ছাপিয়ে নিস্বনে তবু
স্টিরিওতে বেজে যায় ডোনা সামারের গলা আর্ত শীৎকারে
বারান্দার অন্য প্রান্তে বনি এম, জ্বরদগ্ধা কুমারী বিলাপে
আশ্লেষ ঘনত্ব ভাব, পাভলভস্কায়া স্ট্রিটে কেমন বিজয়ে
মত্ত মাতালের গলা, জড়িত স্খলিত কারো পদক্ষেপে কাঁপে
মদালসা করিডর, স্বর্ণকেশী রাজকন্যা শরীরের ভারে
বসেছে ছুরিকা হয়ে, মে দিবসে আমি বুঝি বারাঙ্গনালয়ে
বসে আছি ঝিমধরা, রাস্তার পতাকা থেকে রক্তিম আবির
ঝরে পড়ে দুর্নিবার, ও শুধু আবির বুঝি, ও কিছু রক্তের
রাখেনি তো প্রতিচ্ছবি, উনিশশো সতেরো সালে শীতপ্রাসাদের
দুয়ারেই রেখেছিল অগ্নির স্ফুলিঙ্গ জ্যোতি, এখন পশ্চিমী
নৃত্যের গুঞ্জন ধ্বনি, পশ্চিমবঙ্গের বুকে যন্ত্রের দানব
ওয়ালজের সুরে সুরে নেচে যাবে মায়াময়, নিঃস্ব এ শরীর
ছাপিয়ে নিস্বনে তবু ঝরে কেন রক্ত স্রোত, অকর্ষিত ভূমি
কেন থাকো প্রতিবিম্বে মায়াবী দর্পণে এই, স্টিরিওর নব্
ঘোরালে বাজে না কেন বজ্রনাদে শঙ্খরব কাস্ত্র হাতুড়ি!
*
চানের ঘরে কালকেউটে
চানের ঘরে যেই গিয়েছি লাফিয়ে ওঠে কালকেউটে
বাষ্পে ধূমে প্রায়ান্ধকার ঘরের মধ্যে সাপের ফণায়
ফেনিয়ে ওঠে নীলচে দ্যুতি, সাবান সাবান ফেনায় জলে
লেপটে আছে শরীর জুড়ে, চাঁদ সদাগর লোহার ঘরে
ছিদ্র কেটে শাপশাপান্ত, অ্যাদ্দিন তো দিব্বি ছিলে
পাষাণ হয়ে রন্ধ্রভারে, হঠাৎ কেন আজকে উঠে
মুষল হয়ে অস্থি ভাঙো, স্বস্তিটুকু, ঘনায় ঘনায়
নিকষ অমাবস্যা কালো, নরক বা বেহেশতে
প্রথম পদচ্ছায়া আমার, অচেনা অঞ্চলে
বুক কাঁপানে মূর্তি ছায়া, আমায় ঘিরে লৌহকঠিন স্বরে
সাপের এমন ফুঁসিয়ে ওঠা, আমার কাছে ঘেঁষতে
কি শাপ তোমায় সাহস দিল, ক্ষিপ্ত প্রতিমূর্তি
শরীর জুড়ে বিষিয়ে ওঠে, অন্ধ কারাকক্ষে
রাখব না আর বন্দি করে, তোমায় আমি মুক্তি
দেবই দেব সত্যি দেব শানবাঁধানো মেঝেয় এবার
আর পারি না আর পারি না, বিষের নীলে গ্রন্থি গলা
জ্বলতে জ্বলতে নীলকণ্ঠ, তুমিও জানো অলি
মুষল হাতে এই নিয়েছি, প্রমত্ত এই চাপে
যাক ভেঙে যাক শক্ত তালা, গলার সরু নলি বেয়ে
সাপ চলে যাও, সাপ চলে যাও সুজিতটাকে সঙ্গে নিয়ে
শরীর থেকে যেই বেরোল অলি জানো শরীর অবশ
পক্ষাঘাতে আজ নিপাতে প্রাচীন মহাপাপে
তোমার জন্য জমিয়ে রাখা নৈবেদ্য ভালবাসার
রূপান্তরে অশ্রু ভরা বিনষ্ট অঞ্জলি।
*
রোম নগরী তোমায় চিনি
মনের মধ্যে জড়িয়ে আছে, মনের মধ্যে তিন কুলুপে
রঙিন রোমান চাবি দিয়ে শক্ত করে নিপুণ চাপে
কোন জাদুকর রাখলে এমন বন্দি করে ভোমরাটিকে
রোম থেকে তাই ফ্লোরেন্স যেতে চিকনকালো সূক্ষ্ম পাপে
তলায় শ্যামল নৌকোখানি, নিঝুম রাতে একটু চুপে
ফিসফিসোনো বিষের ধোঁয়া, এমনতর সর্পিলতা
আমার জন্যে রোম নগরী, আমার জন্যে শ্বেত মদিরা
পাত্র ঠোঁটে ঠেকিয়ে রাখো, চুলের কালো মৌচাকে আর
চিরুনি সোনা কাঁকড়া দাঁড়া, কখনো কেউ তোমরা ফিকে
নীলচে রঙের পরদা দেখো, তোমরা নাকি রোমান নারী
অশ্বক্ষুরে শহর দাপাও, এমনধারা আজব কথা
কে বিশ্বাস করবে এমন কে আর আছে তপস্বিনী
ট্রেনের কাচে আধঝলকে তরল ধাতুর তীক্ষ্ণ ব্রীড়া
ফোটাও যত উন্মাদিনী, অস্ত্রখানি তার বুকে যার
তির বেঁধানো জন্ম, মায়ার রোম নগরী তোমায় চিনি।
*
ভেনিসে প্রতীক্ষাঘরে
নিশুতি নিঝঝুম ঝুম, অন্ধকার ঘর ভরে অজস্র কুহেলি
ভেনিসে প্রতীক্ষাঘরে ঝুমঝুম ঘুমঘুম, মায়াবী আঁধারে
দুচোখে বিঁধেছে তির, এ কার প্রতীক্ষা বলো ধূধূ জলধারে
মরীচিকা ঝিকমিক, জ্যোৎস্নাময় কুয়াশায় অপরূপ খেলি
কেবল নিজের সঙ্গে, এ খেলার গোলঘরে রুমালচুরির
বৃত্ত ঘুরে চলাফেরা, ভিয়েনার ট্রেন এসে সরল ঋজুতা
দেখাবে বাঁকানো তার বাজপাখি ঠোঁট দিয়ে, সে তার কিছুটা
মুখাগ্র আড়ালে রাখে, ঝমঝম ঝমঝম বর্ষা মেঘ তীর
সহসা ফুটেছে চোখে কৃষ্ণসার অন্ধকারে, গোধূলি গোধূলি
ভেনিস স্টেশন জুড়ে, ফিকে নীল পুরু পরদা দোলনা ঝুলনে
ঝুলেছে নিঃসাড় চুপ, এ রাসপূর্ণিমা এই বৃন্দাবন ধূলি
মেখেছ বৈষ্ণব গায়ে, তারই ঝড় বৃষ্টিধারা ভেনিস স্টেশনে
শরীরে তোমার ঝরে কুয়াশার বর্শা হয়ে, ভিয়েনার ট্রেন
এ থেকে কতটা মুক্তি দিতে পারে, চারিদিকে সমুদ্র সফেন।
অসাধারণ অসাধারণ। শব্দচয়ন আর ছন্দের শরীর নিয়ে এমন ভাঙাগড়া এসময় খুব কম চোখে পড়ে। কবি আর কবিতা কোনো কালের গন্ডিতে বাঁধা থাকেনা; মননে নিগড় বাঁধে না কোনো ভূগোলের শক্ত সীমানা। এসব লেখায় সেসব বেশ বোঝা যায়। একমাত্র এক শক্তিশালী কবিই পারেন পঞ্চাশ বছর প্রায় নাড়া দেবার মতো রচনার মধ্যে নিজেকে উজাড় করতে। সুজিত বসু আদ্যান্ত কবিতা, তাঁর কবিতা কখনো ফুরানোর নয়। অভিনন্দন কবিকে। ভালভাষাকে ধন্যবাদ, তাঁরা কবিকে পৌঁছে দিচ্ছেন অনুরাগী ও মনোযোগী পাঠকের কাছে
খুব ভাল লাগল। সুজিত বসুর কবিতা আগে পড়িনি। কবি সম্পর্কে আগ্ৰহ জাগল।