উত্তরাখণ্ডের একটি বিখ্যাত উৎসব হল ফুল দেই বা ফুলদেয়ি বা ফুলদেলি। চৈত্রমাসের প্রথমদিন থেকে শুরু হয়ে পুরো চৈত্রমাস জুড়ে এই উৎসব পালিত হয়। এই উৎসবের প্রধান গুরুত্ব কৃষিপ্রধান সমাজে উর্বর ফলনের জন্য উপাস্য দেবতাকে আমন্ত্রণ জানানো ও প্রার্থনা করা, যা ভারতীয় সভ্যতার এক চিরায়ত প্রার্থনা। ছোট থেকে বড় সকল মহিলা এই উৎসব অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে পালন করেন। কিশোরী ও যুবতী মেয়েরা প্রথমে বাগান ও জঙ্গল থেকে অনেক ফুল সংগ্রহ করে আনেন। তারপর সেইসব ফুল ও চাল দিয়ে নিজেদের, আত্মীয়স্বজনদের, বন্ধুবান্ধবের বাড়ির প্রধান ফটক বা প্রবেশদ্বারের চৌকাঠের সামনে সুদৃশ্য অলংকরণ নির্মাণ করেন। এরপর মেয়েরা দলবেঁধে প্রতিবেশী ও গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িতে যান একটি থালায় কিছু ফুল, চাল ও গুড় নিয়ে। তারা এই গ্রাম পরিক্রমার সময় গান গেয়ে থাকেন। গানের কথা অনেকটা এমন: ‘ফুল দেই, ছম্মা দেই, দৈণী দ্বার, ভরী ভকার, য়ে দেলী স বারংবার নমস্কার, পূজৈঁ দ্বার বারংবার, ফুলে দ্বার…।’ বিনিময় উপহার হিসেবে তারা পান নানারকম মিষ্টি, টাকা, ফল, নারকেল ইত্যাদি।
ফুলদেই উৎসবের জন্যে যেসব বিশেষ খাবার তৈরি হয় তার মধ্যে প্রধান হল সাআয়া। এটি চালের গুঁড়ো, দই ও চিনি বা গুড় এবং ঘি দিয়ে তৈরি একরকমের দেশীয় সুস্বাদু পুডিং। এছাড়া ঝাংগোড়ের ক্ষীর, সিংগালস বা সেলরোটি, গুলগুলে, আরসা, ক্ষীরখাজাও তৈরি করেন বাড়ির বউ বা বিবাহিত মেয়েরা। এই আনন্দময় উৎসবে বড়দের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ছোটরাও খুব সক্রিয়ভাবে পুষ্প ও পত্রচয়নে অংশগ্রহণ করতে পারে বলে শৈশব থেকেই তাদের মনে ঐতিহ্য ও ললিতকলার বিকাশ ঘটে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। যা এই উৎসবের একটা শিক্ষণীয় দিক। এছাড়া এই উৎসব সমগ্র উত্তরাখণ্ড অর্থাৎ কুমায়ুন ও গাড়োয়াল অঞ্চলের মানুষের পরিবার ও কম্যুনিটির সঙ্গে এক অভ্যন্তরীণ সংযোগ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
বাড়ির মেয়েদের নিজের পরিবার ও প্রতিবেশী এবং আত্মীয়স্বজনের পরিবারের উন্নতি, সাফল্য প্রার্থনা উৎসবটিকে প্রাত্যহিক দিনযাপনের ক্ষুদ্র গণ্ডি ভেঙে এক বৃহত্তর বোধে মহিমান্বিত করে তোলে, যা শাশ্বত ভারতবর্ষের অনন্য পরিচয়বাহী। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে উত্তরাখণ্ডের পাহাড়িয়া লোকগীতিও উত্তুঙ্গ পাহাড়ের চূড়ায় ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয়ে, পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে এখানকার মানুষজনের মত। এইভাবে একটি মূলত উৎকৃষ্ট কর্ষণ ও ফলনের জন্য প্রার্থনাবাহী উৎসব ফুল দেই, বসন্তের রঙিন ফুলের সংযোজিত নিবেদনে, মণ্ডলকলার নৈপুণ্যে সমগ্র উত্তরাখণ্ডে এক মনোমুগ্ধকর বিস্তৃত উদার পরিমণ্ডল তৈরি করে উৎসবটিকে সর্বাঙ্গীন সুন্দর ও সাফল্যমণ্ডিত করে তোলে।
উত্তরাখণ্ডে চৈত্র মাসে অনুষ্ঠিত আর একটি বড় উৎসব হল ঘোঘা মাতা উৎসব। এটি উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রূপে অনুষ্ঠিত হলেও উৎসবের কয়েকটি মূল বিষয় এক। আসলে উত্তরাখণ্ডের জঙ্গল, উপত্যকা, বুগিয়াল চৈত্রমাসে ফুলে ফুলে ভরে যায়। তাই ঘোঘা মাতা উৎসবেও ফুলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেরাদুনের গভর্নর হাউসে যেমন জাঁকজমকের সঙ্গে ফুল দেই উৎসব পালিত হয়, তেমনই আবার শৈবতীর্থ কেদারনাথধাম সংলগ্ন অঞ্চলে অর্থাৎ রুদ্রপ্রয়াগে অনেক বড় করে অনুষ্ঠিত হয় ঘোঘা মাতা উৎসব।
পুরাণ মতে, বহু যুগ আগে পার্বতীমাতা দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে তাঁর পিতৃগৃহে গিয়ে কিছুদিন থাকার জন্য অনুমতি চান। কিন্তু মহাদেব এই আর্জি উপেক্ষা করেন। এর ফলে দেবী পার্বতী অত্যন্ত হতাশ হন এবং শেষপর্যন্ত স্বামীর অনুমতি ছাড়াই তিনি তাঁর জন্মস্থানে যাওয়ার জন্য রওনা হন। স্ত্রীর এই কাজে ক্রুদ্ধ মহাদেব তখন নিজের রূপ পরিবর্তিত করে এক অসুরের রূপ ধারণ করেন এবং পার্বতীমাতা যখন তাঁর জন্মস্থানে যেতে চেষ্টা করেন তখন সেই অসুরের রূপধারী মহাদেব তাঁকে বারবার ভয় দেখিয়ে বাধা দিতে থাকেন। শেষপর্যন্ত দেবী পার্বতী ফিরে যাবার জন্য মনস্থির করেন। ফিরে আসার সময় মাঝপথে তার খুব খিদে পায়, কিন্তু সামনে কিছু না পেয়ে বরফখণ্ড ভক্ষণ করেন। এই সময় দেবী পার্বতী ন’মাসের গর্ভবতী ছিলেন আর ওই সময়েই হঠাৎ করে তিনি এক ‘ঘোঘা’ অর্থাৎ জড়বুদ্ধিসম্পন্ন সন্তানের জন্ম দেন। মহাদেব এসব জেনেও যখন দেবী পার্বতী ফিরে আসার পরে তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চান, তখন দেবী পার্বতীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় আর তখনই তিনি যে তুষারখণ্ড ভক্ষণ করেছিলেন, তা বমি করে দিয়ে, স্বামী মহাদেবের ওপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর জন্মস্থানে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। স্ত্রীর বিচ্ছেদে মহাদেব নিজের ভুল বুঝতে পারেন, তিনি দেবী পার্বতীর জন্মস্থানে গিয়ে দেবীর রাগ কমানোর জন্য তাঁর পুজো করতে শুরু করেন এবং আটদিন পরে দেবী পার্বতীর রাগ কমে ও তিনি আবার খুশিমনে স্বামী মহাদেবের সঙ্গে ফিরে যান। এই লোককাহিনিকে মনে রেখে উত্তরাখণ্ডে চৈত্রমাসের প্রথমদিন থেকে শুরু করে আটদিন ঘোঘা মাতার পূজা করা হয়।
সাতদিন ধরে একটি কাঠের তৈরি পালকিকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে তার মধ্যে একটি বস্ত্র রেখে কাঁধে করে সারা গ্রামের প্রতিটি বাড়ির প্রবেশদ্বারে ঘোরানো হয়, এই সময় গৃহস্থ বাড়ির মেয়ে-বউরা পালকিবাহক শিশু, বালক ও কিশোর ভক্তদের চাল, ডাল, সব্জি, টাকাপয়সা দেন। অষ্টম দিনে এইসব পূজা উপাচার একত্রিত করে গ্রামবাসীরা নদীর পাড়ে কোনও মাঠে ওই পালকির পূজো করে সমবেতভাবে দেবীর প্রসাদ গ্রহণ করেন। পিওলি, বুরান (রডোড্রেনডন), পাইয়া এইসব স্থানীয় ফুলে সুসজ্জিত হয়ে তারা নাচ, গান, খাওয়াদাওয়া করে উৎসবের আনন্দ উপভোগ করেন।