Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

গড়িয়া: ত্রিপুরার জনজাতিদের উৎসব আজ সর্বজনীন

ত্রিপুরার কয়েকটি উপজাতি সম্প্রদায় বিশেষ করে ত্রিপুরী, জমাতিয়া, নোয়াতিয়া ও রিয়াং সম্প্রদায়ের মধ্যেই সাধারণত ‘গড়িয়া পূজা’ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তবে সামাজিক কাঠামো অনুসারে এই গড়িয়া পূজার পদ্ধতি, রীতিনীতি সম্প্রদায়ভেদে কিছুটা পার্থক্যও থাকলেও উদ্দেশ্য মূলত এক।

বর্তমানে সর্বজনীন চেহারা নিলেও ‘গড়িয়া পূজা’ ত্রিপুরার বিশেষ কয়েকটি উপজাতির এক মহান গৌরবময় পূজা ও উৎসব। তাঁদের সমাজে কোন যুগ থেকে এই পূজা চলে আসছে তা বলা কঠিন, তবে বয়সের দিক দিয়ে এই পূজা-উৎসব যে সুপ্রাচীন তা বলতেই হবে। গড়িয়া দেবতা তাদের পরম আরাধ্য এবং উপজাতিদের বদ্ধমূল ধারণা ও বিশ্বাস, তাঁর শুভাশিস ছাড়া জাগতিক কল্যাণ, সুখশান্তি, ভোগবিলাস ও অস্তিত্ব কোনওটাই সম্ভব নয়। তাই, দেবতাকে পরম ভক্তিভরে শ্রদ্ধা নিবেদনের অভিপ্রায়ে প্রতিটি উপজাতি নরনারী এই ‍পূজা-উৎসবের শুভদিনের জন্য সাগ্রহ প্রতীক্ষায় থাকেন। এসময় তারা প্রাত্যহিক জীবনের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট, শোক-তাপ, হতাশা-বেদনা, অতৃপ্তি-অপ্রাপ্তি ভুলে নাচ-গান, হাসিঠাট্টায় মশগুল হয়ে থাকেন।

গড়িয়া মূর্তি তৈরি হয় বাঁশ, আদিবাসীদের হাতেবোনা তাঁতে তৈরি কাপড় ও চাল দিয়ে।

কলকাতা বা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ গড়িয়া কথাটা শুনলে ভাবেন যাদবপুরের কাছে অবস্থিত গড়িয়া বা গড়িয়াহাটের কথা। কিন্তু ত্রিপুরার বাসিন্দাদের কাছে গড়িয়া একটা উৎসবের নাম। বৈশাখ মাসের সপ্তম দিনে হয় মূল গড়িয়া পূজা। আগে গড়িয়া পুজো ত্রিপুরার জনজাতিদের লৌকিক দেবতার পুজো হিসাবে চিহ্নিত হলেও আজ তা সর্বজনীনতা লাভ করেছে। গড়িয়া পুজো এখন সমগ্র ত্রিপুরাবাসীর। ত্রিপুরায় উনিশটি জনজাতি সম্প্রদায় রয়েছে। এরা অনেকাংশই বিশ্বাস করেন, গড়িয়া দেবতা এমন এক অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন দেবতা যাঁর কৃপাতেই মানুষ সুখে ও শান্তিতে বসবাস করতে পারেন। তাঁর ইচ্ছাতেই দেশের সমৃদ্ধি ঘটে।

খুব জাঁকজমকভাবে ত্রিপুরার জনজাতি সম্প্রদায়ের লোকেরা এই পুজো পালন করে থাকেন। পুজোকে কেন্দ্র করে নানান ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। ভোগে থাকে বিভিন্ন প্রকারের পিঠে। তাছাড়া পাঁঠা, হাঁস-মোরগ, পায়রা বলি দেওয়া হয়। এই পূজায় হাঁসের ডিমও ব্যবহৃত হয়। ভোগেও মাংসের আয়োজন করা হয়। জনজাতিদের বিশ্বাস, গড়িয়া পুজোর সাতদিনের মধ্যে যদি কেউ অসুস্থ হন কিংবা কোনও বিপদে পড়েন তা হলে গড়িয়া দেবতার মানত করলে সেই ব্যক্তি সুস্থ উঠবেন। এই পূজা অনেকটা শাক্ত মতে শিবের রাজসিক পূজা। মতান্তরে হিন্দু দেবতা দুর্গাপুত্র গণেশকে সনাতন ‍আদিবাসীরা গড়িয়ারূপে পূজা করেন। জনজাতিরা এই পূজার পূজারীদের ‘অচাই’ এবং প্রধান পূজারীকে ‘চন্তাই’ বলে বিশেষ মর্যাদা দেন।

পাঁঠা, হাঁস-মোরগ, পায়রা বলি দেওয়া হয়। এই পূজায় হাঁসের ডিমও ব্যবহৃত হয়। ভোগেও মাংসের আয়োজন করা হয়।

প্রতিবছর বৈশাখ মাসের প্রথম দিন থেকে গড়িয়া দেবতাকে নিয়ে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে ঘোরেন একদল লোক। গড়িয়া দেবতা বাড়িতে আসছেন দেখে বাড়ির নারীরা উঠানে জল ছিটিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে একটি পিঁড়ি বসান। গড়িয়া মূর্তিকে সেই পিঁড়িতে বসনো হয়। পরিবারের কর্তা, গৃহিণীসহ সব সদস্য ধূপ দেখিয়ে বরণ করে প্রণাম করেন। একই সঙ্গে চালসহ অন্য ফসল ও নগদ টাকা চাঁদা হিসেবে দেন। দেবতাকে উঠানে পিঁড়িতে বসানোর পর পরিক্রমা করা হয় সমবেত গান ও নৃত্য সহযোগে। একইভাবে পহেলা বৈশাখ থেকে ৬ বৈশাখ পর্যন্ত এভাবে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে পরিক্রমা করা হয়। বৈশাখ মাসের সপ্তম দিনে হয় গড়িয়া পূজা। এদিন গ্রাম ঘুরে যে চাঁদা সংগৃহীত হয়, তা দিয়ে পূজার আয়োজন হয়।

গড়িয়া মূর্তি হিন্দুদের অন্য সব মূর্তি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। গড়িয়া মূর্তি তৈরি হয় বাঁশ, আদিবাসীদের হাতেবোনা তাঁতে তৈরি কাপড় ও চাল দিয়ে। কোথাও পূজোর প্রসাদ হিসেবে চাল বা ভাত থেকে তৈরি সুরা পরিবেশিত হয়। ‘রাজমালা’ সহ সমসাময়িক গ্রন্থাদি মতে, মহাভারতে যযাতি নামে একজন পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন। রাজা যযাতির অবাধ্য পুত্র দ্রুহ্য পিতা কর্তৃক স্বীয় রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে গঙ্গা ও সাগরের সঙ্গমস্থল ‘সাগর দ্বীপে’ নির্বাসিত হন। রাজা দ্রুহ্যের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দৈত্যরাজ সিংহাসন আরোহণ করেন। মহারাজা দৈত্যের পুত্রের নাম ত্রিপুর। এই রাজা ত্রিবেগ থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে ধাবিত হয়ে কিরাত রাজ্য অধিকার করেন এবং ত্রিবেগ ও কিরাত জনজাতির মধ্যে মহামিলন ঘটান। ত্রিপুর রাজা তাঁর বিজিত রাজ্যের নামকরণ করেন ত্রিপুরা এবং প্রজাদের নামকরণ করেন ত্রিপুর জাতি।

দেবতাকে উঠানে পিঁড়িতে বসানোর পর পরিক্রমা করা হয় সমবেত গান ও নৃত্য সহযোগে।

বিষ্ণু পুরাণ গ্রন্থে আছে, ভারত সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রান্তে কিরাতের বাস। কামরূপ (আসাম) ও রাক্ষ্যাং (আরাকান) প্রদেশের মধ্যবর্তী ভূ-ভাগকে আর্যরা সুম্ম বা সুহ্ম নামে আখ্যায়িত করেন। টিবেটো বর্মন শান বংশীয় জনগোষ্ঠী সেখানে শক্তিশালী রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। এই রাজ্যটিই মহাভারত গ্রন্থে ত্রৈপুরা, কখনও বা ত্রৈপুরী নামে আখ্যায়িত হয়।

ত্রিপুরীরা নিজেদের চন্দ্রবংশোদ্ভুত ক্ষত্রিয় কুলজাত বলে দাবি করেন। নৃতাত্ত্বিক বিচারে ত্রিপুরা জাতি মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভুত। মঙ্গোলীয়রা প্রায় ৫ হাজার বছর আগে মঙ্গোলিয়া থেকে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে আগমন করেছিল। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর একটি অংশ পরিচিত ছিল বোডো (Bodo) বা বরো (Boro) নামে। পূর্ব ভারতে আর্যদের আগমনের পূর্বে এই বোডো বা বরো জনজাতি এখানে আধিপত্য কায়েম করেছিল। রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনিসূত্রে জানা যায়, ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বাঞ্চল রাজ্যসমূহ বোডো বা বরো জনজাতির নৃপতি কর্তৃক শাসিত হত। আর্যগণ তাদেরকে কিরাত, দানব ও অসুর নামে আখ্যায়িত করত। এই বোডো বা বরো জনজাতির একটি শক্তিশালী দল গঙ্গা, শীতলক্ষা, ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী প্রভৃতি নদনদীর অববাহিকার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ত্রিপুরীরা সম্পূর্ণ অনার্য জাতি। তাই ত্রিপুরার সনাতন অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে বৈচিত্র্যমণ্ডিত উৎসব ও পূজাপার্বণ। আর এই পূজাপার্বণে যে অনুষ্ঠানের রীতি রয়েছে, তার পুরোটাই প্রকৃতি জগতের রূপ-রসের ব্যঞ্জনায় পুষ্ট।

বৈশাখ মাসের প্রথম দিন থেকে গড়িয়া দেবতাকে নিয়ে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে ঘোরেন একদল লোক।

এখন উপজাতিদের প্রধান উৎসব গড়িয়া পূজা ত্রিপুরা রাজ্যের সর্বত্র যথাযোগ্য মর্যাদায়, ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে পালন করা হয়। এই রাজ্যের উপজাতিদের প্রধান‌ এই উৎসবকে কেন্দ্র করে রাজ্যের সর্বত্র ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। গড়িয়া পূজাকে কেন্দ্র করে গত প্রায় এক মাস ধরে উপজাতি মানুষের মধ্যে নানারকম প্রস্তুতি চলে। গড়িয়া পূজার জায়গাও তৈরি করা হয় বাঁশ দিয়ে। পূজার দিন হাঁস, মুরগি, কবুতর ও পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। আবার কেউ কেউ কবুতর বলি না দিয়ে গড়িয়ার কাছে উৎসর্গ করে ছেড়ে দেন। এই পূজাতে প্রয়োজন হয় বাড়িতে তৈরি বিশুদ্ধ মদ ও মুরগির ডিম।

এছাড়া গড়িয়া পূজা উপলক্ষে ত্রিপুরার জনজাতিদের বাড়িতে পিঠাপুলি সহ নানারকমের চিরাচরিত খাবার তৈরি করা হয়। যেমন চিকভর্তা, হলুদভর্তা, গোদক, বাঁশের অঙ্কুর দিয়ে তৈরি নানা রকমারি খাবার, দেশি মুরগির ভর্তা, কাঁকড়া ভাজা, গুগলি শামুক দিয়ে তৈরি খাবার, বাঁশের ভেতর রান্না করা মাংস, জুমের চাল দিয়ে তৈরি খাবার অতিথি আপ‍্যায়নের জন্য তৈরি করা হয়। বাঙ্গুই ভাত, মুয়া (বাঁশের অঙ্কুর) সেদ্ধ, মাউখভি (মিষ্টি) এগুলো তো ভোজের পাতে থাকেই।

চৈত্রসংক্রান্তিকে ত্রিপুর ভাষায় বলে বিষু আর হারি। বিষু অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন গড়িয়া পূজার ঘট স্থাপন করেন গড়িয়া পূজার প্রধান পুরোহিত ‘চন্তাই, ও তার সহকারী ‘বাবুয়া’। ত্রিপুরার সংস্কৃতির এক বিশেষ অঙ্গ নাচ। ভিন্ন ভিন্ন উপজাতির নিজস্ব নৃত্যধারা বজায় আছে এখানে, যা বিভিন্ন পার্বণের সময় প্রদর্শিত হয়। নিজ নিজ ঐতিহ্যের পোশাক, গহনায় সজ্জিত হয়ে এরা নাচ করেন। গড়িয়া দেবতার পূজা উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হয় উপজাতীয় ‘গড়িয়া নৃত্য’। এই নৃত্য মাদলের তালেতালে করা হয়। ৫-৭ দিন ধরে ‘গড়িয়া নৃত্য’ পরিবেশন করা হয়। দল বেঁধে গড়িয়া দল গ্রামে গ্রামে ঘুরে গড়িয়া নৃত্য পরিবেশন করে। এছাড়া পালাগান ও বিভিন্ন খেলাধুলাও এইসময় চলে।

গড়িয়া দেবতা বাড়িতে আসছেন দেখে বাড়ির নারীরা উঠানে জল ছিটিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে একটি পিঁড়ি বসান।

লেখক মৃগাঙ্ক চক্রবর্তীর একটা লেখা থেকে গড়িয়া পূজার মিথ সম্পর্কে জানা যায়: বহুকাল আগে ত্রিপুরায় হাচুকতি আর লকতায় নামে দুজন দম্পতি বাস করত। পেশায় তারা ছিল জুমচাষি। ত্রিপুরার পাহাড়ি এলাকায় ওরা শান্তিতে বসবাস করত। কিন্তু শান্তি আর কোথায়? এত বছর বিয়ের পরও ওরা নিঃসন্তান। অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও সন্তান হয়নি। শেষে উপায় না দেখে হাচুকতি আর লকতায় একটা ছেলেকে দত্তক নিল। সুখেই কাটছিল এরপরের দিনগুলো। কিন্তু সে গুড়ে বালি। জন্মানোর তিন বছরের মধ্যেই সেই সন্তান অকালে মারা গেল। সন্তানশোকে মুহ্যমান হাচুকতি আর লকতায় দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে সন্তানকামনায় ব্রহ্মার উদ্দেশে প্রার্থনায় লেগে পড়ল। ওদের খাওয়াদাওয়া ঘুম সব মাথায় উঠল। সাত বছর কেটে গেলে, একদিন ব্রহ্মার টনক নড়ল। তখন তিনি নিজেই নরসিঁয়ং নামে হাচুকতি আর লকতায়ের ভিটায় জন্ম নিলেন। আর তার বছর তিনেকের মধ্যেই জন্ম নিল খুলুংতি আর মাইলুংতি নামের দুই মেয়ে। হাচুকতি আর লকতায়ের এখন ভরা সংসার। আর সন্তানশোক নেই। কিন্তু সমস্যা একটাই, নরসিঁয়ংয়ের মেরুদণ্ড অস্বাভাবিক শক্ত। অথচ বাচ্চাদের মেরুদণ্ড এত শক্ত হওয়া ভাল লক্ষণ নয়। সে যাই হোক, বড় হয়ে এই নরসিঁয়ংই হলেন নরসিংহ বা নৃসিংহ। তিনি হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করে ভক্ত প্রহ্লাদকে রক্ষা করলেন। কালক্রমে নরসিংহের বীরত্বের কথা জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। এমন একজন নির্ভীক বীর ছেলের এবার তো বিয়ে দিতে হয়। কিন্তু সেখানে আর এক বিপত্তি।
ছয় ছয় বার বিয়ে দেওয়ার পরও বিয়ে ভেঙে গেল নরসিংহের। বন্ধুবান্ধবরা এসব নিয়ে নরসিংহের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করে। টোনটিটকিরি কেটে নরসিংহকে ওরা ডাকে ‘গরয়া’ নামে। কারণ নরসিংহের সবেতেই গড়মিল। বিয়ে টিকছে না একের পর এক। তাই এরকম নামকরণ। গরয়া কথার মানেই তো গড়মিল। এই গরয়া নামটাই অপভ্রংশে হল গড়িয়া।
এদিকে আগের বিয়েগুলো ভেঙে গেছে তো কী হয়েছে? তাই বলে তো আর গড়িয়াকে বিয়ে না দিয়ে থাকা যায় না। অতএব গড়িয়ার জন্য সপ্তম বারের জন্য আর একটা বিয়ের আয়োজন করা হল। পাত্রীর নাম বুকমা। বুকমার সঙ্গে গড়িয়ার বিয়ে তো হল। কিন্তু বিয়ের পরদিনই গড়িয়া জেদ ধরল, সে সন্ন্যাস নেবে। সন্ন্যাসে যাওয়ার সময় গড়িয়া সবাইকে জানাল, সে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার এক রূপ। তারপর গড়িয়া তার স্ত্রী বুকমাকে জলের দেবী আর বোন মাইলুমার আর খুলুমাকে যথাক্রমে ধান আর কার্পাসের দেবী বানিয়ে, সন্ন্যাসের উদ্দেশে নিজের বাড়ি ছাড়ল।
হাচুকতি আর লকতায়ের এই সন্তান নরসিঁয়ংই গড়িয়া দেবতা নামে ত্রিপুরার দেববর্মা, জমাতিয়া, নোয়াতিয়া, খাকলু, রিয়াং, কলই, উচই সম্প্রদায়ের মানুষদের দ্বারা পূজিত হয়ে আসছেন।

এত গেল পৌরাণিক বা ধর্মীয় বিশ্বাসের কথা। তবে যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ পূজাতেও নানা পরিবর্তন এসেছে। এখন ত্রিপুরার বিভিন্ন জেলার লোকজন এমনকি অনেক ক্লাবের উদ্যোগেও গড়িয়া পূজার আয়োজন করা হয়। এই বারোয়ারি পূজায় গড়িয়া দেবতার বিগ্রহকে সঙ্গে নিয়ে সাত দিনব্যাপী পাড়া না ঘোরা হলেও প্রতি বছর ৭ বৈশাখ নিয়মনীতি মেনে ও পূর্ণ শ্রদ্ধার সঙ্গে গড়িয়া পূজার আয়োজন করা হয়। আর এই উপলক্ষে মেলা ও নানান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আয়োজন হয়। এই পূজা এখন তাই ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিকভাবেও সমগ্র ত্রিপুরা রাজ্যের একটি অন্যতম প্রধান উৎসবে পরিণত হয়েছে। তাই ত্রিপুরায় গড়িয়া পূজা উপলক্ষে রাজ্যব্যাপী সরকারি ছুটি থাকে।

চিত্র: গুগল

বাথুকাম্মা: মেয়েদের একান্ত নিজস্ব কুসুম মহোৎসব

ফুল দেই: উত্তরাখণ্ডের ফুলেল উৎসব

4 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »