Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ছোটগল্প: পিঁপড়া ও সাহিত্যসভা

সবুজ পাঞ্জাবিটা পরে মনের ভেতর কেমন খচখচ করছে। পাঞ্জাবি পরলে তার পিঠের হাড় দেখা যায়। গড়পড়তা মানুষের চেয়ে উচ্চতাটা একটু বেশি, তাই কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলে একটু ঝুঁকতে হয়। তখন দূর থেকে ঠিক হাড়গিলের মত দেখায়। কেউ বলেনি, নিজেই ব্যাপারটা রিয়েলাইজ করেছে। কিন্তু এত বড় একজন কবির সঙ্গে আর-একজন কবির প্রথম সাক্ষাৎ, পাঞ্জাবি ভিন্ন অন্য কোনও পরিচ্ছদে নিজেকে কল্পনাও করতে পারছে না কবি অনন্য মাহমুদ। অগত্যা খদ্দরের ববলিন-ওঠা পুরনো পাঞ্জাবিটা গায়ে টিকেট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে উসখুস করে। পেছন থেকে কে যেন পাঞ্জাবির খুঁটো ধরে টানে। বিরক্তিতে মুখ ব্যাদান করে বস্ত্র টানদাতার দিকে তাকায়।
—কী অইছে?
—আর কতক্ষণ?
—আমি কী জানি!
—ফোন লাগান না।
অনন্যর অসহিষ্ণুতা মাত্রা ছাড়ায়। এক মোচড়ে শরীরটা ঘুরিয়ে নিয়ে কবি সজীব সাদিকের মুখোমুখি হয়। সার্চলাইটের মত আক্রমণোদ্যত দুটো চোখ তাক করে তার দিকে।
—কালা অইছস? কানে কিছু যায় না?
সজীব সাদিক চোখরাঙানিকে বিশেষ একটা গ্রাহ্য করে না। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আবার থোতা বাড়ায়।
—ভাই, ক্ষুধা লাগছে।
নিষ্ফল ক্রোধ প্রদর্শন শেষে ক্লান্ত হয়ে পড়ে অনন্য। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দেয়। এ কোন পোলাপাইনরে নিয়া ঘুরতাছি! এত মোটিভেশন এত লাইফ হিস্টরি শুনানো সব বৃথা। এরা কবি হতে চায়। এক লাফে হেলাল হাফিজ। যে জলে আগুন জ্বলে। না জ্বইল্যা না পুইড়্যা হেলাল হাফিজ। বাহ। চোরাবালিতে পড়া ছাগশিশুটির যেমন ম্যা ম্যা করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না, তেমনি অবস্থা কবি অনন্যর। আর গরম দেখালে ব্যাটা বেয়াদব ওকে ফেলে চলে যেতে পারে। তখন খালি গায়ে কবির সামনে দাঁড়ানোর মত অবস্থা হবে তার। তাই তিক্ততা আর বাড়ানো যাবে না। বরং কৌশলী হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। মনে মনে অনন্য শোধ তোলার ছক কাটে। আগামী সংখ্যা থেকে সজীব সাদিক অফ। অন্য কোনও উদীয়মান কবির পেছনে ব্যয় হবে তার সম্পাদিত সাহিত্য কাগজ উদ্যম-এর পৃষ্ঠা। কিন্তু তা প্রকাশ করে না। উল্টো একটা আন্তরিকতার পরিবেশ তৈরিতে তৎপর হয়ে ওঠে অনন্য।
—একটু সবুর কর না ভাই। কবি আসুক…
—ধুরু ভাই, আইজ আপনার লাইগ্যা বাড়িত গিয়া ধমক খাওয়া লাগব। কইলেন দশটার ভেতর—
—হইছে রে ভাই হইছে একটা দিন…
কথা শেষ করতে পারে না, পিঠের উঁচু মালভূমিতে তেল গ্যাসের খোঁজে কূপ খোঁড়ার যন্ত্রণা টের পায়। ডান হাতটাকে পুরো উল্টো দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে যন্ত্রণাদাতার খোঁজ করে অনন্য।
—ছোট ভাই, একটু দেখবা।
সজীব সাদিক পাঞ্জাবির পেছনটা তুলে দিয়ে যেন গাড়ির পার্টস সারাতে নামে। অনন্য মাহমুদের তামাটে পিঠ থেকে চিমটি কেটে গোটা চারেক পিঁপড়া তুলে আনে। পিঁপড়াগুলো অনন্যর চোখের সামনে তুলে ধরে গৌরবের সঙ্গে বলতে থাকে সাদিক—
—ভাই, আপনার আর অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া লাগব না।
—ক্যান?
—জিওগ্রাফিতে দেখছি, কাউয়াগো স্কিন ডিজিজ অইলে পিঁপড়ার ডিবিত গিয়া গড়াগড়ি খায়। সারা গায়ে পিঁপড়া…
—ওই তুই আমারে কাউয়া বানাইলি!
—আরে ভাই, কথাটা তো শ্যাষ…
এ সময় স্টেশনের পিএ সিস্টেমটা ট্যাংটুং আওয়াজ দিয়ে বেজে উঠল। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে এক মহিলা ধীর লয়ে বলতে লাগল, সম্মানিত যাত্রীবৃন্দ, আর কিছুক্ষণের মধ্যে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ৭০২ ডাউন সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনটি চট্টগ্রাম স্টেশনের ৪নং প্লাটফর্মে প্রবেশ করিবে…
ঘোষণাটি কানে যেতেই তরুণ কবিদ্বয়ের অক্ষিযুগল নেচে ওঠে। কলের পানির ধরার মত করে চঞ্চল দুটো পায়ে প্লাটফর্মের দিকে ছুটল তারা।
—চলেন…
—আরে না, রাখ। আমরা কুলি নি? ব্যাগ টানতে টানতে আসুক। তার পর আমরা ফুল দিয়া রিসিভ করমু।
প্লাটফর্মের গেটের সামনে কবিদ্বয়ের মধ্যে খুচরো আলাপন চলে। স্টেশনের বড় টিভিতে শিম্পাজির ছবি দেখাচ্ছে। আট-দশটা ভবঘুরে নতুন বসানো অটবির চেয়ারগুলোতে বসে পরমাগ্রহে তা দেখছে। একজন স্বস্তিতে দু’পা মেলে দিয়েছে সামনে। চোখ খোলা; সঙ্গে মুখও। পাশের জন দু’পা তুলে এমনভাবে বসেছে, পা নামালেই কুমিরে খাবে। কবি অনন্যর চোখ এসব মানুষের দিকে। বিদ্যুতের মত তার মাথায় কবিতার লাইন খেলে ওঠে। যেখানে ঘড়ির কাঁটা স্থির। কী শক্তিমান প্রকাশ এই থেমে থাকা জীবনগুলোর। এর সঙ্গে লুপ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়ির সাযুজ্য খুঁজে পায় অনন্য। একপশলা সুখের বৃষ্টি যেন শুরু হয় তার বুকের ভেতরে। কী দারুণ একটা কবিতা সে প্রসব করতে যাচ্ছে। ভাব পুরো ফিট। এবার চরণগুলো বুঝেশুনে বসিয়ে দিলে হল। সাব্বিরের দোকানে গিয়ে কম্পোজ করে প্রিন্ট করিয়ে নিতে হবে। তার পর কয়েক কপি ফটোকপি। নিতাই দা’র ওখানে একটা আর দুটো ন্যাশনাল ডেইলিতে। হয়ে গেল। নিতাইদা ৭৫ টাকা দিবে এটা ঠিক। কিন্তু ন্যাশনালের রেট সে জানে না। জানার দরকারও নেই। আগে ছাপা হউক। তার পর সারাদেশে কেমন হইহই পড়ে যায় দেখা যাবে। কিন্তু সমস্যাও আছে। সাব্বিরের দোকানে গেলে ওকে বেঁধেও রাখতে পারে। গত দুই সংখ্যার কম্পোজের একটা টাকাও দেয়া হয়নি। সাব্বিরের ঘাড়ে বন্দুক রেখে বিনে পয়সায় প্লেটও করিয়ে নিয়েছে। সাব্বির জনে জনে তার বিরুদ্ধে আকথা-কুকথা বলে বেড়াচ্ছে। একবার বাগে পেলে… ভয়ে সারাটা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল কবি অনন্য মাহমুদের। থাক, কম্পোজ লাগবে না। হাতে লিখে পাঠাবে। রোল করা কাগজ নিচে রেখে গোটা গোটা অক্ষরে লিখবে। সম্পাদকের আশা করি পড়তে কষ্ট হবে না। কবিতা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে স্থির হয়ে বাস্তবের জমিনে ফিরে আসে কবি। কিন্তু কবি সজীব সাদিককে আশেপাশে খুঁজে পাওয়া যায় না। ডান হাত থেকে বাম হাতে ফুলের তোড়াটা রেখে পকেট থেকে ফোন বের করে। ফোন লাগায় সজীব সাদিককে।
—ভাই আমি তো আপনার পিছনে।
ঘাড় ফিরাতেই দেখে সাদিক চেয়ারে বসে টিভিতে শিম্পাজির রমণক্রিয়া দেখছে। বিশাল আকৃতির একটা মাদী শিম্পাজিকে সামাল দিতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ে গেছে তরুণ রোমিও।
—পিছনে আছস তো ফোন ধরলি ক্যান?
—বুঝুম ক্যামনে আপনার কল, আমার তো ডিসপ্লে নষ্ট।
বেয়াদবের সঙ্গে বাক্যব্যয় বৃথা। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয় অনন্য। প্লাটফর্মের দিকে তাকায়। তখনই হুইসেলের আওয়াজ শোনা যায়। দূরাগত আলোয় ধীরে ধীরে প্লাবিত হতে থাকে সম্মুখের শুষ্ক জমিন। আলোর স্রোতের সাথে ধেয়ে আসে ট্রেনটা। স্টেশনের শরীর থেকে ঝিনঝিনানি কেটে গিয়ে ব্যস্ততার লোহিত-সঞ্চালন শুরু হয়। লাল শার্ট পরা কুলিগুলো বর্গির মত ঝাঁপিয়ে পড়ে কামরাগুলোর ওপর। আগত যাত্রীদের ভিড় সামলাতে প্লাটফর্ম টিটিরা তৎপর হয়ে ওঠে গেটে। হইহই করে একদল পুলিশ ছুটে যায়। ধীরে ধীরে ট্রেনটা থিতু হয় স্টেশনে। বাজারের ব্যাগ উল্টে দিলে সব আনাজপাতি যেমন হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তেমনি করে যাত্রীরা নামতে শুরু করে। বাঁধভাঙা প্লাবনের মত লোকজন ধেয়ে আসতে লাগে গেটের দিকে। কবিদ্বয় গেটের একপাশে এসে দাঁড়াল। অনন্যর মনে শংকা, এই প্লাবন থেকে কী করে কবি মিহির মাহবুবকে সে ছেঁকে নেবে। এই সময় আন্ডারওয়্যারের ভেতর থেকে ফরমিক অ্যাসিডের যন্ত্রণা টের পায়। একসঙ্গে কমসে কম তিনটা পিঁপড়া কামড় বসিয়েছে। পাঞ্জাবি তুলে প্যান্টের ভেতরে ডান হাতকে পিঁপড়ার সন্ধানে ডুবুরি করে নামায় অনন্য। মনে মনে পিঁপড়ার মা-বোনকে তুলে একটা গালি দেয়। এই পিঁপড়ার যন্ত্রণায় তার জীবন বিষময় হয়ে উঠেছে। একটা পুরনো দালানের নীচতলায় স্যাঁতস্যাতে একটা রুমে রাতে গিয়ে ও শোয়। আসবাব বলতে একটা তুলা কাঠের খাট। রাতে গিয়ে দেখবে চার পায়ায় চারটা চলমান লাল রেখা। অক্ষৌহিণী অক্ষৌহিণী পিপীলিকাযোদ্ধা তার জন্য শরণশয্যা বিরচনে ব্যস্ত। দুঃখে ক্রোধে তার কাঁদতে ইচ্ছে করে। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে একটু শান্তিতে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাবে সে সুযোগ নেই। ট্যালকম পাউডার, কর্পূর, পিঁপড়ার ঔষধ সবকিছুতে ব্যর্থ হওয়ার পর এখন কেরোসিন থেরাপিতে গেছে অনন্য। পায়ার গোড়ায় গোড়ায় কেরোসিন মেখে দিলে আর ব্যাটারা গা ঘেঁষার সাহস করে না। বিছানায় ছাড় দিলেও দেয়াল দরজা চৌকাঠ এসবে তো হামলা করতে বাধা নেই। দেয়ালের হুকে ঝুলে থাকা জামাকাপড়গুলো হয়ে উঠে পিপীলিকাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। মাঝে মাঝে পিঁপড়া নিয়ে তার ভাবালুতা জাগে। ছোট ছোট প্রাণীদের মাথা গুঁজার জায়গার কোনও অভাব নেই, তাই তারা বিলুপ্ত হয় না। বরং সম্প্রসারিত হয় দ্রুত। বিপদে পড়ে বড় বড় প্রাণীরা। মানুষের আগ্রাসনের মুখে তাদের বসতি হুমকির মুখে পড়ে। ধীরে ধীরে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু অস্তিত্বের এই নীতিটা মানুষের ক্ষেত্রে খাটে না। বড় মানুষের জায়গার অভাব নেই, অভাব যা কবি অনন্যর মত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষগুলোর। তার তাই পিপীলিকা হয়ে যেতে শখ জাগে। থাকা-খাওয়ার কোনও চিন্তা নেই। সুযোগ পেলে মানুষের পায়ুপথে গিয়ে কামড় বসানো। অথচ এই শখের পিঁপড়ার যাতনায় অস্থির এখন কবিবর। সাদিকের গুঁতোয় ডুবুরি তুলে এনে বন্দরের দিকে তাকায় অনন্য। কবি কবি। দুটোমাত্র শব্দ করে সাদিক ছুটে যায় গেটের দিকে। সাদিকের ক্বরিৎকর্মতা বিস্মিত করে দেয় অনন্যকে। ছোটখাটো শক্তপোক্ত গড়নের একটা মানুষকে গেটের আলজিভ থেকে টেন বের করে নিয়ে আসে সাদিক। কবি মিহির মাহবুব তার কাঁধের ব্যাগটা সাদিকের হাতে সঁপে দিয়ে বলেন, তুমিই মঈন?
অনন্য মাহমুদের মুখটা কালো হয়ে যায়। তার ফেলে আসা গায়ের চামড়াটা কেউ যেন ফেভিকল দিয়ে আবার তার গায়ে সেঁটে দিতে চাচ্ছে। কুইনাইনের স্বাদ পাওয়া মুখ নিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে অনন্য। ফুলের তোড়াটা কবির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, স্যার, আমি অনন্য মাহমুদ। সম্পাদক উদ্যম।
স্যার বলাটা ঠিক হল কি? মনে মনে নিজেকে চার্জ করে। এতে একধরন আত্মসমর্পণ ধরা পড়ে। রাষ্ট্র ছোট না বড় সেটা ব্যাপার না, জাতিসংঘে গেলে সবাই সমান। কবি বড়-ছোট পরের কথা, অনন্যও একজন কবি। আবার আর-এক মন বলে উঠে, সমান না কচু। নিরাপত্তা পরিষদে যারা থাকে তারাই সব, বাকিরা সার্কাস পার্টি। যুক্তিতর্কে অনন্যের ভেতরটা মুখর হয়ে ওঠে।
কবি মিহির মাহবুব হয়তো অন্তর্যামী। নইলে এত সহজে ব্যাপারটা টের পেয়ে যাবেন কেন। উনি অনন্যের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসেন। মনে মনে বলেন, বুঝছ তো চান্দু, তোমার মৌজা দাগ খতিয়ান সব আমার জানা।
কবি মিহির মাহবুবই এই টেলিপ্যাথিক-ওয়ারের সামারি টানেন, হোটেল কতদূর?
—এই তো কাছে।
—গাড়ি এনেছ?
—একটা সিএনজি নিয়া নিমু। নিজের মুখ থেকে নির্গত শব্দগুচ্ছ শুনে নিজেকে খ্যাত বলে গালি দেয় অনন্য। কবি কী সুন্দর করে শান্তিপুরি ভাষায় কথা বলছেন, আর সে কিনা নিমু খামু করছে। মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করে মুখের ওপর সে একটা কথার ফিল্টার বসাবে। একটাও চাষাভুষার আওয়াজ বের করা যাবে না। তার ভাষার শক্তি সে দেখিয়ে দেবে।

বেড়ি বাঁধের ওপর রাস্তা। রাস্তার পাশে ইটের দেয়াল। দেয়াল না বলে রেলিং বলাই যৌক্তিক। রেলিংয়ে বসে সবাই মোহনার সৌন্দর্য্য দেখছে। কত রং-বেরঙের জাহাজ নদীর ওপর ভিড়িয়ে রাখা হয়েছে। ঘাটের কাছাকাছি সাম্পানের সারি। দু-একটা সাম্পান যাত্রী পারাপারে ব্যস্ত। দূরে দিগন্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঝাউগাছের সারি, ইউরিয়া সার কারখানা, কাফকো, বন্দরের বাতিঘর…। ওপারের সবগুলো স্থাপনার নাম কারওই জানা নেই। যতগুলো জানা তর্জনী উঁচিয়ে সেসবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে অভ্যাগতকে। ক্ষণে ক্ষণে আগ্রাসী হাওয়ারা হানা দিচ্ছে। উড়ছে কবিদের ফতুয়া পাঞ্জাবি উড়নি। কবি মিহির মাহবুব দুহাত একই সরলরেখায় এনে চোখ বুঁজে হাওয়াদের উন্মাদনা গ্রহণ করেন। একসময় তার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে।
দুরন্ত হাওয়ায় উড়ছে দু’পার
জল সিঞ্চিত বুক তিরতির
মাধুরী শিল্প গড়ে বিস্রস্ত খোঁপার
নদী ও মাধুরী দুই অস্থির…
সবাই মুগ্ধ হয়ে কবির আবৃত্তি শোনে। এই মাধুরী সিরিজের জন্য মিহির মাহবুব আজ কবি মিহির মাহবুব। কত তরুণ তার এই মাধুরীর খোঁজে রাতের পর রাত কবিতা আওড়িয়েছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। এমন একটা ঝকঝকে বিকেলে স্বয়ং কবির সামনে বসে তার কণ্ঠেই মাধুরী সিরিজের কবিতা শোনা সে তো পরম ভাগ্যের ব্যাপার। কবি অনন্য মাহমুদ তার এই মানবজনম সার্থক মনে করে। এই বিরল মুহূর্তের জন্যই সে বুঝি এতকাল বেঁচে ছিল।
তোমরা কেমন লোক হে, উচ্ছল কবি তরুণদের দিকে তাকিয়ে বলেন। জলের কাছে এসে জলধারা নেই—
‘এই অনন্য’, কবি পরীক্ষিৎ কর্মকার আর্তনাদ করে ওঠেন। ‘তোমার কি কোনও আক্কেলজ্ঞান নেই? কবিতা পাঠ করতে করতে কবির কণ্ঠ শুকিয়ে যাচ্ছে, একটু তরল সুধার ব্যবস্থা করো না বাবা।’ কবি পরীক্ষিতের পাশে লুঙ্গি পরা একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে কয়েকটা বিয়ারের ক্যান। অনন্যের মন বিরক্তিতে বিষিয়ে ওঠে। পরীক্ষিৎ লোকটাকে তার মোটেও পছন্দ নয়। একটা ধূর্ত ও অকর্মণ্য লোক। এই জীবনে কিছু আদিরসে চুবানো কবিতা ছাড়া কিছুই পয়দা করেননি। বউয়ের আয়ে বসে বসে খান। পথেঘাটে কখনও বউদির সঙ্গে দেখা হলে জোঁকের মত ছেঁকে ধরে। অবিরাম পরীক্ষিতের চরিত্রহনন করতে থাকে। শেষ করে কবিতাবাজি আর মাগীবাজিকে এক কাতারে এনে কিছু গালিগালাজ করে। বউয়ের কাছে গেলে ঝাড়ুপেটা খেলেও সাহিত্যাসরে তিনি তুবড়ি ছোটান। সব জানেন, সব বুঝেন এমন একটা ভাব। কারও কবিতা লেখা হয় না। এই মিহির মাহবুব নিয়ে তো কম কথা বলেননি। তিনি নাকি মাধুরী দীক্ষিতের ফ্লিম দেখে কবিতা লিখেন। তার কবিতার মাথামুণ্ডু কিছুই হয় না। মিহিরের কবিতা নিয়ে শেষ মন্তব্য ব এ আকার ল…। আর এখন কবি মিহির মাহবুবকে কাছে পেয়ে প্রশংসার অমৃতে গাঁজিয়ে ছাড়ছেন।
পরীক্ষিতের প্রস্তাবে অনন্য বাদে সবাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সবার মনের কথা প্রকাশ করেছেন যেন তিনি। অনন্যর মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। সিএনজি ভাড়া আর ফয়েস লেকের টিকেট বাবদ ইতোমধ্যে দেড় হাজার টাকা হাওয়া হয়ে গেছে। এখন সবাই মিলে বিয়ারোৎসবে মাতলে সে কোত্থেকে পাবে টাকা? সজীব ও শান্তর দিকে একবার তাকাল অনন্য। সজীব ইতোমধ্যে একটা বিয়ারের ক্যান হাতে তুলে নিয়েছে। শান্ত অমায়িক ছেলে। ইশারা করলে যে স্পর্শ করবে না অনন্যর সে বিশ্বাস আছে।
—নেন না। শুকনো গলায় বলল অনন্য। তবে কবি সজীব সাদিকের বোধহয় ওসব স্পর্শ করা ঠিক হবে না। ওর বাবা একটু সন্দেহপ্রবণ তো…
ঔষধটা কাজ দিল। শুকনো মুখে ক্যানটা ফেরত দিয়ে দিল সজীব। কাঁকড়ার ঝাল তরকারি আর পিঁয়াজির সঙ্গে শুরু হল পানোৎসব। অনন্যের অনুরোধে শান্ত গলা মেলল… বাঁশখালী মইশখালী, পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুরগুরাই টানে, ও তোরা খন খন যাবি আঁর সাম্পানে…
দেখতে দেখতে চার বোতল গলাধঃকরণ করে ফেলল বুড়ো ভামদুটো। অনন্যর মাথায় শুধু টাকার রিডিং ওঠে।
শান্ত আর সজীব সুযোগ বুঝে তাদের কবিতাগুলো পাঠ করা শুরু করল। সজীবের কবিতা শুনে কবি উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন। ‘এই বালক তুমি তো দারুণ লেখো হে—’
অনন্যের মুখ পাংশুটে হয়ে যায়। মনে মনে বলে, মাল একটু বেশি পইড়া গেছে রে—

সাতসকালে নান আর ডিম ভাজি নিয়ে রুমে ঢুকে দেখে কবি ব্যতিব্যস্ত। দুহাতে একটা ফতুয়া ধরে জোরে জোরে ঝাড়ছেন। টেবিলে রাখা প্লেটে খাবারটা রেখে অনন্য প্রশ্ন করে,
—কী অইছে ভাইয়া?
—কী হয়নি বলো। সারা রাত যদি একটু ঘুমুতে পারতাম। কী এক হোটেলে উঠাইছ মিয়া!
এবার কবি অনন্য ভাল করে তাকাল। খারাপ কিছু তো তার চোখে ধরা পড়ছে না। সুন্দর ছিমছাম রুম। দুটো খাট— একটা ডাবল, অন্যটা সিঙ্গল। মধ্যে একটা ড্রেসিং টেবিল। আলমারিও আছে একটা। সবই নতুন ডিজাইনের। বাথরুমের ভেতরে ঢোকেনি। সেটাও খারাপ হওয়ার কথা না। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
—সারা রাত পিঁপড়ার যন্ত্রণায় যদি একটু ঘুমাতে পারতাম।
নিজেই নিজের কাছেই যেন ধরা পড়ে গেল অনন্য। সে তো জানে এই পিঁপড়ার উৎসমূল কোথায়। কিন্তু নার্ভাসনেস দেখানো যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে সে ফোন লাগায় কবি দিলশাদ আলমের কাছে। তিনি একাধারে হোটেল দিলরাজের স্বত্বাধিকারী ও সাহিত্যকাগজ উদ্যম-এর উপদেষ্টা। আশির দশকের শক্তিমান এ কবি এখন নিজে লেখার সময় পান না, তরুণ কবিদের দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেন। তিনবার ট্রাই করার পর কবি দিলশাদকে ফোনে রিচ করা গেল। সব শুনে ‘কী কও, আমি এক্ষনই আসতেছি’ বলে লাইন কেটে দিলেন দিলশাদ। একটু পরেই এরোসেল ও ফিনাইল নিয়ে এল রুম সার্ভিসের ছেলে। কবি মিহির ও অনন্য বাইরে এসে রিসিপশনের পাশের ঝুলবারান্দায় বসল। কালকের বাতাসটার দুরন্তপনা কিছুটা কমেছে। ঝিরঝির করে বইছে। বড়ই মনোরম লাগছে চারদিক।
—দেখতে দেখতে তোমাদের শহরটা কুঁজো হয়ে যাচ্ছে।
—বয়স অইছে না ভাই।
—মাঝে মাঝে মনে হয় ইট-পাথরের জঙ্গল ফেলে এখানে চলি আসি।
—আপনারা এলে জঙ্গলটা সাথে করেই নিয়ে আসবেন।
—হা হা হা দারুণ বলছ।
খুব খোশমেজাজে আছেন কবি। এই সুযোগে কথাটা পাড়তে হবে। মনে মনে ভাবে অনন্য। কথার ফাঁক খুঁজে কথা পুরিয়ে দেয়ার জন্য।
—মোখলেছ ভাই নাকি একটা পত্রিকা করছেন?
—হুম, আমাদের নিয়ে সেদিন বসেছিল।
—লোক-টোক নেয়ার কথা উঠলে আমার নামটা একটু বিবেচনায় রাখবেন।
কবি চোখদুটো সরু করে তাকালেন অনন্যের দিকে।
—কবিতা লিখতে চাও, না অন্য কোনও মতলব …
—ছিঃ ছিঃ কী বলেন!
—শোনো, পত্রিকার গারদখানায় ঢুকলে আর কিছু হবে না বুঝলে… সারাদিন খালি কলম পিষে যাবে…
—কিন্তু…
—এক্সামপল দিয়ো না। যাদের কথা বলবে তাদের কবিতা হয়েছে কিনা সেই মীমাংসা এখনও শেষ হয়নি।
—আসলে ভাই, আমি খুব ক্রাইসিসের মধ্যে আছি। চাকরিটা না হলেই…
—বুঝছি বুঝছি। সব একই কেস…
তখন রিংটোন বেজে উঠল। আশ্চর্যজনকভাবে ফোনটা মোখলেছ আনোয়ারের। ভাগ্য আর কাকে বলে। আনন্দে অনন্যের মন নেচে উঠল। অনেক কথা হল, কিন্তু অনন্যর প্রসঙ্গটা তুললেন না। ফোন রেখে চায়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। নিচ থেকে চা এনে দিল অনন্য। চা খেতে খেতে আবার গল্প অগ্রসর হতে থাকে।
—তোমাদের এখানে ছুরি নামে কোনও শুটকি আছে নাকি?
—জি।
—আমি তো উত্তরের লোক। এসব আমার বিশেষ পছন্দ নয়। তোমার ভাবী আবার এদিককার মেয়ে। তার এসব খুব পছন্দ।
অনন্য হিসাব মেলায় গত দেড় দিনে তার কত গেল। সাড়ে চার হাজার। আর মাত্র পাঁচ’শ আছে পকেটে। বড় ছুরি শুটকির কেজি সাত’শর কম হবে না। তার ওপর আছে আজকের সাহিত্য সভার টুকটাক খরচ। এত টাকা সে যোগাড় করবে কী করে? আবার মিহির মাহবুব একটা আব্দার করছেন, সেটা না রাখলেও বিপদ। ঢাকায় গিয়ে যদি এই শুটকির অভিমানে মোখলেছভাইকে মুখ ফুটে কিছু না বলেন, তাহলে আগের খরচগুলোও মাটি হয়ে যাবে। যেকোনওভাবে হলেও শুটকিটা ম্যানেজ করতে হবে। ও, হ্যাঁ। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে অনন্য। তাদের মেসে শাহ আলম নামে একটা ছেলে থাকে। বিশেষ কথাবার্তা হয়নি। সে নাকি রিয়াজুদ্দিন বাজারের শুটকির আড়তে কাজ করে। ওকে ধরলে কি বাকিতে এক কেজি শুটকি দেবে না?
—কী ইয়াংম্যান, বড় চিন্তায় পড়ে গেলে মনে হয়!
—না কিছু না।
—তা তোমাদের এখানে ভাল শুটকি কোথায়…
—কোনও ব্যাপার না ভাই। ট্রেনে ওঠার আগেই পেয়ে যাবেন না।
—বেশি আনা লাগবে না। কেজিখানেক এনো। একটু বড় বড় দেখে। আর ভালভাবে শুকনো।
ঘড়ির কাটা এগারোটা ছুঁতেই লোকসমাগম শুরু হতে লাগল। প্রথমে দিলশাদ। তার পর পত্রিকার লোকজন। শহরের সুধীজন। যথারীতি পরীক্ষিৎ-ও। শহরের কিছু সিনিয়র কবি অনুযোগ করলেন, কাজটা ঠিক করলা না অনন্য। কবি যে পরশু রাত আসছে…
—আমি কী করব, উনিই তো মানা করলেন।
—হইছে ভাই হইছে, তোমার জন্মের আগে থেকে এই লাইনে আছি, আর বুঝানো লাগব না।
কবির রুমে ছোটখাটো আসর বসে গেল। কেউ ব্যস্ত তার নতুন কাব্যগ্রন্থ কবির হাতে সঁপে দিতে। কেউ ছবি তুলতে। কেউবা সাক্ষাৎকার নিতে। আসর যখন দুপুরের রোদে পক্ক হয়ে উঠেছে, তখন শুরু হল পরচর্চা আর অভিযোগের প্রতিযোগিতা।
কবি দিলশাদের কণ্ঠ সবচেয়ে উঁচায়, আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি মিহিরদা? আশির দশক থেকে লিখচি, আর এখন কিনা আমার লেখা আসে তরুণ কবির টাইটেলে।
পরীক্ষিৎ উনুনে দুটো কয়লা ঢেলে দিল, মফস্বলের কবিরা মৃত্যুর আগদিন পর্যন্ত তরুণ। মরলে প্রয়াত।
অনন্য মনে মনে তেতে ওঠে। বিড়বিড় করে বলে, সব শালা পিঁপড়া।
মহিলা কবি বিলকিস আসাতে ঝড় একটু থামল। সবার চোখ তার গাঢ় মেকআপ আর স্লিভলেজ ব্লাউজের দিকে। পরীক্ষিৎ পথ দেখানোর নাম করে দু-চারবার তার পিঠ ছুঁয়ে নিল। কবিকে দেখে তথাকথিত তরুণীর আবেগ উথলে উঠল। এই সুযোগে মিহির মাহবুব সজোরে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। সিনিয়র কবিরা চোখের ইশারায় পরস্পর আনন্দ বিনিময় করে নিল। পরীক্ষিৎ অনন্যর কানে কানে বলল, আজ রাতে হয়তো কবি থেকে যেতে পারেন। জেনে নিয়ো। যদি তাই হয়, বিকেলে টিকেটটা ব্ল্যাকে ছেড়ে দিয়ো। কিছু পয়সা বাঁচবে।
বিলকিস আবার পুরনো আগুনেই ঘি ঢালল। দশক বিতর্ক জমজমাট হয়ে উঠল। আবেগের চোটে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। অনন্যর এসব ভাল লাগে না। সন্ধ্যায় সাহিত্যসভা। এখনও অনেক যোগাড়যন্ত্র বাকি। তার ওপর শুটকি কিনতে হবে। বিকেলে কেনার সময় মিলবে না। রাতে আবার কবি ট্রেনে চাপবেন। তাই নীরবে উঠে পড়ল অনন্য। আরও কিছু তরুণী এসেছেন। তাদের আদিখ্যেতায় আসর বুদবুদ করছে।

শুটকিকে শিল্প ঘোষণা করা উচিত। শুটকির আড়তে এসে এই কথাটাই ঘুরপাক খাচ্ছে অনন্যর মাথায়। কী সুন্দর করে সরু সরু শুটকিগুলোর পেট চিরে বাঁশের কাঠি পুরে আস্ত এক-একটা মাছের রূপ দিয়ে দেয়া হয়েছে। তারপর সযত্নে পলিথিনে মুড়ে তা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে দোকানের সামনে। আরও কিছু সাপের মত সরু সরু শুটকিকে গুচ্ছ করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সামনের টুকরিতে সুন্দর করে সাজানো ছোট ছোট শুটকিগুলো। এই সাজসজ্জার মধ্যে পরিপাট্য আর শৃঙ্খলাবোধ খুবই কড়া। বড় বড় চেইনশপেও এতটা দেখা যায় না। তাদের আসবাব আর বাহ্যিক সজ্জায় থাকে চটকদারিতা, পণ্যসজ্জায় নয়। এই শুটকিওলাদের বড় বড় ভার্সিটির মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের গেস্ট লেকচারার করা উচিত। শাহ আলমের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে এসব ভাবছিল অনন্য। শাহ আলমের কথায় চিন্তার সূত্রগুলো কেটে গেল।
—ভাই, নিয়েন না।
—কেন?
—অফ সিজন। পুঁটি মাছের শুটকিগুলো দুহাতে সাজাতে সাজাতে শাহ আলম মুখ নাড়ায়।
—অফ সিজনে কি শুটকি কেনা নিষেধ নাকি, এমন কোন আইন আছে?
শাহ আলম মুচকি হাসে। এক হাতে একটা শুকনো রূপচাঁদা মাছ নিয়ে আর-এক হাতের ওপর আঘাত করে।
—দেখছেন কী পিঁপড়া। এত ঔষুধ মারি, তার পরও পিঁপড়ায় ছাড়ে না।
—বর্ষার দিন পিঁপড়া তো অইবই।
—এই তো ভাই পয়েন্টে আইছেন। শুটকি বানায় আসলে শীতের দিনে। তখন এত পিঁপড়ার উৎপাত থাকে না। কিন্তু বর্ষা আইলে তো…
—কী ঔষুধ দাও তোমরা?
—ডিডিটি। খাইলে জায়গার উপর শ্যাষ। একটা গৌরবের হাসি হাসল শাহ আলম। শুটকিতে একটু হিসাব কইরা দেয়, তাই টের পান না—
‘জায়গার উপর শ্যাষ’ কথাটা দারুণ লাগল কবি অনন্য মাহমুদের। একটা কাব্যের গন্ধ আছে। আবার আদিম উন্মাদনাও। অনন্যর দুটো চোখের মণি জ্বলে ওঠে। ‘জায়গার উপর শ্যাষ’। অনন্যর ছাইচাপা আগুনটা দাউদাউ করে ওঠে। আর কোনও ব্যাটার কাছে গিয়ে মাথা নিচু করা নয়। সবগুলোকে একসাথে শ্যাষ করে দিয়ে ও-ই থাকবে একমাত্র। কবি বলতেই অনন্য মাহমুদ। বইমেলা বলতেই অনন্য মাহমুদ। সাহিত্য সাময়িকী বলতে অনন্য মাহমুদ। অনন্য চিৎকার করে ওঠে—
—বেশি কইরা ঔষুধ দিয়া এক কেজি প্যাকেট করো। একটা পিঁপড়াও যেন গা ঘেঁষতে না পারে।
—ওমা, কী কন, মাইনষে খাইব কী কইরা?
—মানুষে খাইব না, পিঁপড়ায়েই খাইব। তুমি রেডি করো শাহ আলম।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
Advertisement
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »
শুভদীপ রায়চৌধুরী

শুভদীপ রায়চৌধুরীর দুটি কবিতা

অন্ধকারের তুমি,/ নরম পুঁইমাচার নিচে সবজেটে বহুরূপী/ তোমাকে আলোর কণার ভেতর গড়িয়ে যেতে দেখব বলে/ আমি এই পাগলের পৃথিবী ছেড়েছি/ টিলাপায়ে বাস করি/ নাম, সমুদ্রসম্ভব।/ পাতার ইমারত আছে, আছে/ কিছু দৈনন্দিন কাজ/ মাছ ধরার নাম করে/ বালসাভেলায় অনেকদূর যাওয়া/ যতদূর ভেসে গেলে ঢেউয়ের চুম্বন থেকে/ ছোবলটুকু আলাদা করাই যায় না

Read More »
নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | দ্বিতীয় পর্ব

সকালে চিড়ে নারকেল-কোরা আর গুড় খেয়ে আমি সাইকেলে চেপে ছুটিয়ে দিলাম— আট মাইল রাস্তা ঠেঙিয়ে যখন পৌঁছালাম— তখন গণগণে রোদ্দুর তেষ্টায় গলা কাঠ। ঘন্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে একটা বাড়ি দেখে সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম যদি একটু জল খাওয়া যায়। বাড়ির বারান্দায় একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি বসেছিলেন— তার কাছে উদ্দিষ্ট ঠিকানার কথা প্রশ্ন করতেই তিনি উঠে এসে আমার হাত ধরে আমাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে একটা পাটি পেতে বসতে দিলেন। আমি আবার জল চাইলে বললেন, “দাদাঠাকুর ব্যস্ত হবেন না— ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন।”

Read More »