আমাদের ভয়ে ফুল যদি ভেসে যায়
যদি অনুতাপী পাপী প্রীতি নাহি পায়,
বৃথা গান ধর্মগীতি
বৃথা ভাণ ‘বিশ্বপ্রীতি’
আমাদের এ জীবন বৃথা এ ধরায়!
আয় তোরা বাঁচি-মরি
ঝাঁপ দিয়া জলে পড়ি,
বাঁধিয়া আনিব ফুলে স্নেহ-মমতায়।
[স্রোতের ফুল/ মানকুমারী বসু]
উনিশ শতকের অন্যতম মহিলা কবি মানকুমারী বসু (২৩ জানুয়ারি ১৮৬৩-২৬ ডিসেম্বর ১৯৪৩)। তৎকালীন যশোহর জেলার শ্রীধরপুরে মামাবাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ‘মানসিক’ করায় তাঁর জন্ম, এজন্যই নাম রাখা হয় মানকুমারী। মাতা শান্তমণি দেবী এবং পিতা আনন্দমোহন দত্ত। বাবা-মায়ের কনিষ্ঠ সন্তান তিনি। তাঁর কাকা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্যে বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন মানকুমারী।
পিতা আনন্দমোহনকে আদর্শ মানুষ মনে করতেন মানকুমারী। তাঁর আত্মকথা ‘আমার অতীত জীবন’-এ বাবার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ নানাভাবে প্রকাশ করেছেন কবি। জ্ঞান হওয়ার পরই তিনি বুঝেছিলেন, ‘আমার বাবা– আমার ঋষিপ্রতিম বাবা– ধর্মাচরণ ও জ্ঞানানুশীলন লইয়াই দিনযাপন করেন। …আমি অতি বাল্যকাল হইতে আমার মাতা-পিতাকে সাংখ্যের পুরুষ-প্রকৃতি অথবা পুরাণের প্রণব-শক্তির মতই দেখিতে পাইয়াছিলাম।’’
প্রথম সাহিত্যরচনার প্রসঙ্গে আত্মকথায় কবি লিখছেন, ‘আমার মনে হয়, একদিন আমার এক ভগিনীকে দিয়া একখানি ছোট খাতা বাঁধাইয়া লইয়াছিলাম। অতি নির্জনে বসিয়া সেই খাতা এবং দোয়াত-কলম লইয়া তাহার নামকরণ করিলাম ‘‘লাইবাইটের উপাখ্যান’’। কিন্তু সেই লাইবাইট পুস্তকে কি লিখিয়াছিলাম, তাহা আমার ভাল মনে নাই। …যাহা হউক, সেই লাইবাইটই আমার প্রথম রচনা।’
বাড়িতেই বাবা, দিদির কাছে মানকুমারী লেখাপড়া শেখেন। বাড়িতে ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা আসত। তা পড়ে কিশোরী মানকুমারীর মনেও লেখার বাসনা জাগে। গোপনে তিনি খাতায় পদ্য লেখা শুরু করেন। একদির বাবার চোখে পড়ে। ভেবেছিলেন, বাবা বকবেন। তার বদলে ‘বাবা বড় আনন্দিত হইয়া আমাকে বুকে টানিয়া লইয়া খুব আদর করিলেন।’ বাবার উৎসাহেই মানকুমারী কবিতা লেখায় মনোযোগ দেন।
এদিকে সেই সময়ের সামাজিক রীতি মেনে মাত্র দশ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে দেওয়া হয়। স্বামীর নাম বিবুধশঙ্কর বসু। মানকুমারীর প্রতি তাঁর স্বামী সদয় ও আন্তরিক ছিলেন। বৃহৎ শ্বশুরবাড়িতে তাই সমস্যা ও কষ্ট পেলেও স্বামীসঙ্গ তাঁর সব দুঃখ ভুলিয়ে দিত। কিন্তু এই সুখ তাঁর ভাগ্যে সয়নি। ১৮৮২ সালে হঠাৎই ‘দয়ালু দেবপ্রতিম পতিরত্ন’ তাঁকে এবং তাঁদের একমাত্র কন্যাকে রেখে চিরতরে চলে যান।
সেইকালে বিধবাদের জীবন ছিল দুঃসহ। মানকুমারী বৈধব্যব্রত পালনে নিষ্ঠার পরিচয় দেন। অন্যদিকে এই প্রিয়বিয়োগের শোকে তাঁর কবিহৃদয় মথিত হয়। অজস্র কবিতা লেখেন। ‘প্রিয়-প্রসঙ্গ’ (১৮৮৪) এমনই এক গ্রন্থ। তবে তাঁর ‘কাব্যকুসুমাঞ্জলী’ (১৮৯৩) পাঠে উনিশ শতকের বিশিষ্ট সাহিত্যিকরা সন্তোষ বোধ করেন। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘কবিতাগুলি সরল, সুমধুর ও সুপাঠ্য।’ নবীনচন্দ্র সেন জানান, ‘আপনার সুললিত কবিতার অক্ষরে-অক্ষরে আপনার সরল রমণী-হৃদয়ের কবিতামৃত প্রবাহিত, অক্ষরে অক্ষরে কল্পনার উচ্ছ্বাস, অক্ষরে অক্ষরে ভাবুকতার তরঙ্গ।’
তাঁর আরও একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘কনকাঞ্জলী’ (১৮৯৬)। সেই ‘কনকাঞ্জলী’ পাঠে মুগ্ধ কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় একটি পত্রে লেখেন, ‘পুস্তকখানি পড়িয়া আমি চমৎকৃত হইয়াছি। যেখানেই খুলি, সেইখানেই মন আকৃষ্ট হয়।… কবিতাপ্রিয় ব্যক্তিমাত্রেই, যিনি ইহা পাঠ করিবেন, তিনিই গ্রন্থকর্ত্রীর ক্ষমতা এবং প্রভাব অনুভব করিতে পারিবেন, এবং তাঁহার প্রতিভার ছটায় মোহিত এবং পুলকিত না হইয়া পারিবেন না।’
কবিতা প্রসঙ্গে মানকুমারীর নিজের বক্তব্যও প্রণিধানযোগ্য। লিখেছেন, ‘এ জগতে ফুলের ফুটিয়াই সুখ, পাখির গান গাহিয়াই সুখ, কিন্তু ইহা ছাড়া আরও একটি কথা আছে, ফুলের শোভা ও সৌরভ যখন অপর-চিত্ত বিনোদন করে, তখনই ফুলের শোভা ও ফুলজীবন সার্থক হয়। বিহঙ্গগীতি যখন অপরের শ্রুতি মুগ্ধ করে, তখনই কলকণ্ঠের গান করা সার্থক হয়, মানবের কবিতাও যখন পরের হৃদয়ে আদরপ্রাপ্ত হয়, তখনই সে কবিতার জীবন সার্থক হয়।’
মানকুমারীর কবিতায় বিষাদ ও নিঃসঙ্গতাবোধ চোখে পড়ে। কখনও বলেন, ‘মানবজীবন ছাই বড় বিপদের’; কখনও বলেন, ‘একা আমি চিরদিন একা’। এ সংসারে তাঁর অরণ্যরোদন– ‘কি যেন হয়েছে আহা/ যা চাই না পাই তাহা’। গীতিকবিতার পাশে তাঁর ‘বীরকুমারবধ’ (১৯০৪) এপিকধর্মী কাব্যটিও উল্লেখযোগ্য। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারত সরকার তাঁকে আর্থিক বৃত্তি দেয়। ১৯৩৭-এ চন্দননগরে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের কবিতা অধিবেশনে তিনিই সভানেত্রী হন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ভুবনমোহিনী ও জগত্তারিণী স্বর্ণপদক দিয়ে সম্মানিতও করে। আশি বছর বয়সে খুলনায় মেয়ের বাড়িতে কবির জীবনাবসান ঘটে।
অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে কবিতা ছাড়াও মানকুমারী লিখেছেন উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং গল্পও। তাঁর গ্রন্থতালিকাও দীর্ঘ নয়। কোন-বঙ্গমহিলা-প্রণীত ‘প্রিয় প্রসঙ্গ বা হারানো প্রণয়’ (গদ্য-পদ্য), ‘বনবাসিনী’ (উপন্যাস), ‘বাঙালী রমণীদিগের গৃহধর্ম’ (সন্দর্ভ), ‘স্বর্গীয় মহাত্মা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিয়োগে শোকোচ্ছ্বাস’, ‘কাব্যকুসুমাঞ্জলী’, ‘কনকাঞ্জলী’ (কাব্য), ‘বীরকুমারবধ (কাব্য), ‘শুভ-সাধনা’ (গদ্য-পদ্য), ‘বিভূতি’ (কাব্য), ‘সোনার সাথী’ (কাব্য), ‘পুরাতন ছবি’ (আখ্যায়িকা) ইত্যাদি। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে একটি ছোটগল্পের জন্য জিতে নিয়েছিলেন প্রথম বছরের ‘কুন্তলীন পুরস্কার’-ও।