Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

মৃত্যুহীন জীবন

১৯৭২ সাল। স্বাধীনতার পরে ইন্ডিয়া গেলাম। অনেকদিন ছিলাম বহরমপুর মাসি বাড়ি। এটা দামোদরের (যদিও গঙ্গা বলেই ডাকে) উল্টোদিকে, গোয়ালজান গ্রামে। বাড়ির সঙ্গেই স্কুল। তাই শুরু করলাম স্কুলে যাওয়া। ১৯৬৯ সালে যখন প্রথম ইন্ডিয়া যাই, তখনও ওই স্কুলে কিছুদিন গেছিলাম। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ক্লাস ছিল না, তাই মনে হয় স্কুলের প্রতি বেশ টান ছিল। ঘুম থেকে উঠেই চলে যেতাম স্কুলে। বাংলা বইয়ে বিভিন্ন গল্প ছিল। এখনও মনে আছে নেতাজি সুভাষ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন। যদি ভুল না করি ‘অবাক জলপান’ সেখানেই ছিল। আর ছিল গ্রিক গায়কের গল্প। মা ছিলেন নেতাজির ভক্ত। মায়ের মুখে নেতাজির কথা শুনতে শুনতে কবে যে নিজেই তাঁর অনুরাগী হয়ে যাই। এরপর ছিল তাঁকে নিয়ে অনেক গল্প, অনেক পড়া। এক ধরনের অলৌকিক আওরা ছিল তাঁকে ঘিরে। পরে শানেওয়াজ খানের ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ায়। প্রায়ই তপনদার আলমারি থেকে ওই বইটা নিয়ে পড়তাম। অনেক পরে যখন সিঙ্গাপুর যাই মনে মনে খুঁজে বেড়াই তাঁকে। ‘আমি সুভাষ বলছি’ বার্লিন থেকে নেতাজির বেতারভাষণ সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের মতই আমাকে নাড়া দিত।

১৯৮৩ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করতে আসি আর সোভিয়েত জনগণের ওপর হিটলারের বাহিনীর অত্যাচারের কথা শুধু বইয়ে পড়ে নয়, সারা সোভিয়েত দেশে ছড়িয়ে থাকা সেই বর্বরতার চিহ্ন দেখি, নেতাজি হিটলারের সাহায্যে ভারত স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন বলে কষ্ট পেয়েছি। সে সময়ে নেতাজির প্রতি আবেগে অনেকটাই ভাটা পড়ে। পরে তাঁর ‘An Indian Pilgrim’, ‘The Indian Struggle’, রুদ্রাংশু মুখার্জির ‘Nehru and Bose: Parallel lives’ এসব বই পড়ে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়। নতুন করে নেতাজিকে ভালবাসতে শিখি। নেতাজি ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অনুসারী। একসময় সি আর দাশ আর মতিলাল নেহরু খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং তাঁরা স্বরাজ পার্টি গড়ে তোলেন। এ সত্ত্বেও জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে নেতাজির কখনওই তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। শুধু তাই নয় গান্ধী, মৌলানা আজাদ, বল্লভভাই প্যাটেল— এঁদের সঙ্গে সুভাষ বসুর সম্পর্ক ভাল ছিল না, যদিও নেতাজি প্যাটেলের বড়ভাইয়ের বিশ্বাসভাজন ছিলেন। কংগ্রেসের ভেতর তাঁরা দুই ভিন্ন ধারার প্রতিনিধি ছিলেন। এ সবই শুধু কংগ্রেসের ভেতরের নয়, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে যে বিভিন্ন পরস্পর-বিরোধী স্রোত ছিল, সেটাই প্রমাণ করে। আর এই দলাদলিই শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সমস্যা সামনে নিয়ে আসে যার ফলে আমরা পাই বিভক্ত ভারত। তাই নেহরুর ‘An autobiography’ বা গান্ধীর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘An experiment with the truth’ বা মৌলানা আজাদের ‘India wins freedom’ বইয়ে নেতাজির তেমন উল্লেখ না দেখে অবাক হইনি। আসলে, বাংলার বাইরের লেখকেরা কখনওই নেতাজিকে নিয়ে তেমন কিছু লিখেছেন বলে মনে হয় না, তারা অতি যত্নে তাঁর প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন। হতে পারে আমি নিজে হয়তো সেসব লেখার সঙ্গে পরিচিত নই। কিন্তু সুনীল গাঙ্গুলির ‘প্রথম আলো’-য় যেখানে সমসাময়িক ছোটবড় সবাই অল্পবিস্তর পরিসরে সামনে এসেছেন সেখানে নেতাজির পরিপূর্ণ অনুপস্থিতি ছিল অবাক করার মত। যে সময় ও যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই বই লেখা হয়েছে সেখানে নেতাজি মিসিং এলিমেন্ট হয়েই থেকে গেছেন। অবশ্য প্রথম আলো ইতিহাস নয়, ঐতিহাসিক পটভূমিতে লেখা উপন্যাস। সেখানে কাকে রাখবেন আর কাকে রাখবেন না সেটা লেখকের ব্যাপার। তবে যারা সেই সময়ের বাংলা বা ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত তাদের মনে এই প্রশ্নটা আসতেই পারে।

মানুষমাত্রই ভুল করে, তবে কিছু ভুল ইচ্ছাকৃত, ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের হিসেব-নিকেশ থেকে, কিছু ভুল মানুষ করে পথ খুঁজতে গিয়ে। জানি না, কী হতে পারত নেতাজি বেঁচে থাকলে, তবে এ নিয়ে ভাবতে মানা নেই। যদি আমেরিকার দিকে তাকাই কী দেখি? লড়াই করে অর্জিত স্বাধীনতা তাদের সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন করেছে, তাদের পৃথিবীর অন্যতম সফল জাতিতে পরিণত করেছে। বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আমার সেটাই মনে হয়। একাত্তরে দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের ফলে আমাদের দেশেও এক ধরনের দেখিয়ে দেওয়ার মানসিকতা গড়ে উঠেছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া সন্তান যেমন সব সময় অন্যদের দেখিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে আমরাও কিন্তু সব সময় চেষ্টা করি সব ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যেতে। ভারতকেও। ভারত আর পাকিস্তান লড়াই করে আজাদি অর্জন করেনি, করেছে ইংরেজের কাছে আবেদন-নিবেদনের মধ্য দিয়ে। তাই এরা কখনও ইংল্যান্ডকে ছাড়িয়ে যাবার কথা ভাবেনি, বরং তাকে অনুসরণ করেছে। নেতাজি ভিন্ন পথে গিয়েছিলেন। তিনি অনুগ্রহ নয়, লড়াই করে ভারত স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। সেটা হলে হয়তো দেশভাগ হত না, হলেও দেশেও মানুষ হত ভিন্ন রকমের, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। এটাই হয়তো ভারতকে আলাদা করত, ভারতকে অন্য পথে নিয়ে যেত। সবচেয়ে বড়কথা, তিনি ক্ষমতার জন্য নিজের স্বপ্নের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করেননি। আজীবন যে স্বপ্ন দেখেছেন সেটা অর্জনের জন্য নিষ্ঠার সঙ্গে লড়াই করে গেছেন। নিজেকে বিশ্বাস করা, নিজের স্বপ্নকে বিশ্বাস করা— ক’জন সেটা পারে। আজ তাঁর জন্মদিন। মৃত্যু নিয়ে রহস্য তাঁকে মৃত্যুহীন করেছে। নেতাজি মৃত্যুহীন। শুভ জন্মদিন। বার বার আমরা যেন শুধু জন্মদিনেই নয় অন্য সময়েও তাঁকে স্মরণ করি, তাঁর দেখানো পথ থেকে শিক্ষা নিয়ে সমাজ ও দেশ গড়তে মনোযোগী হই আর তিনি যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ এসবের ঊর্ধ্বে উঠে আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়ে তুলেছিলেন দেশকে যেন সেভাবেই গড়ে তুলতে উদ্যোগী হই।

দুবনা, ২৩ জানুয়ারি ২০২৩

চিত্র: গুগল
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শতবর্ষে মহানায়ক উত্তমকুমার

‘মহা’ শব্দটি মহান আর বিশাল, এই দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ‘মহাকাব্য’ বা ‘মহারাজ’। কাব্য আর রাজার চেয়ে তার মাত্রা ভিন্ন, মহিমা অনেক বেশি তাৎপর্যময়। উত্তম বাংলা চলচ্চিত্রের সেই তাৎপর্যময়তার একমাত্র উদাহরণ। যাঁকে শ্রদ্ধাভরে আমরা ‘কিংবদন্তি’-ও বলে থাকি। তাই সত্যজিৎ রায়ের মতো আরেক কিংবদন্তি তাঁকে নিয়ে চিত্রনাট্য লেখেন, ছবি বানান, আর সে ছবির ‘নায়ক’ হন উত্তমকুমার।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সুকান্ত ভট্টাচার্য: ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার সহোদর এক কবি

‘–ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে’, সুকান্ত লিখেছেন নিজের সম্পর্কে। বলেছেন, ‘আমি এক অঙ্কুরিত বীজ’। এই বীজ মহীরুহে পরিণত হতে পারল না, বাংলা সাহিত্যের পরম দুর্ভাগ্য এটা। কিন্তু তাঁর একুশ বছরের জীবনে তিনি আভাস দিয়ে গেছেন, তাঁর সম্ভাবনা কতদূর প্রসারিত হতে পারত। সুকান্ত মানে একজন কবিমাত্র নন, তার চেয়েও আরও অধিক কিছু।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাইশে শ্রাবণ ও প্রসঙ্গত

প্রয়াণের আগে, সব হিসেব বাদ দিয়ে যদি তাঁর জীবনের শেষ পাঁচ বছরের কথা-ই ধরি, দেখব, কত প্রিয়জনের মৃত্যুশোক বহন করতে হয়েছে তাঁকে। যেহেতু তিনি ছিলেন মানুষের সান্নিধ্যপ্রিয়, তাই অন্যের চেয়ে ঢের ঢের বেশি মৃত্যুবেদনা সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। এসব মৃত্যু তাঁকে বেদনার্ত করলেও নিজের মনোবলের জোরে সে-অরুন্তুদ বিষাদকে কাটিয়েও উঠেছেন। পাশাপাশি মৃত্যু নিয়ে তাঁর দর্শন গড়ে উঠতেও তা ভূমিকা রেখেছে। তাই তিনি বলতে পারেন, তিনি-ই বলতে পারেন, ‘দুদিন দিয়ে ঘেরা ঘরে/ তাইতে যদি এতই ধরে/ চিরদিনের আবাসখানা সেই কি শূন্যময়?’ কেন পারেন?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার: অন্য ও অনন্য

তাঁর জন্মদিনের চেয়েও মৃত্যুদিনটিকে অধিকভাবে স্মরণ করা হয়, এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। তাছাড়া বাংলা চলচ্চিত্র-জগতে তো কম খ্যাতিমান ব্যক্তির আবির্ভাব হয়নি, সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল, ছবি বিশ্বাস-কানন দেবী-সুচিত্রা-সৌমিত্র, তবু তাঁর মতো, ঠিক তাঁর মতো স্মরণযোগ্য হয়ে রইলেন না কেউ। শ্রাবণের অনুষঙ্গে নয়, উত্তমকুমারের প্রয়াণদিবসটি চিহ্নিত চব্বিশে জুলাই তারিখটির বিধুরতায়। ১৯৮০-র এই দিনটিতে বাংলা চলচ্চিত্র-জগতের এই দিকপাল প্রতিভার জীবনাবসান ঘটে। আজ তাঁর মৃত্যুর পঁয়তাল্লিশ বছর পূর্তিতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করে উত্তম সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্যের ডালি।

Read More »
শৌনক দত্ত

রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী

নাটকটির নাম প্রথমে রেখেছিলেন যক্ষপুরী, তারপর নন্দিনী এবং পরিশেষে রক্তকরবী নামে থিতু হয়। শিলং-এ ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে যে নাটক লেখা শুরু হয়েছিল তার দশম খসড়া প্রকাশিত হয় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রায় দেড় বছর পর আশ্বিন ১৩৩১ বঙ্গাব্দে—১৯২৪ সালে। প্রকাশিত হবার পরেও, একাদশতম খসড়া প্রস্তুত করার কথা ভাবেন নাট্যকার। অনেকেই বলেছেন, এটি নাট্যকারের হৃদয়ে লালন করা কোনও স্বপ্ন। কেউ কেউ এই নাটকের মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম চেতনার ছায়া খুঁজেছেন। নানা প্রশ্ন, নানা যুক্তি নিয়ে নাটকটি রচনার পর থেকে সমসাময়িক সময় পর্যন্ত দারুণ আলোচিত ও জনপ্রিয়। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত নাটকটি নিয়ে বহু আলোচনা। শতবর্ষে এসে দাঁড়ানো সেই রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নানামাত্রায় বিবেচনাযোগ্য একটি নাটক; বহুমাত্রিক এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ।

Read More »
নুশান জান্নাত চৌধুরী

নুশান জান্নাত চৌধুরীর কবিতাগুচ্ছ

কিছুকাল ঘুমিয়ে, কিছুকাল লুকিয়ে,/ কিছু শহর, কিছু মানুষের ভিড়ে হারিয়ে/ আমি দেখি—// কোনও এক/ পথহারা দেবদূতের বিষণ্ণ ডানার পাশে/ আমি বুক পেতে দিয়েছি// চুলের ভেতর জন্ম নিয়েছে/ ঘাসফুল থোকা থোকা, বুকের মাঝখানে একটা প্রাচীন পেরেক,// ঝরাপাতার রাজ্যপাটে/ আমার বাম হাঁটুতে গেঁথে আছে—/ আগামী বছরের প্রথম সন্ধ্যা;

Read More »