ঘাসফুল নদী থেকে প্রকাশিত ‘বালকেরা অচেনা থাকে’ গল্পগ্রন্থটি যতই এগোনো হয়, একটা অনুতাপ ভর করতে থাকে পাঠকের মনে— কেন আগে সন্ধান পায়নি এই অমূল্য রত্নসম্ভারের! হ্যাঁ, রত্নসম্ভারই, কারণ একটা-দুটো নয়, প্রায় দশটি রত্ন, তাও নানা জাতের— লুকিয়ে ছিল গল্পগ্রন্থটির অনাবিষ্কৃত খনিতে। গল্পগুলো শিহরণ সৃষ্টিতে যেন পাল্লা দেয়, এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়। চিন্তার অতলে ডুব দিয়ে এমন সব ছবি আঁকে, যার দিগন্ত যতই পাঠক ভাবনার রাজ্যে দৌড়ুতে থাকে আরও সম্প্রসারিত হতে শুরু করে। লেখক মাসউদুল হক গল্পের মোচড়ে এমন সব আপ্তবাণী রেখে যান, পাঠক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। তার মনে হয়, পৃথিবীর সব রহস্য, জীবনের সব গূঢ় সত্য, খেলার যাবতীয় নীতি ও সূত্র তার সামনে এসে ধরা দিচ্ছে।
এ যেন এক আদিগন্ত ভ্রমণ। বেশিরভাগ গল্প উত্তম পুরুষে লেখা হয়েছে। এই গল্পগুলির কয়েকটিতে পাঠক আলবেয়ার কাম্যুর নির্লিপ্ততা খুঁজে পাবেন। কিছু গল্পে রয়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কঠিন ও নির্মোহ সমাজবাস্তবতা। সার্তের অস্তিত্ববাদী দর্শন নীরবে নিভৃতে খেলে গেছে অনেক গল্পের বুক চিরে! কিন্তু এসবই হয়েছে লেখকের স্বকীয় কলমে, যা আলো করে রেখেছে পাঠকের মন তার অপরূপ গল্প বলার স্টাইল, বিচিত্র ও অভিনব প্লট, ঝরঝরে ও নির্মেদ গদ্য, বিশ্বস্ত সংলাপ ও শক্তিশালী আখ্যানের শক্তিতে। কিছু গল্পের নামকরণ পাঠকের স্বাধীনতাকে কিছুটা হলেও ক্ষুন্ন করেছে বলে মনে হয়েছে। আর কতিপয় জায়গায় কিছুটা ধারাবাহিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। কিন্ত সবশেষে পাঠক লাভ করেছে এক অনির্বচনীয় ভ্রমণের আস্বাদ, নতুন দেশ দেখার এক অবর্ণনীয় আনন্দ, ও কঠিন সব অভিজ্ঞতায় জারিত হওয়ার অনুশীলন।
পোড়া মানুষ
কিছু গল্প হয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক, ব্যক্তির অন্তর্লোকে উঁকিঝুঁকি মেরে সৃষ্টি হয় একটি মহৎ আখ্যানের। আবার কিছু গল্প দেখতে চেষ্টা করে সমাজের বিস্তৃত ক্যানভাসে, সামষ্টিক যন্ত্রণাকে ধারণ করা হয় একটি ব্যাষ্টিক চিত্রে। ‘পোড়া মানুষ’ সেরকম একটি গল্প, যা ভাষার বর্ণনাগুণে জান্তব এবং বিশ্বস্ত চিত্রগ্রহণে হয়ে উঠেছে বিশ্বজনীন। পুরো গল্পটি পাঠ করে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে পাঠক ভাবে যে, শেষ কবে এমন একটি গল্প পাঠ করেছে, যা তাকে এতটা পুড়িয়েছে! ‘পোড়া মানুষ’ গল্পটি পাঠকের অভিজ্ঞতায় শুধু এই গ্রন্থেরই শ্রেষ্ঠ গল্প নয়, বাংলা সাহিত্য, এমনকি বিশ্বসাহিত্যেরও এক অমূল্য সম্পদ বলে প্রতীয়মাণ হয়।
গ্রামের এক প্রান্তিক কৃষক জহুর আলী, ফসলি জমির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে এক ভোরে; পা ডুবিয়ে পরখ করে— পানি নামল কত দূর। কিন্তু ‘পানি সরে গিয়ে যে জমির বুক ভেসে আসার কথা সেই বুকের ওপর এখনও হাঁটু পানি।’ আর ‘পানি নামার বিষয়ে কৃষকের যত তাড়া পানির ততো তাড়া নেই। বর্ষায় এসে জমিতে দাঁড়ানোর পর পানিকে এক ধরণের আলসেমি চেপে ধরে। পানি এমন ধীরে ধীরে এবং অনিচ্ছায় নামতে থাকে যেন পারলে এখানেই থেকে যায়।’ মাত্র দুই পুরুষ আগে ধান কাটতে এই অঞ্চলে এসে ‘আবাদি’ বা ‘অভিবাসী’-র তকমা লাগিয়ে বসত গাড়ে জহুরের দাদা, কারণ ‘পরিবার বড় হয়, সন্তানদের চাহিদা বাড়ে’ কিন্তু নিজের এলাকার ‘জমি আর বাড়ে না।’ কিন্তু অতীত নিয়ে পড়ে থাকার সুযোগ নেই, এমনকি তাদের ভবিষ্যৎও মাত্রই এক বছরের ফসলি ক্যালেন্ডারে সীমাবদ্ধ, এরপর কী হবে তার আগে বর্তমানটা কী করে পার করবে, তা নিয়েই তাদের সংগ্রাম! শীতের কুয়াশা পড়ার আগেই জমিটা তৈরি করা দরকার, কিন্তু পানি নামতে যে দেরি হচ্ছে। এ জায়গায় এসে এক অতলান্তিক দার্শনিক সত্যের মুখোমুখি হয় পাঠক জহুরের অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে, ‘পানি যে কোথায় যায় তা জহুরের মতো হাওরের কোন মানুষই জানে না। সাতফুট-আটফুট উচ্চতা নিয়ে যে পানি ছয় মাস দাঁড়িয়ে থাকে জমিতে, সেই পানি তো সূর্যের তাপে শুকোয় না।’
যদিও দেশি জাতের ধান দ্রুত পাকে আর তুলনামুলক বন্যার পানিতে বেশি টেকে, কিন্তু ফলন বেশি হয় উফশী ধানে, দেশি ধানের প্রায় দ্বিগুণ। তাই উফশীতে ঝুঁকে জহুরের মত প্রান্তিক কৃষক। কিন্তু ভাল ফলন হওয়ার পরেও গেল মৌসুমে লাভ করতে পারেনি, কারণ তার আগের বছর বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল পাকা ফসল, শুধু পানির নিচে ডুব দিয়ে যৎসামান্য বাঁচাতে পেরেছিল। সেই নিদানকালে দাদন নিতে হয়েছিল জহুরকে সংসার বাঁচিয়ে রাখতে। পরের বছর তাই ফসল উঠতে না উঠতেই প্রায় নামমাত্র মূল্যে জমিতে থাকা অবস্থাতেই বিক্রি করে দিতে হয়েছিল ফসল। এখন পর্যন্ত দাদনের ঋণ পুরো শোধ হয়নি, এদিকে নতুন উফশী ধানের জন্য বীজ ও সার কেনার অর্থও নেই হাতে; বাড়িতে যে ধান আছে তা থেকে কিছু বিক্রি করে সে বীজ ও সার কিনে নিতে পারে সত্যি; কিন্তু তাহলে আগামী বৈশাখে নতুন ধান আসার আগ পর্যন্ত কী করে বাঁচবে সংসারের এতগুলো প্রাণী! আমাদের সমাজে যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত শোষণ ও বঞ্চনার একটি মর্মভেদী চিত্র পেয়ে যায় এখানে পাঠক।
প্রত্যেকের জীবনে একটি অর্থনীতি থাকে, সে প্রান্তিক কৃষক জহুরেরও আছে। আর তার বাজেট ভাবনা দেশের অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনাবিদদের থেকে কম জটিল নয়। সেই ভাবনা মাথায় নিয়ে জহুর যখন বাড়ি ফিরে আসে, দেখতে পায় গোলায় রাখা চালের মজুদ হঠাৎ করেই কমে গেছে। স্ত্রী আফিয়া ‘ছেলেমেয়ে বড় হইছে, এহন কি আর আগের মাপে চলে’ বলে পার পেতে চাইলেও বড় মেয়ে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেয়— ছোট ভাইয়ের কান্নার মুখে দু’বার আধা বস্তা চাল দান করে দিয়েছে আফিয়া। এই সংবাদে রাগে কান দিয়ে আগুন বেরুতে থাকে জহুরের, ‘উঠোনে পড়ে থাকা এক টুকরা গাছের ডাল হাতে তুলে নিয়ে, স্ত্রীর চুলের মুঠো ধরে আঘাত করতে থাকে।’ পাঠক আবার সন্মুখীন হন এক নির্মম প্রান্তিক চালচিত্রের। শহরের আরামপ্রদ বিছানায় শুয়ে গল্পটি পড়তে পড়তে মুখোমুখি হন আর-এক পৃথিবীর, যার অবস্থান অন্য কোনও দেশ বা মহাদেশ নয়; শুধু শহর থেকে কয়েক কদম বাইরে!
এরপর যখন আফিয়া উঠোনে পা ছড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে অভিশাপ দিতে থাকেই নিজেরই কন্যা জরিনাকে, ‘তুই জামাই পাইবি না, পথে পথে বেশ্যা হইয়্যা ঘুরবি’, তখন জরিনা রান্নার কাজে হাত দেয়, মায়ের সত্য ফাঁস করে দেয়ায় তার কোনও অনুতাপ নেই। এদিকে তার অবর্তমানে কিশোরী মেয়ের সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার ঘটনা আফিয়াকে আরও ক্রুদ্ধ করে তুলে। আর জরিনাও যেন তা বুঝতে পেরে মায়ের জন্য একটা কাজ নির্ধারণ করে দেয়, ‘মজনুরে দুধ দেও, হের খিদা লাগছে।’ পাঠক এ জায়গায় এসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কঠিন জীবনবাস্তবতার মুখোমুখি হয়, যেখানে সাংসারিক স্নেহ-ভালবাসাকে ছাপিয়ে উঠে আসে মা-মেয়ের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। বিমল করের ‘আত্মজা’-র কথাও মনে পড়বে কোনও কোনও পাঠকের।
এদিকে জহুর আলী তার বাক্স বের করে দেখতে পায় মাত্রই হাজারখানেক টাকা জমানো আছে, বীজ ও সারের জন্য যা খুবই অপর্যাপ্ত। আর জমানো ধানেও তো হাত দেয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া, আগের বছরের মত দাদনে যাওয়ার ইচ্ছেও নেই তার। একমাত্র উপায় হিসেবে তার সামনে এসে দাঁড়ায় এনজিও ঋণ। কিন্তু এনজিওগুলো ‘লোনের টাকা পুরুষেরা ফেরত না দিলে ঘরের টিনে হাত দেয়, মামলা মোকদ্দমা করে ঝামেলায় ফেলে দেয়’; অন্যদিকে ‘মহিলাদের মানবিক আবেদন বেশি বলে তাদেরকে সহজে কিছু করে না।’ এই সমীকরণ থেকেই যখন জরুর আলী স্ত্রীকে ডাকে, ‘জরিনার মা, একটু এই ঘরে আয়’, তখন আফিয়া খুশি হয়ে স্বামীর আদর-সোহাগের আশায় শিশুপুত্র মজনুকে নিয়ে ঘরে ঢোকে, আর পাঠকের অভিজ্ঞতা হয় সম্পর্কের এক অদ্ভুত সমীকরণের! বেদম মারের পরেও এক প্রান্তিক নারী কী চাতকের মত চেয়ে থাকে স্বামীর আশ্রয়ের জন্য!
আশ্চর্য হল, এ স্থানেই আবার এনজিও কর্তৃক নারীর ক্ষমতায়নের কথাও নিয়ে আসা হয়। আসলে নারী ক্ষমতায়ন যে একটি সাইনবোর্ড বা কার্ডই শুধু, তার শিল্পীত পরিচয় ঘটিয়ে দেন লেখক এখানে পাঠককে। নারীর ক্ষমতায়নের চিত্রটি ভীষণ বিদ্রূপ করতে থাকে যখন আফিয়া জানায় যে সে তার ছোটভাই জয়নালের জন্য টিপসই দিয়ে ইতিমধ্যেই টাকা তুলেছে একটি এনজিও থেকে, আর জহুর আলী আফিয়াকে তার ভাই জয়নালের বাড়িতে রেখে আসে এই বলে যে, ‘তোর বইনরে দিয়া গেলাম, আমার চাউল আর এনজিওর লোনের টাকাসহ তোর বইনরে বাড়িত পাঠাইবি, নাইলে তালাক দিয়া দিমু।’
কিন্তু একজন মহৎ লেখক একটি চরিত্রকে শুধু একরৈখিক করে আঁকেন না, কারণ তাহলে তো আর মানুষগুলো আর মানুষ থাকে না, রোবটে রূপান্তরিত হয়। তাই পাঠক দেখতে পায়, বাড়ি ফিরে জহুরের মনখারাপ হয় স্ত্রীর জন্য, তার সহজ-সরল বউটা ভাইয়ের প্রতি অপত্য স্নেহ থেকেই ভুলটা করে ফেলেছে! এরই ঘণ্টাখানেক বাদে শ্যালক জয়নাল তার স্ত্রী আফিয়াকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকে দুলাভাই জহুরের পা চেপে ধরে, আর পরবর্তী ফসল ওঠার সাথে সাথেই ঋণ পরিশোধের অঙ্গীকার করে। জয়নাল যখন এক পর্যায়ে নিজের বউয়ের একজোড়া স্বর্ণের কানের দুল বন্ধক দেয়ার কথা বলে, তখন বাধা দিয়ে ওঠে জহুর আলী, ‘হুন, আমার থাকলে আমি কি দিতাম না। আমারই নাই, আমি কেমনে দেই।’ এরপর দুলজোড়া ফেরত দিয়ে শ্যালককে বিদায় জানায় সে। পারিবারিক স্নেহ-সম্পর্কের চিত্র এখানে বিশ্বস্ততার মোড়কে চূড়ান্ত উৎকর্ষ লাভ করে; পাঠকের অভিজ্ঞতা হয় এমন এক সিনেমা দেখার, যা বলে যে, পৃথিবীটা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে স্নেহভালবাসার জোরেই, সেই টলস্টয়ের নীতিগল্পকে অনুসরণ করে।
এরপর অর্থসংস্থানের উদ্দেশ্যে জহুর আলি ছোটবেলার বন্ধু খলিল মাস্টারের শরণাপন্ন হয়, যে পরামর্শ দেয় ব্যাংক লোনের, কারণ ‘দাদনের টাকা আর এনজিওর টাকা ফেরত দিতে হয়, কিন্তু ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিলেও চলে। …ব্যাংক সার্টিফিকেট মামলা করে, যদিও তা দুর্বল মামলা। আজ পর্যন্ত কেউ ঐ মামলায় জেলে গেছে এমন কোন খবরও সে পায়নি।’ পাঠকের এ জায়গায় এসে নিশ্চিত মিলিয়ে দেখবে দেশের বর্তমান ব্যাংক-চিত্রকে, ঋণখেলাপিদের খবরগুলোকে। কিন্তু প্রান্তিক কৃষক তো আর দিনেদুপুরে ব্যাংক ডাকাতি করা ঋণখেলাপিদের মত নয়, তাই সে ভয় পায়, আর সিদ্ধান্ত নেয় কোনও প্রকার ঋণই করবে না, বরং, পানি নেমে গেলেই গোয়ালের গাভীটা বাচ্চাসহ বিক্রি করে দেবে।
এক সপ্তাহের মধ্যেই পানি নেমে গেলে গরুকে গোসল করিয়ে বুধবারের রাজাবাজার হাটে তোলে জহুর আলী। কিন্তু ষোল হাজার টাকার গোরু মাত্র এগার হাজার টাকায় বেচে দিয়ে ধানের বীজ ও সার কিনে ফিরতে হয় তাকে। উত্তরাঞ্চলের মঙ্গার মত হাওরের এই শীতের শুরুর নিদানকালটা বাজার পায়নি; কিন্তু এই সময়ে অন্য সব কিছুর মত গোরুর দামও কমে যায় আর ব্যাপারিরা তার গন্ধে ভিড় জমায় হাটে। গোরু বিক্রি করতে কৃষকের যাতায়াত খরচটাও বাড়তি বোঝা হয়ে চাপে। তাই ব্যাপারিদের কাছে কৃষকগুলোকে নতিস্বীকার করতেই হয়! আর এভাবে পাঠকের পরিচিতি ঘটে গ্রামীণ অর্থনীতির আর-এক শোষণের সঙ্গে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার ট্রলারে চেপে জহুর তার মত আরও পরাজিত মানুষ দেখতে পায়; ‘বৈশাখের নতুন ফসল তোলার আগের কঠিন সময়টা পার করতে স্বল্প দামে কেউ বেচে গোরু, কেউ বেচে শ্রম, কেউ বেচে ইজ্জত, কেউ বা করে চুরি। যাদের সাহস বেশি তারা দল বেঁধে করে ডাকাতি।’
বাজার-ফেরত এই মানুষগুলো একসময় যখন ক্ষুধা চাপা দিতে সস্তা বিড়ি ধরায়, তখন বাতাস কেটে তরতর করা চলা নৌকায় বেচতে না পারা গোরুগুলো তাদের পাশেই গাদাগাদি করে অবস্থান নেয়। আর এ সময় এক অবিস্মরণীয় গদ্যের অভিজ্ঞতা হয় পাঠকের, ‘অন্ধকারে মানুষগুলোর চাহনি আর গবাদিপশুর চাহনি পার্থক্য করা যায় না। গবাদি পশুরা নির্বাক চোখে জাবর কাটে আর মানুষেরা নির্বাক মুখে বিড়ি টানতে থাকে। পেটে চেপে বসা ক্ষুধার সাথে লড়াই করতে যেয়ে লম্বা লম্বা টানে বিড়ি ফুঁকতে থাকা জহুরেরা জানে না যে, তারা বিড়ি নয় নিজেকেই পোড়াচ্ছে।’
তারপর শেষ হয়ে যায় পাঠকের পঠিত জীবনের এক শ্রেষ্ঠ গল্প ‘পোড়া মানুষ’। পাঠক অবাক হয়ে ভাবে, এই গল্পটি কেন আগে পড়েনি? কেন জানতে পারেনি আগে এর কথা? ২০০৮ সালে সুনামগঞ্জে রচিত, তার মানে, প্রায় পনের বছর! এক অপরাধবোধে ভোগে সে! তার মনে আরও প্রশ্ন উঁকি মারে— এই গল্পটি কি বাংলা সাহিত্যের সেরা গল্পের তালিকায় স্থান পেয়েছে? এটি কি দেশের কোনও টেক্সবুকে স্থান পেয়েছে? এটি কি অনূদিত হয়েছে বিশ্বের অন্য কোনও ভাষায়! এভাবে অনেকক্ষণ ঘোরের মধ্যেই কেটে যায় পাঠকের, সময়ের হিসেব হারিয়ে ফেলে সে!
দারিদ্র্য রেখা ধরে ঝুলে থাকা প্রেম
‘একটা সময় ছিল যখন ওরাও স্বপ্নের ফানুস উড়াতো। …তবুও আজ সবকিছু যেভাবে ঘটে যাচ্ছে তা কল্পনাকে পিষ্ট করা বাস্তবতার গাড়ির কঠিন চাকা ছাড়া আর কিছুর সাথে তুলনীয় নয়।’ এই হচ্ছে পুরো গল্পটির সারাংশ, যা গল্পের প্রথম প্যারাতেই রয়েছে, কিন্তু তাও পাঠককে পুরো গল্পটি পড়ে নিতে হয়, কারণ তা না হলে যে গল্পগ্রন্থটির অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পটি পাঠের স্বাদ থেকেই তাকে বঞ্চিত হয়! একটি সাধারণ ঘটনাকে কত সুন্দর করে উপস্থাপন করা যায়, তাকে খুঁড়ে খুঁড়ে কী করে আরও সব জীবনসত্য বের করে আনা যায়, তার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ এই গল্পটি। এই গল্পে কিছু সাধারণ বিষয়কে ভিত্তিপ্রস্তর করে কিছু অসাধারণ সত্যকে আলোয় নিয়ে আসতে চেয়েছে, আর এই পথে তার সন্ধান মিলেছে অনেক অনেক বাঁকের, যা শুধু বিশ্বস্ততাকেই উচ্চকিত করেছে। একমাত্র অভিযোগ নামকরণ নিয়ে, যা আর-একটু ভিন্নরকম ও সংকেতবাহী হয়ে পাঠককে স্বাধীনতা দিতে পারত ভাবনার!
সকাল এগারোটায় ফকিরেরপুলের ইউসুফ কাজীর কাছে হাজির হয় লোকমান ও হাবিবা, সঙ্গে হাজির থাকে দুজন বন্ধু ও এক বন্ধুপত্নী। বর-কনে স্বেচ্ছায় এসেছিল, কিন্তু কাজী সাহেব যখন হাবীবাকে প্রশ্ন করেছে সে রাজি কিনা বিবাহে, মেয়েটি তখন ‘ঘরের কোণে মাকড়সার জালে আটকা পড়া একটা ছোট পোকার নড়াচড়া পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত।’ এরপর কবুল, বিরানি, ধনিয়া, টুথপিক ইত্যাদি সব আবশ্যিক পর্ব শেষে নেভি চলে আসে, আর ‘লোকমান বাবুল, জয়নাল তিনজনে তামাক পোড়ানো ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকাতে পাকাতে ভবিষ্যতের মত ঝাপসা করে তুলে টেবিলের মানুষগুলোকে।’ এরকম অনবদ্য চিত্রকল্পের সাথে পাঠক পরিচিত হয় গল্পের শিরা-উপশিরা পাড়ি দিতে গিয়ে। এরপর যখন বর লোকমান বিল দিতে হাত বাড়ায়, তা দেখে বন্ধু ‘জয়নাল, বাবুল উদাসী হয়ে যায়। তারা টেবিলের কাঠ, ঘড়ির কাঁটা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত হয়ে উঠে’ আর পাঠক বিস্মিত হয় লেখকের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দেখে, একটি দৃশ্য ও ঘটনার কী ডিটেইল অঙ্কন!
এরপর ওয়েটারকে বখশিশ থেকে বঞ্চিত করতে কসরৎ করতে দেখা যায় লোকমানকে; কারণ তাকে ‘কেউ বখশিশ দেয় না, আসলটা উসুলেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়’। অন্যদিকে, যখন অতিথিদের বিদায় দিয়ে লোকমান রিকশা করতে যায়, তখন দেখে যে ৮ টাকার ভাড়া ১২ টাকা চাওয়া হয়, আর টেম্পু খোঁজ করতে শুরু করে হাবীবা। নতুন বিবাহিত দম্পতি এভাবেই টেনশনে বিদ্ধ হতে থাকে এই গল্পের ঘড়ি কাঁটার ছেদবিন্দুগুলোতে! একসময় একটি রিকশা পেয়ে যায় তারা যাতে উঠেই লোকমানের উক্তি— ‘যেই গরম, হুডটা উডাই দেই’। যখন তারা চাপাচাপি করে বসে তখন ‘লোকমানের ভাল লাগে নিজের স্ত্রীর শরীরের উত্তাপ কিন্তু হাবীবার লোকমানের ঘামের গন্ধে বমি বমি ভাব আসে।’ এক নবদম্পতির এরকম দৃশ্যের সাথে পাঠক মোটেও পরিচিত না, আর এখানেই গল্পটার আলাদা মাহাত্ম্য। সেই মাহাত্ম্যের সন্ধান পেতে এরপর পাঠককে পড়তে হয় বাকি গল্পটা।
তাদের পরিচয় হয় একই অফিসে কাজ করার সুবাদে। তিন বছর আগে হাবীবা যখন কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে যোগ দেয়, তখন চল্লিশের কোঠা ছুঁই ছুঁই করতে থাকা লোকমান অফিস সহকারী হিসেবে ওই অফিসেই কাজ করত। সংসারের প্রয়োজনে নিজের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দেয়া লোকমানকে সেই সময় কেউ বিয়ের কথা বললে সে শুধু গম্ভীর হয়ে বলত, ‘আরেকটু গুছাই লই।’ দুজনেই অবিবাহিত হওয়ায় তাদের নিয়ে গল্প ফেঁদে অবসর কাটানোর প্রবণতা দেখা দেয় অফিসে। কিন্তু ‘বিয়ের শেয়ার মার্কেটে চাকরি পাওয়া মেয়ের মূল্যসূচক যে ঊর্ধ্বগামী’— এ বিষয়ে গভীর সচেতন হাবীবা লোকমানকে তার স্বপ্নের পুরুষ হিসেবে কল্পনা পর্যন্ত করতে পারেনি, তা ‘সৃষ্টিকর্তা ফর্সা চামড়া না দিক, দাঁতটা একটু উঁচু হোক’ না কেন! কিন্তু যে বোনের বাসায় তার ঠাঁই মিলেছিল সেই বোনের স্বামী এক রাতে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে, আর পরে দরজা বন্ধ করে শুয়েও যখন রেহাই মেলে না, তখন বোনের আকুতির মুখে সেই ঘর ছাড়ার চিন্তা হাবীবার মাথায় আসে; একই সাথে লোকমানও একটু একটু করে স্থান পেতে শুরু করে তার চেতনে।
এদিকে লোকমান সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক কোনায় বসে কাজ করেই যায়। কিন্তু বন্ধু বাবুলের ‘ও লোকমান ভাই, সারাদিন এত শব্দ হয় তোমার আশে পাশে একটু খেয়াল কর না কেন?’ চিৎকারে সে হাবীবার দিকে চোখ তুলে তাকায় বটে, কিন্তু পরক্ষণেই লজ্জায় সরিয়ে নেয়। ওদিকে সত্যি যে, হাবীবার কম্পিউটার টেপা হাত হঠাৎ থেমে গেলে সে বিরক্তির ভঙ্গি করে আরও দ্রুত শব্দ করে টাইপ করতে থাকে; কিন্তু তার কেমন একটা মায়া মায়া ভাব হয় লোকমানের জন্য। পরে অফিস পিকনিকে পাশের সিটে আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকা লোকমানের প্রতি সেই মায়ার পারদ আরও খানিক উঁচুতে ওঠে। লোকমান সিগারেট বের করে হাবীবার দিকে তাকিয়ে তা আবার প্যাকেটে ঢুকিয়ে ফেললে হাবীবার মনে হয়, অন্তত একটা মানুষ তাকে সম্মান করে। পরে যখন হাবীবা বলে, ‘লোকমান ভাই, সিগারেট খাওন ছাইড়া দেন’ তখন লোকমানেরও ভাল লাগে, ‘সে যে একটা মানুষ, নিকোটিনে ছাই হচ্ছে, কারো সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় হয়নি’ যে এতদিন!
পরের সপ্তাহে লোকমান বাবার হাঁপানির কষ্ট, মায়ের বাতের ব্যথা, ছোটবোনের বিয়ের যৌতুক ইত্যাদিকে সয়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত যখন বিয়ের কথা পেড়েই ফেলে পরিবারে, তখন মা বলে উঠেন, ‘বাজান, আর কয়টা দিন যাউক, আমি নিজে তোর লাইগা সুন্দরী মাইয়া ঠিক করুমু, তুই অন্তত বইনডারে বিয়া দিয়া লও।’ আর বাবা স্মরণ করিয়ে দেয় হাদিসের কথা, ‘পরিবার পোষণের ক্ষমতা না থাকলে গরম বালুর ওপর উপুড় হইয়া থাকতে হয়, তুব বিয়া করন মানা।’ হাবীবা এদিকে ছোট্ট বাসা, একসেট সোফা, একটি বারান্দার চিন্তায় মেঘের ডানায় চড়ে বেড়াচ্ছিল; কিন্তু বাড়ি-ফেরত লোকমানের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে সে মনে মনে বলে ‘কাপুরুষ’, আর এভাবে ধুলো জমে যায় বিয়ের ব্যাপারটায় তাদের দুজনেরই।
কিছুদিন পর আবার নতুন বাঁকের সন্ধান মেলে পাঠকের জন্য। অফিসে আরও কয়েকজনের সাথে লোকমান ও হাবীবারও বেতন বাড়ে। লোকমান নতুন স্বপ্ন দেখে, পরিবার পোষণ এখন আর কোনও সমস্যা না। কিন্তু হাবীবারও বেতন বেড়েছে, আর সঙ্গে বেড়েছে আত্মবিশ্বাস, আর হাতে এসেছে ঠিকাদারি ব্যবসার সাথে জড়িত এক ছেলের প্রস্তাব। হাবীবা জানে, ‘চাকরির সচ্ছলতা আর ব্যবসার সচ্ছলতা এক নয়।‘ কিন্তু পাত্রপক্ষ শুধুই সময় নিতে থাকে। এই অবস্থায় হাবীবা আবার লোকমানের দিকে ফিরতে চায়, কিন্তু লজ্জা আচ্ছন্ন করে ফেলে তাকে, সাড়া না পেয়ে লোকমান যে অভ্যস্ত জীবনে ফিরে গেছে। এভাবে মুহুর্মুহু টার্ন নিতে থাকে গল্পটি। আর পাঠকের জন্য রহস্য ও রোমাঞ্চের ডালি সরবারহ করে যেতে থাকে।
এরপর এক সময় বোন ও ভগ্নিপতি দুজনেই বাসা ছাড়ার নোটিশ দেয় হাবীবাকে। আর হাবীবাও ভীষণ শংকায় কেঁপে উঠতে থাকে— লোকমান যদি অন্যত্র বিয়ে ঠিক করে ফেলে! এই সময়টা ‘যতটা সময় পারা যায় অফিসে কাটাতে চায় হাবীবা, কিন্তু রাত নামলেই অশান্তি চেপে ধরে।’ তাই একদিন বাধ্য হয়ে লোকমানের টেবিলের সামনে দাঁড়ায় সে; আর চুল কমে যাওয়া মাথাটা লোকমান ফাইল থেকে তুললেই ফুঁপিয়ে উঠে হাবীবা, ‘লোকমান ভাই, আমারে বাঁচান।’
পাঠককে গল্পটুকু জানার সুযোগ দিয়ে কড়কড় করে কাঠফাটা রোদে রিকশার হুডের নীচে পেছনের কথাগুলো এমনি করেই ভাবতে থাকে লোকমান ও হাবীবা। যদিও তারা একে অপরের ভাবনার জগৎকে জানে না, কিন্তু একই হুডের নীচে থেকে তারা একে অপরকে চেয়ে চেয়ে দেখে; আর এরই মাঝে যখন কেঁদে ফেলে হাবীবা, লোকমান বলে ওঠে, ‘তুমি কানলে, আমার মনডা খারাপ লাগে।’ আর হাবীবা লোকমানের কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দেয়। একই হুডের নীচে তাদের মধ্যে এমন এক বন্ধন গড়ে ওঠে যে, এখন আর লোকমানের ঘামের গন্ধটা খারাপ লাগে না হাবীবার, কারণ পুরনো ঘটনাগুলো তাদের এই বর্তমান অস্তিত্বের অমোঘ নিয়তিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে তাদের নিজেদের কাছেই।
এভাবেই শেষ হয় মধ্যবিত্তের এক নিপুণ আলেখ্য। এখানে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাস্তবতাকে অনুসরণ করেই আঁকা হয়েছে জীবনের এক অমোঘ পরিণতি। পারিবারিক স্নেহ-সম্পর্ককে দেখা হয়েছে নির্মোহ দৃষ্টিতে। ভালবাসার রসায়নকে আবেগে না বেঁধে গাথা হয়েছে কঠিন জীবন বাস্তবতার সুতোয়। তাই এ গল্পটি কখনওই ভোলা সম্ভব হয় না পাঠকের।
বালকেরা অচেনা থাকে
গল্পগ্রন্থটির শিরোনাম গল্প। নামটির ভিন্নধর্মিতা, না কি গল্পটির প্রতি লেখকের পক্ষপাত— কী কাজ করেছে গল্পগ্রন্থের শিরোনাম নির্ধারণের পেছনে, তা নিয়ে ভাবনায় ডুবে থেকে কাজ নেই পাঠকের; কারণ পাঠক তো ইত্যবসরে আর-একটি অতীব সুন্দর গল্পের স্বাদ নিয়ে নিতে পেরেছে।
গল্পের শুরুতেই একটি রাত চলে আসে। যখন ‘একজনের ঘুম না হওয়ার বিষয়টি অন্যজনকে জানানোর রেওয়াজ নেই, প্রত্যেকেই নিজের মতো করে প্রায় না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে রাতটা।’ বড়ভাই মারা যাওয়ার পর স্কুল দপ্তরি মোবারক যে ভাস্তে হানিফকে নিজের ছায়া দিয়ে বড় করেছে, জমি বেচে, টাকা কর্জ করে, স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে ঢাকা বা জেলা সদরে সময় ও পয়সা খরচ করে বিদেশ পাঠিয়েছে, সেই ‘বালক’-টিই বিয়ে হওয়ার পর বদলে গিয়েছে; কারণ ‘স্ত্রী বড় ঘরের মেয়ে, ভাই কোর্টের মুহুরি উপরন্তু এসএসসি পাস’, আর তাই হানিফ স্ত্রীর ধারণার কাছে আত্মসমর্পণ করে আর আকাশ ফুঁড়ে বের হতে থাকে চাচার প্রতারণা, শোষণ ও বঞ্চনার নানা গল্প— ‘কবে ভাতিজাদের অভুক্ত রেখে নিজের সন্তানদের দিয়ে মুরগি জবাই করে খেয়েছে, জমি মাপার সময় কি করে আমিনকে দিয়ে কৌশলে জমির আইল ভাতিজার জমির ভিতর চাপিয়ে দিয়েছে…’। কিন্তু নিজের ত্যাগের কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে বলতে যেয়ে নিজেকেই ছোট মনে হতে থাকে মোবারকের। আসলে ‘মোবারকের কৃত ত্যাগ সমাজের চোখে হানিফের অধিকার, আর মোবারকের কর্তব্য। পুরো ঘর বেড়া দিয়ে আটকে রাখাটা কেউ দেখে না, সবাই দেখে বেড়ার ফাঁক গলে ঢুকে পড়া আলোর তীব্রতা।’ তাই যেন সমাজের কাছেও মাপ নেই মোবারকের! সে কখনও ভাবেনি যে একদিন দায়িত্ব পালনে ‘অসামর্থ্যের ছেঁড়া অংশটুকু ঢাকতে… পালন করা দায়িত্বের স্মৃতির সুতো জমিয়ে রাখতে হবে। আবার গলা উঁচিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করে যা বলা যায়, তা দিয়ে পনের বিশ বছর আগের ঘটনার সবটুকু বলা হয় না।’
একদিন একটি গাছ কাটা নিয়ে বিরোধ চরমে ওঠে; দুজনের সীমান্তেই গাছের অংশ পড়েছিল। চাচাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ছয় হাজার টাকা দিয়েও লাভ হয় না, তাকে না জিজ্ঞাসা করে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেয়া হল কেন, সেই প্রশ্ন করে বসে মোবারক; আর ভাতিজা বলে ওঠে, ‘আফনে কি এমুন লাড বাহাদুর অইয়্যা গেছেন যে আমনেরে জিগাইয়া গাছ কাডন লাগবো?’ হানিফের এই উত্তরে চাচা মোবারকের দীর্ঘদিনের পুষে রাখা ক্ষোভ ‘হঠাৎ ছিপি খোলা পানীয়ের মতো বের হয়ে আসে’ আর ‘বেইমান, নাফরমান’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে ভাতিজার ওপর। আত্মীয়স্বজনের বাধায় ঘটনা বেশিদূর না গড়ালেও হানিফের স্ত্রী তার ভাইয়ের সহায়তায় একে কোর্ট পর্যন্ত নিয়ে যায় এবং ডাক্তারের কাছ থেকে আঘাতের সনদ যোগাড় করে সমন জারি করিয়ে বাড়ি ফিরে ঘোষণা দেয় ‘শক্ত মামলা করছি।’
জেলাসদরে হাজিরার দিন ফজরের আযান ভেসে আসতেই স্বামীর আগেই বিছানা ছেড়ে উঠে মোবারকের স্ত্রী রাজিয়া রান্নাঘরে অবস্থান নেয়। স্বামী জামিন নিয়ে ফিরে আসতে পারবে কিনা, না এলে কতদিন পরে আসবে— সেই আশংকায় গরম ভাত চাপিয়ে দেয় উনুনে। এদিকে ‘মোবারক মোল্লা বছরের পর বছর ঘসা খেতে খেতে লালচে হয়ে যাওয়া মেলামাইনের থালার সাথে বসে… গরম ভাতের জন্য বৃষ্টিভেজা কাকের মতো অপেক্ষা করতে থাকে।’ কিন্তু পছন্দের টাকি মাছের ভর্তা, আর পালং শাক দিয়ে মাগুর মাছের সাথে ভাত খেতে খেতে মোবারক বলে ওঠে, ‘এমুন মজা কইরা রানছ মনে হয় আমার আইজ ফাঁসি, আমি আর খাইতে পারুম না।’ এরপর রাজিয়ার চেপে রাখা ভয়টা জল হয়ে গড়িয়ে পড়লে মাকে প্রবোধ দিতে গিয়ে মেয়েও কেঁদে ফেলে, আর ‘চোখের নোনা পানি ভাতের সাথে মিশে পেটে চলে গেলে মোবারক খাওয়া বন্ধ করে উঠে পড়ে।’ বলতে কী, এ জায়গাটা গল্পের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সংবেদনশীল অংশ; পাঠকও হয়ত ব্যর্থ হয় চোখের অশ্রু সংবরণ করতে— এতই জীবন্ত ও বিশ্বস্ত এই নির্মাণ!
এরপর যখন রাজিয়ার নফল নামাজ আর সোয়া লাখ জপার মানত বিফল করে খবর আসে মোবারকের হাজতবাসের, তখন আত্মীয়স্বজনের আহাজারি ও অভিশাপ চলাকালীন হানিফের বউ চাপকলে জোরে জোরে চাপ দেয়, আর হানিফ বাহরাইন থেকে শখ করে আনা রেডিওর ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে একটার পর একটা নব ঘোরাতে থাকে। কিন্তু এখানেই গল্পটা শেষ হয় না। ছোটবেলায় হানিফ বিলের মাঝ থেকে শাপলা তুলে আনার বায়না করলে মোবারক তাকে কাঁধে করে বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে পূরণ করেছিল ভাস্তের শখ। আজ এতদিন বাদে সেরকমই একটা স্বপ্ন দেখে হানিফ। যেমনটা তার শৈশবে ঘটেছিল, তেমনি তাকে কাঁধে চড়ানো লোকটা এক সময় ডুবে যেতে থাকলে সে চিৎকার করে ঘুমের ঘোরেই বলতে থাকে, ‘কাহা, আমারে ফালাইয়া যাইও না।’ স্বপ্নের মাঝেও ডুবন্ত লোকটিকে সে ঠিকই চিনতে পারে; কিন্তু কাঁধের ছেলেটিকে একদমই চিনতে ব্যর্থ হয় হানিফ। এভাবে বালকেরা কেন অচেনা থাকে তার একটি ইঙ্গিত রেখে গল্পটি শেষ হয়। সঙ্গে হানিফ চরিত্রকেও বিশিষ্ট করে তোলা হয়। তার আপাত একরৈখিক চরিত্রের মধ্যে নিয়ে আসা হয় সংবেদন ও মানবিকতার সংশ্লেষ!
আমাদের দেখা, আশেপাশে ঘটে যাওয়া জীবনের এত বিশ্বস্ত আলেখ্য খুব কমই পাওয়া যায়। এই চরিত্রগুলো কমবেশি আমাদের সবারই কিছুটা চেনা-জানা। আমরা সবাই দেখি আমাদের পাশের বাড়ির প্রতিপালিত ছেলে বা মেয়েটি কী করে প্রতিপালকের অবদানকে অস্বীকার করে; স্বার্থের ঘূর্ণিকাদায় কীভাবে পুরো ডুবে যায়! সেই চিত্র এত মায়া, এত মর্মস্পর্শী করে আঁকা হয় যে, পাঠকের পক্ষে একে ভোলা সম্ভব হয় না দীর্ঘদিন।
স্বাধীনতা
‘সেই প্রথম বুঝেছিলাম মানুষের চোখ কি করে হয় চুম্বক; আর আস্ত মানুষটা রূপান্তরিত হয় লৌহজাত পদার্থে। …সবার চোখ তো কথা বলে না; কিন্তু যার চোখ কথা বলে, সে বধির হলেও ক্ষতি কি?’ এরকম কিছু লিরিক দিয়ে শুরু হয়ে গল্পটি, আর পাঠককে নিজেই এক চুম্বক হয়ে টেনে নিয়ে যায় শেষ অবধি! নৈর্ব্যক্তিকতার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই গল্পটি বিশ্বসাহিত্যের আঙিনায় অবলীলায় পা ফেলতে সক্ষম! বুদ্ধদেব বসুর বিখ্যাত গল্প ‘রজনী হল উতলা’-র কথা হয়ত পাঠকের মনে পড়বে; কিন্তু ‘স্বাধীনতা’-র স্বকীয়তা ছত্রে ছত্রে— অভিনব প্লট ও অসাধারণ বিন্যাসের কথা ছেড়ে দিলেও।
ছোট্ট এই গল্পটি থেকে উদ্ধৃতি খুঁজে বের করতে গিয়ে পাঠক হয়রান হয়ে পড়বে। এক সময় তার মনে হবে পুরো গল্পটাই একটি উদ্ধৃতি, বা একটি ছন্দময় কবিতা! যেমন, ‘বিবাহ বার্ষিকীর সে অনুষ্ঠানে কোলাহল, জমকালো আয়োজন, রহমান বাবুর্চির রকমারি রান্না সব কিছুই আমার অনুভূতি থেকে পৃথক হয়ে গেল। সমগ্র আয়োজন হয়ে গেল ঘরের কোণে ঝুলে থাকা মাকড়সার জাল। আমার জন্য রইলাম শুধু আমি আর মিনি।’ একটি অনুষ্ঠানে একদিনের জন্য একটি মফস্বল শহরে আসা হয় গল্পের নায়কের; আর সেখানেই মিনিকে দেখা, আর তারপর তাকে অনুসরণ করে পরিচিত হওয়া। মিনি তখন তাকিয়েছিল নায়কের দিকে, আর তার ঠোঁটদুটো কেঁপে উঠেছিল— রিখটার স্কেলের ভগ্নাংশ পরিমাণ কম্পনে নায়ক জেনে যায় যে নায়িকা রেখে দিতে চায় তার ঠিকানা। কারণ সে নিশ্চয়ই চিনে নিয়েছিল এই ঘোরলাগা যুবককে, ‘পদ সঞ্চালন আর ঘোর লাগা মুখের দিকে তাকিয়ে লোকে যদি মাতালকে চিনে তবে রূপের মোহবিষ্টতা দেখে নারী কেন পুরুষকে বুঝবে না।’
এরপর মুদির দোকান থেকে পান মোড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হওয়া কাগজে ঠিকানাটা মিনির হাতে তুলে গল্পের নায়ক ঘরের অন্ধকার একটি কোণে সরীসৃপের মত গা ঢাকা দেয়। তারপর রাতে শরীরবৃত্তীয় রাসায়নিক হরমোনের প্রভাবে ঘুম উধাও হয়ে গেলে সে না দেখা ঘটনাগুলিকে নিজের মত করে ভাবতে থাকে, যার ফাঁকে পাঠকের জন্য বরাদ্দ হয় অনিন্দ্যসুন্দর এক গল্প— স্বপ্নের মত রোমাঞ্চকর, ও শিহরণসৃষ্টিকারী!
গল্পের নায়ক ভাবতে থাকে, মিনির কাছে অচিরেই উৎসব-বাড়ির ঝলমলে আলোকসজ্জা, শত যুবকের চোখের আহ্বান, বান্ধবীদের চটুল দুষ্টুমি অর্থহীন লাগতে শুরু করবে; এক সময় সে শরীর খারাপের ভান করে বাড়িতে চলে এসে বাতি নিভিয়ে দেবে। একে একে বাড়ির অন্য সব বাতি নিভে গেলে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে সে, যেখানে সে থাকবে শুধু মিনির সাথে। যে মিনি অপেক্ষা করেছে বিশটি বছর তার জন্য, সেই কাঁপতে থাকবে শরীরের উত্তাপে, নাড়ির অস্বাভাবিক স্পন্দনে। এক সময় মিনি বাতি জ্বালিয়ে চিঠি লিখতে বসবে, আর তখন ‘মিনির একাকিত্বকে ঘনীভূত করতে এতক্ষণ তার চারপাশে যে অন্ধকারেরা জমাট বেঁধেছিল বাতি জ্বালতেই আবার তারা ঢুকে পড়বে কাপড়ের ভাঁজে, খাটের নীচে, বইয়ের মলাটের মতো অভ্যস্ত আস্তানায়।’
গোপন এক কুঠুরি থেকে ভালবাসার মানুষকে লেখার জন্য বান্ধবীর উপহার দেয়া চিঠি লেখার নীল প্যাড আর একটি সুদৃশ্য কলম নিয়ে মিনি বসবে তার ছোট্ট পড়ার টেবিলে; কিন্তু তাতে স্থান পাওয়া পরীক্ষা পাসের মাল-মসলাগুলো আজ হয়ে যাবে ফেরিওয়ালার অর্থহীন কাগজের বোঝা। ‘বইখাতাগুলো হা করে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখবে পড়ুয়া ছাত্রীর তাদের প্রতি প্রবল অনীহা’; কারণ মিনি কচুরিপানার মত সেগুলোকে সরিয়ে লেখার জন্য জায়গা করে নেবে, আর তখন ‘প্যাডের প্রথম পৃষ্ঠা তরতর করে কাঁপতে থাকবে প্রথম কলমের আঁচড় নেবার জন্য। কলমের মুখটা খুলতেই বর্ণ হয়ে ঝরার জন্য ফুটন্ত পানির মত টগবগ করতে থাকবে লম্বা রিফিলে ঢুকানো বিদেশি কালি।’ চিত্রকল্পের সৌন্দর্যে বিমোহিত পাঠক অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই হোঁচট খাবে লোডশেডিংয়ের কারণে। কিন্তু ‘অন্ধকার… ঘরের সবটুকু জায়গায় ভূমি দস্যুদের মতো দখলদারিত্ব কায়েম করলেও টেবিলটার চারপাশে এসে থমকে’ যাবে; কারণ পূর্ণিমার চাঁদ এসে দাঁড়িয়েছে মিনির জানালায়! এরপর অনেক দিন আগে লাগানো কাঁঠালি চাঁপা গাছ থেকে ভেসে আসবে ফুলের বাসনা, যেন সেও অপেক্ষা করছিল এই মুহূর্তটির জন্য!
এরপর প্যাডের শেষ পাতায় এসে মিনি লিখতে পারবে সেই কথা, যার জন্য এতদিন অপেক্ষা করেছে। তার আগে ‘মোটা প্যাডটা পাতা হারাতে হারাতে রুগ্ন হয়ে যাবে, শীতের বৃক্ষের মতো। ময়লার ঝুড়িটা উপচে পড়বে ডিমওয়ালা ইলিশের পেটের মতো। তবু লেখা শেষ হতে চাইবে না।’ নিজের লেখাগুলি বারবার পড়ে এক সময় চিঠিটা ভাঁজ করে নীল খামে সাজিয়ে দেবে। তারপর গল্পের নায়কের দেয়া চিরকুটের সাথে মিলিয়ে খুব সতর্কভাবে ঠিকানাটা লিখবে যেন ডাকপিয়ন ফিরিয়ে দিতে না পারে। কিন্তু যখন ডাক বিভাগের মাসখানেক বিলম্বের কথা মনে পড়বে, হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাবে মিনির। কিন্তু ইচ্ছেপূরণের এই দিনে মিনির এক জোড়া ডানা গজিয়ে যাবে, আর সে উড়তে উড়তে নায়কের জানালায় এসে হাসতে থাকবে। তারপর নায়ক মিনির হাত ধরলে তারও ডানা বের হবে পিঠ ফুঁড়ে, আর ‘জানালার গ্রীলের ছোট্ট ফাঁক গলে ধোঁয়ার মতো বের হয়ে’ তারা চলে যাবে সকলের দৃষ্টিসীমার বাইরে, যেখানে ‘তারা থাকবে আরো কাছে, চাঁদ থাকবে …গা ঘেঁষে।’
গল্পের শেষে অবশ্য পাঠকের জন্য একটা চমক অপেক্ষা করে। গল্পের নায়ক-নায়িকা উড়তে উড়তে পৌঁছুবে তাজমহলের ছাদে, যেখানে সম্রাট শাজাহান বিরক্ত কণ্ঠে বলবেন, ‘তোমাদের জন্য কতদিন আগে তাজমহল বানালাম, আর তোমরা এতদিনে এলে।’ এতক্ষণ ধরে এক অসাধারণ নৈর্ব্যক্তিক প্রেমের ভ্রমণসঙ্গী হয়ে শেষটায় এসে পাঠক কিছুটা হোঁচট খাবে হয়তো; কারণ গল্পটির মূল শক্তি যে নৈর্ব্যক্তিকতা, তা ভীষণভাবে ভেঙে পড়ে সবার মুখে মুখে ফেরা তাজমহল ও শাজাহানের উপস্থিতিতে। এটুকু ছাড়া পুরো গল্পটায় অবশ্যই এক মাদকীয় ঘোরের মধ্যেই কাটিয়েছে পাঠক, পেয়েছে বিশ্বমানের একটি গল্পপাঠের আস্বাদ!
স্থির চিত্র
‘কলশিতে তোলা জলের মত জীবন হাতেম আলীর। স্রোত নেই, জোয়ার নেই, শুধু উত্তাপে উড়ে উড়ে শেষ হয়ে যাওয়াই নিয়তি। ধনীর কিংবা শোষকের উত্তাপ লাগে না, সমাজের বিরাজমান স্বাভাবিক উত্তাপই সেই জল শেষ করতে যথেষ্ট।’ মাসউদুল হকের ‘বালকেরা অচেনা থাকে’ গ্রন্থটির গল্পগুলো সেই স্বাভাবিক উত্তাপেরই স্থির চিত্র; এখানে প্রবল ভাঙন, মোচড়, শোরগোল বা আওয়াজ পাওয়া যাবে না। আর আমাদের সমাজগুলি তো এমনই নয়। নীরবে নিভৃতে ঘটনাগুলি ঘটে চলে, সেখানে মারদাঙ্গা হাঙ্গামা থাকে; কিন্তু অ্যাকশান মুভিতে যেমন দেখা যায়— মুহুর্মুহু বিস্ফোরণে কানে তালা লেগে যায়, এক দণ্ডও স্থির হওয়ার সুযোগ মেলে না দর্শকের, প্রবল এক উত্তেজনা আর ঘোরের মধ্যেই কেটে যায় সময়টা— জীবন তো সেরকম ক্ষণস্থায়ী কোনও চলচ্চিত্র নয়। জীবনকে আঁকতে চাই একটি স্বাভাবিক উত্তাপ, যা একটু একটু করে ফুটতে থাকে আর নিঃশেষিত করতে থাকে রূপ, রস, জল— জীবনেরই নিয়মে। লেখক মাসউদুল হক সেই উত্তাপেরই সন্ধান করেছেন তাঁর গল্পগুলোতে। আর এজন্যই এগুলো হয়ে উঠেছে চিরকালীন, নির্মাণ করেছে এমন সব চিত্র যার আবেদন বিশ্বজনীন।
‘স্থির চিত্র’ বইটির সবচেয়ে সার্থক নামকরণের একটি গল্প, যা শুরু হয়েছে ‘সব গরীবেরই একটা সচ্ছল ইতিহাস থাকে।’ এমন একটি মহাকাব্যিক লাইন দিয়ে। এই ইতিহাস ‘ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল ঘুরে সত্তরের দশকের শেষ ভাগে এসেও, উত্তরপুরুষের অপুষ্ট শরীরের পুষ্ট মুখে বেঁচে থাকে।’ কিন্তু গল্পের মূল চরিত্র হাতেম আলীর জীবনে এমন সচ্ছল ইতিহাস না থাকায় তার আর ‘সব কিছু ভাইগ্য’— এমন গল্পের গোলায় নাও ভাসানোর সুযোগ থাকে না। সন্তানেরা খেলাধুলো সারার পর ‘চুলো জ্বললে খাবারের জন্য ঘুরাঘুরি করে; না জ্বললে পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে’। বাচ্চারা বিবাদে লিপ্ত হলে হাতেমের স্ত্রী গাছের শক্ত ডাল নিয়ে হাজির হয়, তারপর মারের চোটে কোনও বাচ্চা বাড়ি ছেড়ে গেলে বিচলিত হতে দেখা যায় না তাকে; কারণ ‘সে জানে, মায়ার বন্ধন যত, তার চেয়ে বেশি পেটের বন্ধনে এ সংসারে আবদ্ধ তারা।’ বস্তুত, সন্তানদের মানুষ করা নিয়ে হাতেম বা তার স্ত্রীর আলাদা কোনও পরিকল্পনা নেই। যেন তারা সেভাবেই বড় হবে যেভাবে পৃথিবীর অন্য সব প্রাণী বড় হয় গায়ে-গতরে, যেভাবে উদ্ভিদ সম্প্রসারিত হতে থাকে আকাশের দিকে।
এই যে চিত্র নির্মাণ সমাজের, তা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। আবেগ-সাগরে মন্থন, নায়কোচিত মহানুভবতা আরোপ, ঘটনার ঘনঘটায় ইন্দ্রিয়ের অলিগলিতে আন্দোলন— প্রচলিত এই ফর্ম্যাটে অভ্যস্ত পাঠক অবাক হয়ে আবিষ্কার করে— রুক্ষ, খটখটে কিছু চরিত্র যা তাদের আশেপাশে দেখা চরিত্রের মতই, যাদের জীবন চলছে যেন বা শক্তির নিত্যতার সূত্র মেনে। পাঠক খুব চিনতে পারে এই চরিত্রগুলোকে, মেলাতে পারে নিজের অভিজ্ঞতার সাথে; কিন্তু এদেরও যে গল্প আছে, তা আবিষ্কার করে শুধু এ গল্পগুলোতেই এসে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা মাসউদুল হক এভাবে আমাদের নিজেদের গল্পই শোনাতে আসেন, চিনিয়ে দিতে চান নিজের সত্তাকে! এর একটি উদাহরণ এই লাইনটি— “উঠোনের কোনায় বসে কাঁথা সেলাইয়ে মায়ের দক্ষতা বংশানুক্রমিকভাবে ধারণের প্রচেষ্টারত কিশোরী কন্যা রানু, যৌবন সমাগত হওয়ায় সামাজিক ও শারীরিক ইঙ্গিত পাওয়ায় পুরুষ ডাকপিয়নের দৃষ্টির আড়ালে গিয়ে মায়ের পেছনে দাঁড়ায়।’ মূল গল্পে রানু বা তার এইভাবে দাঁড়ানোর কোনও ভূমিকা নেই তেমন। কিন্তু একটি পূর্ণ ছবি ফুটিয়ে তুলতে হয়ত তার প্রয়োজন ছিল, আর পাঠকের সৌভাগ্য যে, লেখকের বিশ্বস্ত ছবি নির্মাণের অদম্য প্রচেষ্টা পাঠককে কী ভীষণ জীবন-দর্শনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়!
হাতেম আলীর নিস্তরঙ্গ জীবনের উঠোনে একদিন এসে দাঁড়ায় এক ডাকপিয়ন, যার সাইকেল ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে অর্ধউলঙ্গ শিশুর দল। হাতেম আলী নামে একজনকে খুঁজছে যার ছেলে ঢাকা থেকে টাকা পাঠিয়েছে। কিন্তু হাতেমের তো এমন কেউ নেই যে ঢাকায় থাকে। হ্যাঁ, জয়নাল নামে একটা ছেলে ছিল, যে উত্তরপাড়ার হামিদ মিয়ার মেয়েকে একলা পেয়ে ধানখেতে অসামাজিক কাজের চেষ্টার অভিযোগে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। যদিও জয়নালের দাবি ছিল উভয়ের সম্মতিতেই ঘটনাটা ঘটেছে, কিন্তু লায়েক ছেলে বাবার কষ্ট লাঘবের পরিবর্তে বিপদ ডেকে আনায় তাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয় হাতেম আলী। সেই লোকটারই কিনা ডাকপিয়নের মুখে ‘তোমার নামে টেহা আইছে?’ এবং ‘তোমার কোন পোলাপাইন ডাহা থাহেনি?’ এই প্রশ্ন দুটো শুনে পুত্রের জন্য বুকটা হু হু করে ওঠে! আর দরজার আড়ালে থাকা হাতেমের স্ত্রী ‘ও আমার জানুরে, মা’রে ফালাইয়্যা কই গেলিরে’ বলে চিৎকার করতে করতে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসে। আর এভাবে মানিক-বাস্তবতা যেন পূর্ণতা পেয়ে যায়। পুত্রকে ত্যাজ্য করা আর তাকে আবার আপন করে নেয়া টাকার গন্ধে— এমন শুধু মহৎ সাহিত্যিকের বাস্তবের কালিতে মাখা কলমেই উঠে আসতে পারে।
পরে যখন আবিষ্কৃত হয়, ডাকপিয়ন খুঁজছে অন্য এক হাতেম আলীকে, তখন ‘হাতেমের স্ত্রী চুলায় ভাত চড়াতে যায়, রানু আবার উঠানের কোনায় কাপড়ে পট্টি দিতে বসে যায়। ডাকপিয়ন আসার পূর্বে দা দিয়ে গাছের যে জায়গায় আঘাতে ব্যস্ত ছিল, সে জায়গায় আবার আঘাত শুরু করে হাতেম আলী।’ জীবন আবার নিস্তরঙ্গ প্রবাহিনীর ন্যায় চলতে থাকে, উপর থেকে যাকে একটি স্থিরচিত্রের মতই মনে হয়। সত্যিকারের জীবন তো এরকমই, উপর থেকে একটি স্থিরচিত্রের মতই দেখতে সে! এতই কোমল আর শান্ত আর নিরুপদ্রব সে, কিছু মোচড় যদিও থাকে, কিন্তু তার জন্য চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে না! আর এমনই এক জীবনের চিত্র আমরা পাই জীবনশিল্পী মাসউদুল হকের গল্পের তুলিতে, যেখানে নাটবোল্টগুলো আপনাআপনি লাগে আর খোলে, কোনও জোর নেই যেখানে, নেই কোনও জবরদস্তির চেষ্টা! আর এখানেই ধরা গল্পটির শক্তি!
মৌরাজা
মফস্বলের একটি কলেজ। সেই এন সি সি কলেজের সভাপতি নিয়োগ নিয়ে কলেজের শিক্ষক, অভিভাবক, ছাত্র-ছাত্রী, পিয়ন, ঝাড়ুদার, আর কলেজ সংলগ্ন জমিতে ভাড়া দোকানের মালিক-কর্মচারী— সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। বাজার, চায়ের দোকান, নৌকার ঘাট হয়ে উঠে সরগরম। এই ডামাডোলে মূল কুশীলবের ভূমিকায় আছে তিনজন; একজন কলেজটির অধ্যাপক কাজি হাফিজ, দ্বিতীয়জন কলেজের প্রাক্তন ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ক্রীড়া সম্পাদক সাইদুর রহমান আর সাংগঠনিক সম্পাদক তকদির হোসেন।
এলাকার সাংসদ নিজে সভাপতি না হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিতে চেয়েছিল। কলেজটির অধ্যক্ষ তাকে সমর্থন করেছে। কিন্তু কাজী হাফিজ অধ্যক্ষকে বুঝিয়েছে যে আইনকানুন জানা ও বুঝা লোককে সভাপতি বানালে তাদের উভয়েরই সমস্যা হবে। বিগত সরকারের আমলে সহযোগী অধ্যাপক পদে প্রমোশানের জন্য বেসরকারি শিক্ষকের ইনডেক্স নাম্বারজনিত সমস্যার কারণে আবেদন করতে পারেনি কাজী হাফিজ; কিন্তু একেই রাজনৈতিক নিপীড়ন বলে দলীয় আনুগত্য পুরো আদায় করে নিয়েছে। আর এখন নিজের দল ক্ষমতায় আসার পর তার দায়িত্ব এত বেড়ে গেছে যে শিক্ষকতায় সময়ই দিতে পারছে না, এলাকার উন্নয়নে বেছে নিয়েছে ঠিকাদারি ব্যবসা ছোট ভাইয়ের মাধ্যমে।
ছাত্রনেতা সাইদুর কাজী হাফিজেরই ছাত্র; তাকে নিয়ে সাইদুর পূর্বতন অধ্যক্ষকে উৎখাত করেছে যখন তিনি ছাত্রদের নকল ও শিক্ষকদের ক্লাস অনুপস্থিতিকে কঠিন করে তুলেছিল। মফস্বল অঞ্চলে শিক্ষক-বধের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রটিই প্রয়োগ করা হয়েছিল— কলেজের তিন-চারজন ছাত্রীকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল। কাজী হাফিজ নিজে অধ্যক্ষের কক্ষে ঝোলানোর জন্য চাইনিজ তালা ও দেয়াল লিখনের উদ্দেশ্যে রং কিনে দিয়েছিল সাইদুরকে। কিন্তু অধ্যক্ষের বিদায়ের পরে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ উদযাপনের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সাইদুর ও কাজী হাফিজের মাঝে দূরত্ব এতটা বেড়ে যায় যে, নিজস্ব আলাপচারিতায় সাইদুর কাজী হাফিজকে ‘টাউট মাস্টার’ আর কাজী হাফিজ সাইদুরকে ‘গাঁজাখোর’ সম্বোধন করতে থাকে। এরই পরিণতিতে সাইদুর তার চাচা স্থানীয় ইউনিয়নের ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক আক্কাসকে প্রার্থী করে, যে কিনা চোরাকারবারির খেতাব থেকে বের হতে ভাতিজার পরামর্শে রাজনীতির সাথে যুক্ত হয় আট দশ বছর আগে।
সাইদুর ও কাজী হাফিজের দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে কলেজ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসে তকদির হোসেন, যে সভাপতির বাজার-সদাই করে উপজেলা সদরের এক স্কুলের শরীরচর্চার শিক্ষক পদটি লাভ করতে সক্ষম হলেও ছাত্রীদের শরীরের বিশেষ জায়গায় হাত দিতে গিয়ে চাকরি হারায় এবং পরে জমির দালালি করতে গিয়ে একটি বিরোধে ডান হাতের কব্জি হারায়। কিন্তু এদুটি ঘটনাকে উপজীব্য করেই তকদির হোসেন রাজনৈতিক নির্যাতনের ধোঁয়া তুলে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে ব্যাপক সহানুভূতি পায় এবং এন সি সি কলেজের সভাপতি পদের জন্য শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হয়।
কলেজ সংসদে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার এই ত্রিবিধ লড়াইয়ে কাজী হাফিজ রেখে দেয় নিজের হাতে শক্তিশালী দুটি গুটি। সে বোর্ড ক্লার্কদের ঘুষ দিয়ে আইনগত জটিলতা তৈরি করে শিক্ষক নিয়োগ স্থগিত করে দিয়েছে বছর দুয়েক আগে। এদিকে কলেজের সামনের মার্কেটের লিজের মেয়াদ শেষ হলেও এক বন্ধুকে দিয়ে মামলা করিয়ে নতুন লিজচুক্তির ওপর ইনজাংশন করিয়ে রেখেছে। এক পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ ও দোকান লিজ বাণিজ্যের ভাগ দিয়ে সে অন্য দুই ক্যান্ডিডেটের সাথে এক সমঝোতায় উপনীত হয় যে তাদের মধ্যে কেউই আর সভাপতি হচ্ছে না। অনেক আলোচনা শেষে তারা এলাকার প্রবীণতম শিক্ষক আখলাক মাস্টারকে সভাপতির পদে বসাতে সক্ষম হয়। আর মাস্টারের সাবেক ছাত্র কাজী হাফিজ তাকে রাজি করানোর দায়িত্ব নেয়।
এরপর আসে গল্পের অন্তিম পর্ব। যখন কাজী হাফিজ প্রস্তাবটি তুলে ধরে তার কাছে, আখলাক মাস্টার তখন হেলেপড়া সূর্য দেখছিলেন। প্রস্তাব শুনে বিস্ময়ে বৃদ্ধের ভাঁজপড়া মুখের ভাঁজ আরও বেড়ে যায়, বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘শিক্ষকতা ছাড়লাম পনের বছর, তোরা কতজন কত কিছু হইলি, কই আমারে তো ডাকলি না? আইজ এত বছর পর যখন চোহে দেহি না, কানে হুনি না, লাডি ছাড়া আটতাম পারি না, তখন আমারে কলেজের সভাপতি বানাইতে ডাকছস্!’ এরপর একটা পুরনো কথা মনে করার প্রাণান্ত চেষ্টায় বৃদ্ধের মুখে এক সময় হাসি ফুটে ওঠে, আর বলে ওঠে, ‘তোরে এতক্ষণে চিনছি! ….আমার ভবিষ্যৎ বাণী মিথ্যা হয় নাই… তুই মানুষ হস্ নাই!’
এরপর আখলাক মাস্টারের সীমানা থেকে কাজী হাফিজের বিদায়ের মাধ্যমে গল্পটিরও বিদায় টানা হয়। কিন্তু পাঠকদের মনে তার বিদায় হয় না। যে সমাজচিত্র লেখক এই গল্পে তুলে ধরেছেন তা যেন পুরো বাংলাদেশকেই প্রতিনিধিত্ব করছে; এন সি সি কলেজের ছাত্র সংসদ বাংলাদেশের জাতীয় রাজনৈতিক ময়দানেরই যেন একটি মাইক্রো ফুটেজ, যেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত লোভী ও অসৎ একদল মানুষ। আর সেই কাজে তাদের মাঝে মাঝে দরকার পড়ে যায় কিছু সৎ লোক, যারা কিনা তাদের চোখে অথর্ব!
বক্ষ্যমান গল্পগ্রন্থে ব্যক্তিজীবনের ওউপর আলো ফেলার পাশাপাশি কিছু গল্পে বৃহত্তর সমাজের ওপরও আলো ফেলা হয়েছে। ‘মৌরাজা’ গল্পটি সেই ধারারই একটি গল্প যাতে উত্তম পুরুষের ব্যবহার হয়নি অন্য গল্পগুলোর মত। গল্পটির মাঝে মাঝেই রসের অবতারণা করা হয়েছে; যেমন: ‘শিক্ষার অভাব এই দেশে থাকতে পারে, কিন্তু শিক্ষানুরাগীর অভাব নেই। বাংলাদেশে সবাই কম বেশি শিক্ষানুরাগী।/ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে ব্যক্তিগতভাবে নিগ্রহের দু-চারটা বাস্তবভিত্তিক উদাহরণ না থাকলে চলে না।’ পুরো গল্পে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ওপর এমন কথার চাবুক প্রচুর। চরিত্রগুলোর বর্ণনা এত মনোরম যে গল্পটিকে কোথাও ক্লান্ত হতে দেয় না। সব মিলিয়ে এই গল্পগ্রন্থের একটি সেরা গল্প পাঠের আস্বাদ লাভ করে পাঠক। শুধু বর্ণনাগুলোর সাজানোয় একটু কমতি আছে বলে মনে হতে পারে পাঠকের কাছে। এ ছাড়া আর সব দিকে দিয়েই পূর্ণ গল্পটি।
বন্ধুত্বের শ্রেণীদ্বন্দ্ব
শুধু শিরোনামটা নিয়েই পাঠকের কিঞ্চিৎ অভিযোগ উঠতে পারে— কেন এত সরাসরি একটা নাম দেয়া হবে যে, পাঠকের ভাবনার স্বাধীনতাটুকু হারিয়ে যাবে। না হলে একটি ছোট্ট পরিসরে এত বাঁক, মনোজগতের এত গভীরে নোঙ্গর ফেলা, সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্বের এমন জান্তব বর্ণনা… গল্পটিকে বিশ্বস্তরে উত্তীর্ণ করে নিঃসন্দেহে! একজন পাঠক এই গল্প পড়বে আর নীচের লাইনটিকে চিহ্নিত করবে না, আর তার উদ্ধৃতির খাতায় তুলে দেবে না তা হতেই পারে না—
‘আমি আমার ছোট্ট জীবনে এত অল্প সময়ে এত রকমারী অনুভূতির সন্মুখীন কখনো হইনি। হিংসা, বিদ্বেষ, পাপ, অনুতাপের চক্রাকার আবর্তন আমাকে ভারসাম্যহীন করে তুলেছে।’
গল্পটির এমন সব জায়গা পাঠককে ফিউদর দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। অস্তিত্ববাদের এক ঘোর সংকেত যেমন লেখকের অন্য গল্পগুলোতে পাই, এ গল্পটিও তার ব্যতিক্রম নয়। গল্পের উত্তম পুরুষ তার বন্ধু রাজীবকে গল্পের প্রথমদিকে যখন বলে, ‘তুমি শালা সেঞ্চুরি মারার টাইম পাও না, মারলে কয় দিন আগে মারতা, আমার পিছে ক্যান?’ তখন তার চরিত্রের স্বরূপটি পাঠকের সামনে প্রতিভাত হয়। সে রাজীবের ভাল কিছু চায় অবশ্যই; কিন্তু তাকে ছাপিয়ে নয়। তাই আন্তঃবিভাগ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ বক্তা হয়েও উপভোগ করতে ব্যর্থ হয় সে; কেননা নবীন বক্তা রাজীব মাত্র দুই ঘণ্টার প্রস্ততিতে তার মত প্রতিষ্ঠিত বক্তাকে ‘প্রায় হারিয়ে’ দিয়েছিল! এর পেছনে ছিল এক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা, বন্ধু হলেও রাজীব গল্পের উত্তম পুরুষকে ‘গুরু’ সম্বোধন করত। গল্পের ভাষায়, ‘অন্যদের সম্বোধনে যেমন একটি হেঁয়ালি ভাব থাকত, রাজীবের সম্বোধনে তেমনটা ছিল না। ওর সম্বোধনই বলে দিত, ও আমার শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করে।’
কিন্তু সেই রাজীব যখন চাকরিজীবনে প্রবেশের পর উত্তম পুরুষের কর্মস্থল ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলে আর একদিন তার ফিয়াসেঁ তাহমিনার সাথে রমনা রেস্টুরেন্টে চলে যায়, তখন উত্তম পুরুষের মধ্যে অনুভূতি হয় ‘যেন এক নিরীহ প্রজা, একে একে …পুরো জমিদারি গ্রাস করে নিচ্ছে।’ আর তাই রাজীব যখন রাস্তা পার হতে থাকে, উত্তম পুরুষ ‘ইচ্ছেকৃতভাবে এবং ঠান্ডা মাথায় ওর মনোসংযোগে বিঘ্ন ঘটিয়ে, বাসের চাকায় রাজীবকে পিষ্ট করার বাসনায় চিৎকার করে’ ডাকে। কিন্তু এরপরেই আবার বাঁকবদল করে গল্পটি— রাজীবকে গাড়িটা আঘাত করতেই উত্তম পুরুষের ‘ভেতরের আদিম মানুষটা দৌড়ে পালাতে থাকে কোন অজানা গুহায়।’
এই অবস্থায় রাজীবকে হাসপাতালে নিয়ে যায় উত্তম পুরুষ। কিন্তু রাজীবের রক্তে কাপড় ভেজা থাকা অবস্থাতেই সে এমন কাউকে খুঁজতে থাকে যার কাছে টাকা চাইলে খবরটা পৌঁছে যাবে তাহমিনার কাছে; আর প্রমাণিত হবে সে কত বড় হৃদয়ের মানুষ। এখানে পাঠক মুখোমুখি হয় নতুন এক বাঁকের। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, যখন রাজীবের পিতা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বাবা, আজকালকার যুগে তোমার মতো বন্ধু খুঁজে পাওয়া কঠিন।’, তখন গল্পের নৌকোয় চড়তে চড়তে পাঠক মুখোমুখি সবচেয়ে বড় বাঁকের। এ সেই সময় যখন উত্তম পুরুষের নিজেকে কীটেরও অধম মনে হয়, আর হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে শাহবাগের অন্ধকার রাস্তায় প্রার্থনা করতে থাকে ‘আল্লাহ, তুমি আমার বন্ধুকে বাঁচাও।’ সেই সময় তাহমিনার বার্তা ‘ডোন্ট মিস্আন্ডারস্ট্যান্ড মি, রাজীব ওয়াজ মাই ফ্রেন্ড ওনলি’ কোনও স্বস্তি যোগায় না, প্রেয়সীর ফিরে আসার সংবাদকে ছাপিয়ে যায় বন্ধুর অঘটনের শংকা। উত্তম পুরুষ ছুটে যেতে থাকে হাসপাতালে কাঁদতে কাঁদতে, আর সেখানেই গল্পটি শেষ হয় একগাদা প্রশ্ন রেখে পাঠকের জন্য।
গল্পটির এক জায়গায় আছে, ‘মজার বিষয় হলো, যে সমালোচনাটি আমি মনে মনে করতে চাইতাম, রাজীব নিজেই অকপটে তা স্বীকার করে নিতো। অতএব রাজীবের সমালোচনা করেও সুখ পাওয়া যেত না।’ গল্পের পুরো শরীর জুড়েই এমনি সব বৈপরীত্য, আর মুহুর্মুহু বাঁকবদল আর সেরকমই এক বিশাল উন্মুক্ত এক বাঁকের মুখে রেখেই গল্পটির বিদায়। আসলে আমাদের জীবন তো এমনই; মুহূর্তের তরেও সে একরৈখিক না হয়ত! গল্পটি একটি বিশেষ ঘটনার সূত্রপাত করে কিছু মানুষের মনস্তত্ত্বে মৃদু টোকা দিয়ে জীবনের এই অন্তর্লীন চরিত্রকেই যেন ধরতে চেয়েছে।
কোকিল জীবন
গল্পটি শুরু হয় আলেয়া বেগম নামে একজন মধ্যবয়সী নারীকে দিয়ে, যে কিনা দুপুরে ভাত খাওয়ার পর ঘণ্টা দুয়েক ঘুমোয়, আর ঘণ্টাখানেক সন্ধ্যার অন্ধকারে চোখ বন্ধ করে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকে। এই তিন ঘণ্টা আলেয়া বেগমের একদম নিজস্ব সেই জগৎ, যা কিনা ত্রিশ বছরের সংসারজীবনে কমতে কমতে এতটুকুনে এসে দাঁড়িয়েছে! গল্পের গোড়ার দিকে দেখা যায়, আলেয়া বেগম মেয়ে লীনাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়; কারণ সে সরকারি কোম্পানির পরিবর্তে বেসরকারি কোম্পানিতে রসায়নবিদ পদে যোগ দিয়েছে। বদনাম আর সামাজিক মর্যাদা নিয়ে সদাসতর্ক আলেয়া বেগম ‘নিজের ভেতর ধারণ করা ধ্বংসস্তূপ থেকে সন্তানদের ঠেলে বের’ করাকেই যেন জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছে।
কিন্তু কেন এই ব্রত? ময়মনসিংহ শহরের ধনী পাটের আড়তদারের মেয়ে আলেয়া কুমারী অবস্থাতেই ঢাকা শহরে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ছেলে কিসলুর সন্তান পেটে ধারণ করে। পরে কিসলুর পরিবারের প্রত্যাখানের মুখে ভ্রুণটিকে পৃথিবীর মুখ দেখানো আর সম্ভব হয় না। তখন মামার বাড়িতে পোষ্য হিসেবে বেড়ে ওঠা আবু তাহেরের সামনে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় চলে আসে, কারণ ‘পৃথিবীর যে একটা মানুষের প্রতি সে দুর্বল; সেই একটা মানুষই আজ তার করুণা ভিক্ষা করছে।’ কিন্তু আবু তাহের তো আলেয়ার কাছে শুধুই ছিল এক ‘গায়েপড়া ধরণের ফুফাতো ভাই।’ আর ‘ভাই সত্ত্বাটি যে অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র হাতিয়ার এ কথা যেন প্রকৃতি তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।’ তবু ‘আলেয়ার স্খলন এবং আবু তাহেরের দায়বদ্ধতা’— তাদের উভয়ের ‘মধ্যে বিদ্যমান অযুত-নিযুত পরিমাণ দূরত্বকে কমিয়ে নিয়ে আসে সমান্তরাল রেখায়।’
আলেয়া বেগম বিয়ের দিন আত্মহত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল বটে। তবে এই হুমকিটা জারি রেখেছিল বিয়ের পরেও। আর বাবা ভাগ্নের সাথে মেয়েকে বিয়ে দেবার প্রায়শ্চিত্ত করতে চল্লিশ বিঘা জমি আর বাজারের দু’টি দোকান মেয়েকে লিখে দেয়। আর এগুলো সামলানোই হয়ে দাঁড়ায় আবু তাহেরের একমাত্র কাজ; কারণ ‘সংসারে তার ভূমিকা ময়মনসিংহ শহরয়ের মতোই রয়ে গেছে। দুর্বল ব্যক্তিত্বের কারণে আলেয়া বেগমের স্বামী না হয়ে হয়েছেন সহযোগী।’ অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার কারণে আলেয়া বেগমের নিজেকে নিয়ে সচেতনতা যে কারও থেকে বেশি ছিল; তার যেন কেবলই মনে হত, ‘এই পৃথিবীতে তার আপন বলে কেউ নেই।’ এই যে কিছু না পাওয়া থেকে সব কিছু পাওয়ার দিকে তীব্র ঝোঁক, এই চরিত্রটি লেখক খুব ভাল করে ফুটিয়েছেন আলেয়া বেগমের চরিত্রের মাঝে। এজন্য মেজছেলে রায়হান রংপুর মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেলেও খুশি হতে পারে না আলেয়া বেগম। কিন্তু ছোটছেলে সায়েম বুয়েটের অ্যাডমিশান টেস্টে টিকে গেলে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখা যায় তাকে, ‘কি যে শান্তি, তোমাকে বুঝাতে পারব না।’
আনন্দের কারণটি পরিবারের সকলের কাছে দৃশ্যমান হলেও শান্তির ব্যাখ্যাটি তো শুধু আবু তাহেরেরই জানা। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কিসলুর সাথে ঘর বাঁধার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার সবকিছু কেড়ে নিয়েছিল একদিন। আজ তারই ছেলে আরও উঁচু দরের ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পাওয়ায় আলেয়া বেগমের অতৃপ্ত আত্মা যেন একটুখানি প্রতিশোধের হাওয়ায় ডানা মেলতে পারছে; হৃত সামাজিক মর্যাদা যেন ফিরিয়ে আনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আর এখানেই গল্পের নামকরণটি পাপড়ি মেলে ধরে পুরো। মানুষের জীবন অনেকগুলো নয়, একটিই। কিন্তু এই জীবনে মানুষ যেন ভালবাসে একজনকেই। স্বপনে থাকে একজনই। হয়ত আরও অনেকে বাসা বাঁধে তার মনে; কিন্তু সে হয়ত ক্ষণিকের তরে— স্বল্পস্থায়ী সাংসারিক প্রয়োজনে। এ শেষের জায়গাটা গল্পের পরিণতিটি জায়গামত সেট করে দেয়; তার আগ পর্যন্ত পাঠককে কিছুটা দৌড়ুতে হয়েছে এলোমেলো। যদিও আলেয়া চরিত্রটি একটু একটু করে এগিয়েছে একদম লাইন ও লেংথ মেনেই; শেষটায় এসেই গল্পটি তার সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে; কারণ এখান থেকেই অনুরণিত হতে শুরু করে পাঠকের জীবনের সেই কুও কুও… যা চলতেই থাকে, চলতেই থাকে!
অন্তর্গত
‘মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার জন্য কত নারীর কত হাহাকার দেখেছি। কত পুরুষকে দেখেছি সহায় সম্বল নিয়ে মাদ্রাজ সিঙ্গাপুর দৌড়াতে, অথচ আমার সামনে কত সহজ একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছিল।’ অন্তর্গত গল্পটি সেই সহজ ঘটনারই গল্প, যা খুব সহজ করেই বলা হয়েছে, কিন্তু পাঠকের মনে রেখে গেছে গভীর প্রভাব।
অন্য সব গল্পের মত এটিও উত্তম পুরুষে লেখা, যে বদলি নিয়ে আসে সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে, যেখানে ‘সবার বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করে মাঝরাতে বিদ্যুৎ উঁকি দেয়’, যেখানে ‘মানুষের দারিদ্র্য ডোবার পানির মতো বছরের পর বছর জমে থাকায় তার ব্যাপকতা বহুমাত্রিক’, যেখানকার মানুষ ‘একাধারে দেহে, মনে, চিন্তায়, কল্পনায়, এবং ধনে দরিদ্র।’, যেখানে ‘খেয়ালি বালকের মতো প্রকৃতি …মানুষের জীবনের একমাত্র নিয়ন্ত্রক’, যেখানে ‘আত্মসমর্পণ হয়ে ওঠে যুৎসই বেঁচে থাকার কৌশল।’ এরকমই এক প্রেক্ষাপটে গল্পটি গাঁথা হয়।
উত্তম পুরুষ আমাদের সাধারণ মধ্যবিত্তের চরিত্রের সাথে সাযুজ্য রেখে গ্রামের বাড়ি যেতে চাইত না; কিন্তু তার মধ্যে ছিল পূর্বপুরুষের হাওর জীবনের বীজ, যা টের পেত হাওর অঞ্চলের ফসলভরা মাঠের গন্ধে, বর্ষার উথাল-পাথাল জল আর দুলে ওঠা নৌকায়! আসলে ‘পূর্বপুরুষেরা উত্তরপুরুষের জন্য যে সম্পদ রেখে যায়, সে সম্পদ যতটা সম্পদ, তার চেয়ে বেশি নিজেকে স্মরণ রাখানোর জন্য উৎকোচ।’ আর সেজন্যই কিনা এই হাওর অঞ্চলের বৃষ্টি উন্মাতাল করে দিত উত্তম পুরুষকে। আসলে ‘সব জায়গায় বৃষ্টি পড়ে, কিন্তু এখানে বৃষ্টি বয়ে যায়।’ উত্তম পুরুষের ভাবনার সাথি হয়ে পাঠকের অভিজ্ঞতা হয় এমনই অপূর্বসুন্দর আরও কিছু গদ্যের, যা কাব্যের প্রতিধ্বনি তোলে, যেমন: ‘সামাজিক মানুষ মনের গহীনে একাকিত্বের যে সুপ্ত বাসনার বীজ লালন করে চলে নিরন্তর আমি সেই বীজ ফুঁড়ে একাকিত্বের গাছে ডালপালা গজাতে দেখেছি হাওরের বৃষ্টির রাতে। এমনি রাতগুলোতে মনে হতো, আমার প্রেমের প্রয়োজন নেই, গৃহের প্রয়োজন নেই, বন্ধুর প্রয়োজন নেই। আমি শুধু আমার জন্য।’
কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষিক ও উপভোগ্য জীবনেই একদিন সিগারেট ধরিয়ে বৃষ্টি উপভোগ করতে করতে এক রমণীকণ্ঠের গান ভেসে আসে, বৃষ্টির তৈরি নানাবিধ শব্দের ফাঁক গলে যার কথাগুলো বোধগম্য হয় না। পরে জানা যায় উত্তম পুরুষের বাসার কাছের একটি পরিত্যক্ত খাদ্য গুদামে বসবাস ওই রমণীর, যে দার্শনিকের মত গুদামের বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথা হেঁটে বেড়ায়। সে যখন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গান গেয়ে যেত, তখন মনে হত ‘সহস্র দর্শকের সামনে এক পেশাদার গায়িকা গান গেয়ে যাচ্ছে।’ কিন্তু এই ‘পাগলী’ একদিন গর্ভবর্তী হয়ে পড়ে; যদিও চারদিক কানাঘুষো চলতে থাকে, ওর মাঝে কোনও ভাবান্তর ছিল না। এলাকাটির সরকারি ডাক্তার, থানার কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা প্রমুখের কাছে উত্তম পুরুষ যখন বিষয়টি তোলে, তখন সবাইকে ‘সরকারী নির্দেশনা’ নেই বলে এড়িয়ে যেতে দেখা যায়। আসলে ‘একটি সন্তান এবং একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মায়ের আসন্ন মৃত্যু হলে সমাজের কিছুই যায় আসে না।’ তাই একদিন সে উধাও হলেও কারও এ নিয়ে কিছু উদ্বেগ থাকে না।
একদিন অবশ্য পাগলি ফিরে আসে। রাজাপুর গ্রামের তালেব মিয়া তার নিঃসন্তান আত্মীয়ের ঘরে পাগলির গর্ভজাত শিশুটিকে দিয়ে বিনিময়ে ভাল উপার্জন করে নেয়। শুধু ‘সন্তানের আসল বাবা মা কোনওদিন সন্তানের সন্ধান পাবে না, আর সন্ধান না পেলে দাবি নিয়ে হাজিরও হবে না।’— এই শর্তটুকু থাকে। কিন্তু পাগলির এ নিয়ে যে কোনও দুশ্চিন্তা ছিল তা বোঝার উপায় থাকে না; সে আগের মতই দার্শনিকের বেশে হেঁটে বেড়াতে থাকে গুদামের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। কিন্তু উত্তম পুরুষ প্রায় আট বছর পর ময়মনসিংহ অঞ্চলের একটি ডাকবাংলোয় যখন বৃষ্টি উপভোগ করতে থাকে, তখন তার কানে বেজে উঠে সেই সুর। দ্রুত জানালা দিয়ে নীচে তাকিয়ে দেখতে পায় একটি বালককে, যে পাশের বাড়িটার জানালার শিক ধরে আকাশের তাকিয়ে আছে— মুখে অদ্ভুত হাসি।
এ জায়গায় এসে গল্পটি একটি যাদুবাস্তবতার রসে ভাসতে থাকে আর ডুবিয়ে দিতে থাকে পাঠককে সেই গহীনে! এই গল্পটি পড়ে পাঠকের কমলকুমার মজুমদারের ‘মতিলাল পাদ্রী’-র গল্পটিও মনে পড়বে। সে অর্থে এই গল্পের প্লট কিছুটা চেনা; কিন্তু এর দার্শনিকতা পাঠককে অনেক নতুন চিন্তার খোরাক দেয়!
মেয়াদোত্তীর্ণ স্বপ্ন
আমাদের জীবনে এমন কেউ থাকে, যার সাথে রেলস্টেশনে বা শপিংমলে বা পথে আচমকা দেখা হলে মাথা নীচু করে পালিয়ে যেতে চাই, একদম চিনতে চাই না। কিন্তু ‘দুটি ভিন্ন জীবনবৃত্ত যখন ঘুরতে ঘুরতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরস্পরকে ছেদ করতে উন্মুখ হয়, তখন নিয়তি ছাড়া আর কাউকে দোষ দেয়ার উপায় থাকে না।’ তখন ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়ায় যেন ‘কঠিন অসুখে ভুগে… হঠাৎ সুস্থ হয়ে’ উঠি আমরা, আর ‘ক্ষণস্থায়ী বিচ্ছেদের যে যন্ত্রণা নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম, তা প্রশমিত হয়ে স্থায়ী বিচ্ছেদে রূপান্তরিত হয়ে’ যায়।
গল্পটির উত্তম পুরুষ হঠাৎ আবিষ্কার করে যে, তার সহকর্মী আফসারুল আমিন তারই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রেমিকা রেবার স্বামী। একই ডিপার্টমেন্টে পড়েছে জেনে সহকর্মী জানতে চায় রেবার সাথে পরিচয় রয়েছে কিনা। আর উত্তম পুরুষ তা অস্বীকার করে কোনও চিন্তাভাবনা ছাড়াই। কিন্তু হাসি-খুশি আড্ডাবাজ চরিত্রটা তার মরে যেতে থাকে, তার মনে হতে থাকে— রেবা আড়ালে বসে তার স্বামীর চোখ দিয়ে তাকে অনুসরণ করছে। নিজেকে ‘পৃথিবীর ভয়ংকরতম অপরাধের একজন অপরাধী’ মনে হতে থাকে তার তখন— নির্দোষ রেবাকে স্বপ্ন দেখিয়ে তা নিজহাতে হত্যা করেছিল সে। আসলে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসার পর ‘তার ভালবাসা মরে গিয়েছিল।’ কিন্তু উত্তম পুরুষ এসব ক্ষেত্রে ‘মানুষ সাধারণত চায় প্রাক্তন প্রেমিকা তার জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলুক কিংবা একমুখী হলেও ভালবাসাটা বেঁচে থাকুক’, সেরকম কোনও তৃষ্ণায় ভোগে না; বরং তার জন্য রেবা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে না যায় সেই দুশ্চিন্তা তাকে অহর্নিশি বিঁধতে থাকে; আর অফিসের অন্য সবার কাছে আউটসাইডার করে তোলে।
এ জায়গায় এসে আলবেয়ার কাম্যুর বিশ্বখ্যাত ‘আউটসাইডার’-এর কথা মনে পড়ে যায় পাঠকের। সেই একই রকম নির্লিপ্তি, একই নৈর্ব্যক্তিকতার টান গল্পের শরীর জুড়ে। উত্তম পুরুষের বন্ধু জাহিদ যখন ভর্ৎসনা করে মিথ্যে বলার জন্য, তখন পাঠকের মনে হয়— রেবাকে চিনতে না চাওয়ার মধ্যে আছে এক নিঃশব্দ, অনুচ্চকিত পলায়ন, এক অপরাধবোধের কাছে সমর্পণ। শেষ পর্যন্ত চাকরিটা ছাড়তেই হয় উত্তম পুরুষকে, কিন্ত সেখানে শেষের চমক রয়েছে পাঠকের জন্য। সতের বছর আগে টিউশানির পয়সায় যে কানের দুল কিনে দিয়েছিল সে রেবাকে, তাই পত্রমারফত ফিরে আসে তার কাছে। যে কানের দুল ‘এতই হাল্কা ছিল যে রেবাকে দিতে গিয়ে ভীষণ সংকোচ ছিল… মনে হয়েছিল একজোড়া ঘাসফুল… অথচ এত বছর পর সেই হাল্কা কানের দুল জোড়াকেই অনেক ভারী মনে হতে লাগলো। মনে হচ্ছে এ যেন হাতির বিশাল শুঁড়। কোনভাবেই আড়াল বা বহন করার ক্ষমতা’ নেই উত্তম পুরুষের। আর তাই তো এক অন্ধ ভিখিরি হাত বাড়িয়ে দিলে তার হাতে সঁপে দিয়ে পরিত্রাণ পেতে চায় সে।
কিন্তু পরিত্রাণ কি মিলবে? মেয়াদোত্তীর্ণ স্বপ্নের এই প্রতীকটি হয়ত আপাত একটা ছাড়াছাড়ি তৈরি করল; কিন্তু অন্য কোনও অফিসে, কোনও শহরে, বন্দর বা ঘাটে যে রেবা আবার হাজির হবে না, তা কে বলতে পারে? লেখক মনে হয় সে সুতোটুকু পাঠকের চিন্তার জগতে ছেড়ে দিয়ে গল্পটি শেষ করেন! এদিকে ‘কেন চেনে না রেবাকে… বলেছিল গল্পের নায়ক’— এই প্রশ্নের ঘুড়ি কিন্তু পাঠকের উন্মুক্ত আকাশে উন্মত্ত হয়ে চক্কর দিতেই থাকে, দিতেই থাকে!