ্গে তেমন কথা হয় না। পরিচিত রিলেটিভরাও দুচার কথা বলার পর খাওয়ার সন্ধানে।
সেকেন্ড ব্যাচে অ্যাটেমট নিল পলাশরা। ভেতরে ঢুকে লাইন দিয়ে খাওয়ার জায়গায় তারা বসল। তার চোখ চারদিক খুঁজছে। পুরো অনুষ্ঠানটার মধ্যে সে এখন খুঁত খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে সৌজন্যাকে বলল,— ‘এ দিকে বসলে কেন?’
—‘কেন?’
—‘দেখছ না? হাওয়া কম। একটু বুঝে বসতে হয়।’
—‘আরে বসো। অনেক লোক। জায়গা পাওয়া যাবে না।’
মুখ গম্ভীর করে পলাশ বসল। এদিকওদিক দু-চারজন পরিচিত, দু-একবার হাসি বিনিময় করল। তারপর খাওয়ার দিকে নজর দিল। মেনু কার্ডে চোখ বোলাল। সে ফিসফিস করে বলল,— ‘করেছে অনেককিছু। কিন্তু টেস্ট কেমন হয় দ্যাখো?’
—‘ভালই হবে। তুমি অশোকদাকে প্যাকেটের কথা বোলো কিন্তু।’
পলাশ খেতে খেতে বলল,— ‘ধ্যাৎ। একই কথা। খাও তো।’
সৌজন্যা একবার দেখল। সে বলল,— ‘তুমি মাসিমার সাথে দেখা করবে না?’
পলাশের আচম্বিতে মনে হল। তাই তো। মাসিমার কথা সে ভুলেই মেরে দিয়েছে। আয়নাটাও তো দেওয়া হয়নি। সে বলল,— ‘মাসিমা কোথায়? দেখলাম না তো?’
—‘মাসিমা ছিলেন তো। তোমাকে খুঁজছিলেন। বাড়ি চলে গেছেন। আমি এসে তোমাকে খুঁজছিলাম। দেখতে পেলাম না।’
যাহ! দেখা হল না মাসিমার সঙ্গে। খারাপ লাগে পলাশের। সে বলে, ‘শোনো। বেশিদূর নয়। খাবার পরে একবার চলো ঘুরে যাই।’
—‘আবার যাবে? ওদিকে গেলে দেরি হয়ে যাবে।’
—‘না। না। দেরি হবে না। মাসিমার সাথে না দেখা করলে খারাপ ভাববেন। কতদিন পর এলাম। আবার কবে আসব ঠিক নেই।’
সৌজন্যা বলল,— ‘আমার আর ইচ্ছে করছে না। তুমি দেখা করে আসো। বউদির সাথে একটু কথা বলি। তুমি যাও।’
—‘আর ওইটা। যেটা কিনলে?’
—‘বলো। আমি পাঠিয়েছি।’
বাহ! নিজে নড়বে না অথচ ওর নামই বলতে হবে! বেশ মজা!
||৫||
মাসিমার বাড়ি যাবার আগে মেজাজ একটু বিগড়ে গেল পলাশের। এবার নাকি প্যাকেটের ব্যবস্থা করেনি অশোকদা। কী বিচ্ছিরি! চাইতে গিয়ে লজ্জার একশেষ। অশোকদা বলল, ‘আর বলিস না। প্যাকেট করলে মুসকিল হচ্ছে সবার লাগবে। আরে ভাই। নেমতন্ন করেছি। বসে খেয়ে যা। তুই ভাই বলেই বললাম। তোর কথা আলাদা। তুই থাক একটু।’
তার মানে প্যাকেটের ব্যবস্থা আছে। খুব পেয়ারের লোকদের অশোকদা দেবে। তাকেও দেবে। কিন্তু ঘুরিয়ে বুঝিয়ে দিল প্যাকেট চাওয়া অপছন্দের। রাগ রাগ মুখ করেই পলাশ গেল। সে ঠিক করল দ্বিতীয়বার আর অশোকদার কাছে প্যাকেট চাইবে না।
মিনিট পাঁচেকের পথ। অশোকদাকে সে জিজ্ঞেস করেছিল,— ‘মাসিমা চলে গেল কেন?’
—‘মা আর কী করবে? কিছুক্ষণ ছিল, চলে গেল।’
পলাশের মনে হয় মাসিমাকে কেউ হয়তো থাকতে বলেনি এখানে। কিছুক্ষণ এসেছেন তারপর নিজের মতো ফিরে গেছেন নিজের জায়গায়। মাসিমার জন্য বড় মনখারাপ লাগে। সে বলে,— ‘আমি যাচ্ছি মাসিমার সাথে দেখা করতে।’
—‘যা। তাহলে।’
মাসিমা নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়বেন না। পলাশ ভাবে। তড়িৎগতিতে সে ও সৌজন্যা পা বাড়াল। সৌজন্যা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত পালটেছে। বউদি মোটেই ওকে পাত্তা দেয়নি। সুতরাং এখন সেখানে বসে থাকা অর্থহীন। রাস্তায় বেরিয়ে সেই পুরনো মনোভাব আবার টের পেল পলাশ। সৌজন্যা আবার পালটি খেয়েছে। টুকটুক করে নিন্দা শুরু করেছে। পলাশও নিজেও তাই চেয়েছিল। একটু হালকা নিন্দা। কিন্তু মুসকিল হচ্ছে রান্না নিয়ে কিছু বলার নেই। ব্যাপক খাইয়েছে অশোকদা। সে বলল,— ‘মাসিমার কাছে যাব। দেখা করব। ওখান থেকেই ব্যাক করব।’
সৌজন্যা বলল,— ‘হ্যাঁ।’
যেতে যেতে পলাশের আক্ষেপ হল আরও আগে এলে ভাল হত। মাসিমার সাথে একটু কথা হত।
দু-পা বাড়াতেই অশোকদার বাড়িটা দেখতে পেল পলাশ। বাড়ির সামনেও একটা বাঁশের কাঠামো লাগিয়েছে অশোকদা। দু-চারটে হ্যালোজেন। কিন্তু এখন লোক নেই। অশোকদার বাড়ির পেছনেই মাসিমার বাড়ি। দোতলা ঝকঝকে বাড়ির পরেই সেই মাসিমার ভাঙাচোরা ঘর! ভেবেই আজকের উৎসবটা তার ম্লান লাগল। আয়নাটা সে নিজেই হাতে নিয়েছে। সেটা ও শক্ত হাতে ধরল।
বাঁ-দিকে টার্ন নিতেই পলাশ চমকে উঠল। মাসিমার ঘর কোথায়? তার বদলে একটা ছিপছিপে একতলা ঘর দেখা যাচ্ছে। মাসিমা কি এখানে থাকেন না? অবিশ্বাসের দোলায় সে একটু দুলল। কী করবে সে বুঝতে পারল না!
সৌজন্যা বলল, ‘হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? ওই তো মাসিমা!’
পলাশ দেখল। ওই ছিপছিপে ঘরটার সামনে মাসিমা। তাদের দেখে বলল,— ‘আমি জানতাম। তোরা আসবি, আয়। আয়।’
ঘরটার দিকে চোরা চোখে তাকাল পলাশ। সে বলল,— ‘তোমার বাড়ি কবে হল মাসিমা?’
—‘ওমা! সেই যে তুই এলি। তিনবছর আগে। অশোক বাড়ি করছিল। শেষ হবার পরই তো আমারটা নিয়ে পড়ল।’
পলাশ অবাক হয়ে বলল,— ‘তোমরা কেউ বলোনি তো? অশোকদা, তুমি…’
—আহা! এ আবার বলার কী আছে? তোরা এলি দেখলি কেমন সেটাই তো ভাল হল। বল?’
পলাশ বিরক্তি চেপে একটা শ্বাস নিল।
মাসিমা বলল,— ‘ভেতরে আয়। দেখে যা সব।’
পলাশ বলল,— ‘না, মাসিমা। অন্য একদিন। দেরি হয়ে যাবে।’
—‘আহা! কত যেন আসিস তোরা! মোটেই দেরি হবে না। দেখে যা বাবা, একটু ঘরে এসে ছেলে কেমন আমার জন্য ঘর করে দিয়েছে। পারেও বটে অশোক। মাথায় ছাদ করেছে, মেঝেতে টাইলস বসিয়েছে। রং করেছে। কত কী করে দিয়েছে আমার জন্য।’ মাসিমা খুশির স্বরে বলে উঠলেন।
—‘বাহ!’
—‘তবে সব হয়েছে কিন্তু কী জানিস ঘরে খুব সমস্যা হচ্ছে।’
পলাশ ও সৌজন্যার চোখ বড় হয়ে গেল। এমন কিছুই তো তারা শুনতে চাইছিল! অশোকদার নিন্দা। এবার মাসিমা বলবেন। মাসিমা এটা ছাড়া থাকতে পারেন না। পলাশ বলল,— ‘কী অসুবিধে?’
—আর বলিস না, অশোক একটা মানুষসমান আয়না এনেছে। ওই ডেসিং টেবিল না কী যেন বলে। নিজেকে সারাক্ষণ দেখা যায়। ওভাবে তো দেখিনি কোনও দিন। মাঝেমাঝে নিজেকেই চিনতেই পারি না।’ বলে মাসিমা ফিক করে হেসে ফেলেন।
পলাশ কষ্ট করে হাসে। হাত-আয়নাটা সে লুকিয়ে ফেলে। সত্যিই! নিজেকে চেনা বড় কঠিন!