১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। তার পরের কয়েক বছর ধরে বামপন্থী রাজনৈতিক ও গণ-আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল নানান বিভ্রান্তি, উঠল অনেক প্রশ্ন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল সমাজবাদের মূর্ত আদর্শ। সেই সোভিয়েতের পতন কি আসলে সমাজবাদের ব্যর্থ হওয়ার প্রমাণ? অনেকেই তখন খানিক হতাশ। অন্যদিকে পুঁজিবাদী গণমাধ্যম সোভিয়েত পতনকেই সমাজবাদের পতন বলে চূড়ান্ত আক্রমণাত্মক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিল। সেই দুঃসময়ে এই বিভ্রান্তি কাটাতে, সোভিয়েতের পতনের পরে ওঠা প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে, পুঁজিবাদী আক্রমণের পাল্টা দিতে বিভিন্ন ছোট ছোট পত্রিকায় লাগাতার প্রবন্ধ লিখে গেছেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। সেই প্রবন্ধগুলি বহু বামপন্থী রাজনৈতিক ও গণ-আন্দোলনের কর্মীদের কাছে হয়ে উঠেছিল আঁধার-পথের মশাল। নির্দিষ্ট সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রবন্ধগুলি বিশেষভাবে লেখা হলেও সাধারণভাবে যেকোনও সমাজবাদী কর্মীর কাছেই এই প্রবন্ধগুলি সবসময়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ কর্মীদের বোঝার মত করে সরল ঝরঝরে বাংলায় লেখা প্রবন্ধগুলি, কিন্তু বিষয়বস্তুকে অতিসরল করা হয়নি কোথাও। সেইরকম সতেরোটি লেখা সংকলিত হয়েছে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ বইটিতে। ওই সতেরোটি প্রবন্ধকে বইতে দুটি পর্বে ভাগ করা হয়েছে, প্রথম পর্বর নাম, ‘বিপ্লবের ভূত ভবিষ্যৎ’, দ্বিতীয়টি, ‘ইতিহাসই আমাদের ডাক পাঠাবে’। এছাড়াও আছে অন্য বিষয়ের আরও আটটি প্রবন্ধ।
উত্তর-আধুনিকরা দিব্বি ঘোষণা করে দিয়েছিলেন ইতিহাসের শেষ হয়ে গেছে, পুঁজিবাদ মানুষের সভ্যতার সর্বোচ্চ স্তর আর সোভিয়েতের পতন নিয়ে তো প্রচার করা হয়েছিল বিপ্লব আর সমাজবাদের যুগও শেষ। আদৌ কি তাই? রামকৃষ্ণবাবু লিখছেন,
“আবার বিপ্লবে হবেই— কথাটা শুনলে কেউ কেউ অবিশ্বাসের চোখে তাকাচ্ছেন। কেউ বা ঠাট্টা করছেন: এখনও খোয়াব কাটেনি। আরও অল্পবয়িসি লোকজন ভাবছে: এ আবার কী বলে! বিপ্লব এখন ঠাঁই পেয়েছে যাদুঘরে। বর্তমানে বা ভবিষ্যতে তার কোনও সম্ভাবনাই নেই।
মুশকিল হচ্ছে বিপ্লবটা কারও ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপর নির্ভর করে না। কোনও বিশেষ ব্যক্তি (স্পার্তাকুস, বা দাতঁ বা মার্কস) এটি আবিষ্কার করেননি। বিপ্লব একটা ঐতিহাসিক সত্য— ইতিহাসের সব পর্বেই তার দেখা মেলে ও মিলবে। যতদিন সমাজে শ্রেণীভেদ থাকবে, শ্রেণীতে-শ্রেণীতে দ্বন্দ্বও থাকবে। সেই দ্বন্দ্ব ক্রমেই তীক্ষ্ণ ও তীব্র হবে। একদিন-না-একদিন সংঘাত বাধবেই।” (পৃ. ১৩-১৪)
কিন্তু সমাজবাদী বিপ্লব তো ব্যর্থ হল। ও পথে আর কিছু কী হবে? রামকৃষ্ণবাবু জবাব দিচ্ছেন,
“আজ অবধি সফল বিপ্লবের চেয়ে ব্যর্থ বিপ্লবের সংখ্যাই বেশি। প্রতিটি ব্যর্থ বিপ্লব যদি একই শিক্ষা দিত তবে আর তারপরে কোনও অভ্যুত্থানই ঘটত না। ঘটনা কিন্তু এই যে, বারবার ব্যর্থতার পরেও আবার বিপ্লবের চেষ্টা হয়। পরিস্থিতিই বাধ্য করে শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।
প্রত্যেক যুগেই ব্যর্থ বিপ্লবের অভিজ্ঞতায় হতাশ হয়ে কিছু লোক জ্ঞান দেন: ও পথ ছাড়ো। তবু তাঁদের উত্তরপুরুষ বিপ্লবের জন্যেই তৈরি হয়। তারাও যদি ব্যর্থ হয়, তাতেও চেষ্টা থামে না। আবার হয়।” (একই)
তবু পুঁজিবাদী গণমাধ্যম আর তাদের পোঁ-ধরা মধ্যশ্রেণির একটা অংশ বিপ্লব নিয়ে কেবলই নেতিবাচক কথাই বলে চলেন। ফালতু তক্কে কালক্ষয়। রামকৃষ্ণবাবু পরিষ্কার জানান,
“বিপ্লব হবে, না হবে না— এই নিয়ে তুলকালাম তর্ক করে অনেকের রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে। বিপ্লব কিন্তু তাঁদের জীবনে অপরিহার্য নয়। বিপ্লব না-হলেও তাঁরা যেমন আছেন, তেমনই থাকবেন। বিপ্লব হলে বরং কিছু সুযোগ-সুবিধে কমে যেতে পারে। কিন্তু পরিস্থিতির কারণেই সত্যিকারের শোষিত মানুষের কাছে বিপ্লবের রাস্তাই হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র রাস্তা। বিপ্লবটা তাঁদের কাছে তাত্ত্বিক সমস্যা নয়, ব্যবহারিক সমাধান।” (পৃ. ১৬)
পূর্ব-ইউরোপের পতনের পরেও সমাজবাদের প্রতি অটুট আস্থা আর বিশ্বাস রাখা কি ধর্মবিশ্বাসের মতই অন্ধবিশ্বাস নয়? ঈশ্বরের বদলে কেবল ইতিহাস? আর কোনও তফাৎ আদৌ আছে? রামকৃষ্ণবাবু জানাচ্ছেন,
“আসলে সমস্যা হচ্ছে ‘বিশ্বাস’ শব্দটা নিয়ে। ধর্মে বিশ্বাস আর ইতিহাসে বিশ্বাস— দুটো কিন্তু আলাদা ব্যাপার। ধর্মবিশ্বাসী কোনও প্রমাণ ছাড়াই তাঁর বিশ্বাস বজায় রাখেন।… তারই আপ্তবাক্য হল: বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।
ইতিহাসবিশ্বাসীর ক্ষেত্রে এই ধরনের সান্ত্বনার কোনও সুযোগ নেই। তর্ক দিয়েই তাঁকে বুঝতে হয়েছে— সমাজবাদ কেন অনিবার্য, ইতিহাসের গতি কেন অমোঘভাবেই সমাজবাদের দিকেই। সে গতি অবশ্যই সরলরেখায় নয়, অনেকটাই সর্পিল (spiral) কিন্তু কোনওভাবেই তা চক্রাকার নয়। এক জায়গা থেকে শুরু করে আবার সেই জায়গাতেই ফিরে আসাটা ইতিহাসের নিয়ম নয়। এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে পেছোনোর ব্যাপারও ঘটে। কিন্তু সেটা স্থায়ী হয় না। আবার এগোয়।” (পৃ. ১৯)
এই প্রসঙ্গে এসেছে ইতিহাসের অর্থনৈতিক তত্ত্বর কথাও। পুঁজিবাদ যত বিকশিত হয় উৎপাদন হয়ে ওঠে সামাজিক, কিন্তু উৎপাদনের উপকরণ থেকে যায় মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মালিকানায়। আর এইখানেই শুরু হয় সংঘাত। উৎপাদন সামাজিক হলেও উৎপাদনের উপকরণকেও সামাজিক হতেই হবে। ইতিহাসের প্রগতিই সেইদিকে। এতদিন মানুষের ইতিহাস এগিয়ে চলেছে উৎপাদন ব্যবস্থা আর উৎপাদনের উপায়ের মালিকানার সংঘাতের ভিত্তি করেই। এক ব্যবস্থাকে ছুড়ে ফেলে নতুন ব্যবস্থা এসেছে বিপ্লবের মাধ্যমে। সেইদিক থেকেই সমাজবাদের অনিবার্যতার কথা আসে।
তবে এ প্রসঙ্গে একটি কথা মনে রাখা অবশ্যই দরকার। মানুষের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি কোনও প্রাকৃতিক ঘটনা নয়। প্রকৃতির নিয়মেই ঋতুতে বদল আসে আপনাআপনি। শীতের পরে বসন্ত। কিন্তু সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিবর্তন আপনাআপনি হয় না। মানুষকেই সংগঠিতভাবে সেই কাজ করতে হয়। “দিন আসে না, আনতে হয়”।
কিন্তু বিক্ষোভ, আন্দোলন, বিপ্লব এসব তো স্রেফ অশান্তিরই নামান্তর মাত্র। অশান্ত পরিবেশে কি সভ্যতার কোনও উন্নতি সম্ভব? পুঁজিবাদী গণমাধ্যম জনমানসে এই কথাটা গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করে যে, যে-কোনও বিক্ষোভ, আন্দোলন আর বিপ্লব হল শান্তির পরিপন্থী তাই অবশ্যই সেই পথ পরিত্যাজ্য। বাস্তব কিন্তু অন্যরকম। পুঁজিবাদ নিজের সর্বোচ্চ লাভের জন্যে দেশে দেশে যুদ্ধ লাগায়, দেশের মধ্যে গৃহযুদ্ধ বাধায়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আছিলায় শান্তিরক্ষী বাহিনীর নামে দিব্বি সামরিক অভিযান চালানো হয়। তখন শান্তির কথা ওঠে না। কিন্তু মজুররা তাঁদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে আন্দোলনে নামলেই তা নাকি হয়ে ওঠে সর্বনাশী অশান্তি। শান্তিই কি উন্নতির একমাত্র শর্ত? এই বইতে রামকৃষ্ণবাবু “দ থার্ড ম্যান” সিনেমার একটি সংলাপ উদ্ধৃত করেছেন,
“তিরিশ বছর ধরে ইতালিতে বোর্জিআ পরিবারের অধীনে তাদের ছিল যুদ্ধ, সন্ত্রাস, খুন, রক্তপাত— তারা সৃষ্টি করেছিল মিকেলাঞ্জেলো, লেওনার্দো আর রনেসাঁস (নবজাগরণ)। সুইটসারল্যান্ড-এ তাদের ছিল ভায়ে ভায়ে ভালবাসা, পাঁচশ বছরের গণতন্ত্র আর শান্তি, আর সেটা কি সৃষ্টি করল? কোকিল-ডাকা ঘড়ি।”
এই উদ্ধৃতির পরে রামকৃষ্ণবাবু লেখেন,
“কথাটা ভাল করে বোঝার আছে। শান্তি, মৈত্রী, গণতন্ত্র— এসব খুব ভাল জিনিস, সন্দেহ নেই। কিন্তু, কিছু লোকের নিরুপদ্রব জীবন, গণতান্ত্রিক অধিকার (মানে রাজাপ্রজা সক্কলেরই একটা করে ভোট, আর সব ব্যাপারে অসমান), নিয়মিত নির্বাচন (রিগিং-সমেত কিংবা রিগিং-মুক্ত)— একটানা এগুলো চললেই সমাজ বা সভ্যতা এগোয় না। বরং তীব্র অশান্তির অতিসংক্ষিপ্ত পর্বেও দেখা গেছে মানুষের সৃষ্টিশীলতার অনুপম অভিব্যক্তি। তার মানে এই নয় যে, অশান্তি থাকলেই তা ঘটবে। অন্যদিকে এটাও ইতিহাসের সাক্ষ্য যে, শান্তির পর্ব মাত্রেই সৃষ্টির পর্ব হয় না।
শখ করে লোকে বিপ্লব করে না। অবস্থা সহ্যের সীমা ছাড়ালে তবেই তা হয়। কয়েকজন লোক ইচ্ছে করলেই যখন-তখন তা করতে পারেন না। ক্রমাগত শোষণ আর অত্যাচারই ডেকে আনে বিপ্লবকে। আর বিপ্লব হলে অশান্তি তো হবেই। কিন্তু তার জন্যে ভয়ে, শাকসব্জির মত শান্তিতে বাঁচা— এও তো মানুষের অবধারিত পরিণতি হতে পারে না। ঝুঁকি তো নিতেই হয়, নিতে হবেই। পৃথিবী জুড়ে বহুজাতিক সংস্থাগুলো নির্ঝঞ্ঝাট ব্যবসার জন্যে যে-শান্তি চায়, মানুষের সর্বাঙ্গীণ অগ্রগতির সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?” (পৃ. ২৬)
এই পর্বর একটি অসাধারণ প্রবন্ধ, ‘চেতনায় প্রেরণায় পরিবেশে অন্তরে’। প্রবন্ধটি শুরু হয় বিশিষ্ট নৈরাজ্যবাদী এবং পরবর্তীতে কমিউনিস্ট ভিক্টর সার্জ-এর ছেলেকে নিয়ে। ভ্লাদিমির সার্জ জন্মেছিলেন সমাজবাদী সোভিয়েত ইউনিয়নে। কৈশোরের শেষবেলায় রাশিয়া থেকে বেলজিয়াম-এ যেতে বাধ্য হন। আর শ্রেণিহীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শ্রেণিবিভক্ত বেলজিয়ামে এসে একেবারে ধাক্কা খান ভ্লাদিমির। একেবারে কালচার শক। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ব্যাপারটা তাকে আশ্চর্য করে। একজনের এত প্রভূত সম্পদের কীসের দরকার সেটা তার ঠাওর হয় না, আবার এর পাশাপাশি বহু বহু মানুষের ভদ্রভাবে বেঁচে থাকার মত সামান্য সম্পদও নেই। অথচ শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সেটাই নাকি স্বাভাবিক। রামকৃষ্ণবাবু লিখছেন:
“সত্যি, এ এক আজব দুনিয়া। পথের ধারে দোকানে থরে থরে জুতো সাজানো থাকবে, কিন্তু রাস্তার মানুষ খালি পায়ে চলবে। ফ্যালো কড়ি মাখো তেল— এ-ই নাকি ‘স্বাভাবিক’। খাবার থাকলেও খেতে পাবে না, ঘর থাকলেও শুতে পাবে না, কাপড়জামা থাকলেও পরতে পাবে না, হাসপাতাল, নার্সিং হোম থাকলেও চিকিৎসা হবে না, স্কুল-কলেজ থাকলেও পড়তে পাবে না— যদি-না তোমার পয়সা থাকে। এটাই নাকি ‘স্বাভাবিক’। অভাবী লোক অভাবেই থাকবে— জিনিসের অভাব আছে বলে নয়, সাধ্যের অভাবে।” (পৃ. ৫০)
শুধু বিপ্লব করে অর্থনীতি রাজনীতির আমূল পরিবর্তন করলেই হয় না, বদল আনতে হয় মানুষের চেতনাতেও। সে-কাজ সফল হয়নি বলেই পূর্ব ইউরোপে প্রতিবিপ্লব মাথাচাড়া দিয়েছে। ভবিষ্যতের বিপ্লবের কাছে এও এক বড় শিক্ষা। চেতনা বদলানোর কাজও লাগাতার করে চলতে হবে— বিপ্লবের আগে এবং পরেও।
শোষণের পালা থাকলে বিপ্লবের পালাও আসবেই। একে খণ্ডানো যাবে না।
“কিন্তু বিপ্লবের পালা চিরদিনের মত ফুরিয়ে যায় না। মূর্খ পুঁজিপতি ও তাদের মোসায়েবের দল যতই ফুর্তিতে থাকুক, বিপ্লব নিয়ে যতই বিদ্রূপ করুক, আবার বিপ্লব হবেই। ভারতে, রুশদেশে, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও, শোষণই যে ব্যবস্থার ভিত্তি, তাকে অনেকদিন ঠেকা দিয়ে রাখা যায়, কিন্তু চিরদিন বাঁচিয়ে রাখা যায় না।” (পৃ. ১৭)
এই পর্বর ‘লেনিন-লুকাচ: কাল্পনিক সংলাপ’ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ লেখা। অতি বামপন্থা ঝোঁকের বিপদ নিয়ে বেশ কিছু কাজের কথা আছে এই সংলাপে।
বইটির দ্বিতীয় পর্ব, ‘ইতিহাসই আমাদের ডাক পাঠাবে’। এই পর্বর বেশিরভাগ প্রবন্ধই সংলাপের আকারে লেখা। রামকৃষ্ণবাবুর সৃষ্টি বিখ্যাত চরিত্রগুলি— সবজান্তা, বাচাল, জিজ্ঞাসু, সংশয়ী, এবং আশাবাদী-দের নিজেদের মধ্যেকার আলাপ-আলোচনার ঢঙে লেখা প্রবন্ধগুলি। এই লেখাগুলোর টার্গেট পাঠক হলেন বামপন্থী বিভিন্ন গণ-আন্দোলনের কর্মীরা। হয়তো তাঁরা কোনও পার্টিতে নেই কিন্তু সমাজবাদ আনার পথে তাঁরাও অবিরত কাজ করে চলেছেন। মার্কসকে অনুসরণ করে রামকৃষ্ণবাবু বলেছেন, বর্তমানের কোনও পার্টিতে না থাকলেও ঐতিহাসিকভাবে পার্টিতে তাঁরা অবশ্যই আছেন। গণ-আন্দোলনের এইসব কর্মীদের মধ্যেকার নানান দ্বিধা সংশয় কাটানো এবং এই কাজগুলো করে চলবার যৌক্তিকতাই এই প্রবন্ধগুলির উপজীব্য। কাজের পাশপাশি লেখক জোর দিয়েছেন নেতাদের মুখের দিকে না চেয়ে থেকে নিজেদের ভাবনাচিন্তা করার দিকে। ‘মনের জনগণ : কোথায় পাব তারে’ প্রবন্ধটি তো বামপন্থী বিভিন্ন গণ-আন্দোলনের কর্মীদের (জনগণের জন্যে সাহিত্য, নাটক, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে যাঁরা কাজ করছেন) অবশ্যই পড়া উচিত।
এই দুই পর্ব ছাড়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ‘রামায়ণী কথা’। বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ হসমুখ ধীরাজলাল সাংকলীয়া-র একটি বক্তৃতামালার ওপর ভিত্তি করে “রামায়ণ”-এর ভূগোল আর নৃতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা চালানো হয়েছে প্রবন্ধটি। সাংকলীয়া নানান তথ্যপ্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন “রামায়ণ” রচনার সময় আর্যদের ভূগোল দক্ষিণ ভারত অবধি বিস্তৃত হতে পারেনি। “রামায়ণ”-এর লঙ্কা কখনওই সিংহল বা শ্রীলঙ্কা হতে পারে না। তা ছিল দণ্ডকারণ্যের মধ্যেই কোনও অঞ্চল। দণ্ডকারণ্য অঞ্চলের গোণ্ডদের ভাষায় ‘লঙ্কা’-র অর্থ হল “উঁচু জায়গা”, “দ্বীপ” বা “রাজার আবাস”। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গাকেই গোণ্ডরা ‘লঙ্কা’ বলেন। এছাড়াও “রামায়ণ”-এর আরও অনেক বিষয়ই এই প্রবন্ধে জায়গা পেয়েছে।
বইটির প্রচ্ছদ সুন্দর, এঁকেছেন প্রবীর সেন।