Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ফুল দেই: উত্তরাখণ্ডের ফুলেল উৎসব

উত্তরাখণ্ডের একটি বিখ্যাত উৎসব হল ফুল দেই বা ফুলদেয়ি বা ফুলদেলি। চৈত্রমাসের প্রথমদিন থেকে শুরু হয়ে পুরো চৈত্রমাস জুড়ে এই উৎসব পালিত হয়। এই উৎসবের প্রধান গুরুত্ব কৃষিপ্রধান সমাজে উর্বর ফলনের জন্য উপাস্য দেবতাকে আমন্ত্রণ জানানো ও প্রার্থনা করা, যা ভারতীয় সভ‍্যতার এক চিরায়ত প্রার্থনা। ছোট থেকে বড় সকল মহিলা এই উৎসব অত‍্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে পালন করেন। কিশোরী ও যুবতী মেয়েরা প্রথমে বাগান ও জঙ্গল থেকে অনেক ফুল স‌ংগ্রহ করে আনেন। তারপর সেইসব ফুল ও চাল দিয়ে নিজেদের, আত্মীয়স্বজনদের, বন্ধুবান্ধবের বাড়ির প্রধান ফটক বা প্রবেশদ্বারের চৌকাঠের সামনে সুদৃশ্য অলংকরণ নির্মাণ করেন। এরপর মেয়েরা দলবেঁধে প্রতিবেশী ও গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িতে যান একটি থালায় কিছু ফুল, চাল ও গুড় নিয়ে। তারা এই গ্রাম পরিক্রমার সময় গান গেয়ে থাকেন। গানের কথা অনেকটা এমন: ‘ফুল দেই, ছম্মা দেই, দৈণী দ্বার, ভরী ভকার, য়ে দেলী স বারংবার নমস্কার, পূজৈঁ দ্বার বারংবার, ফুলে দ্বার…।’ বিনিময় উপহার হিসেবে তারা পান নানারকম মিষ্টি, টাকা, ফল, নারকেল ইত‍্যাদি।

থালায় কিছু ফুল, চাল ও গুড় নিয়ে গ্রাম পরিক্রমা।

ফুলদেই উৎসবের জন্যে যেসব বিশেষ খাবার তৈরি হয় তার মধ্যে প্রধান হল সাআয়া। এটি চালের গুঁড়ো, দ‌ই ও চিনি বা গুড় এবং ঘি দিয়ে তৈরি একরকমের দেশীয় সুস্বাদু পুডিং। এছাড়া ঝাংগোড়ের ক্ষীর, সিংগালস বা সেলরোটি, গুলগুলে, আরসা, ক্ষীরখাজাও তৈরি করেন বাড়ির বউ বা বিবাহিত মেয়েরা। এই আনন্দময় উৎসবে বড়দের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ছোটরাও খুব সক্রিয়ভাবে পুষ্প ও পত্রচয়নে অংশগ্রহণ করতে পারে বলে শৈশব থেকেই তাদের মনে ঐতিহ্য ও ললিতকলার বিকাশ ঘটে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। যা এই উৎসবের একটা শিক্ষণীয় দিক। এছাড়া এই উৎসব সমগ্র উত্তরাখণ্ড অর্থাৎ কুমায়ুন ও গাড়োয়াল অঞ্চলের মানুষের পরিবার ও কম‍্যুনিটির সঙ্গে এক অভ্যন্তরীণ সংযোগ গড়ে তুলতে সাহায‍্য করে।

চৌকাঠের সামনে সুদৃশ্য অলংকরণ।

বাড়ির মেয়েদের নিজের পরিবার ও প্রতিবেশী এবং আত্মীয়স্বজনের পরিবারের উন্নতি, সাফল্য প্রার্থনা উৎসবটিকে প্রাত‍্যহিক দিনযাপনের ক্ষুদ্র গণ্ডি ভেঙে এক বৃহত্তর বোধে মহিমান্বিত করে তোলে, যা শাশ্বত ভারতবর্ষের অনন্য পরিচয়বাহী। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে উত্তরাখণ্ডের পাহাড়িয়া লোকগীতিও উত্তুঙ্গ পাহাড়ের চূড়ায় ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয়ে, পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে এখানকার মানুষজনের মত। এইভাবে একটি মূলত উৎকৃষ্ট কর্ষণ ও ফলনের জন্য প্রার্থনাবাহী উৎসব ফুল দেই, বসন্তের রঙিন ফুলের স‌ংযোজিত নিবেদনে, মণ্ডলকলার নৈপুণ্যে সমগ্র উত্তরাখণ্ডে এক মনোমুগ্ধকর বিস্তৃত উদার পরিমণ্ডল তৈরি করে উৎসবটিকে সর্বাঙ্গীন সুন্দর ও সাফল্যমণ্ডিত করে তোলে।

‘ফুল দেই, ছম্মা দেই…’।

উত্তরাখণ্ডে চৈত্র মাসে অনুষ্ঠিত আর একটি বড় উৎসব হল ঘোঘা মাতা উৎসব। এটি উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রূপে অনুষ্ঠিত হলেও উৎসবের কয়েকটি মূল বিষয় এক। আসলে উত্তরাখণ্ডের জঙ্গল, উপত্যকা, বুগিয়াল চৈত্রমাসে ফুলে ফুলে ভরে যায়। তাই ঘোঘা মাতা উৎসবেও ফুলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেরাদুনের গভর্নর হাউসে যেমন জাঁকজমকের সঙ্গে ফুল দেই উৎসব পালিত হয়, তেমনই আবার শৈবতীর্থ কেদারনাথধাম স‌ংলগ্ন অঞ্চলে অর্থাৎ রুদ্রপ্রয়াগে অনেক বড় করে অনুষ্ঠিত হয় ঘোঘা মাতা উৎসব।

পুরাণ মতে, বহু যুগ আগে পার্বতীমাতা দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে তাঁর পিতৃগৃহে গিয়ে কিছুদিন থাকার জন্য অনুমতি চান। কিন্তু মহাদেব এই আর্জি উপেক্ষা করেন। এর ফলে দেবী পার্বতী অত্যন্ত হতাশ হন এবং শেষপর্যন্ত স্বামীর অনুমতি ছাড়াই তিনি তাঁর জন্মস্থানে যাওয়ার জন্য র‌ওনা হন। স্ত্রীর এই কাজে ক্রুদ্ধ মহাদেব তখন নিজের রূপ পরিবর্তিত করে এক অসুরের রূপ ধারণ করেন এবং পার্বতীমাতা যখন তাঁর জন্মস্থানে যেতে চেষ্টা করেন তখন সেই অসুরের রূপধারী মহাদেব তাঁকে বারবার ভয় দেখিয়ে বাধা দিতে থাকেন। শেষপর্যন্ত দেবী পার্বতী ফিরে যাবার জন্য মনস্থির করেন। ফিরে আসার সময় মাঝপথে তার খুব খিদে পায়, কিন্তু সামনে কিছু না পেয়ে বরফখণ্ড ভক্ষণ করেন। এই সময় দেবী পার্বতী ন’মাসের গর্ভবতী ছিলেন আর ওই সময়েই হঠাৎ করে তিনি এক ‘ঘোঘা’ অর্থাৎ জড়বুদ্ধিসম্পন্ন সন্তানের জন্ম দেন। মহাদেব এসব জেনেও যখন দেবী পার্বতী ফিরে আসার পরে তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চান, তখন দেবী পার্বতীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় আর তখনই তিনি যে তুষারখণ্ড ভক্ষণ করেছিলেন, তা বমি করে দিয়ে, স্বামী মহাদেবের ওপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর জন্মস্থানে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। স্ত্রীর বিচ্ছেদে মহাদেব নিজের ভুল বুঝতে পারেন, তিনি দেবী পার্বতীর জন্মস্থানে গিয়ে দেবীর রাগ কমানোর জন্য তাঁর পুজো করতে শুরু করেন এবং আটদিন পরে দেবী পার্বতীর রাগ কমে ও তিনি আবার খুশিমনে স্বামী মহাদেবের সঙ্গে ফিরে যান। এই লোককাহিনিকে মনে রেখে উত্তরাখণ্ডে চৈত্রমাসের প্রথমদিন থেকে শুরু করে আটদিন ঘোঘা মাতার পূজা করা হয়।

পালকিবাহকেরা।

সাতদিন ধরে একটি কাঠের তৈরি পালকিকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে তার মধ‍্যে একটি বস্ত্র রেখে কাঁধে করে সারা গ্রামের প্রতিটি বাড়ির প্রবেশদ্বারে ঘোরানো হয়, এই সময় গৃহস্থ বাড়ির মেয়ে-বউরা পালকিবাহক শিশু, বালক ও কিশোর ভক্তদের চাল, ডাল, সব্জি, টাকাপয়সা দেন। অষ্টম দিনে এইসব পূজা উপাচার একত্রিত করে গ্রামবাসীরা নদীর পাড়ে কোনও মাঠে ওই পালকির পূজো করে সমবেতভাবে দেবীর প্রসাদ গ্রহণ করেন। পিওলি, বুরান (রডোড্রেনডন), পাইয়া এইসব স্থানীয় ফুলে সুসজ্জিত হয়ে তারা নাচ, গান, খাওয়াদাওয়া করে উৎসবের আনন্দ উপভোগ করেন।

চিত্র: গুগল

বাথুকাম্মা: মেয়েদের একান্ত নিজস্ব কুসুম মহোৎসব

গড়িয়া: ত্রিপুরার জনজাতিদের উৎসব আজ সর্বজনীন

4 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

ভূতের একটি বাজে গল্প

দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিতেই প্রথমে যেটি চোখে পড়ল, সেটি সেই লাল-হলুদ মাফলার, খাটের পাশে ঝোলানো। তাহলে সিড়িঙ্গেবাবু নিশ্চয়ই এই ঘরেই অধিষ্ঠান করেন, তালা দিয়ে কোথাও বেরিয়েছেন। হঠাৎ আমি ভূতগ্রস্তের মত করিডর ধরে হাঁটছি আর এক-একটা করে ঘরের দরজা ঠেলে ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছি। কী আশ্চর্য, প্রতিটি ঘরেই কোথাও না কোথাও দেখছি একটা করে ওই লাল-হলুদ মাফলার ঝুলছে। যত দ্রুত পারি দোতলায় ঘরগুলোর দরজা ঠেলে উঁকি দিলাম। সবখানেই এক ছবি।

Read More »
সুজিত বসু

কবিতা: জীবনের নানা দিক

ট্রেনের জানালা থেকে চোখে পড়ে ঘাসের গালিচা/ কোমল রোদের স্নেহে ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চল শান্তির নিদ্রায়/ সমুদ্রে দ্বীপের মতো ছোট ছোট বাড়িগুলি ঘাসের শয্যায়/ অতি দ্রুত বদলে যায় দৃশ্যাবলি, ট্রেন থামে ব্রাসেলস স্টেশনে/ বেলজিয়ামের মোহ দূরে রেখে ট্রেন চলে স্থির নিশানায়/ অভ্রান্ত লক্ষ্যের দিকে, আমস্টারডাম ডাকে কুহকী মায়ায়/ নগরে পৌঁছেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য, সুন্দরী ট্রামেরা/ হাতছানি দিয়ে ডাকে, বহু বহুদিন পরে প্রিয় বাহনের/ ডাকে সাড়া দিয়ে আমি পৌঁছে যাই মহার্ঘ নিবাসে

Read More »
নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | প্রথম পর্ব

আমাদের খেলা করা দরকার, তাই আমাদের কয়েকজন ছেলে মিলে ক্লাব তৈরি করতে হবে। কোথায় করা যায়? — অমুক জায়গায় — ওই জায়গাটা পড়ে আছে, তা যাদের জায়গা তারা বললেন, “ওই তো ওখানে জঙ্গল হয়ে আছে, তা যদি তোমরা জঙ্গল-টঙ্গল পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে ক্লাব তৈরি করতে পার তো করো।” আমাদের আর পায় কে — আমরা মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলে। উদ্ধার করলাম। উদ্ধার-টুদ্ধার করে এর বাড়ি থকে চারটে বাঁশ, ওর বাড়ি থেকে তিনটে হোগলা এভাবে যোগাড়-যন্ত্র করে-টরে একটা চালাঘর তৈরি করা হলো। সেই চালাঘরকেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে আমাদের নতুন লাইব্রেরী তৈরি হলো। ক্লাবের নাম হলো ‘সেনহাটি অ্যাথলেটিক ক্লাব’।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বাঘেশ্বরীদেবীর পুজো! সেই থেকেই ‘বাগনান’!

ছোট্ট ওই ভূখণ্ডটি বাঘের উপস্থিতির জন্যই তখন ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয় বলে প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরার অভিমত। এই বিষয়ে তিনি আরও জানান, আরবি ভাষা অনুযায়ী ‘নান’ কথার অর্থ হল ‘চরভূমি’। ‘নান’ শব্দের আরও একটি অর্থ হল ‘ছাউনি’। তখন কাছারিপাড়া ছাড়াও নদী সংলগ্ন বেশ কয়েকটি এলাকায় ইংরেজ সেনাদের ছাউনি ছিল বলে জানা যায়। যার মধ্যে খাদিনান, পাতিনান, খাজুরনান, বাইনান, চিৎনান, মাছিনান ইত্যাদি জনপদগুলি উল্লেখযোগ্য। যেহেতু নদীর চরে বাঘেশ্বরী দেবীর পুজো হত, সেই জন্য প্রাথমিকভাবে এলাকাটি ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ‘বাঘনান’ অপভ্রংশ হয়ে ‘বাগনান’-এ পরিণত হয়েছে।

Read More »
আবদুল্লাহ আল আমিন

কবিগান: সমাজবাস্তবতা, বিষয়বৈভব ও রূপবৈচিত্র্য

এমন লোকপ্রিয় বিষয় বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা ভাষা, সঙ্গীত ও সাহিত্যে কবিগান ও কবিয়ালদের অবদানের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগান সংগ্রহ এবং এ বিষয় পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে কবিয়ালদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান কিংবা কবিগানকে সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক এ গানকে সংরক্ষণ করার সুপারিশ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই গানের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে লোকায়ত বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা দিক যার অধিকাংশই অনালোচিত ও অনালোকিত রয়েছে অদ্যাবধি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার: মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভা

সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন, এবং জাতীয় কংগ্রেসে নিয়মিত যোগ দিতেন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ববর্তী বছরের জাতক এবং প্রখর প্রজ্ঞাবান অশ্বিনীকুমার ১৮৯৭-এর কংগ্রেসের অমরাবতী অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে একে ‘Threedays’ mockery’,— ‘তিনদিনের তামাশা’ বলে উল্লেখ করেন। দুর্ভাগ্য দেশের, তাঁর কথা অনুধাবন করলেও কেউ গুরুত্ব দেননি। সে-অধিবেশনের সভাপতি চেট্টুর শঙ্করণ নায়ারকে নিয়ে অক্ষয়কুমার-অনন্যা পাণ্ডে অভিনীত বায়োপিক তৈরি হয়েছে। অথচ সারা উপমহাদেশ-কাঁপানো অশ্বিনীকুমারের মূল্যায়ন আজ-ও অপেক্ষিত।

Read More »