বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণের অগ্রদূত
প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক রাজনারায়ণ বসু তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘আরবদিগের মধ্যে এইরূপ প্রথা আছে যে, তাহাদিগের দেশে একটি সর্বাঙ্গসুন্দর ঘোটক অথবা উষ্ট্র জন্মিলে অথবা তাহাদিগের বংশে একজন উৎকৃষ্ট কবির উদয় হইলে, তাহারা আনন্দোৎসব করিয়া থাকে। একজন কবিকে ঘোটক বা উষ্ট্রের ন্যায় পশু বলিয়া গণ্য করা আমাদের অভিপ্রায় নহে, কিন্তু আমাদের স্বদেশে একটি মহাকবির উদয় জাতি সাধারণের আনন্দের কারণ বলিয়া বিবেচনা করা কর্তব্য। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই শ্রেণীর কবি।’’ দুঃখের হলেও সত্য, বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কাব্যপ্রতিভা, বাংলার নবজাগরণে উদ্দীপ্ত আধুনিক কবি, চির উপেক্ষিত, মধু কবি মধূসূদন দত্ত সম্পর্কে আমরা বড্ড নির্দয়, উদাসীন। ইউরোপ থেকে বিপ্লব-বিদ্রোহের ঘাত-প্রতিঘাতময় প্রতিক্রিয়া যখন বাঙালির চিত্তবৃত্তিতে ঢেউ তুলেছিল, তাকে নস্যাৎ করার মত শক্তি কারও ছিল না। রবীন্দ্রনাথও এই অভিঘাতকে অস্বীকার না করেই বলেছিলেন— ‘‘আমরা হাজার খাঁটি হইবার চেষ্টা করি না কেন, আমাদের সাহিত্য কিছু-না-কিছু নূতন মূর্তি ধরিয়া এই সত্যকে প্রকাশ না করিয়া থাকিতে পারিবে না। ঠিক সেই সাবেক জিনিসের পুনরাবৃত্তি আর কোনোমতেই হইতে পারে না; যদি হয় তবে এ সাহিত্যকে মিথ্যা ও কৃত্রিম বলিব।’’ বাংলা কাব্যে মধুসূদন সেই সত্যকে প্রথম পাঠকের সামনে তুলে ধরেছিলেন।
যুগে যুগে প্রতিভাকে কষ্ট পেতে হয়, প্রতিভাধরদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়— এই দৃষ্টান্ত বিপুল। বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার ভগীরথ মাইকেল মধুসূদন দত্তের মত অনন্যসাধারণ এক কাব্যপ্রতিভার অধিকারী শক্তিশালী সাহিত্যিকের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। ষোলো বছর বয়সে স্বপ্নে বুক বাঁধলেন, জীবনে মিল্টন, হোমার, ভার্জিল, কালিদাস, ওভিড বা টাসোর মত বড় কবি হবেন। ধর্মান্তরিত হলেন, সমাজচ্যুত হলেন— হয়ে গেলেন আত্মবঞ্চিত এক রিক্ত পথিক। কলম হাতে ভাঙলেন প্রাচীন যুগজীর্ণ সাহিত্যপ্রথা, তছনছ করলেন মধ্যযুগের দেবনির্ভর, ভাগ্যনিয়ন্ত্রিত জীবনের চেনা ছকের কাব্যিক প্রকাশরূপ। আধুনিক চেতনা ও আদর্শে অনুপ্রাণিত কবি বাংলা সহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করলেন সংকট-সংশয়, সুখ-দুঃখ, বিরহ-মিলন নিয়ে গড়া দৈবীশক্তি ও নিয়তিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সোচ্চার মানবসত্ত্বার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে। বাংলা সাহিত্যে আনলেন নতুন কাব্যিক ছাঁচ, ছন্দ আর স্বাদ। অসম্ভব প্রতিকূলতা, সমালোচনা স্বীকার করে ক্ষতবিক্ষত কবি ইউরোপীয় রেনেসাঁর অভিঘাতে নবালোকে, নব মননে নির্মাণ করলেন নতুন সাহিত্য প্রকরণ। প্রতিষ্ঠিত করলেন বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত, বিপণ্ন মানুষের চিরন্তন লড়াই সংগ্রাম আর তাদের অবিনাশী প্রাণশক্তিকে।
মধুসূদনের স্বদেশচেতনা ও জাতীয়তাবোধ
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী স্রষ্টা মধুষুদন দত্তের ব্যক্তিজীবন, আদর্শবোধ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতার আলোকে তাঁর কাব্যবৈশিষ্ট্য আলোচনা করলে দেখা যাবে এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে ধর্মান্তরিত হওয়া, বিদেশে পাড়ি জমানো বা ইংরেজিতে প্রথম কাব্যচর্চা, কল্পবিলাস থেকে দ্রুত বাস্তবের মাটিতে নেমে এসে তিনি ভালবেসেছেন তাঁর স্বদেশ, তাঁর স্বদেশবাসী আর মাতৃভাষাকে। সুদূর ভার্সাই নগরে থেকেও তাঁর মানসপটে উদিত এই বাংলার একটি ছোট নদকে। ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতায় আবেগাপ্লুত কবি লিখলেন— ‘‘সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে!/ সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;/ সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে/ শোনে মায়া-মন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে/ জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!/ বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,/ কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?/ দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমি-স্তনে।’’ মধুসূদনের আগে কেই বা এভাবে নিজের জন্মভূমি, তার প্রকৃতি, নদনদীর জন্য এরকম আকুতি অনুভব করেছেন? তাঁর কাব্যরচনায় তিনি ইতালির কবি পেত্রার্কের সনেট-নীতি গ্রহণ করলেও তার স্বদেশীয়ানা একটুও বিসর্জন দেননি। নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও পরম্পরাকে অনুসরণ করে ঐতিহ্য ও স্বদেশ-স্বজাতির প্রতি দায়বদ্ধ থেকেই তিনি কাব্যচর্চা করেছেন। জীবনের প্রারম্ভের কল্পনাবিলাস থেকে সরে এসে মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি তাঁর নিখাদ প্রেম ধরা পড়েছে তাঁর ‘বঙ্গভাষা’ কবিতায়— ‘‘হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;—/ তা সবে, (অবোধ আমি) অবহেলা করি,/ পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ/ পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি!/ কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি।/ অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ,/ মজিনু বিফল তপে অবরণ্যে বরি;—/ কেলিনু শৈবালে, ভুলি কমল-কানন।’’
কবি মধুসূদনের ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতায় একই সুরের অনুরণন আমরা দেখি। বাংলা কাব্য-কবিতায় স্বদেশচেতনা ও স্বদেশপ্রেম কবি ঈশ্বর গুপ্ত, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তের সৃষ্টিতে অনুপম শিল্পসুষমামণ্ডিত হয়েছে। তাঁর রচনায় পৌরাণিক কাহিনিসমূহের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মূল্যায়ণে দেশচেতনা ও বোধের প্রকাশ হতে দেখি। কবির ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে মহত্ব, বীরত্ব ও দেশের প্রতি গভীর ভালবাসা তৎকালীন শিক্ষিত বাংলার মননে পরাধীনতার প্রতি ঘৃণা ও শৃঙ্খলামুক্তির আবেগকে সঞ্চারিত করেছিল। মদূসূদন মনে করতেন, ধর্ম ও জাতিত্ব এক নয়। স্বধর্মত্যাগী মধুসূদন হিন্দু ধর্মের বিদ্বেষী ছিলেন— এটা বলা যাবে না। ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে স্বজাতিদ্রোহী বিভীষণকে ভর্ৎসনার মধ্যে তাঁর স্বজাতিপ্রীতি ফুটে উঠেছে। ‘Madras Hindu Chronicle’ পত্রিকায় কবির সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ ও প্রবন্ধগুলির মধ্য দিয়ে মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, মুক্তচিন্তার অধিকারী মধুসূদন দত্তকে আমরা খুঁজে পাই। বিধবাবিবাহের সমর্থক মধুসূদন নারীর স্বাধিকার রক্ষার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। মনুসংহিতার তীব্র বিরোধিতা করে তিনি লিখেছেন— ‘‘In India I may say in all the Oriental countries, women are looked upon as created merely to contribute to the gratification of the animal appetites of men… it not only makes them appear as of inferior mental endowments, but no better than a sort of speaking brutes.’’ সমাজমনস্ক কবি মনে করতেন নারীদের শিক্ষিত করা ছাড়া তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটানোর দ্বিতীয় কোনও পথ নেই। তাঁর ভাষায়— ‘‘Extensive dissemination of knowledge amongst women is the surest way that leads a nation to civilization and refinement, for it is woman who first gives ideas to the future philosopher and would-be poet!’’
মধুসূদনের ষোলো আনা বাঙালিয়ানার খবর যেমন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রাখতেন, তেমনই বঙ্কিমচন্দ্রও রাখতেন। কবির মৃত্যুর পর বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন— ‘‘আজি বঙ্গভূমির উন্নতি সম্বন্ধে আর আমরা সংশয় করি না— এই ভূমণ্ডলে বাঙ্গালী জাতির গৌরব হইবে। কেন না বঙ্গদেশ রোদন করিতে শিখিয়াছে— অকপটে বাঙ্গালী, বাঙ্গালী কবির জন্য রোদন করিতেছে। … বিদ্যালোচনার কারণেই প্রাচীন ভারত উন্নত হইয়াছিল, সে পথে আবার চল, আবার উন্নত হইবে। কাল প্রসন্ন— ইউরোপ সহায়— সুপবন বহিতেছে দেখিয়া জাতীয় পতাকা উড়াইয়া দাও— তাহাতে নাম লেখ ‘‘শ্রীমধুসূদন’’।’’
মধুসূদন দত্ত সম্পর্কে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের এই জয়ঘোষণা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আসলে স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি তাঁর আবেগ ছিল অকৃত্রিম। বহিঃরঙ্গে যতই তিনি সাহেব হোন না কেন, তাঁর অন্তর ছিল দেশীয়। ১৮৭১ সালে ঢাকায় একটি নাগরিক সংবর্ধনায় তিনি বলেছিলেন— ‘‘আমার সম্বন্ধে আপনাদের আর যে কোনো ভ্রমই হউক, আমি সাহেব হইয়াছি এ ভ্রমটি হওয়া ভারী অন্যায়। আমার সাহেব হইবার পথ বিধাতা রোধ করিয়া রাখিয়াছেন। আমি আমার বসিবার ও শয়ন করিবার ঘরে একখানি আরশি রাখিয়া দিয়াছি। এবং আমার মনে সাহেব হইবার ইচ্ছা যখন বলবৎ হয় তখন অমনি আরশিতে মুখ দেখি। আমি শুধু বাঙালি নহি। আমি বাঙ্গাল। আমার বাটি যশোহর।’’ শুধু তাই নয়, কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোডে মহাকবি মধুসূদনের সমাধিফলকে তাঁরই লেখা এপিটাফে তিনি লিখেছেন— ‘‘দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব/ বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে’’— এখানে লক্ষ্যনীয়, কবি বঙ্গপথিককে ‘দাঁড়ান’ বলেননি, বলেছেন ‘দাঁড়াও’। আসলে নিজের দেশ, নিজের দেশের মানুষ ও মাতৃভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা এবং দৃঢ় প্রত্যয় ও অটুট বিশ্বাস ছিল বলেই তিনি এরকম সম্বোধন করতে পেরেছেন।
মধুসূদনের বিদ্রোহী কবিসত্ত্বা
বঙ্গীয় রেনেসাঁ যখন ধর্মীয় কুসংস্কার, জড়তা ও নানামুখী অন্ধকার প্রবণতা থেকে মুক্ত করে সমাজসংস্কারকে উদ্বুদ্ধ করে, সেই যুগ পরিপ্রেক্ষিত ও পটভূমির দ্বারা প্রভাবিত ইউরোপীয় চিন্তনের আলোকে আলোকিত কবি মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী সত্ত্বা। প্রাচীন গ্রিক, রোমান সভ্যতার পর ভারতীয় সভ্যতা এবং ইসলামি সভ্যতার সুদীর্ঘ পথ বেয়ে ইতিহাসের আলোকে তাঁর অভিব্যক্তি— ‘‘The trumpet-call of the Anglo-Saxon, is destined to rouse from his grave, the Hindu, to a brighter, a fairer existence; the mystic wand of the Anglo-Saxon is destined to break the dreamless slumber which now curtains him round.’’ একদিকে ছকভাঙা সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা, অন্যদিকে প্রচলিত বিশ্বাস ও মিথ ভেঙে বাল্মীকির রামায়ণের বিনির্মাণে রচিত তাঁর ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য বাংলা সাহিত্যে এক দুঃসাহসী প্রচেষ্টা। বাল্মীকির সংস্কৃত রামায়ণ বা কৃত্তিবাসী বাংলা রামায়ণে নায়ক রামচন্দ্র। ঐশী শক্তির অধিকারী তিনি। কিন্তু ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীভুক্ত নবচেতনায় উদ্দীপ্ত বিদ্রোহী মধুসূদনের কলমে রামায়ণের দেবতা রাম কোনও আদর্শবান, ব্যক্তিত্ববাদী, ভগবানের অবতার নন, বরং মানসিকভাবে দুর্বল, কপট, নীতিহীন মানুষ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন। মদূসূদন দীর্ঘলালিত বিশ্বাসে আঘাত হেনে তাঁর সময়ে বাঙালি মনন ও মনে ঢেউ তুলেছিলেন। কবি একজন আধুনিক মানুষ হিসাবে রামচন্দ্র চরিত্রে কোনও দেবত্ব আরোপ করেননি। তাঁর রচনায় সীতাহরণ কাণ্ডে রাবণের প্রেমময়তা প্রকাশিত হয়েছে। বীরবাহুর মৃত্যুর পর মেঘনাদের সেনাপতিত্ব গ্রহণ, নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে নিরস্ত্র মেঘনাদকে লক্ষ্মণের হত্যা করা— কবি অন্য আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন। রামায়ণের খলনায়ক রাবণ নিছক এক রাক্ষসকুলপতি নন, বরং পিতার স্নেহ-মমতা, স্বদেশ-স্বজাতিকে রক্ষার তাগিদ তাকে মহিমান্বিত করেছে। বিভীষণের স্বজাতি-বিরোধিতা কবির কলমে ধিকৃত হয়েছে। নতুন বিষয়কে মহাকাব্যে উপস্থাপন এবং নতুন আলোকে চরিত্রের বিনির্মাণের মত দুঃসাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী সত্ত্বা। জন মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ মহাকাব্যের মতই তাঁর ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে চিরায়ত প্রতিনায়ক রাবণ শৌর্যবীর্য, অনমনীয় আদর্শবোধ ও মানবিক গুণে হয়ে উঠেছেন নায়ক চরিত্র। এখানে রাবণ স্বদেশপ্রেমী, অপরদিকে রামচন্দ্র পরদেশ আক্রমণকারী, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের প্রেরণা, ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ আর পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের আকুতি কবিমননকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তাই তাঁর বিদ্রোহী সত্ত্বায় রাবণ চরিত্রটি হয়ে উঠেছে আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত স্বাধীনচেতা মানুষের লড়াইয়ের মুখ।
কবির বিদ্রোহী মানসপটের ভিত্তি ছিল ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’। আর ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য-পরবর্তী রচনাতেও সে বিদ্রোহের সুর অম্লান ছিল। ‘ব্রজাঙ্গনা’, ‘বীরাঙ্গনা’, ‘শর্মিষ্ঠা’ প্রভৃতি কাব্য ও নাট্যেও আধুনিক দ্রোহী মধুসূদনকে আমরা খুঁজে পাই। উনিশ শতকের মানবতাবাদ নারীর কাছেও নিয়ে এসেছিল সাম্য-মৈত্রী ও স্বাধীনতার মূলবাণী। ‘বীরাঙ্গনা’-র প্রতিটি চরিত্র পৌরাণিক হলেও কবি তাদের মধ্যে বাংলা নবজাগরণের মুক্তির বাণী ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সঞ্চারিত করেছেন। শুধু কাব্য বা নাটক নয়, তাঁর প্রহসনমূলক রচনায় সামাজিক বিদ্রোহ সরব হয়ে উঠেছে। ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনদুটিতে তৎকালীন সমাজের প্রতি চিরবিদ্রোহী মধুসূদনের প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মতে, আধুনিকতা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে হয়। প্রতিটি যুগেই পুরনো ঐতিহ্যকে সরিয়ে কবিকে নতুন পথের সন্ধান করতে হয়। আর তাতেই তাঁকে হতে হয় বিদ্রোহী। এভাবেই আধুনিক মননে ঋদ্ধ মধুসূদন দত্ত হয়ে উঠেছেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম ‘বিদ্রোহী’ কবিসত্ত্বা।
দুশো বছরের আলোকে মধুসূদন কেন প্রাসঙ্গিক?
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) বাংলা সাহিত্যের ছায়াপথে এক আলোকোজ্জ্বল নক্ষত্র। নতুন আঙ্গিক, বর্ণনাভঙ্গি আর গঠনরীতির প্রয়োগে এক উজ্জ্বলতম সাহিত্যিক হিসাবে তিনি আজও বহুলচর্চিত ও সমাদৃত কাব্যপ্রতিভা। এটা ঠিক, কবি তাঁর প্রতিভা অনুযায়ী প্রাপ্য স্বীকৃতি পাননি। বাংলা সাহিত্যবোদ্ধারা তাঁর যথাযথ মূল্যায়ণে ব্যর্থ হয়েছেন। কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার তাঁর ‘শ্রী মধুসূদন’ গ্রন্থে যথার্থই লিখেছেন— ‘‘মধুসূদনের দুর্ভাগ্যই এই যে, এত বড় কবিশক্তির অধিকারী হইয়াও তিনি বাংলার কাব্যসাহিত্যে কেবল খ্যাত-খনন, সেতু নির্মাণ ও সোপান রচনাই করিয়া গিয়াছেন। এক দুঃসাহসিক অভিযানের পথিকৃৎ হিসেবেই তিনি এ যুগের সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করিয়া আছেন; যত বড় প্রতিভা তত বড় সৃষ্টির নিদর্শন রাখিয়া যান নাই।’’
সাহিত্য জীবনের দর্পণ, সমাজের বিশ্বস্ত প্রতিভাস। একথা সত্য মধুসূদনের কাব্য, নাটকের চরিত্ররা পৌরাণিক কাহিনির নায়ক-নায়িকারা। ফলে আধুনিক কবির চরিত্রগুলি আজ যুগান্তরে অনেকটা অচেনা, অধরা। কবি মধুসূদন যে কবিকে তাঁর জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তিনি ইংরেজি সাহিত্যের দিকপাল কবি জন মিল্টন। পিউরিটান বিপ্লবের সৈনিক মিল্টন যখন তাঁর অমর কাব্য ‘প্যারাডাইস লস্ট’ লেখেন, তখন তিনি অন্ধ, চরম সংকটাপন্ন। তাঁর বিপ্লবী উদ্যোগ পরাভূত হয়েছে, রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটেছে, পিউরিটানরা বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত। কিন্তু হার মানেননি কবি। ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এ বীরত্ব আছে, কিন্তু সে বীরত্ব কর্তৃত্বপরায়ণ ঈশ্বরের নয়, ঈশ্বর-বিদ্রোহী স্যাটার্নের। মহাকাব্যের কেন্দ্রে রয়েছে আদম ও ঈভের ঈশ্বরাদেশ অমান্য করার ঘটনা। সেও এক বিদ্রোহ বটে, যার পরিণতি অতি করুণ— আদি পিতা-মাতা আদম ও ঈভের স্বর্গচ্যুতি। মিল্পনকে জয়ের নয়, পরাজয়ের কাহিনিই লিখতে হয়েছিল। আমাদের কবি মধুসূদনকেও ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে তাঁর কাব্যরচনা চালিয়ে যেতে হয়েছিল। যুগজীর্ণতায় মলিন সংস্কার আর সাহিত্যরীতিতে বুঁদ হয়ে থাকা বাংলার মানুষের প্রতি তাঁর অভিমান ব্যক্ত হয়েছে— ‘‘অলীক কুনাট্য রঙে, মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে, নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।’’ তবুও হাল ছাড়েননি কবি। যে মধুসূদনকে রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিকে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত ছিলেন, তিনিই পরবর্তীতে ‘ভারতী’ পত্রিকায় লেখেন— ‘‘তিনি স্বতঃস্ফূর্ত শক্তির প্রচণ্ড লীলার মধ্যে আনন্দবোধ করিয়াছেন। এই শক্তির চারিদিকে প্রভূত ঐশ্বর্য; ইহার হর্ম্যচূড়া মেঘের পথ রোধ করিয়াছে; ইহার রথ-রথি-অশ্ব-গজে পৃথিবী কম্পমান; … যে অটলশক্তি ভয়ংকর সর্বনাশের মাঝখানে বসিয়াও কোনোমতেই হার মানিতে চাহিতেছে না,— কবি সেই ধর্মবিদ্রোহী মহাদম্ভের পরাভবে সমুদ্রতীরের শ্মশানে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কাব্যের উপসংহার করিয়াছেন। যে-শক্তি অতি সাবধানে সমস্তই মানিয়া চলে, তাহাকে যেন মনে মনে অবজ্ঞা করিয়া, যে-শক্তি স্পর্ধাভরে কিছুই মানিতে চায় না, বিদায়কালে কাব্যলক্ষ্মী নিজের অশ্রুসিক্ত মালাখানি তাহারই গলায় পরাইয়া দিল।’’
সর্বশক্তিমান মৃত্যুকে অবজ্ঞা করার দুঃসাহস মধু কবির ছিল বলেই অমরত্বের বাসনা তাঁর হৃদয়ে কোথাও যেন উঁকি মেরে গেছে। তাই লিখেছেন— ‘‘সেই ধন্য নরকুলে,/ লোকে যারে নাহি ভুলে,/ মনের মন্দিরে সদা সেবে সর্ব্বজন;—’’। আজ দুশো বছরে পদার্পণ করা কবিকে আমরা ভুলিনি। তাঁর কাব্যকবিতার চরিত্রগুলির গুণমুগ্ধরা রাষ্ট্রীয় শক্তি বা আর্থিক শক্তিতে বলীয়ান আত্মদম্ভী, আধিপত্যকামীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আরও রসদ পান, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী কবি-সাহিত্যিকরা চলমান স্রোতের বিপ্রতীপে কাব্যসাধনার অনুপ্রেরণা পান, ক্ষতবিক্ষত সৈনিক নতুন লড়াইয়ের উৎসাহ পান। আর এই প্রাপ্তির মধ্যেই বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী সাহিত্যিক মধুসূদন দত্ত কালজয়ী হয়েছেন।
সূত্র:
১. মধুসূদন : সাহিত্য প্রতিভা ও শিল্পী ব্যক্তিত্ব— সম্পাদনা : দ্বিজেন্দ্রলাল নাথ (পুথিপত্র)
২. উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে স্বদেশপ্রেম— অঞ্জলি কাঞ্জিলাল (মডার্ন বুক)
৩. উনিশ শতকের বাংলা কাব্যে দেশ ও জাতীয়তাবাদ— অবিনাশ সেনগুপ্ত ( Vidyasagar University Journal of History, Vol-1, 2012-2013)
৪. মধুসূদনের ইংরেজি প্রবন্ধ : নারী ও সমাজভাবনা— ফিরদৌসি খাতুন (জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি জার্নাল অফ আর্টস, ভলিউম-৮, নং-১, জানুয়ারি-জুন ২০১৮)
৫. মধুসূদনের স্বদেশ চেতনা ও বাঙালী জাতীয়তা বোধ— সাইফুদ্দিন সাইফুল, (‘যায় যায় দিন’, ২৫ জানুয়ারি ২০১৯)
৬. বাঙালীর জাতীয়তায় অবিচল মধুসূদন দত্ত— সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (প্রতিদিনের সংবাদ, ১ ডিসেম্বর ২০১৬)
৭. মাইকেল মধুসূদন কেন আজও প্রাসঙ্গিক— জান্নাতুল যূথী (বাংলা ট্রিবিউন)
৮. মেঘনাদ বধের তাৎপর্য— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র রচনাবলী, ৮ম খণ্ড, (১৩৬০, চৈত্র)।