Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ফেসবুক দুর্গা

—হাই।

মেসেঞ্জারে এমন টিউন প্রায়শই বেজে ওঠে ড্যানিয়েলের। ড্যানিয়েল… ড্যানিয়েল সুন্দর বোস। নামকরা তথ্যচিত্র নির্মাতা। ‘হাসি’ নিয়ে একটি তথ্যচিত্র এবার জাতীয় পুরস্কার পাবার পরে, দু-একটি নিউজ চ্যানেল আর কিছু দ্বিতীয় শ্রেণির খবরের কাগজের পাঁচের পাতা আগ্রহ দেখিয়েছিল। টেলিভিশন, খবরের কাগজ কোনওটাই পড়া হয় না ড্যানিয়েলের। খবরে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ওর। একবার এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন— এটা উন্নাসিকতা, নাকি উদাসীনতা? ড্যানিয়েল জবাব দিয়েছিল— “এটা বিশালতা। ফিচার ফিল্ম হচ্ছে বটগাছের মত, আর তার শিকড় হচ্ছে ডকু-ফিল্ম। ‘পেজ-থ্রি’ সাংবাদিকতা বটগাছ খোঁজে। তাদের পক্ষে শিকড়ের গভীরতা আর তার বিশালতা জানা সম্ভব নয়।” এই হচ্ছে ড্যানিয়েল, যার ফেসবুক প্রোফাইলে লেখা, চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাই এমনতর ‘হাই’ সাঁই সাঁই মেসেঞ্জারে ‘বাই-ডিফল্ট’ ভাসে ড্যানিয়েলের ইনবক্সে।

আজ সপ্তমী। সকালে একটা বৈঠকী সভা শেষ করে দৌড়ে সবে বাড়ি ঢুকেছে ড্যানিয়েল। মন-কে নিয়ে সপ্তমীর আলো শুষে নেবে সাঁঝে। তেমনটাই ঠিক আছে। কিন্তু কখনও কখনও দুটো দৌড় বিপরীতে ছোটে। কেউ ছোটে ছেলেবেলায়, কেউ ছুটতে চায় সামনে; কেবল দু’জনে। মন আজ ব্যস্ত… খুব ব্যস্ত। এইমাত্র ইনবক্সে জানিয়ে দিয়েছে— ‘আজ আর হল না ডেন্… এতদিন পর ওর সাথে দেখা, প্লিজ ডোন্মাইন্ড।’

বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকল ড্যানিয়েল মেসেজটার দিকে। ও কি কিছু জবাব দেবে? নাহ থাক। ভীষণ দীর্ঘশ্বাস পাচ্ছে ড্যানিয়েলের… সে সময় আবার…

—হাই।

মেসেজটা পড়েই নারী ও নক্ষত্র সব জ্যান্ত হয়ে গেল। কচুপাতা বৃষ্টিফোঁটায় ভেজে না… দানা করে গড়িয়ে ফেলে দেয় মাটিতে। আবার কিছু কিছু বৃষ্টিদানা গড়িয়ে যেতে যেতে ভেঙে যায় অজান্তে। কচুপাতা ভিজে ওঠে তখন। কী যেন মনে হল ড্যানিয়েলের! পাল্টা জবাব দিল: হাই।

—দেখা করবে?

—আপনি আমায় চেনেন?

—চিনি তো! তোমার খবর পাই ফেসবুকে। সেদিন অনুষ্ঠানও দেখলাম তোমার। কী রোমান্টিক ভয়েস গো তোমার! মেয়েরা পাগল হয় না?

—কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনি না!

—না চিনলে, আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করলে কেন?

—খুব ভরসার কমন ফ্রেন্ড থাকলে মাঝেসাঝে করে ফেলি।

—দেখা করবে?

—কোনও দরকার?

—তুমি কি দরকার ছাড়া কারুর সাথে দেখা করো না?

—অপরিচিতর সাথে করি না।

—ফোন নম্বর দাও। পরিচয় করে নিচ্ছি।

একটা অজানা উৎসাহ ক্রমশ চেপে বসছে ড্যানিয়েলের আঙুলে। আপনি বলে সম্বোধন করার পরেও, জোর করেই যেন, জেদ করেই যেন মেয়েটা তুমি বলে সম্বোধন করতে চাইছে। এটা নির্ঘাত ফেক আইডি। অসাধারণ টানা টানা চোখ। পিয়ান দে। ফেসবুক প্রোফাইলটা খুব ভালভাবে চেক করল ড্যানিয়েল। অ্যাক্ট্রেস। কিন্তু তেমন আহামরি অ্যাক্ট্রেস-সুলভ কিছু খবর তো দেখা গেল না। ইন্টারেস্টিং! কেন দেখা করতে চাইছে এভাবে? অপরিচিত উৎকট এমন হাই, ওয়েভ, ‘আপনার লেখা পড়ে জাস্ট ফিদা, আমাকে নিয়ে লিখবেন?’ এরকম বহু মেসেজ আসে… জমা হয়ে থাকে ইনবক্স, পাত্তা দেয় না ড্যানিয়েল। তবে এভাবে কখনও কেউ দেখা করার জন্য জেদ করেনি। তাও আবার ফোন নম্বরের আর্জি নিয়ে। এবার নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে বসল ড্যানিয়েল; সেই বা চ্যাটিং এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কেন? আগে তো কত ইগনোর করেছে এসব! নাকি মনের উপেক্ষাটা ওর ক্ষতে ভীষণ জ্বালা ধরাচ্ছে… ভীষণ জ্বালা। কী জানি!

আবার মেসেজ বক্সে ব্যাক করল ড্যানিয়েল। পিয়ান ফোন নম্বর সেন্ট করেছে। কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল ফেক প্রোফাইল। বহু পুরুষ এখন এই ছদ্মবেশ নিয়ে মহিলাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতায়। তারপর আলাপ জমিয়ে ‘লঞ্জরী’ নিয়ে আলোচনায় মেতে ওঠে। এসব ভার্চুয়াল পারভারশনের গল্প জানা আছে ড্যানিয়েলের। কিন্তু ফোন নম্বর দেওয়া মানে তো…

মেয়েটি কিন্তু কনস্ট্যান্ট অনলাইন। যেন ও জানে ড্যানিয়েল মেসেজ করবেই।

—কোথায় থাকেন আপনি?

—কেন? ফোন নম্বর দিলাম তো, ফোন করে জিজ্ঞেস করে নাও।

—হ্যাঁ করছি।

—আমায় এতক্ষণ বসিয়ে রেখে, আমার প্রোফাইল ঘাঁটছিলে; না? ভয় করছে?

—না। ভয় করবে কেন?

—আমি থাকি সার্ভে পার্ক। অজয়নগর বা সন্তোষপুর চেনো তো? দু’দিক দিয়েই আসতে পারো তুমি। কতক্ষণ লাগবে আসতে?

—আমি অনেক দূরে আছি।

—হ্যাঁ দূরে মানে কত দূর? আসতে আসতে ভোর হয়ে যাবে কি?

—আজ ছেড়ে দিন, পরে কখনও দেখা হবে’খন। আমি এখন কোলাঘাটে, বাড়ি ফিরতে রাত বারোটা হয়ে যাবে।

—নো প্রবলেম।

—মানে?

—মানে… জাস্ট নো প্রবলেম। সার্ভে পার্কে যে অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক আছে, আমি ওখানে দাঁড়াব। রাত বারোটা।

—কিন্তু কী ব্যাপার বলুন তো?

—তেমন কিছু নয়। বাই দ্য ওয়ে… নিজের গাড়ি আছে তো?

—হ্যাঁ।

—ড্রাইভ করতে জানো?

—নিজেই ড্রাইভ করি। কেন?

—ওয়াও দ্যাটস গ্রেট! আজ সারারাত ঠাকুর দেখব তোমার সাথে।

স্পর্ধারও একটা সৌন্দর্য্য আছে। আবার রহস্যেরও একটা চুম্বকত্ব আছে। এতক্ষণ মনের কোনও মেসেজই আসেনি। ফোন তো দূরের কথা। উপেক্ষা থেকেও একটা তীব্র হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে চেপে বসে। তবে ড্যানিয়েল কি এসবের জন্যই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলছে? আবার প্রশ্ন করল নিজেকে। না। ফাঁদে ও পা দিচ্ছে না। কোনও মহিলা আজ অবধি ওকে টলাতে পারেনি। আর এ তো অপরিচিত একজন সাধারণ মহিলা। ম্যানেজমেন্টের ছাত্র একবার SWOT অ্যানালাইসিস করে নিল… কী কী হতে পারে?

এক: মেয়েটি দুজন পুরুষ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর ওকে খুন করে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে গেল। পুজোর সময় আর যাই হোক, স্বয়ং লাদেনও এই দুঃসাহস করবে না।

দুই: কিছুদূর যাবার পর মেয়েটি বলবে, যা আছে বার করো চাঁদু, নইলে কিন্তু চেঁচাব। নাহঃ… চ্যাট সেভ করা আছে। অত সহজ হবে না।

একটা তীব্র গল্পের নেশা পেয়ে বসেছে ড্যানিয়েলের। অদ্ভুত একটা ইনট্যুশন কাজ করে ড্যানিয়েলের। ওর মনে হচ্ছে এখন, এতে গল্প আছে… অনেক গল্প। একটা অন্য দুর্গার তথ্যচিত্র লুকিয়ে আছে। লিখতে হবে সেসব।

সপ্তমীর চাঁদ তখন শিয়রে বিনীত। এক গ্লাস জল খেল ড্যানিয়েল। সিলিংয়ের দিকে তাকাল দু’মিনিট। পাটুলি থেকে গাড়ি স্টার্ট করার আগে ছুড়ে দিল দুলাইন…

—সাঁতরাগাছি একদম ফাঁকা। আমি হয়তো সাড়ে এগারোটার মধ্যে পৌঁছে যাব। কিন্তু আপনাকে চিনব কী করে?

—আমার প্রোফাইলের ছবির মতোই আমি। আর… রাত সাড়ে এগারোটায় অ্যক্সিস এটিএম’য়ে লাল শিফন পরে, সবচাইতে যে সুন্দরীটা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবে, সেটাই আমি।

—হুমমম

—এক বোতল বিয়ার এনো। আমি হুইস্কি খাই না।

সপ্তমীর রাত… তায় আবার দক্ষিণ কলকাতা। মাইলোমিটারের কাঁটা ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে এই ক’টা মেসেজ উদ্ভ্রান্তের মত ড্যানিয়েলের ব্রেনে ইলেক্ট্রোকেফালোগ্রাম গ্রাফ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। লাল শিফনে ঢাকা এক রাত মহিলা গাড়িতে তার পাশে বসে মদ্যপান করবে। আর যাই হোক, এই অ্যাডভেঞ্চার একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। আর যাই হোক, এই মহিলা, অনুশাসনের ঘেরাটপে থাকা শৃঙ্খলাপরায়ণ কোনও মানুষ যে নয়… সে একেবারে নিশ্চিত। তবুও… নাকতলার হাজার মানুষের লাল সিগন্যালে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে সে:

জীবনে গুঞ্জন নেই, গল্প নেই, গবেষণা নেই, মেধার আর্দ্রতা নেই, হার্দ্য কোনও ডাক নেই, তুমি যে তুমি… তার বর্ণ নেই, স্বর্ণ বালুকণায় খেলা নেই, উড়ন্ত আকাশ নেই, গভীর অরণ্য নেই, বনজ কুটুম্ব নেই, শঙ্খনীল শব্দ নেই, চে-গুয়েভারা নেই, কবীর সুমন নেই, বুকের গভীর জলাশয়ে তির্যক রোদ্দুর নেই… এমন জীবন নিয়ে কী হবে? ভেবেছিল; এই পূজোয়, সোনায় সোহাগের শর্বরী মেখে ধুলোয় লুটোবে; কী লুটোল?

সন্তোষপুর লেকের সামনেটায় আবার তীব্র জ্যাম। এবার একটা ফোন করা যাক। কী মনে হল, মেসেঞ্জারে কল করল ড্যানিয়েল:

—প্রায় এসে গেছি।

—অ্যাক্সিস এটিএম’টার সামনে এসে কল করো।

—কেন? বললেন যে দাঁড়িয়ে আছেন!

—ছিলাম। এখন নেই। খুব অন্ধকার আর নির্জন ওখানটায়। ফিরে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। ওখানটায় এসে কল করো, আমি ডিরেকশন দিয়ে দেব।

এবার কিছুক্ষণের জন্য হলেও ছ্যাঁৎ করে ড্যানিয়েলের রোমশ চওড়া বুক। বাড়াবাড়ি হচ্ছে না তো? সার্ভে পার্কের অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কে দাঁড়িয়ে মেসেঞ্জার চেক করল। নাহঃ… আর কোনও মেসেজ নেই মনের। ওটাই শেষ মেসেজ। জ্বলজ্বল করছে লেখাটা… ‘আজ আর হল না ডেন্… এতদিন পর ওর সাথে দেখা, প্লিজ ডোন্মাইন্ড।’ মুহূর্তের মধ্যে ফিরে গেল সে ওই রোমাঞ্চে… ‘এমন জীবন নিয়ে কী হবে?’

—বলুন… আমি দাঁড়িয়ে আছি।

—ব্যাক গিয়ারে সোজা পিছনে চলে আসো।

—ইয়ার্কি হচ্ছে? ব্যাক গিয়ারে মানে?

—তুমি ড্রাইভার হিসেবে কতটা দক্ষ, একটু দেখে নিতাম। অনেকটা পথ যেতে হবে তো? হা হা হা। না না… মানে একদম পিছন দিকটায় চলে আসো। ফোনটা ছেড়ো না।

—এবার?

—বাঁ হাতের সেকেন্ড গলি। হ্যাঁ আসো… আমি দেখতে পাচ্ছি… ও্ইত্তো কালো সিডানটা তো?

—হ্যাঁ।

—ব্যাস ব্যাস! ওখানটায় দাঁড়াও। আসছি। দশ মিনিট। একটু মেকআপ করে আসছি।

—মানে?

ফোন রেখে দিয়েছে মুদ্রারাক্ষসী।

দশ মিনিট। মনকে শেষ একটা মেসেজ করার জন্য যথেষ্ট সময়।

‘যদি বোঝো… আমার হঠাৎ মৃত্যু, অকস্মাৎ বোমা বিস্ফোরণে, টুকরো টুকরো হাত, পা, বুক, পাঁজর, চোখ-কান-নাক ও মাথার ঘিলু… তুমি তাকে কুড়িয়ে নিয়ো না। শুধু আমার হৃৎপিণ্ডটাকে কিছুটা অগ্রাধিকার দিয়ো। যে হৃৎপিণ্ড সহস্রার কলমে সহস্র এপিক লিখেছে।’

মেসেজ সেন্ট। ফোন অফ করে দিল ড্যানিয়েল।

—হাই।

স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে চমকে বাইরের আঁধারে ঘুরে তাকাল উদ্ভ্রান্ত ড্যানিয়েল।

একটি মুদ্রার মধ্যে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত গ্রীবা ও গোড়ালি। দৃষ্টি বা ভ্রূভঙ্গি থেকে ছলকে পড়া ইঙ্গিতময়তা আলো। এ কি কোনও প্রাচীন কাল? শিল্প ইতিহাস খুঁজে খুঁজে এ কোন নর্তকীর ছায়া নতজানু হয়ে নুয়ে পড়েছে ড্যানিয়েলের বন্ধ কাচে! প্রস্তরের ইশারায় তীব্র আবেদন। গোড়ালিতে নূপুর ঠোকা তাল, ঠোঁটের কোণে দুলে উঠল খিলখিলিয়ে। ঝর্নার শব্দেই হয়তো উইন্ডো গ্লাসের অটোমেটিক বাটনে আঙুল চেপে বসল ড্যানিয়েলের। চোখের ওপর থেকে স্বচ্ছ পর্দা সরে গেল। ঠিক যেমন… নক্ষত্র ছেয়ে থাকা আকাশ, হাঁ করে গিলে থাকে বিবস্ত্র জ্যোৎস্নাকে, তেমনই ড্যানিয়েলের বিস্ফোরিত অপলক মণি চেয়ে আছে স্পর্শসীমার মধ্যে থাকা ফেসবুকীয় দুর্গাতে।

—দাঁড় করিয়ে রাখবে? নাকি বসতে দেবে?

নিজেকে সামলে নেয় ড্যানিয়েল। মন শিখিয়েছে, গাড়ির দরজা খুলে মহিলাদের সম্মান দিতে হয়। আর, আঁচলের যা হরহরে অবস্থা… দরজা খুলতে গিয়ে না বিপদ ডেকে আনে বুক বেয়ে! নেমে এল ড্যানিয়েল। দরজা খুলে বিপদসীমার পাশ এড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাঁহাত অন্ধকারে বাড়িয়ে বলল…

—প্লিজ…

সার্ভে পার্কের এদিকটায় তেমন আলো থাকে না কোনওদিনই। এমনকি সপ্তমীর মধ্যরাতেও নয়। দু-একটা উদ্দাম বাইকের হেডলাইট সেকেন্ডের ভগ্নাংশে ছিটকে আসছে ফ্রন্ট গ্লাসে। টেরিয়ে দেখার অভ্যেস নেই ড্যানিয়েলের। স্টার্ট দেবার আগে সরাসরি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল ড্যানিয়েল। দেবদারু পাতা কুয়াশার ভোরে যেন নিমগ্ন নদী তীরে। চোখের গোপন পরিখা থেকে ড্যানিয়েল সাঁতরে পেরোচ্ছে উত্তরঙ্গ ইভ্। একবার আলোতে, আর একবার মিলিয়ে যাওয়া আলোর আবছাতে। একবার জলে… একবার ধরাতলে। ঝড় ভালবাসে ড্যানিয়েল। কিন্তু ভয় তো এখনও ভালবাসতে পারেনি। মনের সিন্ধুতে যত সারস ছিল… উড়ে গেল। একটা ঢোঁক গিলে কিছু বলতে যাচ্ছিল ড্যানিয়েল… হয়তো বলতো… ঠিক ওই সময়ই একটা নয়… মধ্যমা আর তর্জনী দুটো আঙুল টানটান জড়ো করে ঠোঁটে ছুঁইয়ে চোখের পাতা ফেলল পিয়ান। এক সেকেন্ড। আঁখিপল্লব খুলতেই ড্যানিয়েলের মনে হল কোনও বাঁশপাতা বুঝি দুলে উঠল হাওয়ায়।

—মিলেছে প্রোফাইলের সাথে?

—আমি তো সন্দেহ করিনি!

খিলখিলিয়ে উঠল রক্তকরবী। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে, চোখ দিয়েই স্কেচ করতেন। হাসির রেশ নিয়েই বলল:

—বাঁ দিক… বাঁদিক।

বাঁয়ে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে থামল ড্যানিয়েল:

—কোথায় যাবেন?

—সল্টলেক। বলেছি তো সারারাত ঠাকুর দেখব।

—মানে? আমি মাঝরাতে কখনও গাড়ি চালাইনি।

—আজ চালাবে।

এবার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে ড্যানিয়েলের। ঠিক ভয় হয়তো নয়… ঠিক উৎকণ্ঠাও নয়। মনকে খুব মনে পড়ছে। ভীষণ। চিৎকার করে ডাকতে চাইছে… বলতে চাইছে, ‘মন আমাকে তুমি নিয়ে যাও, আমাকে এভাবে আর উপেক্ষা কোরো না প্লিজ… প্লিজ মন।’ ড্যানিয়েল খেয়াল করেছে, কোনও অজানা ভয় গ্রাস করলেই ও মনকে চিৎকার করে ডাকে। কিন্তু এখানে ও চিৎকারটা করবে কোথায়? আর ওই মহিলাও তো ওকে কিছু করেনি। শুধু ঠোঁটে দুটো আঙুল ছুঁয়েছে মাত্র। হয়তো চুপ করাতেই… নাহঃ! তাহলে তো শুধু তর্জনি রাখত। মধ্যমা মানে তো অন্য কিছু! আবার নাও হতে পারে। তাহলে চেঁচাতে যাবেই বা কেন?

—শুনুন… আপনি খুব জোর করলেন, এর আগেও দু-একবার মেসেজ করেছেন। আর কাছাকাছিই থাকেন বললেন! চারিদিক আলো… তাই চলে এলাম। আমাকে কিন্তু অন্য কিছু ভাববেন না। আমি ওসব করি না।

একনিশ্বাসে বলে খানিক দম নিল ড্যানিয়েল।

—দাঁড়িয়ে রইলে যে!

—পিয়ান, পরে কোনও একদিন। আমার বাড়িতে কেউ থাকে না। ছোট মেয়েটা একটা গোটা তিনতলা ফ্ল্যাটে একা। গভীর রাত এখন। মেয়ে জানেও না, আমি বাড়িতে নেই। প্লিজ পিয়ান। আমি তো চলে যাচ্ছি না… কথা দিলাম পরশু নবমীর রাত… শুধু আমাদের উদ্দাম রাত। প্লিজ।

দু’মুঠো জড়ো করে কাছে পাওয়া পিয়ানের ডান হাতটা মুঠোর মধ্যে ধরল ড্যানিয়েল। একটা অদ্ভুত শিহরণ। পাথর কখনও এভাবে ধরেনি আগে ড্যানিয়েল। ধরেই ছেড়ে দিল তড়িৎ গতিতে।

—কেন কাল কী করবে?

—কাল আমার মিদনাপুরে একটা শ্যুটিং আছে। ভোর ছ’টায় বেরিয়ে যাব। সেটাও একটা কারণ।

—কবে ফিরছ?

—নবমীর দুপুরে। আপনার খিদে পেয়েছে। কিছু খাবেন?

—বিয়ার এনেছ?

—গিয়েছিলাম। এত রাতে দোকান খোলা পাইনি।

—মিথ্যেটা তুমি কিন্তু অসাধারণ বলছ। তুমি আমার প্রোফাইলটা জানো তো!

—হুম… অভিনেত্রী। তবে কোনও অভিনয়সুলভ পোস্ট পাইনি খুঁজে।

—সন্দেহ করছ?

—তুমি পিৎজা ভালবাসো?

—উউফ! আই জাস্ট লাভ পিৎজা। একটু পরে খাব। অ্যাই এটা পাটুলি তো?

—হুম।

—বাঁদিকটা টার্ন করো… ওই দিকটায় একটা পুকুর আছে। চলো না দুজনে একটু বসি।

পিয়ানের হাতটা এখন স্টিয়ারিংয়ে ড্যানিয়েলের বাঁ হাতের ওপর। এক একটা সময়, মানুষ ভিতর থেকে নীরবে চিৎকার করে। চোখ ফেটে জল আসে ওই সময়। চিৎকার করে ডাকছে এখন ড্যানিয়েল… ‘মন… প্লিজ আমার কাছে একটু আয়, তুই যেখানেই থাকিস… প্লিজ প্লিজ প্লিজ আয়।

—শুনুন…

—অ্যাই… আপনি আপনি কী! তুমি বলো। বলো তুমি!

—আচ্ছা বেশ ঠিকাছে ঠিকাছে… শোনো পিয়ান। ওই দিকটা খুব নির্জন, আর পুলিশের গাড়িও থাকে। অলরেডি রাত দেড়টা। ডোমিনোজ কিন্তু বন্ধ হয়ে যাবে দুটোয়।

—পরশু আসবে তো! এই দিকটায়, রাত দেড়টায়?

—কথা দিয়েছি না! আলবৎ আসব। এখন চলো।

ডানদিকে স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে জিজ্ঞেস করল ড্যানিয়েল: আজ সারাদিন কিছু খাওনি তুমি, তাই তো?

—কী করে বুঝলে?

একটা আত্মশ্লাঘার হাসি এল ড্যানিয়েলের ঝুলিয়ে রাখা ঠোঁটে। বেশ বুঝতে পারছে, মেঘ কেটে রামধনু আসছে। বেশ আত্মতৃপ্তি নিয়ে শ্রাগ করল ড্যানিয়েল:

—ও আমি বুঝি।

—তুমি কিচ্ছু বোঝো না। সেই কবে থেকে আমি তোমাকে পিং করছি। আর কিছু না… আমি শুধু ওই ভয়েসটায় একবার ‘হ্যালো’ শুনতে চেয়েছিলাম। তোমার খুব দেমাক। এমন হাবভাব করো… যেন বিরাট পপুলার, বিশাল স্টার! ছাইই!

অজয়নগরের ডোমিনোজে ব্রেক কষল ড্যানিয়েল। জাস্ট একটা পিৎজা ওকে অক্সিজেন দিয়ে দিতে পারে। আর খুব বেশি হলে আধাঘণ্টা। তবে এই ঘটনা ঘুণাক্ষরেও বলবে না ও মনকে। ড্যানিয়েলকে সন্দেহ করাটা মনের এখন অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে ডোমিনজের দোতলায় উঠে এল ড্যানিয়েল। পিছনে কে আসল আর না আসল ওর বয়ে গেছে।

—অর্ডার ক্লোজড স্যার। অত্যন্ত মিষ্টি হেসে বলল দেবশ্রী। বুকের নেমপ্লেটে লেখা নাম।

—হাই দেবশ্রী… আপনি গ্র্যাজুয়েট?

—কেন স্যার?

—ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ … এই যে হাড়ভাঙা ডিউটি করছ উৎসব ছেড়ে… এ সময় নিশ্চই ইন্সেনটিভ দেয় কোম্পানি? এই ইন্সেনটিভে আপনি খুশি?

—না… মানে কেন স্যার?

—আমার ভিজিটিং কার্ডটা রাখুন। আই হ্যাভ লাইকড ইয়োর প্যাশনেট সার্ভিস। পঁচিশ হাজার স্যালারি। এখন যা পাচ্ছেন তার তিনগুণ। ৯ তারিখ এই ঠিকানায় দেখা করবেন। আই নিড আ লেডি ক্যান্ডিডেট উইদ ইম্মিডিয়েট এফেক্ট। বাট্… ইয়োর ইন্টারভিউ উইল স্টার্ট নাও। আই ওয়ান্ট আ পিৎজা রাইট নাও। ইউ গেট মাই পয়েন্ট।

অ্যাজমার পেশেন্ট ড্যানিয়েল। পাগলের মত হাঁপাচ্ছে। বুকের কাছে দলা পাকিয়ে উঠছে কফ। একটু বমি করতে পারলে ভাল হত। ততক্ষণে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে… পিয়ান। ফেসবুকের পিয়ান দে। বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে ড্যানিয়েল। কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে পিয়ানের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল:

—বার্বিকিউ?

—ওকে।

—ওয়ান রেগুলার বার্বিকিউ প্লিজ। কত?

—রেগুলার নয়… মিডিয়াম।

একবার ঘুরে পিছনে তাকাল ড্যানিয়েল। পিছন থেকে বলে চলেছে…

—আমি যখন যাত্রা করতে যাই, আমাকে পার্টি মিডিয়ামই দেয়।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোল ড্যানিয়েলের।

—ওকে। মিডিয়াম বানান।

—কিন্তু স্যার!

—উড ইউ লাইক টু সার্ভ ইন ওয়ান অফ দ্য বেস্ট ফরচুন ফাইভ হান্ড্রেড কোম্পানিজ অ্যালং উইদ ফুল মেডিক্যাল বেনিফিটস?

—এনি টপিং? চিজ্ বার্স্ট স্যার?

—উইদ অ্যাভেলেবল্ এভ্রিথিং। হাউ মাচ ইট উড্ কস্ট দেবশ্রী?

—সিক্স সিক্সটি নাইন স্যার। কার্ড অর ক্যাশ।

—ক্যাশ। এই নিন। ফাইভ হান্ড্রেড প্লাস টু হান্ড্রেড। ব্যালেন্সটা আপনার। সি ইউ অন নাইন্থ। হ্যাপি পূজা!

—হ্যাপি পুজা টু ইউ স্যার। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ্। সার্টেনলি আই উইল মিট্ ইউ স্যার। অন নাইন্থ।

ডান চোখের পাতাটা অর্ধেক বুজে একটা কর্পোরেট লুক দিল ড্যানিয়েল।

—টেক কেয়ার লিল্ গার্ল।

মুখোমুখি পিয়ান দে আর লেখক চিত্রনির্মাতা কর্পোরেট মাঝবয়সি ধনীলাল দত্ত।

—এতক্ষণ কী বকবক করছিলে ওই কচিটার সাথে? কচি দেখলেই তোমাদের পুরুষদের চোখ চকচক করে, না?

একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে ড্যানিয়েল। অপলক। আবছা আলোয় গাড়ির ভিতর পিয়ান এক রকম। ঝকঝকে টিউবের আলোয় সূর্যসত্যি। লাল শিফন। বোধ হয়, যাদবপুর বা বাঘাযতীনের সিন্থেটিক। চুমকিগুলো উঠে এসেছে। কিছু চুমকি উঠে গেছে রিকশার রডের ঘষায়। লাল সুতির ব্লাউজ। কোঁচকানো। আকাচা বহুদিনের। যাত্রাদলের ফেসিয়াল, কাজল এসব ড্যানিয়েলের চেনা। সঞ্জয়দা যখন মেকআপ কিট নিয়ে বসত… ড্যানিয়েলকে জেনে নিতে হয়েছিল এসব, কোন আলোর সঙ্গে কীরকম মেকআপ হবে গ্রুপ থিয়েটারে। অন্য সময় হলে গা গুলিয়ে বমি আসত ড্যানিয়েলের। এখন তেমনটা লাগছে না। হয়তো খানিক ধাতস্থ হয়ে গেছে।

—একটা সেলফি তুলবে?

হাসল ধনীলাল দত্ত। পাসপোর্টে নামের বানান তেমনই।

—নবমীর দিন… আমরা অনেক ছবি তুলব অনেয়েক… অনেয়েয়েয়েক।

—সত্যি?

চোখ বুজে নড্ করল ড্যানিয়েল। পিয়ান ঠোঁটমুখ বেঁকিয়ে সেলফি নেবার চেষ্টা করছে। অদ্ভুত সারল্য চোখেমুখে।

ধীরে ধীরে নিজের মোবাইলটা তুলে নিল মনের একান্ত প্রেম। ফেসবুক খুলে সেটিংসে এল। ব্লক… পিয়ান দে। আ ফেক নেম। একটা সরল শিশুর মত দেখাচ্ছে এখন ওকে। মেসেঞ্জারে কলও অসম্ভব। ভাগ্যিস ফোন নম্বর থেকে ফোন করেনি ড্যানিয়েল।

অর্ডার নেমে এসেছে টেবিলে। ওর হয়তো জীবনের প্রথম পিৎজা। খুব খিদে পেয়েছিল হয়তো। হয়তো ওর মাসি ওকে আজ খেতেই দেয়নি কিছু। হয়তো… আজই ও পালিয়ে এসেছে।

—একটা কথা জিজ্ঞেস করব পিয়ান?

ত্রিকোণ পিৎজার অর্ধেকাংশ ওর মুখের ভিতর। ওই অবস্থাতেই দাঁত চেপে বলল:

—বলো।

—আমাকেই কেন আসতে বললে! তোমার তো এত বন্ধু!

—মনে হল তোমার মনখারাপ! তাই।

—ওহ! তা বুঝলে কীভাবে? মনখারাপ? আমার?

—তোমার কবিতা পড়ে।

—আচ্ছা পিয়ান… এই যে পরচুলা… রেগুলার সেভিং… বুকের ভিতর এই গরমে স্পঞ্জ গুঁজে রাখো… তোমার এই মুখোশ ভাল লাগে?

—বলছি দাঁড়াও। আগে খেতে দাও। সময় কি চলে যাচ্ছে নাকি?

হাসল ড্যানিয়েল।

—এক মিনিট পিয়ান। আমি গাড়ি থেকে জলটা একটু নিয়ে আসি।

—হুমমম। জলদি।

দরজাটা খুলে একবার পিছনে ফিরল ড্যানিয়েল। মুখোশহীন পাথুরে হাতটা একবার মিলিয়ে আসতে ইচ্ছে হল ড্যানিয়েলের। পিৎজাটা এখনও অর্ধেক বাকি।

গাড়ি স্টার্ট করল। একশো চল্লিশ এখনও অবধি ওর হাইয়েস্ট স্পিডোমিটার। তার থেকেও জোরে চালাবে এখন এ রাতে। উড়ে যেতে হবে বহুদূরে। যেখানে কোনও লুকোনো জেন্ডার নেই।

নিষ্ঠুর প্রেমের কাব্য— তাতে ছন্দ আরো ভয়ানক
মানব হিংস্রতা বশে বর্ণমালা ক্রুর, বক্র হবে
তোমাকে লিখবে শুধু দগ্ধ তাপ— আগুন আগুন।
তোমার পথের গান প্রত্যাখ্যাত হবে বারবার।

অন্ধকারে, খোলা মাঠে, ড্যানিয়েল এখন বন্দুকের দোনলা
পিৎজার ঘ্রাণে আত্মহুতি দেয়া কোথা সে দুর্গা বৃহন্নলা
…কোথা সে দুর্গা বৃহন্নলা?

জানালার কাচ খোলা। মিলিয়ে যাচ্ছে চিৎপুরের সস্তা আতর… আর সস্তা আদর।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »