বলা চলে, জৈব-পদার্থবিজ্ঞানের ওপর লেখা এটিই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। বইটির নাম— “What is Life?” বিখ্যাত এই বইয়ের মধ্যে দিয়ে লেখক ফিজিক্সের সঙ্গে জেনিটিক্সের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন প্রথম। না, লেখক জীববিজ্ঞানের লোক নন। তিনি একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী। সেই অর্থে সীমানা ছাড়ানো এই বই। পদার্থবিজ্ঞানী লেখক এই বইয়ের মাধ্যমে আধুনিক জীববিদ্যায় বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনার স্পার্ক নিয়ে এসেছিলেন প্রথম। উল্লেখ্য যে, পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি জীববিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের দর্শনেও গভীর উৎসাহ ও জ্ঞান ছিল তাঁর।
পদার্থবিজ্ঞানী এই লেখকের নাম এরভিন শ্রোয়ডিংগার (Erwin Schrödinger, ১৮৮৭-১৯৬১)। অস্ট্রীয় তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী। কোয়ান্টাম তত্ত্বের অন্তর্গত তরঙ্গ বলবিদ্যার প্রবর্তক। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের জনক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয় তাঁকে। তাঁর আবিষ্কৃত তরঙ্গ সমীকরণ (কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম প্রধান অঙ্গ)। ১৯৩৩ সালে ফিজিক্সে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন “for the discovery of new productive forms of atomic theory” যৌথভাবে ব্রিটিশ পদার্থবিদ পল ডিরাকের (Paul AM Dirac) সঙ্গে। আধুনিক পদার্থবিদ্যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয় এরভিন শ্রোয়ডিংগারকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে দেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে ডাবলিনে আশ্রয় নেন। জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহ ছিল। ১৯৩৯ সাল থেকে দর্শন ও জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অধ্যয়ন শুরু করেন। What is Life? বইটি এই সময়কার মননের ফসল। ১৯৪৪ সালে বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান জগতে সাড়া ফেলে দেয়। বিজ্ঞানের সবচেয়ে প্রভাবশালী বইগুলির মধ্যে এই বই অন্যতম, এরকমই মনে করেন সকলে।
আধুনিক জীববিদ্যার প্রথম সারির কয়েকজন গবেষক, যথা, জে বি এস হলডেন, ফ্রান্সিস ক্রিক, মরিস উইলকিন্স, কুর্ট স্টার্ন, সেমুর বেঞ্জার সহ আরও বেশ কয়েকজন মেধাবী জীববিজ্ঞানীকে প্রণোদনা দিয়েছে “হোয়াট ইজ লাইফ?” নামের গ্রন্থটি। এই বইয়ে তিনি মূলত অবতারণা করতে চেয়েছেন, ভৌতবিজ্ঞানের মূলধারার সঙ্গে জীববিজ্ঞানের পদ্ধতিগুলোর সম্পর্ক কী? শ্রোয়ডিংগার তাঁর এই বইয়ে বলেছেন, জীবন হচ্ছে ‘এ কেমিক্যাল স্ট্রাকচার ইন লিভিং সেলস।’ এ এক অভিনব ভাবনা। জীবনের রহস্য সমাধানে জীববিজ্ঞানের গবেষকরা তখনও উত্তর খুঁজে চলেছেন। ঠিক তখনই এই বই তাঁদের অনেকের ভাবনাকে আলোড়িত করে তোলে। এই বই পড়েই সেসময় জীববিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছেন তাঁরা।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ন’বছর পরে, ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজে ধারাবাহিক তিনটি ‘পাবলিক লেকচার’ দিয়েছিলেন তিনি, যার প্রথম বক্তৃতাটি ছিল ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩। ফিজিসিস্টদের কাছে স্বাভাবিকভাবেই সেই বক্তৃতার শিরোনামটি অদ্ভুত ঠেকেছিল। নোবেলজয়ী তাত্ত্বিক পদার্থবিদের লেকচারের শিরোনাম যদি হয় “হোয়াট ইজ লাইফ?”— তবে তা তো অস্বাভাবিক আর অদ্ভুত মনে হবেই! পরের বছরই ওই বক্তৃতা বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। বই প্রকাশের পরে “হোয়াট ইজ লাইফ?” বিজ্ঞানের জগতে বিপুল সাড়া ফেলে দেয়। বিজ্ঞান ইতিহাসে, আজ পর্যন্ত এই বইকে সবচেয়ে প্রভাবশালী বই হিসেবে মনে করা হয়।
বস্তুত শ্রোয়ডিংগারের “হোয়াট ইজ লাইফ?” নামের এই বইটি ‘মলিক্যুলার বায়োলজি’ বিভাগের সূচনা স্তম্ভ। মনে রাখতে হবে, এই বই প্রকাশের প্রায় দশ বছর পরে, ১৯৫৩ সালের ২৫ এপ্রিল বিখ্যাত ‘নেচার’ গবেষণাপত্রে ওয়াটসন ও ক্রিক-এর ডিএনএ অণুর ডাবল হেলিক্স গঠন সংক্রান্ত প্রবন্ধটি প্রকাশ পাবে। ডিএনএ-র আণবিক গঠন আবিষ্কার একটি মাইল ফলক আবিষ্কার। গুরুত্ব হিসেবে যা পৃথিবীর যাবতীয় আবিষ্কারের প্রথম তিনটি আবিষ্কারের মধ্যে অন্যতম হিসেবে ধরা হয়। নেচার-এ গবেষণাপত্র প্রকাশের ন’বছর পরে, ১৯৬২ সালে ওই আবিষ্কারের জন্যে ওয়াটসন, ক্রিক এবং উইলকিন্স নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
উল্লেখ্য যে, ১৯৫৩ -র ১২ আগস্ট শ্রোয়ডিংগারের ৬৬ তম জন্মদিনে তাঁকে শুভেচ্ছাজ্ঞাপক পত্রে ফ্রান্সিস ক্রিক জানিয়েছিলেন, ওয়াটসন এবং তিনি দুজনেই তাঁর বইটি পড়ে ডিএনএ গঠন জানার কাজে উৎসাহিত ও প্রভাবিত হয়েছিলেন। এ জন্যে কিংবদন্তি পদার্থবিদকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ক্রিক তাঁকে লেখেন:
“ওয়াটসন আর আমি আলোচনা করছিলাম কী করে আমরা আণবিক জীববিদ্যার জগতে প্রবেশ করলাম, আমরা দুজনেই বুঝতে পারি যে আপনার লেখা “হোয়াট ইজ লাইফ?” নামের ছোট্ট বইটি আমাদের দারুণ প্রভাবিত করেছিল’… বইয়ে উল্লেখ করা আপনার ‘aperiodic crystal’ শব্দবন্ধটি খুবই উপযুক্ত হিসেবে আমরা উপলব্ধি করেছিলাম।”
বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক কার্ল পপার “হোয়াট ইজ লাইফ?” বইটি পড়ে বলেছিলেন ‘beautiful and important book’ by ‘a great man to whom I owe a personal debt for many exciting discussions’.
‘কোয়ান্টাম ফিজিক্স’ ব্যবহার করে ‘জেনেটিক স্ট্রাকচার’-এর স্থিতিশীলতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন তাঁর “হোয়াট ইজ লাইফ?” বইয়ে। মনে রাখতে হবে সালটা ১৯৩৯। আর ‘জিন’-এর ‘ফিজিক্যাল নেচার’ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান পুষ্ট হচ্ছে ১৯৪০ থেকে ১৯৫০ এই সময়কালে। ১৯২৫-এ সবেমাত্র ‘মেনডেলিয়ান মডেল’ বহুলভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। ওই রকম একটা সময়ে শ্রোয়ডিংগার পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে জীবন তথা বংশগতি প্রবাহের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। বস্তুত এ যেন ফিজিক্স আর বায়োলজি দুটি বিভাগকে মিলিয়ে দেওয়া!
যদিও শ্রোয়ডিংগারের এই বইয়ের বক্তব্য আণবিক জীববিদ্যার বিকাশের সঙ্গে তা পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে। তবুও এই বই একটি অন্যতম উপযোগী এবং এ বিষয়ের অসাধারণ সূচনাকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
দার্শনিক মূল্যে গুরুত্বপূর্ণ আরও বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন এরভিন। তার মধ্যে রয়েছে ‘Mind and Matter ‘(১৯৫৮), Science and Humanism, Space-Time-Structure (১৯৫০)। তাঁর লেখা সর্বশেষ বই Meine Weltansicht (1961; My View of the World), যাতে বেদান্তর মিস্টিসিজমের সঙ্গে গভীর মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
আজ ১২ আগস্ট, এরভিন শ্রোয়ডিংগারের জন্মদিন। তাঁর প্রতি রইল আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
বিজ্ঞানের জগতে what is life এর মত গুরুত্বপূর্ণ অমূল্য এই বইটির ওপর আলোকপাত… লেখকের এই আন্তরিক প্রচেষ্টা’কে সাধুবাদ জানাই। অনেক অজানা তথ্য সমৃদ্ধ সুন্দর একটি প্রতিবেদন। শ্রয়ডিনজার এই নাম উচ্চারণের সাথে সাথেই তো মনে আসে কোয়ান্টাম মেকানিক্স, ওয়েভ সমীকরণ, শ্রয়ডিনজার ক্যাট, থার্মোডায়নামিক্স ইত্যাদি ইত্যাদি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের স্তম্ভ স্বরূপ অমূল্য সব থিয়োরির কথা। কিন্তু ডীববিজ্ঞানের আঙিনাতে ও একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদের এই গভীর অনুসন্ধিৎসা… পদার্থবিজ্ঞান আর জেনেটিক্স’ এর সংযোগ স্থাপনায় তাঁর এই গভীর অনুসন্ধান এবং অমূল্য অবদানের কথা জেনে… সত্যিই বিস্ময় আর শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়।
ধন্যবাদ জানাই আপনার সহৃদয় মন্তব্যের জন্যে