Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

মাহমুদ দারবিশের কবিতায় ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রাম

ইসরায়েলি সৈন্যবাহিনীর নির্বিচার হামলায় ফিলিস্তিনের গাজার অধিকাংশ বাড়িঘর ও স্থাপনা গুঁড়িয়ে গেছে, চলছে নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ যার নাম দেয়া যেতে পারে জেনোসাইড বা জাতিহত্যা। আক্ষরিক অর্থেই ফিলিস্তিনের গাজা এখন বসবাসের অযোগ্য এক মৃত্যু-উপত্যকা। প্রতিদিনই সেখানে লাশের মিছিল বাড়ছে। এর প্রকৃতির জলপাই রঙের স্নিগ্ধ মেদুরতা প্রায়-অপসৃত, মাটি রক্তাক্ত, আকাশের নীলিমা বিধ্বস্ত। যে পবিত্র মাটি থেকে নবি মুহাম্মদ (সা.) ‘আরোহণ করেছিলেন স্বর্গে, ফিরে এসেছিলেন উদ্যম আর খুশি নিয়ে’, সেই মাটি বর্বরের বেয়নেটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। জলপাইয়ের ডালে কোনও পাখি আর ভোরের আকাশকে স্বাগত জানায় না, বন্ধ হয়ে গেছে সব পথসঙ্গীত, নিভে গেছে সব আলো। প্রতিটি যুবক ভুলে গেছে সাদা টিউলিপ, জলপাইয়ের ডাল আর ‘প্রেমিকার স্তনযুগলের’ স্বপ্ন দেখা। সেখানে কোনও স্বপ্নচারী কিশোর কিংবা যুবা আর ভোরের ‘পাখির স্বপ্ন’ দেখে না, শোনে না কোনও ‘লেবুফুলের গল্প’। জেরুজালেমের বুকেও যুদ্ধের দগদগে ক্ষত, সেই ক্ষত থেকে জেগে উঠছে ‘বাইবেলের একেকটি সাদা গোলাপ’। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নির্বিচার হামলায় পুরো উপত্যকাটির বেশিরভাগ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। দেখা দিয়েছে খাবারের তীব্র সংকট, বোমার আঘাতে হাজার হাজার শিশু পঙ্গুত্বের শিকার হচ্ছে, ছড়িয়ে পড়েছে রোগবালাই। সংঘাত, অপুষ্টি ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতির কারণে গাজায় এমন এক ‘প্রাণঘাতী চক্র’ সৃষ্টি হয়েছে যে, পুরো উপত্যকার লক্ষ লক্ষ শিশুর জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলা থেকে প্রাণ বাঁচাতে মিশর সীমান্তবর্তী রাফা এলাকায় লক্ষ লক্ষ বেসামরিক বাসিন্দা আশ্রয় নিয়েছেন, দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী লেবাননে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন অনেক মানুষ। পৌনে একশো বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা নিগৃহীত, উৎপীড়িত, উদ্বাস্তু, নিজ বাসভূমেই পরবাসী। আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগে, ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় ইসরায়েলি দখলদার বাহিনি ফিলিস্তিনের চার শত গ্রাম দখল করে ধ্বংস করে দেয় এবং সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর গড়ে তোলে ইহুদি বসতি। ধ্বংস করে দেয়া হয় গালিলি প্রদেশের বন্দরনগরী অ্যাকারের নিকটবর্তী আল-বিরওয়া গ্রামটিও। এই গ্রামেই বাস করতেন হুসাইন দারবিশ নামে এক কাব্যপ্রেমী প্রবীণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর বাড়িতে প্রতিদিন গল্প, কবিতা আর শ্লোকের আসর বসত, সেই শ্লোকগুলো ছিল খুবই রোম্যান্টিক। দারবিশ নামের এক মুগ্ধ বালক মনোযোগ সহকারে এই শ্লোকগুলি শুনত। শ্লোকের মর্মার্থ হয়তো সে তেমন বুঝত না, তবুও শব্দের ঝংকারে বালক দারবিশ অভিভূত, পুলকিত, শিহরিত হত, কবিতার সঙ্গে নিত্য বসবাস করতে করতে সেই মুগ্ধ বালক হয়ে ওঠেন স্বপ্নচারী, আকাশবিহারী। ‘বড় হয়ে তুমি কি হতে চাও’— এমন প্রশ্ন করতেই বালক উত্তর দেয়, বড় হয়ে সে কবি হবে, কবিতা রচনা করবে। এই স্বপ্নচারী বালকের নাম মাহমুদ দারবিশ, কাব্যপ্রেমী হুসাইন দারবিশের পৌত্র। এই বালকই এক পর্যায়ে হয়ে ওঠেন ফিলিস্তিনি জনগণের অবিসংবাদিত কণ্ঠস্বর, আরবি সাহিত্যের প্রাণপুরুষ মাহমুদ দারবিশ (১৯৪১-২০০৮)। ১৯৪৮ সাল, যখন তাঁর বয়স মাত্র সাত বছর, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাঁদের ঘরবাড়িসহ পুরো গ্রাম পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দেয়। আরও অনেক ফিলিস্তিনি পরিবারের মতো দারবিশের পরিবার প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আশ্রয় নেয় প্রথমে জেদিদি এবং পরে দামুর অঞ্চলে। শুরু হয় উদ্বাস্তু জীবন, স্বল্প সময়ের জন্য ফিরে আসেন ফিলিস্তিনে, কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট স্থানে থিতু হতে পারেন না। উদ্বাস্তুই থেকে যান, বাধ্য হন সারা জীবন উদ্বাস্তু হয়ে থাকতে। উদ্বাস্তু জীবন কাটাতে হয় মস্কো, প্যারিস, বৈরুত, দামেস্ক, আম্মান কিংবা তিউনিসিয়ায়। উদ্বাস্তু দারবিশের স্কুলজীবন শুরু হয় জাদিদি থেকে দুই কিলোমিটার উত্তরে কাফর ইয়াসিফে, তারপর দীর্ঘ সময় হাইফাতে। বয়স যখন উনিশ, প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘আসাফির বিলা আজনিহা’ (উইংলেস বার্ড অথবা পালকহীন পাখি)। ইসরায়েলি কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র আল-জাদিদ-এ তাঁর কবিতা প্রকাশ চলতে থাকে, মাঝেমধ্যে তাঁকে সাময়িকী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করতে হয়। মাতৃভূমি থেকে উন্মূল উদ্বাস্তু মাহমুদ দারবিশ আজীবন হৃদয়ের অন্তস্তলে ধারণ এবং লালন করেছেন বেদনাপীড়িত, বুলেট-বেয়নেট-বোমায় ক্ষতবিক্ষত ফিলিস্তিনকে, কবিতার শাণিত হাতিয়ার দিয়ে লড়েছেন ফিলিস্তিনি জনগণের জাতীয়মুক্তি ও স্বাধীন বাসভূমির জন্য। কৈশোর থেকেই তিনি ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে থেকেছেন এবং লড়াই করেছেন প্রবল পরাক্রান্তের বিরুদ্ধে। আর সেই লড়াইটা করেছেন কবিতার শাণিত শব্দাবলি দিয়ে। দারবিশ প্রথম কবিতা পাঠ করেন ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে। স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিনি আবৃত্তি করেন:

‘তুমি চাইলেই সোনালি রোদে খেলা করতে পারো, তুমি চাইলেই হাতের নাগালে পাও আলোকিত পুতুল, কিন্তু আমার তা নেই। তোমার আছে ঘর, আমার কিছু নেই। তোমার আছে উৎসব আর উদযাপন, কিন্তু আমি তার দেখা পাই না। বলো, কেন আমরা এক সাথে খেলতে পারি না।’

এই কবিতা শুনে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর লোকেরা কিশোর দারবিশকে শাসিয়ে দেয়। তিনি বুঝতে পারেন তার কবিতাটা কতটা ক্ষুরধার, কতটা অভ্রভেদী। তাঁর কবিতায় প্রেম, দ্রোহ, প্রতিরোধ, আলিঙ্গন হাত ধরাধরি এগিয়েছে। আরবি ভাষার কবি তিনি, তবে অনায়াসে লিখতে পারতেন হিব্রু, ইংরেজি, ফরাসিতে। মাহমুদ দারবিশের কবিতা ও প্রবন্ধ আরব দুনিয়ার বাইরেও বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁকে মনে করা হয় হয় আরব-জাহানের সবচেয়ে অগ্রগণ্য ও সম্মানীয় কবিদের একজন এবং সমকালীনদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। ‘কেউ কেউ মনে করেন আরব-কবিদের মধ্যে অ্যাডোনিসের পরেই তাঁর স্থান। তবে কাব্যচিন্তা ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে অ্যাডোনিসের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য অনেক। বর্তমানে আরব কবিতায় যে আধুনিকতা দেখা দেয় তা প্রধানত এসেছে অ্যাডোনিসের হাত ধরেই। কিন্তু আরব কবিতায় যে বিপ্লবী জোশ দেখা দেয় তা এসেছে দারবিশের হাত ধরে।’ (গাজী সাইফুল ইসলাম (অনূদিত): মাহমুদ দারবিশের কবিতা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা, এপ্রিল ২০১৯। পৃ: ভূমিকা)। তাঁর কবিতায় শৈল্পিক প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক চিন্তা, দেশাত্মবোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। মাতৃভূমি নামক ভাবসত্তার প্রতি দুর্মর ভালবাসা, পাইন-জলপাই ঘেরা স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন তাঁকে কবি করে তোলে, যদিও তিনি বলতেন, ‘আমি এখনও কবি হয়ে উঠতে পারিনি, মনে হচ্ছে এ পথে আসাটাই ভুল হয়েছে।’ তাঁর বেশিরভাগ কবিতাতেই ফুটে উঠেছে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের মর্মভেদী বেদনা এবং তাদের প্রতি কবির উদ্বেগ ও আতঙ্ক। তাঁর প্রায় সব ধ্যানজ্ঞান, স্বপ্নকল্পনা আবর্তিত হয়েছে আরবদের ইতিহাস-ঐতিহ্য কিংবা পিতা-পিতামহের অতীত স্মৃতি ও বেদনাকে ঘিরে। উদ্বাস্তু জীবন থেকে দেশে ফিরে তিনি অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে লিখছেন: ‘আমি ফিলিস্তিনে। কিন্তু কোথায় আমার ফিলিস্তিন? আমি কখনও আমার বাড়িতে ফিরে যেতে পারিনি। প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে আমি দেখতে পেলাম আমার গ্রাম বিধ্বস্ত-ভস্ম।’ দারবিশ বারবার মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে নির্বাসিত জীবনযাপন করেছেন। জন্মভূমি হারানোর বেদনা আর নির্বাসিত জীবনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নানাভাবে মূর্ত হয়েছে তাঁর কবিতায়, তাঁর প্রবন্ধে। মাতৃভূমির প্রতি প্রবল টান, স্বজন-হারানোর বেদনা-হাহাকার, দেশত্যাগজনিত ক্ষত ও রক্তক্ষরণ তাঁকে কলম ধরতে ও তাতে শান দিতে শিখিয়েছে। শেকড়ে ফিরে আসার প্রবল আকুতি, বুকের মধ্যে জমা দ্রোহ-দাহ, ক্ষোভ, হাহাকারই বারবার ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি হয়ে বেজেছে তাঁর কবিতায় ও সৃজনভূবনে। মাহমুদ দারবিশের কবিসত্তা জাগ্রত হয়েছে প্রাচীন আরব কবি মু-আল্লাকারের কবিতার স্বপ্নছোয়ায়, তেমনি পিতামহ হুসাইন দারবিশের কাব্যপ্রীতিও তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তবে তাঁর কবি হয়ে ওঠার পিছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে নিজ মাতৃভূমির রক্তাক্ত-ছিন্নভিন্ন মানচিত্র ও ইসরায়েলিদের বর্বরতা। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বিংশ শতাব্দীর মতো আর কোনও শতাব্দীতেই এত অধিকসংখ্যক মহান কবির জন্ম হয়নি।’ উৎপীড়ন, যুদ্ধ, বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলির উত্থান-পতন, বর্ণবাদ, স্বৈরতন্ত্র, ফিলিস্তিনি ট্র্যাজেডি সত্ত্বেও এই শতাব্দীতে অসংখ্য কবি আবির্ভূত হয়েছেন। এই শতাব্দী যেমন যুদ্ধ, ধ্বংস, অশ্রু এবং ট্র্যাজেডির শতাব্দী, তেমনই কবি ও কবিতার উৎকর্ষের শতাব্দী। দারবিশও বিংশ শতাব্দীর এক মহান কবি, যাঁকে আরবি ভাষার প্রধান কবি এবং ফিলিস্তিনের জাতীয় কবির অভিধায় ভূষিত করা হয়। মাতৃভূমি, নিপীড়িত দেশবাসীর বেদনামাখানো চিৎকার-হাহাকার, বিশ্ব রাজনীতির মোড়লদের কুনাট্য তাঁর কবিতা আখ্যান হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। অগ্নিদগ্ধ জাতির অগ্নি ও উত্তাপ ধারণ ও লালন করার জন্য তাঁকে ‘পয়েন্ট অব দ্য রেজিস্ট্যান্স’ বলেও অখ্যায়িত করা হয়। ‘দখলদার ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা ফিলিস্তিনিদের মূলধারার রাজনীতির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।’ আরবি ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের রক্ষাকর্তা হিসেবে এই কবি বিশ্বাস করতেন, তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি একদিন ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির থাবা থেকে মুক্ত হবেই। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে রাখলেও তারা তাঁর জিহ্বায় উচ্চারিত শব্দ ও প্রতিবাদী কবিতাকে দখল করতে পারেনি, পারবেও না। ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তির লড়াইকে বন্ধ করা যাবে না। তিনি অন্তরে ধারণ করতেন, কবিতাকে যেমন ধ্বংস করা যায় না, তেমনই মানুষের মুক্তির লড়াইকেও থামানো যায় না। প্রিয় স্বদেশের বিপন্ন মুখ, দখলদার বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন এবং বর্বরতার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ, ফিলিস্তিনিদের মরণপণ লড়াই— এসবই দারবিশের কবিতার প্রধান বিষয়। রক্ত, আগুন, প্রতিবাদ, জখম, পাথর এ ধরনের শব্দ ও চিত্রকল্প বারবার ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়। ১৯৪১ সালের ১৩ মার্চ ফিলিস্তিনের উত্তর গালিলির গ্রাম আল বারওয়াহে এক মুসলিম কৃষক পরিবারে জন্ম নেয়া দারবিশ তাঁর পিতামহকে সদ্বংশজাত এক স্বশিক্ষিত কৃষক হিসেবে বর্ণনা করেছেন তাঁর কবিতায়। পিতামহই তাঁকে ‘শিক্ষা দিয়েছিলেন কীভাবে পড়তে হয়’। পিতামাতা খেত-খামারের কাজে থাকার কারণে তিনি বড় হয়েছেন পিতামহের স্নেহছায়ায়। বয়স যখন সাত অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি দখলদারবাহিনী দারবিশের গ্রামটি দখল করে নিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। আক্রান্ত হয়ে দারবিশের পরিবার আশ্রয় নেয় পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে। জাতিসংঘের সামান্য অন্নসাহায্যে তাঁদের উদ্বাস্ত জীবন কাটাতে হয়। প্রায় ৯ লক্ষ ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বরতার শিকার হয়ে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছিলেন। উদ্বাস্তু জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে দারবিশ লিখেছেন, ‘আমি উদ্বাস্ত হিসেবে জীবনযাপন করেছি। এটা ছিল যৌথ অভিজ্ঞতা। এই ক্ষত আমি কখনওই ভুলতে পারব না।’ নিজ বাসভূম থেকে বিতাড়িত হয়ে উদ্বাস্তু হিসেবে যাপিত জীবনের কথা তাঁর কবিতায় এক অনন্য সুর হয়ে বেজে ওঠে। তাঁর কবিতায় স্বদেশপ্রেম, বিদ্রোহ, প্রতিরোধ সবই আছে, কেবল নেই পরধর্মবিদ্বেষ, নেই ক্রোধোন্মত্ততা। তাঁর মনের গহনে বারবার এক অনিবার্য প্রশ্ন জেগে উঠেছে, একই পূর্বপুরুষ, একই ইতিহাসের অংশ হয়েও ইহুদিরা কেন তাদের বিতাড়িত করতে চায়? ‘আনা ইউসুফুন, ইয়া আবি’ কবিতায় বেদনার্ত তিনি গেয়েছেন:

‘পিতা, আমার ভাইয়েরা আমাকে ভালবাসে না, থাকতে দেয় না তাদের সঙ্গে
তারা আমাকে আঘাত করে নির্মম, ছুড়ে মারে পাথর এবং বলে কটু কথা
তারা চায় আমি মরে যাই, এর পর তারা আমার প্রশংসা করবে।
তারা আমাকে ঘরে থাকতে দেয় না, আমাকে বাইরে রেখে দরজায় দেয় খিল
তারা তোমার খেত থেকেও আমাকে বিতাড়িত করে’ (ও আমার পিতা, আমি তোমার ইউসুফ)

কবি হিসেবে দারবিশ স্বপ্নলোকচারী ছিলেন না, তাই অতিব্যক্তিগতভাবে প্রিজমের ভিতরে বসে কিংবা রঙিন চশমা দিয়ে রৌদ্রঝলসিত উজ্জ্বল পৃথিবীকে দেখতে চাননি। তাঁর রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত কবিহৃদয় কেবলই বেদনা-মথিত, ছিন্নভিন্ন পৃথিবীকে দেখতে পেয়েছে। বেদনার রং দিয়ে এথেন্স এয়ারপোর্ট-এর দুর্বিষহ স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন:

“এথেন্স এয়ারপোর্ট আমাদের লাথিয়ে পাঠায় অন্য আরো এয়ারপোর্ট।/ একজন যোদ্ধা বলে: ‘আমি যুদ্ধ করব কোথায়?/ এক গর্ভবতী তাকে বলেন: ‘কোথায় আমরা প্রসব করব আমাদের সন্তান?/ শুল্ক কর্তারা বলেন: ‘তোমরা কোত্থেকে এসেছো?/ আমরা বলি: ‘সাগর থেকে’/ ‘তোমাদের গন্তব্য? ‘সাগর’/ আমাদের দলের এক মহিলা বলেন: ‘এই বোঁচকাই, আমাদের গ্রাম!’ এথেন্স এয়ারপোর্টে আমরা অপেক্ষা করি বছরের পর বছর।” (এথেন্স এয়ারপোর্ট, ইংরেজি অনুবাদ: মুনির আকাশ ও ক্যারোলিন ফারশে)

শৈশবেই তিনি কবিতাতে মেতে ওঠেন। ইসরায়েলি সৈন্যদের কবল থেকে মুক্ত এক গায়কের কণ্ঠে গান শুনে মুগ্ধ দারবিশের মাথায় কবিতার পংক্তি আর গানের সুর ভর করে। সেই থেকে তাঁর পাঁচ দশকের পথপরিক্রমা কবিতার সাথে। ৯ আগস্ট, ২০০৮-এর যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টন শহরের হেরমান মেমোরিয়াল হাসপাতালে দারবিশের শেষনিশ্বাস ত্যাগের মধ্য দিয়ে অবসান হয় এক মহৎ পরিক্রমণের। মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি দিয়ে তিনি ভরিয়ে রেখেছিলেন আরবি সাহিত্যের বিশাল বনভূমিকে। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ডানাহীন পাখি’। এরপর প্রকাশিত হয় ‘লিভস অব দি অলিভ ট্রি ’(১৯৬৪), ‘এ লাভার ফ্রম প্যালেস্টাইন’ (১৯৬৬)। এর মধ্যে প্রথম গ্রন্থটি প্রকাশের পর দারবিশ আরবি ভাষাভাষীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আরবি ভাষার প্রধান কবি হিসেবে তিনি সমাদৃত হতে থাকেন। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল থেকে প্রকাশিত হয় ‘এন্ড অব দি নাইট’। এ সময় তিনি ইসরায়েলি কমিউনিস্ট পার্টি রাকাইর সদস্য ছিলেন এবং পার্টির পত্রিকা ‘আল ইত্তিহাদ’ সম্পাদনা করতেন। ইসরায়েলিদের বর্বরতা, অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে, ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করতে দারবিশ সম্পাদিত ‘আল ইত্তিহাদ’ সাহসী ও সময়োপযোগী দায়িত্ব পালন করেছে। এই সাহসী প্রতিবাদী ও লড়াকু ভূমিকা পালনের জন্য তাঁকে বারবার জেল খাটতে হয়েছে এবং গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে। প্রথম দিকে তিনি ধ্রুপদী রীতিতে কবিতা লেখা শুরু করেন। কিন্তু খুব বেশিদিন এই ধ্রুপদী দুর্গের মধ্যে আটকিয়ে থাকেননি। সিরীয় কবি সিজার কাব্বানি এবং আলী আহমদ সাঈদ অ্যাডোনিসের নব্য কবিতা আন্দোলনের আছড়ে পড়া ঢেউ তাঁর ধ্রুপদী ভাবনার নীল নির্জন দুর্গকে ভেঙে খানখান করে দেয়। স্বপ্নলোকচারী কবি চলে আসেন মাটি ও মানুষের কাছাকাছি। তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে লোকানুবর্তী ও লক্ষ্যভেদী। ফিলিস্তিনের মাঠ, খেত, উপত্যকা, মাটি, অলিভ গাছের সারি প্রভৃতি দিয়ে দারবিশ নির্মাণ করতে থাকেন কবিতার পর কবিতা। ফিলিস্তিনের নিসর্গের বিমূর্ত সুর আর স্বাধীনতা, প্রেম, স্বাদেশিকতার ধারণার যোগসাজসে দারবিশ এক বিশ্বজনীন কবিতা নির্মাণের প্রয়াস পান। দারবিশের কবিতার ভাষা সহজ ও স্বচ্ছ। কিন্তু তাতে রয়েছে মাটি ও মানুষের প্রতি ভালবাসার সুদৃঢ় অঙ্গীকার। তাঁর কবিতা পড়লে এক গভীর মানবিক চেতনয় সমস্ত দেহমন আন্দোলিত হয়ে ওঠে। বিপন্ন অস্তিত্বের মুখোমুখি হয়েও তিনি কখনও মানবতা ও মানবপ্রেমের মন্ত্র থেকে বিচ্যুত হননি। পরিণয়পত্র কবিতায় তিনি মানবতার জয়গান গেয়ে উচ্চারণ করেছেন:

‘আমি মানুষকে ঘৃণা করি না।
আমি কারো কাছ থেকে কিছু চুরি করি না
তারপরও যদি আমার ক্ষুধা লাগে
আমি আমার জবরদখলকারীর মাংস খাব
সাবধান… আমার ক্ষুধা থেকে সাবধান
আমার ক্ষুধা থেকে সাবধান।’ (আইডেন্টিটি কার্ড, ইংরেজি অনুবাদ: ক্যারোলিন ফরসে ও মুনির আকাশ)

মানুষের প্রতি বিশেষ করে ফিলিস্তিনি সংগ্রামী ও উদ্বাস্ত জনগণের প্রতি ভালবাসা ব্যক্ত করতে গিয়ে দারবিশ ধীর অথচ অবিরাম প্রতিরোধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছেন। প্রতিরোধ করতে চেয়েছেন জবরদখলকারীদের। তাঁর লড়াকু মেজাজের কবিতাগুলো স্বল্পদৈর্ঘ্যের হলেও তা পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। কবিতা চলে যায় যুদ্ধশিবিরে, উৎকীর্ণ হয় দেওয়ালে দেওয়ালে মানবমুক্তির স্লোগান হয়ে। তাঁর কবিতা পড়ে মুক্তিযোদ্ধারা কম্পিত, শিহরিত ও অনুপ্রাণিত হয়। মাহমুদ দারবিশ শুধু ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তির কথা চিন্তা করেননি, পুরো আরব নিপীড়িত-নির্য়াতিত জনতাকে স্বজন ভেবেছেন। তাঁর জীবনে অত্যাচারের খড়গ নেমে এসেছে বারবার, রিক্ত নিঃস্ব সর্বহারা হয়ে বাধ্য হয়েছেন নিজ বাসভূমি ছাড়তে, তারপরও দখলদারদের বিরুদ্ধে নিরাপস লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। এভাবেই তাঁর কবিতা আরব জাতিসত্তার উজ্জীবনের অগ্নিঝরা ইশতেহার হয়ে ওঠে। খেটে-খাওয়া গরিব মানুষের মুক্তির কথা উচ্চারণ করতে গিয়ে আরবদের গৌরবমণ্ডিত ইতিহাস নতুন করে নির্মাণ করেন তিনি। আরবদের গৌরবমণ্ডিত, সাহসদীপ্ত ইতিহাসের পথ ধরেই তিনি ফিলিস্তিনিদের মুক্তির সম্ভাবনা খুঁজতে চেষ্টা করেন।

‘আমি একজন আরব/ আমি দিনরাত কষ্ট করে পাথরখনিতে কাজ করি/ আমার আটটি সন্তান/ এই পাথর থেকেই আমি তাদের রুটি, বইখাতা ও জামা কাপড় দেই/ তবুও আমি তোমাদেও দরজায় ভিক্ষা চাই না/ তোমার ভৎর্সনার প্রাসাদে আমি কুর্নিশ করি না।’ (পরিচয়পত্র)

পৃথিবীর সব মহৎ কবিদের মতো দারবিশও ছিলেন প্রেমের ভুবনের নিত্য পরিব্রাজক এবং তাঁর কবিতার গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ প্রেম। তাঁর নারীপ্রেম কখনও কখনও রূপান্তরিত হয় স্বদেশপ্রেমে। তাঁর একটি কবিতায় আছে:

‘ওই রমণীর কথা ও নৈঃশব্দ্য, ফিলিস্তিনি/তার কণ্ঠ, ফিলিস্তিনি/তার জন্ম ও মৃত্যু, ফিলিস্তিনি।’ (ফিলিস্তিনের প্রেমিক) ইহুদি তরুণী তামার-বিন-অমির সঙ্গে দারবিশের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বেদনাপীড়িত ফিলিস্তিনিদের বেদনায় মথিত-ভারাক্রান্ত হয়ে প্রেমিকার প্রতি তিনি লিখেন: ‘আমি আমার জাতির সঙ্গে বেঈমানি করে, আমার শহর এবং তার পরাধীনতা-শৃঙ্খলের বেদনা ভুলে গিয়ে হলেও তোমাকে ভালবাসি।’

প্রায় পাঁচ দশকের কাব্য পরিক্রমা মাহমুদ দারবিশের। এই পাঁচ দশকের পরিক্রমায় তিনি অর্জন করেন ফিলিস্তিনের ‘প্রধান কবি’-র অভিধা। সারা জীবন তিনি এই মর্যাদা ও দায়ভার বহন করে গেছেন। জীবৎকালে তিনি ছিলেন আরবি সাহিত্যের সবচেয়ে শীর্ষস্থানীয় জননন্দিত কবি। তাঁর কবিতা পাঠের আসর পরিণত হত উপচেপড়া মানুষের ভিড়ে। আরব বিশ্বের যেখানেই তিনি কবিতা পড়তে গেছেন, সেখানেই হাজির হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। ২০০০ সালে বৈরুতের স্টেডিয়ামে তিনি কবিতা পড়েছিলেন পঁচিশ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে। তাঁর অনেক কবিতাকে গানে রূপ দেয়া হয়েছে, যা মুখে মুখে ফেরে। যুবা-তরুণ-বৃদ্ধ, বাঙালি, এশিয়ান, আফ্রিকান যারাই তাঁর কবিতা পড়েছেন, তারাই মুগ্ধ হয়েছে। তাঁর কবিতা কেবল ফিলিস্তিনি তথা আরব জাহানে জনপ্রিয় নয়, সারা বিশ্বের ভাবুক-রসিকদের তৃপ্ত করেছে তাঁর কবিতা। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক পঠিত নন্দিত কবিদের একজন। ফিলিস্তিনি প্রসঙ্গ তাঁর কবিতার একটি সর্বজনীন প্রতীক হয়ে ওঠেছিল। এজন্য তাঁকে ফিলিস্তিনি জনগণের কণ্ঠস্বর, ফিলিস্তিনিদের আনন্দ-বেদনা ও নির্বাসনের মূর্ত প্রতীক বলে মনে করা হয়। তিনি আরবিতে কবিতা লিখেছেন, কিন্তু ইংরেজি, ফরাসি ও হিব্রু ভাষা জানতেন। হিব্রু অনুবাদের মাধ্যমে তাঁর পরিচয় ঘটে হিব্রু সাহিত্যের আদি গ্রন্থ তৌরাত এবং ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা ও পাবলো নেরুদার সঙ্গে। তাঁর কবিতায় প্রভাব দেখা যায় ইরাকি কবি আব আল-ওয়াহাব আল বায়াতি ও বদও সাকের আল-সায়েবের। র‌্যাবোঁ ও গিন্সবার্গ যে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছেন সেটা অকপটে কবুল করেছেন। নির্মোহভাবে প্রশংসা করেছেন হিব্রু কবি ইয়াহুদা অ্যামিচির, যদিও তিনি দারবিশ-বিদ্বেষী ছিলেন। কারণ দুজনেই একই পটভূমিকে কেন্দ্র করে লেখালেখি করেছেন। অ্যামিচি লিখেছেন দখলদার ইসরায়েলিদের গৌরবগাথা আর দারবিশের লেখায় প্রতিবিম্বিত হয়েছে আরবদের আত্মপরিচয়ের ইতিহাস।
দারবিশের প্রিয় বিষয় ফিলিস্তিনি জনগণের ছয় দশকের মুক্তিসংগ্রাম। ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামের উপেক্ষিত অথচ অনিবার্য বিষয়-আসয়গুলো বারবার ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কাছে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড স্বর্গের মতো পবিত্র। আর এই ভূখণ্ডের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে স্বর্গের পতন হিসেবে তুলনা করেছেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন। ফিলিস্তিনি জনগণের অন্তর্নিহিত সত্তার পুনরুত্থান ঘটবে একদিন আর এর মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে স্বাধীন ফিলিস্তিনি। তাঁর সকল ভালবাসা বেদনাপীড়িত মাতৃভূমি ফিলিস্তিনকে ঘিরেই। আমৃত্যু নির্বাসিত মাহমুদ দারবিশ তাঁর ‘আবার জন্মভূমি’ কবিতায় বেদনার্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন:

‘সবার মতো আমারও জন্ম হয়েছিল
আমার মা আছে, আছে ভাই ও বন্ধুরা, আর অনেক জানালাওয়ালা
একটি বাড়ি,…
আমার আছে ঢেউ যা ছিনিয়ে নিয়েছে
গাঙচিলেরা, আছে আমার ভেতর একান্ত একটুকরো ছবি
আমার আছে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি
আছে চাঁদ পাখিদের গান, আর একটি শাশ্বত জলপাই গাছ।‘

দারবিশ সারা জীবন কবিতাকে ভালোবেসে গেছেন। কবিতাই ছিল তাঁর আরাধ্য। ১৯ বছর বয়সে লেখা ১৯৬০ সালে প্রকাশিত ‘ডানাহীন পাখি’ দিয়ে যাত্রা শুরু, তারপর কবিতা দিয়েই জীবন-মৃত্যুর গান গেয়ে গেছেন। কবিতার জন্য জেলেও অন্তরীণ হতে হয়েছে। ইসরায়েলি পুলিশকে লক্ষ্য করে দারবিশ ‘পরিচয়পত্র’ শীর্ষক কবিতায় লিখেছিলেন,

‘লিখে নিন
আমি এক আবার,
পরিচয়পত্রের নম্বর পঞ্চাশ হাজার’

কবিতাটি প্রকাশিত হলে দারদিশকে গৃহবন্দি করা হয়। পরে কবিতাটি গান হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁর ‘মা’ কবিতাটিও গান হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিল। কারাগারে অন্তরীণ পুত্র মায়ের হাতে বানানো রুটি আর কফির জন্য নস্টালজিয়ায় কাতর হয়ে গেয়ে উঠেছে এভাবে:

‘আমি আমার মায়ের বানানো রুটির জন্য ব্যাকুল
আমি ব্যাকুল আমার মায়ের বানানো কফির জন্য
আমি ব্যাকুল আমার মায়ের ছোঁয়ার জন্য…’

কবিতাটি প্রসঙ্গে দারবিশ বলেছেন, এটি একটি কোরাস। আমার সব কবিতাই এ রকম। নিজেকে উপস্থাপন করা ছাড়া কোনও কিছুই আমি কবিতায় তুলে ধরি না। আমি উপস্থাপন করি ‘সম্মিলিত স্মৃতিকে’। দারবিশ ‘সম্মিলিত স্মৃতি’ বলতে ফিলিস্তিনের মা-মাটি আর মানুষকে বুঝিয়েছেন। ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের নিজ বাসভূমি থেকে বিতাড়িত করেছে আর কাউকে নিজ বাসভূমেই পরিণত করেছিল পরবাসীতে। অন্যান্য সব ফিলিস্তিনির মতো দারবিশও ছিলেন দেশহীন, গৃহহারা, উদ্বাস্তু। তাই বেদনার্ত কণ্ঠে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন: ‘আমার কোনো বাড়ি নেই/ …বাড়ি শব্দ যে গভীর অর্থ বহন করে সেই অর্থে বাড়ি আমার নেই।’ তিনি সব সময় জায়নবাদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। কিন্তু কোনওভাবেই ইহুদিবিদ্বেষী ছিলেন না। ইসরায়েলের বিখ্যাত কবি য়িহুদা আমিখাই-এর প্রতি ছিল তাঁর পরম শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। তিনি বলেছিলেন: ‘আমি সব কিছুকে মানবিক করে যাবো, এমনকি শত্রুকেও… প্রথম যে শিক্ষক আমাকে হিব্রু শিখিয়েছিলেন তিনি ছিলেন ইহুদী। প্রথম যে মেয়েটিকে ভালোবাসি সেও ছিল এক ইহুদী/ প্রথম যে আমাকে জেলে পাঠায়, সেই বিচারকও ছিলেন এক ইহুদী নারী। ফলে জীবনের শুরু থেকে আমি এটাই দেখিনি যে, ইহুদী মাত্রই শয়তান কিংবা ফেরেশতা, দেখেছি তারাও মানুষ।’ সাদা লিলি ফুল, অলিভ জলপাই গাছ, ‘চাঁদ আর পাখিদের গান’-এ মুগ্ধ ও বিমোহিত দারবিশকে বারবার বাসস্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে তিনি ইসরায়েল ছেড়ে রাজনৈতিক অর্থনীতি পড়ার জন্য মস্কোতে যান। কিন্তু এক বছর পর মোহভঙ্গ হলে মস্কো ত্যাগ করে কায়রো এবং পরে বৈরুত চলে আসেন। তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসেও কিছুকাল কাটান। ১৯৮৫ সাল থেকে প্যারিসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি জীবনে থিতু হতে চেয়েছেন। আর এর জন্য তিনি বিয়ে করেছেন সিরীয় কবি নিজার কাবানির ভগিনী রানা কাবালিকে। কিন্তু তা টেকেনি। এক দশক পরে বিয়ে করেন মিশরীয় অনুবাদক হায়াৎ হিলিকে। তাও ভেঙে যায়। ভাঙন ও বিপন্ন অস্তিত্বেও মুখোমুখি হয়েও তিনি কখনও জীবনের ধর্ম থেকে বিচ্যুত হননি। কবিতার ভাষা, প্রকরণ জায়গা বদলে ফেলার মতো জীবনের প্যাটর্নকেও তিনি বদলেছেন। কবিতাকে যেমন ভালবেসেছেন তেমনই ভালবেসেছেন জীবনকেও। তিনি মনে করতেন: ‘জীবনের ধর্ম প্রেম ও প্রেমে পড়া’। তিনি ১৯৮৭ সালে পিএলও’র সদস্য হন। লেখালেখির পাশাপাশি ফিলিস্তিনি মুক্তি-আন্দোলনের এক সক্রিয় সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্রের মুসাবিদা প্রণয়ন করেন। কেবল ফিলিস্তিনি সংগ্রাম নয়, সারা বিশ্বের সকল মুক্তি-সংগ্রামের প্রতি ছিল তাঁর গভীর সমর্থন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কেও তাঁর জানার আগ্রহ ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ করে তিনি জেনেছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমস্যা-সম্ভাবনা এবং শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে। পৃথিবীর সকল মানবতাবাদী কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে দারবিশের ছিল হার্দিক সম্পর্ক। নাইজেরিয়ার নোবেল-বিজয়ী লেখক ওলে সোয়িস্কা, মার্কিন লেখক রাসেল ব্যস্কস, মার্কিন চলচ্চিত্রকার অলিভার স্টোন, পর্তুগিজ নোবেল-বিজয়ী লেখক হোসে সারামাগো ছিলেন তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু। তবে বেশি সখ্য সম্পর্ক ছিল সমসাময়িক ফিলিস্তিনি (পরে মার্কিন) চিন্তানায়ক, ‘প্রাচ্যবাদ’-খ্যাত এডওয়ার্ড সাঈদের সঙ্গে। আদর্শ ও দর্শনগত দিক দিয়ে তাঁরা দুজনে খুবই কাছাকাছি ছিলেন। দারবিশ ও সাঈদ দুজনেই জায়ানবাদের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে ছিলেন অবিচল ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দারবিশের কবিতা সাঈদের চিন্তাজগৎকে আলোড়িত-বিস্ফোরিত করেছে, দারবিশের কবিতার ভুবনও সাঈদের বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক চিন্তার অনুগামী। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা এবং মানবমুক্তির সংগ্রামে দারবিশ ও সাঈদ দুজনেই ছিলেন সামনের কাতারের সৈনিক। সাঈদের উদ্দেশে লেখা এক কবিতায় দারবিশ উচ্চারণ করেছিলেন:

‘তিনি শেষ মহাকাব্যের মহানায়কের মতো
ট্রয়ের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করে চলেছেন
অন্যদের নিজের ন্যারেটিভের ভাগ দেয়ার জন্য।’

সাঈদের মতো মাহমুদ দারবিশও ছিলেন ‘আকাশের মতো উঁচু’ মহাকালের মহানায়ক। তাঁর কবিতার পংক্তিমালা মহাকালের সামনে দাঁড়াবে নম্র বিনয়ে নয়, উদ্ধত স্পর্ধায়— এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। উচ্চারিত হবে মুক্তিসংগ্রামের মিছিলে, উৎকীর্ণ হবে দেয়ালে, পোস্টারে।

ঋণ স্বীকার:
১. গাজী সাইফুল ইসলাম (অনূদিত): মাহমুদ দারবিশের কবিতা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা, এপ্রিল ২০১৯
২. আদিল মাহমুদ (অনুবাদ): ফিলিস্তিনি ক্ষতের দিনপঞ্জি, চৈতন্য প্রকাশনী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০২০
৩. শরীফ আতিকুজ্জআমান (সম্পাদিত): মাহমুদ দারবিশ পাঠ ও বিবেচনা, সংবেদ, ঢাকা, ২০১৫

চিত্র: গুগল
3.7 3 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | প্রথম পর্ব

আমাদের খেলা করা দরকার, তাই আমাদের কয়েকজন ছেলে মিলে ক্লাব তৈরি করতে হবে। কোথায় করা যায়? — অমুক জায়গায় — ওই জায়গাটা পড়ে আছে, তা যাদের জায়গা তারা বললেন, “ওই তো ওখানে জঙ্গল হয়ে আছে, তা যদি তোমরা জঙ্গল-টঙ্গল পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে ক্লাব তৈরি করতে পার তো করো।” আমাদের আর পায় কে — আমরা মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলে। উদ্ধার করলাম। উদ্ধার-টুদ্ধার করে এর বাড়ি থকে চারটে বাঁশ, ওর বাড়ি থেকে তিনটে হোগলা এভাবে যোগাড়-যন্ত্র করে-টরে একটা চালাঘর তৈরি করা হলো। সেই চালাঘরকেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে আমাদের নতুন লাইব্রেরী তৈরি হলো। ক্লাবের নাম হলো ‘সেনহাটি অ্যাথলেটিক ক্লাব’।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বাঘেশ্বরীদেবীর পুজো! সেই থেকেই ‘বাগনান’!

ছোট্ট ওই ভূখণ্ডটি বাঘের উপস্থিতির জন্যই তখন ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয় বলে প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরার অভিমত। এই বিষয়ে তিনি আরও জানান, আরবি ভাষা অনুযায়ী ‘নান’ কথার অর্থ হল ‘চরভূমি’। ‘নান’ শব্দের আরও একটি অর্থ হল ‘ছাউনি’। তখন কাছারিপাড়া ছাড়াও নদী সংলগ্ন বেশ কয়েকটি এলাকায় ইংরেজ সেনাদের ছাউনি ছিল বলে জানা যায়। যার মধ্যে খাদিনান, পাতিনান, খাজুরনান, বাইনান, চিৎনান, মাছিনান ইত্যাদি জনপদগুলি উল্লেখযোগ্য। যেহেতু নদীর চরে বাঘেশ্বরী দেবীর পুজো হত, সেই জন্য প্রাথমিকভাবে এলাকাটি ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ‘বাঘনান’ অপভ্রংশ হয়ে ‘বাগনান’-এ পরিণত হয়েছে।

Read More »
আবদুল্লাহ আল আমিন

কবিগান: সমাজবাস্তবতা, বিষয়বৈভব ও রূপবৈচিত্র্য

এমন লোকপ্রিয় বিষয় বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা ভাষা, সঙ্গীত ও সাহিত্যে কবিগান ও কবিয়ালদের অবদানের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগান সংগ্রহ এবং এ বিষয় পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে কবিয়ালদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান কিংবা কবিগানকে সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক এ গানকে সংরক্ষণ করার সুপারিশ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই গানের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে লোকায়ত বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা দিক যার অধিকাংশই অনালোচিত ও অনালোকিত রয়েছে অদ্যাবধি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার: মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভা

সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন, এবং জাতীয় কংগ্রেসে নিয়মিত যোগ দিতেন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ববর্তী বছরের জাতক এবং প্রখর প্রজ্ঞাবান অশ্বিনীকুমার ১৮৯৭-এর কংগ্রেসের অমরাবতী অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে একে ‘Threedays’ mockery’,— ‘তিনদিনের তামাশা’ বলে উল্লেখ করেন। দুর্ভাগ্য দেশের, তাঁর কথা অনুধাবন করলেও কেউ গুরুত্ব দেননি। সে-অধিবেশনের সভাপতি চেট্টুর শঙ্করণ নায়ারকে নিয়ে অক্ষয়কুমার-অনন্যা পাণ্ডে অভিনীত বায়োপিক তৈরি হয়েছে। অথচ সারা উপমহাদেশ-কাঁপানো অশ্বিনীকুমারের মূল্যায়ন আজ-ও অপেক্ষিত।

Read More »
দীপক সাহা

বন্দুকের মুখে দাঁড়িয়ে ইতিহাসকে লেন্সবন্দি করেছেন সাইদা খানম

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে উপমহাদেশের বিখ্যাত প্রায় সকল ব্যক্তিত্ব— ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী, বেগম সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আশাপূর্ণা দেবী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়— কার ছবি তোলেননি! সেই সঙ্গে রানি এলিজাবেথ, মাদার টেরেসা, মার্শাল টিটো, অড্রে হেপবার্নের মতো বিখ্যাত মানুষদের ছবিও তুলেছেন। এই বিশাল তালিকায় আরও তিনটি নাম যুক্ত করে না দিলে অন্যায় হবে। চন্দ্রবিজয়ী নিল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিনস, মাইকেল কলিন্সের ছবিও তুলেছেন তিনি।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

মামলায় জয়ী হয়ে থোড় কুঁচি দিয়ে কালীর আরাধনা করেন জমিদার-গিন্নি

দেবী কালিকার খড়ের মেড় দেখে মজুমদার গিন্নি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, মামলার রায় যদি তাঁদের পক্ষে যায় তাহলে কলাগাছের থোড় কুঁচো দিয়ে হলেও জগজ্জননী মা মহাকালীর পুজো করা হবে, আর যদি মামলার রায় তাঁদের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে ওই খড়ের মেড় দামোদরের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। যদিও সেদিন দুপুরের মধ্যেই আদালত থেকে মজুমদার জমিদার পক্ষের জয়লাভের খবর পৌঁছেছিল থলিয়ার মজুমদার বাড়িতে। মজুমদার-গিন্নিও অক্ষরে অক্ষরে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। মামলায় জয়লাভের খবর পাওয়া মাত্রই জমিদার-গিন্নির নির্দেশে প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দীপাবলি উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে যায়।

Read More »