রবীন্দ্রনাথ তাঁর নান্দনিক চেতনা ও বৈচিত্র্যপ্রিয়তার অভিনবত্ব আর নব নব সৃষ্টিশীলতার বৈভবে নিমগ্ন এক মহাপ্রাণ। কেবল সৃজনশীলতা নয়, জীবনের প্রতিটি পর্বে আনন্দ আর সুন্দরতাকে মিলিয়ে গেছেন তিনি, নিত্যকার জীবনধারণের সঙ্গে ভূমাকে। এজন্যই তিনি জমিদারি পরিচালনার কাজে শিলাইদায় গিয়ে ‘পুণ্যাহ’ নামক নিতান্ত আনুষ্ঠানিকতাকে ভিন্ন মাত্রা দেন, ঋতুর উৎসব দোলকে করে তোলেন বসন্তোৎসব। তিনি আমাদের উপনিষদের সেই বাণীটি স্মরণ করিয়ে দেন, আনন্দেই আমাদের জন্ম, পদযাত্রা, আর আনন্দই সব। এই সমগ্র পৃথিবী আনন্দে আবর্তিত, পুনরাবর্তিত। তাই মানুষের জীবনের প্রত্যেক মুহূর্ত-ই আনন্দের নন্দনবারিতে স্নাত হওয়া উচিত।
এজন্যই তিনি তাঁর প্রাণের আরাম ও আত্মার শান্তি সব হতে আপন তাঁর বিদ্যানিকেতন শান্তিনিকেতনে একদিকে রাখেন পঠনপাঠনের ব্যবস্থা, অন্যদিকে স্বাস্থ্যকর বিনোদনের। অধ্যয়নকে কেবল ‘Three R’s (reading, writing and arithmatics)-এ সীমাবদ্ধ না রেখে তিনি তার সঙ্গে যুক্ত করে দেন দশদিশি আনন্দের কাকলি ও ডানা। তাই সেখানে ছবি আঁকা, সঙ্গীত, খেলাধুলা, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, ভ্রমণ ও বনভোজনের আয়োজন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তর থেকে শিক্ষক আসছেন পাঠদান করতে,– ফ্রান্স থেকে সিলভাঁ লেভি, জার্মানি থেকে ভিন্টারনিৎস, ইংল্যান্ড থেকে দীনবন্ধু এন্ড্রুজ, এর প্রভাবে শিক্ষার্থীদের মননে গড়ে উঠছে দেশকে ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকতার আবহ। আবার ছাত্রছাত্রীরা আসছে ভারতের পাঞ্জাব দ্রাবিড় মারাঠা সিন্ধু থেকে। উপমহাদেশকে তারা পাচ্ছে হাতের মুঠোয়, এজন্য তাদের এক পা-ও নড়তে হচ্ছে না।
শান্তিনিকেতনকে কবি করে তুলেছিলেন ঔপনিষদিক আদর্শে যেমন, তেমনি তার সঙ্গে মিশিয়েছিলেন আধুনিক যুগের বিজ্ঞানচেতনা ও বিশ্বকে এক নীড়ে বাঁধার গূঢ়ৈষা। তার সঙ্গে সঙ্গে তিনি জীবনের প্রতি পল-কে, ঋতুকে, মাসকে উৎসবায়িত করতে চেয়েছিলেন। তাই তো গড়ে উঠেছে শান্তিনিকেতনের নিজস্ব বারোমাসে তেরো পার্বণ। বসন্তোৎসব, পৌষমেলা, মাঘোৎসব, হলকর্ষণ, বৃক্ষরোপণ উৎসব ইত্যাদির সূচনা করে গিয়েছিলেন কবি। বিশ্বচেতনার সঙ্গে তাল রেখে জীবনকে অপূর্ব লাবণ্যময় করার জন্যই এমন বর্ণিল অনুষ্ঠানমালা, যা গতানুগতিক জীবনের মধ্যে নিয়ে আসে অবধারিত নন্দনের সংবাদ।
শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ উৎসব তেমনই এক অসামান্য উদযাপন, ১৯২৫ থেকে যা পালিত হয়ে আসছে। এর উদ্যোক্তা স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথ। কবির প্রকৃতিপ্রীতি ও ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর’ যে কেবল কবিসুলভ বাহ্যাড়ম্বর ছিল না, ছিল হৃদ্গত আর্ষবাক্য, তার প্রমাণ, তাঁর আশ্রমটিকে তিনি তিলে তিলে বৃক্ষময় করে তুলেছিলেন। আম্রকুঞ্জ, শালবীথি, তালধ্বজ তার-ই সাক্ষ্য দেয়। কবির ‘বনবাণী’ কাব্যগ্রন্থটি তো বৃক্ষবন্দনায় পরিপূর্ণ।
কবি বৃক্ষবন্দনা করে লেখেন, ‘মরুবিজয়ের কেতন উড়াও, উড়াও শূন্যে, ধূলিরে ধন্য করো’! আবার কখনও বৃক্ষকে তাঁর মনে হয় ‘বিশ্ববাউলের একতারা’। এই নিবিড় ও একান্ত নিজস্ব বোধ থেকে উঠে আসে তাঁর বৃক্ষচেতনা, যা অনেকাংশেই কবি কালিদাসের প্রকৃতি ও বৃক্ষ-অভিবন্দনার সমরেখ। কালিদাস তাঁর ‘শকুন্তলা’ নাটকে শকুন্তলার সঙ্গে বৃক্ষের সখিত্ব দেখিয়েছেন। কণ্বমুনিকে দিয়ে কবি বলিয়েছেন, নারী-মানবীর মতোই বৃক্ষ-ও ‘প্রসূতি’ হয়। উপনিষদের উক্তি, ‘যো ওষধিষু বনস্পতিষু’, অর্থাৎ পরম ব্রহ্ম, যিনি ওষধি ও বনস্পতিতে বিরাজিত, তাঁকে নমস্কার! রবীন্দ্রনাথের বৃক্ষচেতনা সুপরিবাহী হয়ে এসেছে এসবের হাত ধরে। ‘বলাই’ গল্পে তাই প্রকৃতি, আরও বিশেষভাবে গাছ যে মানুষের কতখানি আত্মার আত্মীয় হতে পারে, তা দেখিয়েছেন কবি।
বৃক্ষের অনুষঙ্গে রবীন্দ্র-জীবনের দু-একটি ঘটনা মনে পড়বে। ১৯১৬-তে শেক্সপিয়ারের ৩০০-তম মৃত্যুবছরে তিনি এই কালজয়ী কবির প্রতি শ্রদ্ধায় তাঁর জন্মভূমি স্ট্রাটফোর্ড অন এভনে একটি বৃক্ষরোপণ করেছিলেন। তাছাড়া তিনি বহু গাছ ও ফুলের নিজস্ব নামকরণ করেন। শ্রীনিকেতনে গাছগৃহ, অর্থাৎ গাছের ওপরে ঘর বানানো হয়েছিল তাঁর জন্য (Tree-top), যেখানে মাঝেমধ্যে থাকতেন তিনি। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের শখ ছিল বনসাইয়ের, যা রবীন্দ্রনাথের কাছে খুব-ই অপ্রিয় ছিল।
একবার কবির জন্মদিনে কলকাতা বেতার তাঁর কবিতা সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেন। কবি তখন কালিম্পং-এ। কবি তৈরি হয়ে বসে। নির্দিষ্ট সময়ের আরও খানিক বাকি। কবি বাইরে তাকিয়ে দেখেন, উঠোনে ফুটে আছে নাগকেশর। অমনি কবিতাটিতে তিনি দ্রুত সংযোজন করলেন, ‘আর রবে নাগকেশরের চারা সম্মুখে আমার,/ ফুল যার ধরে নাই,/ আর রবে খেয়াতরীহারা ওপারের ক্লান্ত যাত্রা–‘। বৃক্ষ তাঁকে এইভাবে আলোড়িত করে গেছে সর্বদা।
এই কবির মৃত্যুদিনটিকে তাই শান্তিনিকেতন স্মরণ করে বৃক্ষরোপণ উৎসবের মাধ্যমে। আগেই বলা হয়েছে, বৃক্ষরোপণ উৎসব শুরু হয়েছিল কবির হাত ধরে। তাঁর জীবিতকালে বর্ষার কোনও একটি দিন দেখে তা পালন করা হত। গাছ লাগানো হত কখনও উত্তরায়ণে, কখনও কোপাই, বা অন্যত্র। ১৯৪০-এ কবি শেষবারের মতো নিজহাতে গাছের চারা লাগিয়ে গেছেন, অনুষ্ঠান-উপলক্ষ্যে গান ও কবিতা রচনা করেছেন। এরকম একটি গান, বৃক্ষকে আবাহনীসূচক, ‘আয় আমাদের অঙ্গনে’। পূর্বোল্লিখিত ‘বলাই’ গল্পটিও এই উপলক্ষ্যে লেখা।
কবির প্রয়াণের পরের বছর থেকেই আশ্রমবাসী বাইশে শ্রাবণকে বৃক্ষরোপণ উৎসব বলে স্থির করেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই দিনটিই এ-উৎসবের স্থায়ী তারিখ। বাইশের ভোর থেকেই প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় উৎসব। সকালে কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা বিচিত্রভাবে একটি পালকি চিত্রিত করেন ছবি এঁকে, ফুল, লতাপাতায়। মঙ্গলধ্বনি দিতে দিতে এর পর পালকির ভিতরে টবের মধ্যে একটি চারাগাছকে স্থাপন করা হয়। অতঃপর শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গীত-পরিবেশন-সহ আশ্রম-পরিক্রমা।
পরবর্তী পর্ব একটি নাতিদীর্ঘ অনুষ্ঠান। মণ্ডপ বেঁধে শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী এবং আশ্রমে সমবেত অতিথিদের সামনে তা অনুষ্ঠিত হয়। পৌরোহিত্য করেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য মহাশয়। পরিবেশিত হয় উৎসবোপযোগী সঙ্গীত। আবৃত্তি। ভাষণ দেন উপাচার্য। তার পর তাঁর হাত দিয়ে রোপিত হয় চারাগাছটি। কখনও শাল, কখনও হিজল, কৃষ্ণচূড়া, সপ্তপর্ণী, বা পলাশ। আশ্রম পরিক্রমায় যখন জাপান, ফ্রান্স, চিন, বাংলাদেশ বা সুইডেনের কোনও ছাত্র বা ছাত্রী সামিল হন, বা গুজরাত, মণিপুর, আসাম ও ঝাড়খণ্ডের, তখন বিশ্বভারতীর আদর্শ যে ‘যত্র বিশ্বম্ ভবত্যেকনীড়ম্’, অর্থাৎ যেখানে সমগ্র বিশ্ব একটি নীড়ে, পাখির ছোট্ট ও অপরিসর বাসায় সংহত, তার যাথার্থ্য অনুভব করা যায়।
আজ ভারত, বাংলাদেশ ও অন্যান্য জায়গায় সাড়ম্বরে বনমহোৎসব, সামাজিক বনসৃজন ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। অথচ সেই কবে কবির এমন চিন্তা গড়ে উঠেছিল, এতদিন আগে। বৃক্ষরোপণ উৎসবের শতবর্ষ এবছর। তাঁর জীবিতকালেই তিনি এই উৎসবকে ধ্রুপদী মাত্রা দিয়ে গেছেন। ১৯২৫-এ যা শুরু হয় অশ্বত্থ, বট, বেল, অশোক আর আমলকী, এই পাঁচটি বৃক্ষচারা রোপণের মাধ্যমে (একে বলে পঞ্চবটী), তা আজ বার্ষিক কৃত্যে পরিণত। তারিখটা ছিল পঁচিশে বৈশাখ। কবির জন্মদিন। আর এখন তাঁর প্রয়াণদিনে পালিত হয় তা। ১৯২৬-এ ভুবনডাঙায় জলাশয় তৈরি করা হয়েছিল সেখানকার জলকষ্ট দূর করতে। সেবার ওইখানেই বৃক্ষ রোপিত হয়। ১৯৩৮-এ শ্রদ্ধেয় রাধাকৃষ্ণনের উপস্থিতিতে তা পালিত হয়। ১৯৪০, শেষবার পালিত হয়, তাঁর জন্মকালীন। কবি লেখেন বর্ষা নিয়ে তাঁর শেষতম সঙ্গীত, ‘এসো শ্যামছায়াঘন দিন’!