কথায় বলে, অসিকে অসি দিয়ে জব্দ করতে হয়। আর কলমকে কলম দিয়েই প্রতিবাদ করতে হয়। তাই বলে কলমকে চপার হামলা বা অসি দিয়ে নয়। গত ১২ আগস্ট আমেরিকার নিউ ইয়র্কে বুকার-জয়ী লেখক সলমন রুশদিকে মঞ্চে বক্তব্য রাখার সময় যে নৃশংস চপার হামলা করা হয়েছে, তা আবার একটি নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল। হামলাকারী মৌলবাদী গোষ্ঠীর ওই প্রতিনিধি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রুশদির শরীরে ১৪-১৫ বার চপারের কোপ দিয়েছে। অত্যন্ত আশঙ্কাজনক অবস্থা থেকে কিছুটা বেরিয়ে এলেও তাঁর একটা চোখ কিন্তু চিরতরে খতম হয়ে গেছে।
সলমন রুশদির সঙ্গে আমার বহু বিষয়ের মিল না থাকতেই পারে। কিন্তু নিউইয়র্কে রুশদির ওপর যে হামলাটা হয়েছে, আমি তার তীব্র নিন্দা করি এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজার দাবি করছি। পাশাপাশি আমি একথাও বলতে চাই যে, আয়োজক সংস্থার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এত গাফিলতি কেন? রুশদি শুধু বিখ্যাত লেখকই নন, তিনি একজন বিতর্কিত লেখক। ১৯৮৮ সালে তাঁর বিতর্কিত গ্রন্থ ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ নিয়ে এই বিতর্কের সূত্রপাত। ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা খোমেইনি তাঁর মাথার দাম ধার্য করেছিলেন। তারপর থেকে এই লেখকের নিরাপত্তা নিয়ে লাখ টাকার প্রশ্ন তো ছিলই। আরও দু-একবার তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছিল। তার পরও নিউ ইয়র্কের আয়োজক সংস্থা তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি কেন? মঞ্চে সাক্ষাৎ করার নামে এতবড় হামলা? তাহলে কি বলা যাবে না, এর মধ্যে কোনও ষড়যন্ত্র ছিল?
প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার লেখক-শিল্পীরা পৃথিবীতে বারবার মৌলবাদী হামলার শিকার হয়েছেন। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার ও মুক্তচিন্তার মানুষ মৌলবাদী হামলায় খুন হয়েছেন। তসলিমা নাসরিন আজও সেদেশে ঢুকতে পারেন না। এরকম অনেক ঘটনার কথা বলা যায়। এইরকম আমাদের বিখ্যাত শিল্পী মকবুল ফিদা হোসেনকে দেশ ছাড়তে হয়েছে উগ্র মৌলবাদীদের জন্যই। বিদেশের মাটিতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। একসময় এই মৌলবাদী শক্তির জন্যই শাবানা আজমি ‘ওয়াটার’ ছবির শ্যুটিং করতে পারেননি।
এই মৌলবাদীদের হামলায় প্রাণ গিয়েছে কালবুর্গী, নরেন্দ্র দাভালকার, গোবিন্দ পানসারে ও গৌরী লঙ্কেশের। এই মৌলবাদীদের শিকার হয় মুম্বাইয়ের ক্রিকেট পিচ। এই মৌলবাদীদের হুমকির শিকার হন গজলশিল্পী ওস্তাদ গোলাম আলী খান। কেন মৌলবাদীরা বারবার এটা করে? এর পিছনে কি রাজনীতির হাত রয়েছে? রাজনীতি কোথাও মৌলবাদীদের সঙ্গে হাত মিলায়? এই বিষয়গুলো ভাবাচ্ছে। রুশদি যে মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছেন, সেখানে নিরাপত্তার বেড়ি ভেদ করে একজন দুষ্কৃতী উঠে তাঁকে ১৪-১৫ বার চপারের কোপ মারল। বিষয়টা মনে হয় এত সহজ নয়। জালটা কিন্তু অনেক গভীরের।
যত দিন যাচ্ছে, পৃথিবীতে ধর্ম নামক বস্তুটি সাংঘাতিক স্পর্শকাতর হয়ে উঠছে। তার মানে এই নয় যে, লেখক একটা মত প্রকাশ করবেন, আর তার জন্য তাঁকে চপার হামলা? রুশদি বা তসলিমার সঙ্গে আমি অনেক বিষয়ে সহমত নাও হতে পারি। তাই বলে চপার হামলা? ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ বইটি নিষিদ্ধ হয়েছিল ১৯৮৮ সালেই। সে সময় সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকায় একটা আর্টিকেল লিখেছিলেন লেখকের দায়বদ্ধতা নিয়ে। সেখানে তিনি দাবি করেন, একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, আবার তিনি ধর্মীয় গুরু। তাঁকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে বা লিখতে গেলে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হয়। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ কত সুন্দর কলম দিয়ে কলমের প্রতিবাদ করেন। তাই কলমকে কলম দিয়েই প্রতিবাদ করতে হয়। চপার দিয়ে নয়।
আরবি সাহিত্যের বিখ্যাত কবি ইমরুল কয়েশ। তিনি নাস্তিক ও নির্ধর্মবাদী। কিন্তু হজরত মহম্মদ (সা:) তাঁর কবিতা ভালবাসতেন। তিনি কিন্তু কোনওদিন কারও মাথার দাম ধার্য করেননি। হায়দরাবাদ প্রেস ক্লাবে মৌলবাদীরা যেভাবে তসলিমা নাসরিনকে হামলা করেছে, আমি সেসময় তার নিন্দা করেছিলাম। তসলিমা বা রুশদির অনেক কিছুই আমার পছন্দ নাও হতে পারে। তা বলে চপার হামলা? না মোটেই নয়। লেখককে মেরে ফেলা যায়, কিন্তু তাঁর সৃজনশীলতাকে কি মেরে ফেলা যায়? রুশদির ওপর এই হামলার বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ হোক।