‘সিলভার লাইনিং’ বোধহয় একেই বলে। ঘনকৃষ্ণ আকাশে রুপোলি রেখা। যুদ্ধের ধূম্রজালের মধ্যে স্বস্তির সুখবর।
ফেব্রুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ থেকে চলছে রুশ আর ইউক্রেনের যুদ্ধ। পাঁচ মাস অতিক্রান্ত হবার পরেও কোনও লক্ষণ নেই বিরামের। আর এই সময়কালে হু হু করে বেড়েছে তেল আর গ্যাসের দাম। স্বভাবতই মানুষ এখন খুঁজছে সেই জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প। এইখানেই প্রবলভাবে উঠে আসছে গ্রিন হাইড্রোজেনের নাম। গবেষণা সংস্থা রাইস্ট্যাড এনার্জি জানাচ্ছে, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিগুলির চাহিদা বাড়ছে। আর এগুলির সামনের সারিতে রয়েছে গ্রিন হাইড্রোজেন। বাড়ছে তাকে সাশ্রয়ী ও নিরাপদ করার জন্য গবেষণা। ইতোমধ্যেই এর ওপর গবেষণার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৩০ কোটি ইউরো বরাদ্দ করেছে। যা ২০৩০ সাল নাগাদ ১৯০ কোটি ইউরোতে দাঁড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। গ্রিন হাইড্রোজেন ঠিক কীরকম? কীভাবে উৎপাদন হয় এর?
আমরা জানি, জলের অন্যতম উপাদান হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন। জলের তড়িৎ বিশ্লেষণের ফলে ক্যাথোডে জমা হয় হাইড্রোজেন। কিন্তু এই তড়িৎ বিশ্লেষণে যে তড়িৎ প্রযুক্ত হয়, তা সাধারণ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদিত তড়িৎ হলে গ্রিন হাইড্রোজেন পাওয়া হয় না। গ্রিন হাইড্রোজেন পেতে হলে প্রযুক্ত তড়িৎকেও হতে হবে সৌরবিদ্যুৎ বা বায়ুবিদ্যুৎ। কেন না তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত হয় কয়লা বা পেট্রোল বা গ্যাস। যা অবশ্যম্ভাবীভাবে বাতাসে ছাড়ে কার্বন যৌগ। আর এইভাবে ঘটায় বায়ুদূষণ। গ্রিন হাইড্রোজেন হল সেরকমই এক বস্তু যার উৎপাদনে বায়ুমণ্ডলে কোনওভাবে কার্বন যৌগের নিঃসরণ ঘটায় না। স্বভাবতই এই ধরনের একটি বস্তু বানানোর খরচ যথেষ্ট বেশি। এই খরচ কমানোর চেষ্টা চলছে। আশা করা যাচ্ছে, তা কমবে এবং এ সাধারণ পেট্রোল ও গ্যাস ব্যবহারকারীর মধ্যে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে।
কয়লা, পেট্রোল ও গ্যাস সহ প্রতিটি জীবাশ্ম জ্বালানির দহনে উৎপন্ন হয় কার্বন মনোঅক্সাইড ও কার্বন ডাইঅক্সাইড। যে দুটি গ্যাস স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। শ্বাসকষ্ট, সিভিডি (কার্ডিও ভ্যাসকুলার ডিজিজ) ও অন্যান্য অসুখ ঘটায় এই দুটি গ্যাস। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ায় এরা। যার ফলে হয় বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং। যা এক মারাত্মক বিপদ হিসেবে নেমে এসেছে এই পৃথিবীর বুকে। একে ঠেকাতে ১৯৯২ সালের কিয়োটো প্রোটোকল থেকে অনেক সম্মেলন ইত্যাদি হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েই গেছে। বেড়েছে জলস্তর। গলেছে উত্তর মেরুর বরফ। বিপন্ন হয়ে পড়েছে মুম্বাইয়ের মত সমুদ্রের তীরবর্তী শহরগুলি। বিপন্ন হয়ে পড়েছে মেরুভালুকের মত উত্তর মেরুর প্রাণীকুল। একটি হিসাব বলছে, ১৯৮০-র পর থেকে প্রতি দশকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়েছে কমপক্ষে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে।
এই বৃদ্ধির অন্যতম কারণ, পরিবহণ ক্ষেত্রে আমাদের চিরাচরিত জ্বালানির প্রতি নির্ভরতা। এগুলির দাম এখনও পর্যন্ত গ্রিন হাইড্রোজেনের মত অচিরাচরিত জ্বালানির তুলনায় অনেকটাই কম। মূলত দামের কারণেই ধাক্কা খেয়েছে এই গ্রিন হাইড্রোজেন ব্যবহার। পরিবহণ ব্যবস্থা থেকে গেছে পেট্রোল ও গ্যাস নির্ভর হয়ে। আর সেখানেই টেক্কা মেরেছে রাশিয়া। ইংল্যান্ড, জার্মানির মত ইউরোপীয় দেশগুলি প্রচণ্ড পরিমাণে নির্ভর করে থাকে রাশিয়ার পেট্রোল ও গ্যাসের ওপর। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তারা রাশিয়ার গ্যাস-পেট্রোল কিনছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে গ্রিন হাইড্রোজেনের কদর বাড়ছে। কিন্তু একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এর উৎপাদন খরচ। যে-কারণে পেট্রোলিয়াম উৎপাদনকারী দেশগুলি বিশ্বরাজনীতিতে বড় ভূমিকা পালন করছে। অনেকেই জানি না যে, সৌদি আরবের পর বিশ্বের সর্বোচ্চ তৈল উৎপাদানকারী দেশ হল রাশিয়া। রাশিয়ার তেল ও গ্যাস কেনে পশ্চিম ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলি। এই দেশগুলি আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও সঙ্গী। তাই যখন রুশ-ইউক্রেন সংঘাতের প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে আর্থিক অবরোধ জারি করলেন, তখন মনে করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় বন্ধুদেশগুলি সেই নিষেধাজ্ঞাকে মান্যতা দিয়ে রাশিয়া থেকে তেল-গ্যাস কেনা বন্ধ রাখবে। কিন্তু কোথায় কী। স্যাম চাচার বন্ধুত্ব থেকে এরা যে নিজের দেশের অর্থনৈতিক চাকাটিকে বেশি গুরুত্ব দেয়, তা প্রমাণিত হয়ে গেল আর-একবার। এই চাকাটিকে সচল না-রাখতে পারলে জনগণ যে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করবে, তা বিলক্ষণ জানেন নেতারা। আর তাই, এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা ছাড়া অন্য উপায় নেই তাঁদের।
আর সেই পরিপ্রেক্ষিতেই উঠে আসছে গ্রিন হাইড্রোজেনের কথা। ইউরোপীয় নেতারা বুঝছেন, উন্নয়ন স্তব্ধ না-করে রাশিয়াকে আটকানোর একমাত্র উপায় হল বিকল্প জ্বালানি। যতদিন না প্রতিযোগিতামূলক দরে এই জ্বালানি উৎপাদিত হয়, ততদিন রাশিয়ার উপর তাঁদের নির্ভর করতে হবেই। এই উপলব্ধি থেকেই গ্রিন হাইড্রোজেনের গবেষণায় এই বিপুল খরচ। এর দাম কী করে সাধ্যের মধ্যে আনা যায় তা নিয়ে ব্যস্ত সবাই। কেন না, একমাত্র এই পথেই রাশিয়া-নির্ভরতা কমানো যেতে পারে। আর একমাত্র রাশিয়া-নির্ভরতা কমাতে পারলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরও ভালও সেবাদাস হওয়া যাবে। যা ছাড়া পশ্চিম ইউরোপের বোধহয় কোনও গতি নেই।
কিন্তু এর ফলে একটা ভাল জিনিস হতে চলেছে। মানুষ হয়তো মুক্তি পেতে চলেছে দূষণ সৃষ্টিকারী জ্বালানি থেকে। যদি তা হয়, তার থেকে ভাল কিছু হতে পারে না। সুতরাং এই যুদ্ধ সম্বন্ধে আমাদের যে মতই থাকুক না, আমরা চাইব সার্থক হোক এই গবেষণা।