আনি অ্যার্নো
অনুবাদ: মানব সাধন বিশ্বাস
শেষ যেবার মায়ের কাছে গেলাম, সে দিনটা ছিল জুলাইয়ের এক রবিবার। ট্রেনে গিয়েছিলাম। মত্তিভেল স্টেশনে এসে আমরা অনেকক্ষণ বসেছিলাম। দিনটা গরম ছিল। কামরায়, বাইরে— কোথাও কোনও কোলাহল নেই। আমি খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম। প্ল্যাটফর্ম একেবারে শুনশান। দেখলাম এস.এন.সি.এফ. রেলরোডের বেড়ার ওপাশটায় ঘাস অনেকটা লম্বা হয়ে বেড়ে গিয়েছে— আপেলগাছগুলোর একেবারে নিচের ডালগুলোকে ছুঁয়ে ফেলেছে। বুঝতে পারলাম, সি. এলাকায় ঢুকে পড়েছি, এবার মায়ের সঙ্গে দেখা হবে আরেকটু পরেই। সেদিন সি.-তেও টানা বৃষ্টি হচ্ছিল, তবে ঢিমে ধারায়।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে মনে হল অনেক চেনা-মুখ দেখলাম, তবে কার যে ঠিক কী নাম সেটাই মনে করতে পারছিলাম না। হতে পারে আসলে ওদের নাম কস্মিনকালেও জানতাম না। সেদিন হাওয়ার দৌলতে গরমটা কম ছিল। সি.-তে সবসময়ই হাওয়াটা বেশি। মা তো বটেই, অন্যদেরও ধারণা, মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরের যেকোনও জায়গায় যতটা ঠান্ডা, তার চেয়েও সি.-তে ঠান্ডা বেশি।
রেলওয়ে হোটেলের সামনের পার্কিংয়ে ট্যাক্সি ছিল, কিন্তু ট্যাক্সি নিইনি। অন্য জায়গা হলে নিতাম। সি.-তে এসে হাঁটার সেই পুরনো অভ্যাসে ফিরে গেলাম। ট্যাক্সি যোগাযোগের খাতিরে, বিয়ে ইত্যাদির জন্যে, আর কবরখানার জন্যে ঠিক আছে, নইলে ট্যাক্সি নিয়ে পয়সা খরচের কোনও মানে নেই। হেঁটেই চলে গেলাম রু কার্নো-র দিকে— টাউন সেন্টারে। প্রথম কেক-শপেই ঢুকে পড়লাম; সেখান থেকে কেক, এক্লেয়ার্স, আর খানিকটা টক-ঝালের আচার কিনলাম। চার্চের দুপুরের প্রার্থনা সেরে ফেরার পথে মা এগুলোই আনতে বলত। কিছু ফুলও কিনলাম, তার মধ্যে গ্ল্যাডিওলা ফুল— যেগুলো অনেকদিন টিঁকে যায়, সেগুলোও ছিল। তারপর মায়ের আবাসস্থল— সেই হাউসিং কমপ্লেক্সে পৌঁছনো অব্দি শুধু একটা জিনিসই মাথায় ছিল: মাকে আবার দেখতে পাব, মা আমার জন্যে পথ চেয়ে আছে।
আমি মায়ের এক-কামরার স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় টোকা দিলাম। মা গলা উঁচিয়ে বলল, ‘আয়, ভেতরে আয়!’
‘দরজাটা বন্ধ করে দিস।’
‘জানতাম, তুই এসেছিস। তুই ছাড়া আর কে আসবে।’
মা অ্যাপ্রন পরেনি, ঠোঁটে কিন্তু লিপস্টিক ছিল। টেবিলের পাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়েছিল। আমার কাঁধে হাত রেখে মা হামি দেওয়ার জন্যে মুখখানা বাড়িয়ে দিল। তারপরই ছুড়তে আরম্ভ করল হাজারো প্রশ্ন: কীভাবে এলাম, বাচ্চারা কেমন আছে, কুকুরটা ঠিক আছে কিনা ইত্যাদি। মা কিন্তু আমার কোনও প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। মায়ের ভয়, সর্বক্ষণ নিজের কথা বলে গেলে হয়তো আমার মোটেও শুনতে ভাল লাগবে না— একঘেয়ে লাগতে পারে। পরে, প্রতিবার সে যেমন করে, বারবার বলে চলল গতে-বাঁধা সেই দুটো কথা: ‘এখানে বেশ আছি, এর চেয়ে ভাল আর কী চাই।’ আর ‘আমার কোনও নালিশ নেই।’ টিভিটা চলছিল, তবে নিঃশব্দে— শুধু রঙিন ডোরাকাটা টেস্ট প্যাটার্ন পর্দাটাই দেখাচ্ছিল।
গ্ল্যাডিওলা-র গোছাটা একটু আড়ষ্টভাবে হাতে নিয়ে খানিকটা নাটুকে গলায় মা আমাকে ধন্যবাদ দিল। আসলে আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম, ঘরের মানুষের মত নয়, বলতে গেলে একরকম অচেনা মানুষের মতই অযথা মাকে অনর্থক ব্যস্ত করে তুলছি। কেক তাকে খুশি করল ঠিকই, তবে চার্চ থেকে ফেরার পথে খানিকটা কেক মা নিজেও কিনে এনেছিল।
আমরা টেবিলে মুখোমুখি বসলাম। সেই খাবারদাবার আর পানীয়-ঠাসা টেবিলটা মায়ের অ্যাপার্টমেন্ট প্রায় ভরে ফেলেছিল। মনে পড়ল, মা এখানে আসার পরে আমি প্রথম যেবার আসি, তখন কী বলেছিল: ‘টেবিলটা বড় দেখেই কিনেছি— কম করে দশ জন বসার মত!’ একবার নয়, ছ-বছরে মা বহুবারই বলেছে কথাটা। যাই হোক, মা টেবিলটায় অয়েলক্লথ বিছিয়ে দিয়েছে— যাতে জিনিসটা নষ্ট না হয়।
মায়ের এত সব বলার ছিল যে, কোনটা ছেড়ে কোনটা দিয়ে শুরু করবে, খেই পাচ্ছিল না; দম আটকে যাচ্ছিল। স্টুডিও খানিকটা অন্ধকার, দরজটাও ছোটখাটো। ঘরে সামান্য গুমোট গন্ধ। ঘরে যথেষ্ট হাওয়া খেলে না।
যখন ছোট ছিলাম, প্রতি রবিবার নিয়ম করে মা আমাকে নিয়ে কিছু বয়স্ক মহিলার বাড়িতে যেত। তাদের বাড়ি থেকে বেরনোর সময় মা নিজেও সেসব বাড়ির হাওয়ার ঘ্রাণ নিয়ে বোঝার চেষ্টা করত। ‘বয়স্ক মানুষদের বাড়িঘরে এরকম ছ্যাতলা-পড়া গন্ধ সবসময়ই থাকে। ‘হবেই তো, জানলাগুলো তো কোনওকালে খোলে না।’— মা নিজেই একথা আগে বলত, তাই একসময় নিজেও যে তাদের মতই একজন হয়ে যাবে ভাবিনি।
মা বসন্তকালে এই সি. এলাকার জলহাওয়া নিয়ে কথা বলছিল। শেষ যেবার এখানে এসেছিলাম, তখন থেকে শুরু করে এপর্যন্ত যারা মারা গেছে, সেইসব মানুষদের কথা মনে রাখতে পারিনি বলে মায়ের বেশ রাগ হল; মা ধরে নিল, এই ভুলে যাওয়া ইচ্ছাকৃত: ‘ব্যাপারটা হল, এসব তুই মনে রাখতেই চাস না।’ খুঁটিনাটি বিবরণ দিয়ে মা ঠিক কার কথা বলতে চাইল অবশেষে সেটা ধরতে পারলাম। ভদ্রমহিলার মেয়ে আর আমি সহপাঠী ছিলাম, আমরা একসঙ্গে স্কুলে যেতাম। আরও কত কথা হল।
পৌনে বারোটা নাগাদ আমরা টেবিল গুছিয়ে নিলাম। শেষবার সাড়ে বারোটার আগে সম্ভব হয়নি। ইদানীং সবকিছু এগিয়ে আনছিল মা। এক সময় মা বলে উঠল, এখানকার আবহাওয়া আজকাল ভালই আছে, তবে অবস্থা বদলের আর বেশি দেরি নেই।
হাত-মুখ মোছার ন্যাপকিন খুঁজতে গিয়ে খাবারদাবারের পেছনে ডাঁই-করে রাখা কিছু ম্যাগাজিন দেখতে পেলাম। এনিয়ে মাকে কিছু বলিনি। তবে আমি যে সেগুলো দেখেছি, বোঝা গেল, সেটা মা বুঝতে পেরেছিল। ‘ছোট সাইজের ক’টা ম্যাগাজিন— পুলেট পড়তে দিয়েছিল। নইলে আসবে কী করে বল? তুই ভাল করেই জানিস, ওসব ছাইপাঁশ আমি পড়ি না।’ আসলে মা ওগুলোই পড়ত— ছোট্ট ছোট্ট গল্প, যার মাথামুণ্ডু নেই। তবু সবসময় তার ভয়, এসব অভ্যেস আমি ভালভাবে নেব না। আমি তো প্রায় বলেই ফেলেছিলাম যে, চাইলে আমি নিজে তোমার জন্যে পাবলিক লাইব্রেরি থেকে মালরোঁ-র বদলে মেয়েদের ন্যু দিউ কাগজটা অব্দি এনে দিতে পারি। যদি মা ভেবে নেয় যে আমার মতে ওসব পড়া তার সাজে না, সেক্ষেত্রে তার খারাপ তো লাগতেই পারে।
কোনও কথা না-বলে আমরা খাওয়া সারলাম। মায়ের চোখ তার প্লেটে আটকে ছিল। যেসব মানুষ প্রতিদিন একা একা খায়, তারা সামান্য ঝুঁকে একটা বিশেষ ভঙ্গিতে নড়াচড়া করে। খাবার তৈরির কোনও কাজে মা আমায় হাত লাগাতেই দেয়নি। ‘সব তুই করে ফেললে, তুই চলে যাওয়ার পরে আমার জন্যে আর থাকবে কী?’
হাতদুটো ক্রশচিহ্নের মত করে বিপরীত কাঁধে রেখে মা টানটান সিধে হয়ে চেয়ারে বসেছিল। কোনওদিন মাকে চুলে আলতো আঙুল চালিয়ে বিলি কাটতে দেখিনি। বইয়ের পাতায় ডুবে থাকার সময়েও মায়ের হাত ব্লাউজের মধ্যে চলে গিয়ে কখনো কাঁধ ছোঁয়নি। হতাশায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়লে মা হাঁপ ছেড়ে বিরক্তির সঙ্গে হাতদুটো গালের পাশ দিয়ে শূন্যে তুলে সোজা সামনের দিকে পা বাড়িয়ে সশব্দে চেয়ারে বসে পড়ত।
যেমন বরাবর হয়, এবার মায়ের মুখ ততটা কঠিন হয়ে ওঠেনি তখনও। শুধু দিনযাপনের প্রয়োজনে জীবন জুড়ে যতটা চাপ সইতে হয়, সে চাপ সেদিন তার চেয়ে বরং কিছু কম ছিল। এযাবৎ তার ঘোলাটে চোখ আমাকে সবসময় ঘোরতর সন্দেহ নিয়ে দেখে এসেছে। মায়ের নরম অথচ ক্ষুধার্ত দৃষ্টি আমার দিকে স্থির হয়ে আটকে ছিল। আমার জন্যে মা দিন গুনে চলেছিল। এই সকালেই গুনে ফেলেছে, আজই আমি আসছি। মায়ের সেই হিসেবমতই সেদিন আমরা দুজন একসঙ্গে হলাম। আধঘণ্টা সময় এরমধ্যেই কেটে গেল। আমাদের সেই একসঙ্গে কাটানোর মূল সুর বাঁধা ছিল একান্ত খেলাচ্ছলে আর সুনিবিড় সহানুভূতিশীল কোমল হৃদয়ে। অন্য একটা সুর হল হিংসাশ্রয়িতার স্থায়ী টালমাটাল— যা আমাকে পনেরো বছর বয়েস থেকে অবিরাম তাড়া করে চলেছে আজও: ‘গোরু, কুত্তী, আমি ওর জন্যে নিজেকে শেষ করে দেব।’ ‘পরোয়া করি না, আমি চললাম।’ ‘সবার আগে জেলে যাবি তুইই।’ ‘একটা অকম্মার ঢেঁকি তুই, একটা বোকা গাধা।’— এমন সব বাক্যবন্ধ সেদিন কিন্তু ফিরে আসেনি।
আরও নতুন নতুন বিষয় জুড়ে নিয়ে গল্প করার চেষ্টা করছিল মা। এসব শুধু একটিই কারণে— আজ আমি যেন তাড়াতাড়ি চলে না যাই। মায়ের বড় আশা আমাকে ধরে রাখার। পারলে চিরদিনের জন্যে মেয়ের সঙ্গে একসঙ্গে থাকার দুর্মর ইচ্ছা পুষে রাখত মা। আমি চলে গেলে মা আবার একলা হয়ে যাবে। ‘পুলেট ক’টা গুজবেরি দিয়েছিল। বিশ্বাস করবি না, কত ভাল ওই ফলগুলো। ঠিকই করেছে, মরশুমি ফল তো! হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে, তুই যেদিন গেলি, সেদিন তোকে দিয়েছিলাম।’ পুলেট আমাদের পুরনো প্রতিবেশী, সে আমার সমবয়েসি। প্রতি সপ্তাহে এখানে আসে। সে কোনওদিন এই সি. জায়গাটার মায়া ছাড়েনি।
দূরে বড় রাস্তায় গাড়ির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। পাশের বাড়ির রেডিও বেজে চলেছে। বোধ হয় ‘ট্যুর দ্য ফ্রান্স’ প্রোগ্রাম চলছে তখন।
‘জায়গাটা বেশ শান্ত।’
‘এখানে সবসময় নিরিবিলি। রবিবার একেবারে তো শুনশান।’
আমায় মা বহুবার ছুটিতে এখানে এসে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু আমার সি.-তে গরমকাল কাটানোর অভিজ্ঞতা ছিল বড় একঘেয়ে: সকাল থেকে রাত অব্দি একটানা বসে বসে শুধু পড়া আর পড়া; মাত্র তিন-চতুর্থাংশ দর্শকের সিট খালি পড়ে থাকা মন্ডায়াল থিয়েটারের রবিবারের মুভি— যা ছিল শুধু বড়দের জন্যে; আর আমাদের ‘সুন্দর হাঁটাহাঁটি’ তো ছিলই। মা ভাবত, আমি তুতো দিদির সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েছি; বাচ্চাদের খেলাধুলো দেখতাম। স্থানীয় ব্যবসাদারেরা রাস্তায় যে পথমেলা বসাত, সেখানে যেতাম; পাবলিক ডান্স হলে ঢোকা অবশ্য সাহসে কুলোয়নি।
বিকেলের মাঝামাঝি রান্নার জায়গার দেখি, একটা বেড়াল জানলায় এসে হাজির। মা হাতলওয়ালা চেয়ারে বসেছিল। বেড়ালটাকে দেখামাত্র মা ব্যস্ত হয়ে পড়ল। লাফিয়ে উঠে গিয়ে সেটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিল। বলতে গেলে বেড়ালটা মায়ের ‘পোষ্য’ জীব হয়ে উঠেছে। মা রোজ সেটাকে খাওয়াত। দিনে মায়ের কোলে শুয়ে সে দিব্বি ঘুমত। আজ শুরু থেকেই দেখছিলাম মাকে; এবার মা সবচেয়ে বেশি খুশি। বেড়ালটা আমাদের দুজনকে অনেকক্ষণ ব্যস্ত রেখেছিল। আমরা ওর কাণ্ডকারখানা দেখছিলাম, পালা করে কোলে রাখছিলাম। মা ওর হরেকরকম কায়দা-কসরতের গল্প শুরু করল। সে যেন গল্পের সেই পুঁচকে ভালুকছানা— বিচ্ছু, কিন্তু বুদ্ধি রাখে। থাবার ধারালো নখে পর্দা আঁচড়ায়— মায়ের হাতের কব্জিও বাদ দেয় না। বেড়ালটার গায়ে দু-জায়গায় লাল ডোরা। মা যেমন বরাবর বলে, তেমনি করেই বলল, ‘প্রতিটি প্রাণীই সুন্দর’। মনে হল, গল্পে গল্পে মা ভুলে গেছে যে, আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
একেবারে শেষ মুহূর্তে মা তাড়াহুড়ো করে একটা ফর্ম বের করে আনল। মায়ের সামাজিক সুরক্ষার দরখাস্তের ফর্ম— সেটা জরুরি-ভিত্তিতে পূরণ করার দরকার ছিল। আমি বললাম, ‘হাতে একদম সময় নেই মা; তুমি বরং ওটা আমাকে দিয়ে দাও, আমি ফর্মটা ভরে পাঠিয়ে দেব’খন।’
‘তুই শুধু দেখে নে একবার— কিচ্ছু সময় লাগবে না। তুই জেনে রাখ, স্টেশন থেকে মাত্র পাঁচ মিনিট দূরে আছিস।’
‘ট্রেন মিস করব, মা।’
‘তুই ট্রেন মিস করিসনি কোনওদিন। পরের ট্রেনটাও তো ধরতে পারিস।’ প্রায় কাঁদো কাঁদো চোখে মা বরাবরের মত বলল, ‘আমার মাথাখারাপ হয়ে যাচ্ছে।’
মা দরজায় আমায় হামি দিল। খুব চাইছিল, আরও কিছুক্ষণ গল্প করি। মায়ের সেই শেষ ছবি এখনও মনে ভাসছে: হাতদুটো গুটিয়ে তার গাঢ় ছায়ালেখা তৈরি করে বুক পেট আঁটোসাঁটো করে জড়ানো হলুদ পোশাকে দরজার দিকে হেঁটে আসছে মা। মায়ের এই ছবিটা সবচেয়ে সুন্দর।
ফিরলাম আবার খুব খারাপভাবে, ভীতুর মত।
তারপর সবচেয়ে ছোট রুটের ট্রেন ধরলাম, যেটা সেল স্টেশন ধরে না। পুরনো দিনগুলোতে সেখানে থামতে হত। সিনেমা থেকে ফেরার পর মায়ের জিজ্ঞাসু চোখের সামনাসামনি হতে হত। লিপস্টিকের অবশিষ্ট দাগ মুছে ফেলে মাকে জড়িয়ে ধরতাম। মা বলতো, ‘লোকে কী বলবে?’
ট্রেনে বসে, মায়ের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। মা একা একা নিঃশব্দে আমাদের খাওয়ার ডিসগুলো ধুয়ে নিচ্ছে। জানি এর সঙ্গেই মায়ের কাছে আমার উপস্থিতির সব চিহ্ন মুছে যাবে।
চোখের সামনে থেকে সি.-কে মিলিয়ে যেতে দেখলাম। সেই সেরনাম বিল্ডিংস, সেই রেললাইনের ধারের রেলকর্মীদের হাউসিং— চোখের সামনে থেকে একে একে সব উধাও হয়ে গেল।
এক মাস পরে মাকে দেখতে আমি সেখানে আবার ফিরে এসেছি। চার্চের প্রার্থনা সেরে ঘরে ফেরার পরে মায়ের সানস্ট্রোক হয়েছিল। মাকে সি.-এর হাসপাতালে ভর্তি করা হল। খোলা বাতাসের জন্যে অ্যাপার্টমেন্টের জানলা-দরজা খুলে দিলাম। খাবার-দাবারের জায়গা থেকে কিছু কাগজপত্র উদ্ধার করলাম। ফ্রিজে রাখা পচনশীল সবকিছু ফেলে দিলাম। সবজির ড্রয়ারের মাথায় গিঁটবাঁধা একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ চোখে পড়ল। দেখি ওই ব্যাগে মায়ের দেওয়া সেই গুজবেরিগুলো, যেগুলো আগেরবার ভুলে ফেলে এসেছিলাম। সেগুলো এখন শুধু একটা বাদামি রঙের দলা হয়ে আছে।
চিত্রণ: মুনির হোসেন
***
লেখক পরিচিতি
আনি অ্যার্নো-র জন্ম ১৯৪০ সালে উত্তর ফ্রান্সের নর্ম্যান্ডি অঞ্চলে সীন নদীর অদূরবর্তী লিলবোনা শহরের এক দরিদ্র শ্রমজীবী পরিবারে। শিক্ষা রুঅঁ ও বর্দো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইংরেজি সাহিত্যের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং আধুনিক ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কথাশিল্পী। প্রচলিত গতানুগতিকতাকে অতিক্রম করে লেখিকার সাহিত্যে এক নতুনতর ধারা যুক্ত করে সাহিত্যের লিখন-প্রকরণে অসামান্য অবদানের জন্যে ২০২২ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর রচনায় অলঙ্কারসমৃদ্ধ বুনন নেই, কিন্তু অসাধারণ গভীরতায় সাহিত্যগুণ-সম্পন্ন নিটোল বর্ণনায় সেগুলি ব্যক্তিমানুষকেন্দ্রিক থেকে সার্বজনিক পর্যায়ে উত্তরিত। সেগুলি রীতিমত রুঢ় বাস্তব অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক আত্মজৈবনিক কথনশৈলীতে সমৃদ্ধ, যার সুচিন্তিত আর্থসামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক আবেদন পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়।
নোবেল কমিটি তাঁদের অভিজ্ঞানপত্রে বলেন— লেখিকা ‘ব্যক্তিমানসের শিকড়-স্মৃতি, ক্ষোভ-ক্রোধ-অভিমানপ্রসূত অভিঘাত ও সার্বিক নিয়ন্ত্রণকে সাহসিকতা ও চিকিৎসানিদানশৈলীসন্মত সূক্ষ্মতায় উন্মোচিত করেছেন।’
‘লা প্লাস’ (১৯৬৫), ‘লা জার্মোয়ার ভিদ্’ (১৯৭৪), ‘লা ফাম্মা জলি’ (১৯৮১), ‘ইউন ফাম্মা’ (১৯৮৭), ‘আ উওম্যান্স স্টোরি’ (১৯৮৮), ‘ক্লিন্ড আউট’ (১৯৯০), ‘আ ম্যান্স স্টোরি’ (১৯৯৩), ‘আ ম্যান্স প্লেইস’ (১৯৯৩), ‘জুর্নাল দ্যু দিহোরস’ (১৯৯৩), ‘আ ফ্রোজেন উওম্যান’ (১৯৯৬), ‘জ্যু ন্ও সুইপা সার্তি দ্য মা নুই’ (১৯৯৭), ‘লা ওঁত’ (১৯৯৭), ‘লা ভি এক্সতেরিয়া’ (২০০০), ‘সা পের্দ্র’ (২০০১), ‘লা অকুপেশন’ (২০০২), ‘সিম্পল প্যাশন’ (২০০৩), ‘এক্সটেরিয়র্স’ (২০০৫), ‘দ্য পজেশন’ (২০০৮), ‘দ্য ইয়ার্স’ (২০০৮), ‘হ্যাপ্নিং’ (২০১১), ‘শেইম’ (২০১৯), ‘আই রিমেইন ইন ডার্কনেস’ (২০১৯), ‘ডু হোয়াট দে সে অর এল্স’ (২০২২), ‘দ্য ইয়াংম্যান’ (২০২২), ‘গেটিং লস্ট্’ (২০২২) প্রভৃতি আনি অ্যার্নো রচিত বিশেষ উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।