আর কিছুক্ষণের মধ্যে স্কুলের ছুটির ঘণ্টা বাজবে। শুধু আজকের জন্য নয়, অনির্দিষ্টকালের জন্যে এই ছুটি। এবারের গ্রীষ্ম যে রকম ভয়ংকর রুদ্ররূপ ধারণ করেছে তা দেখে সরকার বাচ্চাদের কষ্টের কথা ভেবে হঠাৎ এই ছুটি ঘোষণা করেছে। তার মানে ধরা যেতে পারে নির্ধারিত গরমের ছুটির পরে অর্থাৎ সেই জুন মাসে আবার স্কুল খুলবে। আর একটু পরেই ছুটির ঘণ্টা বাজবে ঢং ঢং ঢং করে। আহা কী মজা!
ভাবতেই এই তীব্র গরমেও শরীরে কী সুন্দর হাওয়া লাগে। টের পায় রোহণ। মাস্টারমশাই ক্লাসে ছুটির পড়া দিচ্ছেন, খেয়াল নেই। তার দৃষ্টি জানালার বাইরে। বাইরে তখন ধূ ধূ আগুন জ্বলছে! আকাশ পুড়ে ছাই! অথচ ওই ধূ ধূ আগুনের ভেতর ডানা মেলে একটা চিল কে জানে কেন, কী নিশ্চিন্তে অবিরাম চক্কর কাটছে পোড়া আকাশে। রোহণ দেখছে, আর তার মনে হচ্ছে ওই চিলের ডানাদুটি যদি সে এক্ষুনি পেত, উড়ে চলে যেত আপন গ্রামের নিজ বাড়িতে। মায়ের কাছে। বোনের কাছে। আব্বার কাছে।
না, আব্বার কাছে যেতে চায় না রোহণ। আব্বাকে তার ভাল লাগে না। আব্বার জন্যেই তাকে এই এতদূরের মিশন স্কুলে পড়তে আসতে হয়েছে। এখানে না এলে নাকি সে মানুষ হবে না! তাহলে তার আব্বা কী করে মানুষ হয়েছে? দাদু কী করে মানুষ হয়েছিল? মনে এমন প্রশ্ন দেখা দিলেও সেদিন আব্বাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনি। বরং আব্বার ইচ্ছেমত সবাইকে ছেড়ে তাকে বাধ্য হয়ে চলে আসতে হয়েছিল।
আব্বা যেদিন তাকে নিয়ে এসেছিল এই মিশন স্কুলে, সেই দিনটাকেও খুব মনে আছে রোহণের। তাকে নিয়ে আব্বার যে স্বপ্ন— লেখাপড়া করে মানুষের মত মানুষ হওয়া! আব্বা সেই ব্যাপারেই সারাটা পথ তাকে জ্ঞান দিয়েছিল। যদিও সেসব কিছুই তার কানে ঢোকেনি। সে তখন ভাবছিল তার গ্রামের স্কুলের কথা, বন্ধুবান্ধবের কথা, পাড়াপড়শির কথা, আত্মীয়স্বজনদের কথা। সবাইকে ছেড়ে আসতে তার খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু আব্বার ইচ্ছের কাছে তার সেই কষ্টের কোনও মূল্য ছিল না সেদিন। বোন তার জন্য কাঁদলেও মা কোনও আপত্তি করেনি। একরকম প্রায় ঠেলে আব্বার সঙ্গ ধরিয়ে দিয়েছিল।
আব্বার ওপর রাগ হলেও সেদিন মায়ের ওপরেও তার খুব অভিমান হয়েছিল। ভেবেছিল জীবনে আর কোনও দিন মায়ের সঙ্গে কথা বলবে না। হয়তো আর কখনও বাড়িতেই ফিরবে না। যদিও সেসব কিছুই মনে নেই এখন। বরং বাড়ির কুকুরটা— লালুর কথা মনে পড়ছে। লালু তার সবসময়ের সঙ্গী ছিল। এমনকি, সে যখন যখন স্কুলে যেত, লালু তার সঙ্গ ধরত। সে ক্লাসে থাকলে, লালু স্কুলের গেটে বসে তার জন্য অপেক্ষা করত। তাদের আমবাগানটার কথাও মনে পড়ছে। নিশ্চয় প্রচুর আম হয়েছে এবার! শুধুই কি আম? লিচু গাছে লিচু, তালগাছে তালও হয়েছে প্রচুর! তার দাদু বলতেন, ‘কেউ যদি এক মরশুমে একশোটা আম, একশোটা লিচু আর একশোটা তালশাঁস খায়, সে তাহলে হানিফ পালোয়ানের থেকেও মস্ত বড় পালোয়ান হবে।’ তাদের গ্রামের হানিফ পালোয়ানের খুব নাম ছিল আশপাশের গ্রামেও। আমতির লড়াইয়ে এলাকায় হানিফ নামের সেই লোকটা প্রতি বছর চাম্পিয়ান হত। রোহণের মনে পড়ে, সেই হানিফ পালোয়ানের মত পালোয়ান হওয়ার জন্যে সে একবার গুনে গুনে আম, লিচু আর তালশাঁস খাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত সব মিলিয়ে মোট একশোই ছুঁতে পারেনি।
এবার বাড়ি ফিরে আবার চেষ্টা করবে, রোহণ ভাবে। দেখবে দাদুর কথামত সত্যিই সেটা পারে কিনা! তার বন্ধুদের মধ্যে শালিমুদ্দিন আছে, নৌসাদ আছে। ওরা দু’জন যে-কোনও গাছে চড়তে ওস্তাদ। ওদের গাছে উঠিয়ে আম পাড়াবে, লিচু পাড়াবে, তালের কাঁদি কাটবে। তারপর সবাই মিলে বাগানেই বসে বসে খাবে। তবে আর এক বন্ধু আজাদকে সঙ্গে নেবে না। আজাদ একবার তাদের সবার সঙ্গে বেইমানি করেছিল। যা নিয়ে রীতিমত হাতাহাতি হবার উপক্রম। রোহণের মনে পড়ে, তারা চাঁদা তুলে একটা ফুটবল কিনেছিল সেবার। বিকেলবেলা কৎবেলতলার মাঠে খেলবে বলে। সেটা রাখা থাকত আজাদের কাছে। কিন্তু খেলার সময় হলে বল তো দূর, আজাদেরই খোঁজ পাওয়া যেত না। বাড়ি খুঁজতে গেলে আজাদের মা বলত, ‘কে জানে বেটা কুন্ঠে গেলছে!’ তারপর খুঁজতে খুঁজতে শেষপর্যন্ত যখন আজাদকে পাওয়া যেত তখন সূর্য আর আকাশে নেই। কৎবেলতলার মাঠে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। বাড়িতে পড়তে বসার সময় তখন। একদিন আজাদকে তাই চাঁদা দেওয়ার কথা বলে মেজাজ দেখিয়েছিল। আজাদও কম যায়নি, তার সঙ্গে হাতাহাতি না করে বলটাকে হেঁসো দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করেছিল। তারপর যে যেমন চাঁদা দিয়েছিল তাদের ভাগ করে দিয়েছিল। এই ঘটনা থেকে আজাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল তারা।
রোহণ মনে মনে স্থির করে, এবার সে পুরো গরমের ছুটিটাই তাদের বাগানে কাটাবে। গুলতি দিয়ে ঘুঘু মারবে, ডাহুক মারবে, তিতির মারবে। ফাঁদ পেতে বনমুরগি ধরবে। বাগান পাহারাদার ঝাবরাচাচা তো আছেই, তাকে দিয়ে বাগানেই রান্না করাবে। আর আজাদ বাদে সব বন্ধুবান্ধব মিলে খাবে।
হঠাৎ বাগানের মধ্যে তাদের যে পুকুরটা আছে, সেটার কথা মনে পড়ে রোহণের। আহা যেমন সুন্দর পুকুর! তেমনি তার টলটলে পানি। চারপাশে নানা রকমের গাছগাছালি। সেই ভিড়ে একটা বিলাতি আমড়ার গাছ আছে। কোন কালে তার দাদু নাকি কোথা থেকে এনে লাগিয়েছিল! ঝাঁকড়া একটা কাঁঠালিচাপার গাছও আছে। এতই ঝাঁকড়া যে কোথায় তার ফুল ফুটিয়ে রাখে খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ গোটা বাগান তার গন্ধে ম ম করে। সেই গন্ধ শুঁকে শুঁকে কাঁঠালিচাপা ফুল খুঁজতে গিয়ে টুনটুনি পাখির বাসা খুঁজে পেয়েছিল একবার। কী তুলতুলে একটা বাসা। তাতে কী সুন্দর দু’টি ছানা! তাকে দেখে চিঁচিঁ করে ডেকে উঠেছিল। বাড়ি ফিরে বোনকে বলেছিল সেকথা, ‘জানিস— আজ বাগানে পুকুরপাড়ের জঙ্গলে টুনটুনির বাসায় দু’টি বাচ্চা দেখেছি। আমাকে দেখে আনন্দে চিঁচিঁ করে ডাকছিল।’
বোন বলেছিল, ‘আনন্দে নয়— তোর ভয়ে চিঁচিঁ করেছিল।’
সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমার ভয়ে কেন? আমি আবার কী করলাম?’
‘তুই কিছু না করলেও তোর চেহারাটা এমন যে, টুনটুনির ছানা কেন— মানুষের ছানাও তোকে দেখলে ভয় পেয়ে চিঁচিঁ করে উঠবে!’
একথা শুনে বোনের ওপর খুব রাগ হয়েছিল তার। আর বোনকে মারতে তেড়েছিল।
আজ বাড়ি ফেরার দিনে কতকিছু মনে পড়ছে রোহণের। কিন্তু স্কুলে ছুটির ঘণ্টা পড়ছে না কেন? খুব বিরক্তি লাগছে তার। পোড়া আকাশ থেকে চিলটাও কোথায় হারিয়ে গেছে। বাইরে আকাশের সূর্যটা এতই তীব্র যে মনে হচ্ছে প্রচণ্ড গরমে রোদ তিড়বিড় করে নাচছে।
রোহণের এমন ভাবনার মধ্যে স্কুলের ছুটির ঘণ্টা বাজে কী বাজে না, একসময় দেখা যায় মাস্টারমশাই ক্লাসরুম ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। দেখাদেখি ছাত্রছাত্রীরাও। শেষপর্যন্ত রোহণও বেরিয়ে আসে। তবে হুড়োহুড়ি করে নয়, খুব ধীরেসুস্থে। তখন স্মৃতিভারে তার গতি এতই মন্থর, ঠিক যেন এই মধ্যাহ্নের আকাশের সূর্যটা।
দুই
ওভাবেই স্কুল হোস্টেলে ফিরে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে বাসে চড়ে শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে যায় রোহণ। মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত একটি গ্রামে তার বাড়ি। ট্রেনে সময় লাগে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার মত। শিয়ালদার মেন লাইনের শেষ স্টেশনে নেমে ট্রেকার চড়ে যেতে হয়। বাড়ি পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। বাড়িতে একটা ফোন করে দিলে স্টেশনে নিশ্চয় আব্বা দাঁড়িয়ে থাকবে।
কিন্তু বাড়িতে ফোন করে না রোহণ। আব্বার ওপর রাগ আর মায়ের ওপর অভিমান থেকেই করে না। তাছাড়াও একা একা বাড়ি ফিরে সবাইকে চমকে দেবার ইচ্ছেও হয় তার। বিশেষ করে বোনকে।
ন’য়ের এ প্ল্যাটফর্মে লালগোলা প্যাসেঞ্জার দাঁড়িয়ে আছে। রোহণ অনুসন্ধান অফিসে খোঁজ নিয়ে জিজ্ঞেস করতে করতে গিয়ে চড়ে সেই ট্রেনে। কামরায় খুব ভিড়। বসার জায়গা নেই। অধিকাংশই তার বয়সী ছেলে। কিন্তু এরা যে কেউ তার মত ছাত্র নয়, তা সে বুঝতে পারে। বেশভূষা, চেহারায় সবাই কেমন উস্কোখুস্কো! এরা কোথ্ থেকে আসছে? কোথায় যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে? কিছুই বুঝতে পারে না।
রোহণের কৌতূহল হয়। সে ওদের একজনকে জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় যাবে?’
ছেলেটি বলল, ‘বাড়ি।’
রোহণ আবার জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় তোমার বাড়ি? ’
ছেলেটি বলল, ‘মুর্শিদাবাদে।’
‘মুর্শিদাবাদের কোথায়?’
ছেলেটি যেন বিরক্ত হল! বলল, ‘লালগোলা চিনহেন?’
‘চিনব না কেন? আমার বাড়িও তো ওই লালগোলায়!’
‘কুন গাঁ?’
‘পিপলাসরাই।’
‘সেই নবাবপুলের পাশের গাঁ-টা লয়? পাহাড়পুরের মুড় থেক্যা যেতে হয়! যেখানে একটো দরগা আছে! মহরমের মেলা বসে? লাঠি খেলা, জারি গান, ঝান্ডী খেলা হয়!’
‘হ্যাঁ। কিন্তু তুমি এতসব জানলে কী করে?’
‘জানব না কেনি, হাঁরঘের গাঁয়ের নাম যে রাজারামপুর! হামরা প্রত্যেক বছর মহরমের মেলা দেখতে যাই সেখানে।’
‘রাজারামপুর তো সেই গঙ্গানদীর পাড়ে। যেখানে একটা শ্মশান আছে।’
‘গেলছ কুনুদিন?’
‘যাইনি। তবে নাম শুনেছি। আমাদের গ্রামের হিন্দুবাড়ির কেউ মারা গেলে সেখানে পোড়াতে নিয়ে যায়।’
ছেলেটির সঙ্গে পরিচয় হয়ে ভাল লাগে রোহণের। একসঙ্গে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে ভাবে সে। ছেলেটিও হয়তো সেরকম কিছু ভাবে। রোহণকে বসতে জায়গা দেয়।
রোহণ কৃতজ্ঞতা বশত জিজ্ঞেস করে, ‘কী নাম তোমার?’
‘বাবলু সেখ।’
‘কোথায় গিয়েছিলে?’
‘চেন্নাই।’
‘কোনও কাজ ছিল?’
‘সেখানে হামরা সব রাজমিস্ত্রির কাম করি। রমজানের ছুটিতে বাড়ি যেছি।’
রোহণ এই ক’মাস কলকাতাবাসে ভুলে গেছিল তাদের এলাকা থেকে প্রচুর ছেলেপুলে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে যায় তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, কেরালায়। তার একসময়ের খেলার সঙ্গী অনেকেই থাকে চেন্নাইয়ে। ছেলেটিকে দেখে, ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে বলতে, ওদের কথা মনে পড়ে তার।
তাহলে এই রমজানের ছুটিতে ওরাও বাড়ি আসবে নিশ্চয়! দেখা হবে সবার সঙ্গে! দেখা হবে কী, সবার সঙ্গে মাঠঘাট-আগানবাগানে ঘুরে বেড়াবে। গুলতি দিয়ে ঘুঘু মারবে, ডাহুক মারবে, তিতির মারবে। ফাঁদ পেতে বনমুরগি ধরবে। বাগানে রান্না করে খাবে। পুকুরপাড়ের কাঁঠালিচাপা গাছে ফুল খুঁজবে। টুনটুনির বাচ্চা পেলে বাড়ি নিয়ে গিয়ে পুষবে।
স্টেশনের পর স্টেশন পেরিয়ে ট্রেনটা যেমন যেমন ছুটছে, রোহণের ভাবনাও গতি পাচ্ছে। প্যাসেঞ্জারদের হৈ-হট্টগোল, হকারদের চিৎকার, তার ওপর প্রচণ্ড গরমে দম বন্ধ অবস্থা— না, কোনও কিছুই মনে হচ্ছে না তার। বরং গল্প করতে করতে হকারদের কাছে এটা-ওটা কিনে সে যেমন বাবলু নামের ছেলেটিকে দিচ্ছে, বাবলু ছেলেটিও এটা-ওটা কিনে তাকে খাওয়াচ্ছে। যেন বাবলু অপরিচিত কেউ নয়, ট্রেনসফরে তার সঙ্গী হয়েছে গ্রামের বন্ধুদের কেউ একজন।
তিন
বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায় রোহণের। বোন তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে আব্বা-মা জেগে আছে। তাকে দেখে তারা খুব অবাক হয়। আব্বা জিজ্ঞেস করে, ‘কী ব্যাপার— তুই?’
রোহণ কোনও রকমে বলল, ‘প্রচণ্ড গরমের জন্য স্কুলের ছুটি পড়ে গেল।’
ততক্ষণে মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। মায়ের চোখ থেকে পানি ঝরছে। আব্বা বলল, ‘ফোন করে একটা খবর দিলেই তো পারতিস! আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম।’
রোহণ কিছু বলে না। খবর সে দিতেই পারত, কিন্তু রাগ করে দেয়নি। আব্বা হোস্টেলে রেখে আসার পর একবারও যায়নি তার কাছে। কে জানে তার কথা মনে ছিল কিনা! সবসময় জোতসম্পত্তি নিয়েই তো ব্যস্ত থাকে লোকটা। দুনিয়ার কোনও খোঁজখবর রাখে না। কে জানে মা হয়তো তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সেজন্যেই কাঁদছে! সেকথা মাকে জিজ্ঞেস করতেও পারে না। পাশে আব্বা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আব্বা বেশিক্ষণ মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে না, ‘আমি একটু দেখে আসি ওদের বাড়ির কী অবস্থা! আর কোনও খবর এল কিনা!’ বলে আব্বা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
এই রাতে আব্বা আবার কাদের বাড়ি গেল? কাদের কী অবস্থা দেখতে গেল? রোহণের কৌতূহল হয়। সে আর চুপ থাকতে পারে না। মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মা— আব্বা কোথায় গেল? কাদের বাড়ির অবস্থা দেখতে? কার কী হয়েছে?’
মা বলে, ‘ওই যে আজাদদের বাড়ি! ছুঁড়া চেন্নাইয়ে না কোথায় রাজমিস্ত্রির কাম করতে যেই ভারা ভেঙে পড়ি সেখানকার হাসপাতালে ভর্তি আছে। সাঁঝের সুমায় খবর আলছে। খুব খারাপ অবস্থা নাকি, আল্লায় জানে বাঁচবে কিনা!’
রোহণ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, এতক্ষণ মা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল, এবারে সে মাকে জড়িয়ে ধরে, ডুকরে কেঁদে ওঠে। দূরে কোথাও ছুটির ঘণ্টা বাজে— ঢং ঢং ঢং…
সারা রাজ্য আজ কর্ম খোঁজে বাইরের রাজ্যে, রাজ্যের মধ্যে মুর্শিদাবাদ খোঁজে আরও বেশি। কেননা এই জেলা সরকারি নেকনজর থেকে অনেকটাই দূরে। তাই এখাের নব্বই শতাংশ পুরুষ কর্মসূত্রে বাইরে। তাদেরই কথা প্রচণ্ড দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। শিশুমনের কথা নীহারুল ইসলামের কলমে প্রাণ পায়, তা তাঁর ‘পরিকথা’ হোক কিংবা হোক ‘পিরনানার জ্বিন’, কিংবা ছোটোগল্প সমূহ। রোহণের মাধ্যমে যেভাবে শিশুমন ধরা দিয়েছে তা চমৎকার। চিল ওড়ার অনুষঙ্গটি মনে থেকে যায়। থেকে যায় অকৃতজ্ঞ বন্ধু আজাদের শেষ পরিণতি শুনে রোহণের চোখের জলের কথা। যার সঙ্গে মিশবে না বলে মনস্থির করে রোহণ, তারই জীবন-মরণ লড়াই তার চেপে রাখা অভিমান জলের ধারা হয়ে ঝরে পড়ে। শিশুমনের চমৎকার চিত্রণ। 🙏🙏🙏