বাংলা ভাষার চর্চা বহুকাল। কিন্তু প্রাকৃত থেকে বর্তমান রূপ পেতে মোটামুটি হাজার বছর লেগে যায়। এই বাংলা ভাষার একটা শব্দকোষের প্রয়োজন প্রথম থেকেই ছিল। এই শব্দকোষের সংকলন অনুসারে কালাতিক্রমণ করলে আমরা মূলত ভাষার তিনটি কাল পাই। যথা—
প্রাচীন বাংলা (কাল ৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ অব্দি),
বাংলা ভাষার মধ্যযুগ (১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ অব্দি),
বাংলা ভাষার আধুনিক যুগ (১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পরবর্তী কাল)।
এই বিষয়ে শ্রদ্ধেয় সুকুমার সেন কী বলেছেন, দেখি। সুকুমার সেন তাঁর ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে (নবম সংস্করণ, ১৯৪৫, পৃষ্ঠা ১৩৯ থেকে ১৪৫) এ বিষয়ে উল্লেখ করে বলেন, ১১৫৯ সালে সৰ্বানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় নামের ব্যক্তি ‘অমরকোষ’ নামের এক টীকাসর্বস্ব গ্রন্থ রচনা করেন। সেটাই প্রাচীন যুগের বাংলা অভিধান বলা যায়।
এ বিষয়ে শ্রদ্ধেয় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও এই মত পোষণ করেছেন। তিনি তাঁর ‘দ্বাদশ শতকের বাংলা গ্রন্থ’-র ২২৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, ‘১১৫৯ সালে বন্দ্য ঘটীয় সৰ্বানন্দ লিখিত’ অমরকোষ গ্রন্থের টীকা সংখ্যা কিঞ্চিদধিক তিনশো।
মোট কথা সৰ্বানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইখানিতে যে প্রাচীন বাংলা শব্দগুলো পাই তার কয়েকটা নমুনা এবং তার আধুনিক রূপ কী, তা দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।
১. অন্ডু (প্রাচীন)= আটু, হাঁটু
২. কাঙক (প্রাচীন)= কাঁকই, চিরুণী
৩. বাতিঙ্গন (প্রাচীন)= বেগুন
৪. হেঁকটী (প্রাচীন)= হেঁচকি
৫. জেঠী (প্রাচীন)= টিকটিকি।
ইচ্ছাকৃতভাবে এই শব্দগুলো দিলাম। কারণ এখানে একটা লক্ষ্যণীয় বিষয় আছে। পাঠক, আপনারা লক্ষ্য করবেন, প্রাচীন ‘কাঙক’ থেকে হিন্দি ‘কাঙ’ এসেছে অপভ্রংশ হয়ে; যার মানে একই, অর্থাৎ চিরুনি। আবার প্রাচীন হেঁকটী এবং জেঠী অসমীয়া ভাষাতে ঢুকে পড়েছে যার অর্থ একই। এরকম অনেক প্রাচীন বাংলা শব্দ আছে। এবার তার আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাব।
বাংলা ভাষার প্রাচীন যুগ
বাংলা ভাষায় আধুনিক যুগে যেসব শব্দের শেষে ‘ও’ ব্যবহার হয়, প্রাচীন বাংলায় ওই স্থানে ‘অ’ ব্যবহার করা হত। যথা— আধুনিক ‘জানিও’ তখন লেখা হত ‘জানিঅ’। তাছাড়া বেশ কিছু বর্তমানে অপ্রচলিত শব্দ তখন ব্যবহার হত আমরা দেখতে পাই। এই সব শব্দ আবার স্থান বিশেষে আজও প্রচলিত। যথা—
গুবাক (প্রাচীন)= গুয়া, সুপারি। এই গুয়া শব্দটি আসাম অঞ্চলে এখনও প্রচলিত। যথা, গুয়া পান। আবার ওই প্রাচীন বাংলায় ‘ও’-র স্থানে ‘অ’ ব্যবহার অসমীয়া ভাষায় গ্রহণ করা হয়েছে। যথা, স্টুদিঅ।
প্রাচীন বাংলার আরও কিছু শব্দ নিয়ে আলোচনা করে প্রাচীন বাংলার কথা আমরা শেষ করব। চতুর্দশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট কবি ছিলেন বিদ্যাপতি। তাঁর লেখা একটা কবিতার উল্লেখ করব—
মাধব বহুত মিনতি করু তোয়।
লএ তুলসী তিল দেহ সোঁপল দয়া যনু ন ছোড়বি মোয়।।
এখানে দেখুন, ‘বহুত’ শব্দ বাংলায় প্রচলিত ছিল তখন যা এখন হিন্দি ভাষায় গ্রহণ করা হয়েছে। ‘তোয়’ ‘মোয়’ ইত্যাদি অসমীয়া ভাষাতে বর্তমানে প্রচলিত। আবার বলছেন কবি—
গণইতে দোষ গুণলেশ ন পাওবি যব তুহুঁ করবি বিচার।
তুহুঁ জগন্নাথ জগতে কহাওসি জগ-বাহির নহ মোঞে ছার।।
এর পরের লাইনে আছে—
ভণই বিদ্যাপতি অতিশয় কাতর তরইতে ইহ ভবসিন্ধু।
তুয় পদ পল্লব করি অবলম্বন তিল এক দেহ দীনবন্ধু।।
‘ভণই বিদ্যাপতি’, মানে বিদ্যাপতি বলছি। এই বলাটাকে উনি তৎকালীন বাংলায় ‘ভণই’ বলেছেন, যা বর্তমানে নেপালী ভাষায় প্রচলিত।
যথা, ভণে ছ, ভণনুস ইত্যাদি।
এর পরে পঞ্চদশ শতকে ভাষার ব্যবহার কিছুটা বর্তমানের রূপ নিচ্ছিল। চণ্ডীদাস কবি বালগোপালের রূপ বর্ণনা করেছেন এভাবে—
বেশ বানাইছে মায়
চাঁচর চিকুর বনাই সুন্দর
চূড়াটি বাঁধিল তায়
লক্ষ্য করুন, একশত বছরের ব্যবধানে ভাষা কেমন বদলে যাচ্ছে। এরপর আমরা প্রবেশ করব মধ্যযুগীয় বাংলায়।
বাংলা ভাষার মধ্যযুগ
প্রাচীন দুর্বোধ্য বাংলা ভাষার পরিবর্তন ঘটে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবকালে। এই সময় কনৌজীয়া, মাগধী, অর্ধ-মাগধী ইত্যাদি ব্রজবুলি নামে এক ভাষার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে লীন হয়ে যায়। ব্রজবুলির কোনও নিজস্ব লিপি ছিল না। প্রাচীন বাংলা লিপি ব্যবহার শুরু হয় ব্রজবুলিতে, অবশ্যই একটু মার্জিতভাবে।
চৈতন্যদেবের সময়ে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন জোয়ার আসে এবং বাংলা ভাষার রাজপথ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। যে ভাষা এককালে শুধু একশ্রেণির উচ্চবর্ণ মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তা সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
দুর্বোধ্য বাংলার এবং পরবর্তীতে সহজ বাংলার একটা উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। যথা—
পর তাপ্পান ম ভক্তি করু (প্রাচীন)= আপন ও পরে ভ্রান্তি করিয়ো না (বর্তমান)।
এই তুলনা পাই আমরা শ্রীজ্ঞানেন্দ্রনাথ দাসের ‘বাংলা অভিধান’ প্রথম খণ্ডতে। উনি (পৃষ্ঠা ৩২-৩৩) বলেছেন যে, ‘প্রাচীন দুরূহ বাংলা থেকে বর্তমান সুখপাঠ্য বাংলা জানিবার প্রকৃষ্ট উপায় হলো বৈষ্ণব সাহিত্য পাঠ।’ আমরা আগেই দেখেছি যে, বৈষ্ণব সাহিত্য পদাবলি ছন্দে লিখিত এবং বাংলা ভাষা প্রাকৃতিক মাধ্যমে কীভাবে ধীরে ধীরে মধ্যযুগে নিজস্ব রূপ নিয়েছে।
এসব হচ্ছে পঞ্চদশ শতাব্দীর কথা। পাঠকসকলকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, প্রথম পর্বে আমরা জেনেছি বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ খ্রিস্টীয় ১৭৫০ সাল পর্যন্ত ব্যাপৃত। এই সময় একটা অন্য রকম ঘটনা ঘটে এবং বাংলা ভাষার বহু প্রাচীন শব্দ, এবং পরবর্তীতে কনৌজীয়া এবং মাগধী শব্দ লোপ পেয়ে যায়, সুদীর্ঘ মুসলমান শাসনকালের বহু আরবি এবং ফারসি শব্দ বাংলাতে বহুল পরিমাণে ব্যবহারের ফলে। এর জন্য দায়ী কে বা কারা, তা জানব এবার।
মধ্যযুগে বাংলার চর্চা মূলত বৈষ্ণব ধর্ম এবং গীতিকাব্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আমরা প্রথমেই বলেছি যে, বাংলা ভাষার মধ্যযুগ ১৭৫০ সাল পর্যন্ত। তাই চৈতন্যদেবের সমসাময়িক কালে বাংলা ভাষা চর্চা না থাকায় কোনও ব্যাকরণ বা শব্দকোষ রক্ষা করা হয়নি। ইতিমধ্যে মুসলমান নবাবি শাসনকালে নানা আরবি এবং ফারসি ভাষার বহু শব্দ বাংলা ভাষায় প্রক্ষিপ্ত হয়েছিল কিন্তু তার কোনও নথি রক্ষা করার দায় সে সময়ের পণ্ডিতসমাজের ছিল না।
তারপর বাংলায় পা রাখল পর্তুগিজরা। তারা এসেছিল মূলত দুটো উদ্দেশ্য নিয়ে। যথা, ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার এবং খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার ও প্রসার। এই অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ করার প্রধান অন্তরায় ছিল ভাষা। তাই তারা বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ লিপিবদ্ধ করার প্রয়াস গ্রহণ করল।
জনৈক মনোএল দা আসসুম্পসাঁউ নামের এক পর্তুগিজ প্রথম বাংলা ভাষার শব্দকোষ এবং ব্যাকরণ লিখতে প্রবৃত্ত হন। তাঁর সংকলিত পুস্তকে প্রধানত পর্তুগিজ থেকে বাংলা এবং বাংলা থেকে পর্তুগিজ শব্দসংগ্রহই ছিল। এই পুস্তকে তিনি পর্তুগিজ পাদ্রীদের নির্দেশ মেনে যেসব শব্দাবলি ধর্ম প্রচার এবং ব্যবসার সঙ্গে খাপ খায়, তাই লিখলেন। আবার বাংলা শব্দ লিখতে সুবিধার জন্য রোমান লিপি ব্যবহার করেন। এই বই ১৭৩৪ সালে লিখিত এবং প্রকাশ হয় ১৭৫০ সালে। এই সংকলিত পুস্তক আবার ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং প্রিয়রঞ্জন সেন ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুনঃপ্রকাশ করেন। ওই বইয়ের কিছু শব্দ পাঠকদের জ্ঞাতাৰ্থে নীচে দেওয়া হল। যথা—
বাতাস (বাংলা) Batax (Roman) Vento (Portuguese),
লোহা (বাংলা) Loha (Roman) Ferro (Portuguese),
বিড়াল, বিলাই (বাংলা) Biral, Bilai (Roman) Galo (Portuguese) ইত্যাদি।
এভাবে ভাষা বিবর্তনের ফলে বাংলা ভাষায় বহু পর্তুগিজ শব্দ ঢুকে পড়ে। যথা—
আলমারি (পর্তুগিজ armario), ইস্ত্রি (estrirar), ইস্পাত (espada), কামিজ (camisa), গামলা (gamela), চাবি (chave), জানালা (janela), পেরেক (pergo), বালতি (balde), পাদ্রী (Padre), পাউরুটি (Pau) ইত্যাদি।
১৭৫০ সালের পর থেকে বাংলা ভাষার আধুনিক যুগের শুরু এবং যার ব্যাপ্তি বিশাল। তুর্কি, ফরাসি, ওলন্দাজ ইত্যাদি বহু ভাষার শব্দ বাংলার মহাসাগরে এসে মিশে গিয়েছে। মধ্যযুগের পর থেকে এই বিস্তার কীভাবে আধুনিক এবং অধুনান্তিক পর্যায়ে পৌঁছল, এবার তার আলোচনা করব।
বাংলা ভাষার আধুনিক যুগ
বাংলা ভাষার আধুনিক যুগের সূচনা ১৭৫০ সালের পর থেকে। এই যুগের সূচনাপর্বে বলতে হবে ভারতচন্দ্রের নাম। যদিও তিনি ১৭১২ সালে জন্মেছিলেন, কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন ১৭৫২ সালে অর্থাৎ তখন বাংলা ভাষার আধুনিক যুগ শুরু হয়ে গিয়েছে। ‘অন্নদামঙ্গল’ সুললিত আধুনিক বাংলায় রচিত অষ্টাদশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এই কাব্য ইংরেজিতে যাকে বলে aligory অর্থাৎ দু’রকম অর্থে রচনা করা হয়। এখানে দুই-এক পদের উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারলাম না। যথা—
ছদ্মবেশে যখন মা দুর্গা নদী পার হচ্ছেন তখন ওই ঘাটের পাটনি (যার নাম ঈশ্বরী) একলা মেয়েমানুষ দেখে পরিচয় জিজ্ঞেস করলে দুর্গা বলেন—
ঈশ্বরীরে পরিচয় কহেন ঈশ্বরী।
বুঝহ ঈশ্বরী আমি পরিচয় করি।।
(প্রথম ঈশ্বরী পাটনির নাম এবং দ্বিতীয় স্থানে ঈশ্বরী অর্থে ভগবতী দেবীকে বোঝানো হয়েছে)
গোত্রের প্রধান পিতা মুখবংশে জাত।
পরম কুলীন স্বামী বন্দ্যবংশ খ্যাত।।
(সাধারণ অর্থে মুখোপাধ্যায় বংশের প্রধান ওর পিতা এবং স্বামী বন্দ্যোপাধ্যায় বংশের কুলীন। গূঢ় অর্থে গোত্রের প্রধান পিতা মানে দেবতাদের প্রধান শিবকে বোঝানো হয়েছে)
অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ।
কোন গুণ নাই তার কপালে আগুন।।
(এখানে আরও বিশদে বলা হয়েছে ওর পতি বুড়ো এবং সিদ্ধিভাঙ্ ইত্যাদিতে ব্যস্ত। কোনও গুণ ওর স্বামীর নেই এবং ওর কপালে আগুন।
গূঢ় অর্থে অতি পুরাতন ওর পতি সিদ্ধিপ্রাপ্ত। ‘কোন গুণ নাই’ মানে, স্বত্ত্ব, রজ এবং তম এই তিন গুণের ঊর্ধ্বে এবং কপালে আগুন বলতে শিবের তৃতীয় নয়ন বোঝানো হয়েছে)
কী সুন্দর প্রতি ছত্রে দুই অর্থ করে নিপুণ ভাষায় বর্ণনা করে গিয়েছেন ভারতচন্দ্র। উনি কৃষ্ণনগরের রাজার কাছ থেকে রায়গুণাকর উপাধি পান। বাংলা ভাষায় এইরূপ ব্যবহার প্রথম।
ততদিনে বাংলা ভাষা অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে ১৭৬১ সনে উইলিয়াম কেরি নামে এক ব্যক্তি জন্মান ইংল্যান্ডে এবং ব্রিটিশ ধর্মযাজক হিসাবে ভারতে আসেন। শ্রীরামপুর অঞ্চলে উনি প্রথম ‘সমাচার দর্পণ’ নামে এক বাংলা পত্রিকা শুরু করেন। এটিই বাংলা ভাষার প্রথম পত্রিকা। উইলিয়াম কেরি প্রথম বাংলায় গদ্যসাহিত্য প্রবর্তন করেন। এর আগে অব্দি বাংলা ভাষায় যে গদ্য রচনা সম্ভব, তা কেউ ভাবতে পারত না। সমসাময়িককালে প্যারীচাঁদ মিত্র নামে এক ব্যক্তি ছদ্মনামে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ নামে এক গদ্য রচনা করেন, যাকে বাংলা ভাষার প্রথম গদ্যসাহিত্য হিসাবে ধরা হয়।
তারপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ বাংলা গদ্যে অনুবাদ করেন। ততদিনে ফরাসি, ইংরেজি সহ আরও অনেক ভাষার শব্দ বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়ে ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। দু-একটা উদাহরণ দিলাম। যথা—
তুর্কি= দেদে (বাংলা দাদা), নিনে (বাংলা নানী), বাবুর্চি, বেগম ইত্যাদি,
ডাচ= ইস্কাপন, রুইতন, হরতন, চিরতন, তুরুপ, ইস্ত্রি ইত্যাদি,
ফরাসি= রেস্তোরাঁ, শেমিজ, ওলন্দাজ, কার্তুজ, আঁশ, পাতি ইত্যাদি,
জাপানি= চা, সুনামি, রিকশা ইত্যাদি।
আর আমার শিলংবাসীদের জন্য বিশেষভাবে—
খাসি/বাংলা= shabi (চাবি), Tarik (তারিখ), pisa (পয়সা), Tynka (টাকা), jaka (জায়গা) ইত্যাদি। এছাড়া বহু imperative বা যুগ্ম শব্দও দুই ভাষাতে আছে।
যাহোক, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে বাংলা ভাষা শতবর্ষ পেরোল। ওই পর্বে বহু কালজয়ী রচনা হয়েছে মাইকেল, রবি ঠাকুর, শরৎচন্দ্রের হাত ধরে। ভাষা ক্রমাগত সহজ হয়ে এসেছে বিবর্তনের মাধ্যমে। যেভাষা এককালে দুর্বোধ্য এবং একশ্রেণির উচ্চবর্ণের কুক্ষিগত ছিল, সাধারণ লোকের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল, সেই ভাষায় যে গদ্য রচনা সম্ভব তা কেউ ভাবতে পারত না।
বাংলা ভাষা আধুনিক যুগে সাবালক হল নিঃসন্দেহে, কিন্তু যে ভাষা বা শব্দ আমরা সাহিত্যে ব্যবহার করার কথা এখানে ভাবতে পারিনি, তা এসে লিখিত ভাষায় স্থান নিয়েছে উত্তর আধুনিক (post modern) কালে। এই বদলের শুরু রবি ঠাকুরের পরবর্তী কালে এবং বহু আইন আদালত, শ্লীল-অশ্লীলের সীমারেখা পার করেছে মোটামুটি ১৯৫০-এর ভিত্তি ধরে। এই উত্তর আধুনিক যুগের বাংলা নিয়ে এবার আমরা আলোচনা করব।
বাংলা ভাষার উত্তর আধুনিক যুগ
বাংলা ভাষার উত্তর আধুনিক যুগের সূত্রপাত এক যুগসন্ধিক্ষণে। ভাষার ধাঁচ এবং প্রকাশের নমুনা গত শতকের তিরিশের দশকেই মোটামুটি শুরু হয়ে গিয়েছিল। কবিগুরু রবি ঠাকুর তাঁর শেষের দিকের লেখায় অনেক আধুনিক হয়ে ওঠেন। ‘শেষের কবিতা’ একটা উদাহরণমাত্র।
ততদিনে বাংলা রচনায় ইংরেজির আদল এসে গিয়েছে। অর্থাৎ ক্রিয়াপদের ব্যবহার বাক্যের শেষে না হয়ে প্রথমে ব্যবহার শুরু হল। ‘রাম ভাত খায়’ না লিখে ‘রাম খায় ভাত’ রীতিতে কাব্য রচনা শুরু হয়ে গেল। ভাবুন তো, সেই একই রবি ঠাকুর লিখছেন, ‘রূপনারানের কূলে/ জেগে উঠিলাম,/ জানিলাম এ জগৎ/ স্বপ্ন নয়।/ রক্তের অক্ষরে দেখিলাম/ আপনার রূপ, চিনিলাম আপনারে’।
ততদিন বাংলা ভাষায় পরীক্ষানিরীক্ষা করার জন্য অনেকে এসে গিয়েছেন। যথা— সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে। সুধীনবাবুর শাশ্বতী কবিগুরুর মালবিকাকে অতিক্রম করে গিয়েছে। কবিতায় ব্যবহার হচ্ছে ‘সমীরণ পাকসাটে’ অথবা ‘একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে/ ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;/ একটি নিমেষে দাঁড়ালো সরণী জুড়ে,/ থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি;’ ইত্যাদি।
বাংলা ভাষার ব্যবহারের পরীক্ষা পুরোদমে যখন চলছে, তখন পরিচিত শক্তি, সুনীলবাবুরা বেশিদূর এগিয়ে পরীক্ষা করতে ভয় পেলেন। এই সময় এগিয়ে এলেন এক তরুণ কবি। ততদিনে ষাটের দশক আগত প্রায়। এঁদের মোটামুটি নেতৃত্ব দিলেন মলয় রায়চৌধুরী। তাঁর লেখায় প্রথম মানুষের তলপেটের নীচের ভাগ প্রবলভাবে স্থান করে নিল। যেসব শব্দ ভাষায় প্রয়োগ করতে মানুষ লজ্জা করত তিনি সেই শব্দগুলো নিপুণভাবে লিখিত সাহিত্যে নিয়ে এলেন মলয়বাবু এবং তাঁর সঙ্গীরা, যথা— সুবো আচার্য, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ এবং আরও অনেকে। যদিও এর আগে বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘রাতভর বৃষ্টি’ নিয়ে ভীষণভাবে এসে গিয়েছেন।
মলয়বাবুকে সাহিত্যে অশ্লীলতার দায়ে কাঠগড়ায় ওঠাল সমকাল কিন্তু তাঁকে মুক্ত করে দিতে বাধ্য হল প্রশাসন। তিনি ততদিনে পৃথিবীবিখ্যাত হয়ে গিয়েছেন। বাংলা ভাষার উত্তর আধুনিক প্রয়োগে তিনি নিঃসন্দেহে আভাঁ-গার্দ।
ততদিনে সমরেশ বসু সাহিত্যে ভাষা প্রয়োগে নিজস্ব ভাব নিয়ে এসেছেন। তাঁর ‘প্রজাপতি’ সাহিত্যে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হল। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত তাঁকে নির্দোষ প্রমাণ করে তাঁর সপক্ষে রায় দিয়ে প্রজাপতিকে অশ্লীলতার দায় থেকে মুক্ত করে দেন ১৯৮৫ সালে, লেখকের মৃত্যুর এক বছর আগে। সেই ঐতিহাসিক রায় থেকেই বাংলা ভাষা প্রয়োগের ব্যাপারে শ্লীল-অশ্লীলের সীমারেখা নির্দিষ্ট হয়ে যায়।
বাংলা ভাষা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাবালক হয়ে যাওয়ার অনেক দিন হয়ে গেল। মানুষ জানতে পারল ভাষা প্রয়োগের জন্য কোনও শব্দই ব্রাত্য নয় ততক্ষণ, যতক্ষণ তা মূল বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রয়োগ করা হয়। আর বেশি এগিয়ে লিখলাম না। কারণ সাহিত্য সাবালক হয়ে উঠলেও আমাদের বাঙালি পাঠককুল এখনও বহুলাংশে নাবালক আছেন। তাই মলয়বাবুর পৃথিবীবিখ্যাত কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ যা পৃথিবীর অনেক ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে তার কয়েক পঙ্ক্তি এখানে উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলাম।