Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

নিঃসঙ্গতা

মাঝরাতে যখন ঘুম ভাঙল, গ্রীষ্মের মৃদু হাওয়ায় জানলার পর্দা আবছা নড়ছে। কিছুক্ষণ চোখ ধাঁধিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে দেখতে পেলাম ঘরে থাকা জিনিসপত্রের ছায়া। আঁধার হোক বা আলো, তারা যেখানে থাকে সেখানেই রয়ে যায়। ঠিক সেরকম আমার মন এবং শরীরের অস্থিরতা। দিনের আলোয় বুক কেঁপে ওঠে, রাতের নিদ্রা কেটে যায় অর্থহীন চিন্তাধারায়। দোটানায় হারিয়ে ফেলেছি স্বস্তি, নিশ্চল হওয়ার ক্ষমতা হয়েছে শূন্য। ঘরে কেউ নেই, আমি একা, সব মিলিয়ে যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। না, আর না। এবার ঘুমানো যাক।

বিছানায় গা দিতেই ঠান্ডা তোষক যেন ছ্যাঁকা দিল; গায়ের গরমের সঙ্গে মিলিয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। পাশ ফিরে শুয়ে হাতটা রাখতেই বুঝলাম, আমি একা নই; উষ্ণ কোমল দেহ আমার বরফ-ঠান্ডা হাতটাকে যেন নিমেষে গলিয়ে দিল। ঘরে কোনও শব্দ নেই, কোথাও কেউ নেই, আমার বুকের ভেতরে হালকা ঝড় উঠেও সঙ্গে সঙ্গেই উবে গেল। এ তো অজানা কিছু নয়, প্রায়শই হতে থাকা আমার বিবেচনার নিয়মিত খেলা। খুব একটা সময় লাগে না বাস্তব ছেড়ে কল্পনায় ডুবে যেতে। সহজ লাগে, দিনকালের কষ্ট থেকেও সহজ। ভয়ে লাগে না স্রোতের সাথে ভেসে যেতে।

আমার পাশে শুয়ে থাকা শরীরটা একটু নড়ে উঠল। দেখতে পেলাম, তার বুকে নিশ্বাসের উত্থান যেন উপত্যকার প্রতীত। আমার দিকে চেয়ে দেখল। চোখ দুটো নম্র, আকাশে থাকা আবছা মেঘের মত। আমার দিকে তাকিয়েও যেন সে দৃষ্টির রেখা অন্য কোথাও বিচ্যুত। তা কেনই বা হবে না?

এই গোটা পৃথিবীতে দুঃখ শুধু আমার একার নয়। তার স্বাদ আলাদা হলেও মনের ভেতরেই সর্বদা পাওয়া যায় তাকে। গভীরতার পার্থক্য নেই, তাই ভয় করে না। এই নেশার কোনও শারীরিক ক্ষতি নেই, তাই কোনও বাধা নেই। নিজের সাথে কথা বলি, অচেনা লাগে না, তবুও একাকিত্বের নাম শুনলে বুকটা যেন রুদ্ধশ্বাসে ছোটে। মাঝেমধ্যে দম বন্ধ হয়ে ওঠে।

জীবনে এমন পরিস্থিতি আসে যখন স্নেহ, মায়া, মমতা সব গঠন হয়ে তৈরি হয় একটা পথ। এই ভাগ্য সবার হয় না, তবে সেটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিছু মুহূর্ত ক্ষণিকের জন্য হলেও এক অদ্ভুত শান্তি নির্মাণ করে। আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল এই যে, কোনওদিনও মুখফুটে বলতে পারলাম না, ঠোঁটের কোণে শব্দগুলো এসেও যেন আবার হারিয়ে গেল। আজও সেই ক্ষণগুলো চোখের পলকের নিমেষে উপস্থিত হয়— এইসবেই তাকে আমার আপন মনে হয়। কিন্তু অনেকেই আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে যার কোনও পরিণতি নেই তার কী মানে? কেন নিজেকে এইরকম অন্ধকূপের মধ্যে কষ্ট দিয়ে রাখা? ওইজন্যেই বোধহয় বলে, মানুষের অতীত এবং ভবিষ্যৎ তার বর্তমানকে কুরে কুরে খায়।

আমার পৃথিবীটা বড্ড ছোট, ব্রহ্মাণ্ডের এক খুবই ক্ষুদ্র অংশ। সেখানেই আমি খুশি। আলমারি, বইয়ের সেল্ফ, আয়না, দরজা সব ফ্যাকাশে লাগে, যেন তারা থেকেও নেই। আমিও কি তা নই? শরীরের থেকে মনের দূরত্ব এতটাই যে কখনও নিজেকে ছুঁয়ে বলতে পারব না, এই তো আমি।

এখনও?

আমাকে প্রশ্ন করেছিল দিবাকর, যার উত্তরে আমি সবসময় একটা ম্লান হাসি দিয়ে থাকি, কোনও সময়ে কথা এড়িয়ে অন্য কিছু নিয়ে চর্চা করতে বসি। প্রশ্নটা দিবাকর ভুলে গেলেও আমি ভুলি না। কারণ উত্তর আমার কাছে একটাই।

এখনও।

আমার দিন শুরু হয় কলেজ এসে ছাত্রদের পড়িয়ে। গ্রিক থিওরি, ট্র‌্যাজেডি, ফাইন আর্টস কত বিষয় নিয়েই জল্পনা করা হয়, কিন্তু অনেক কথা এমন ছিল যা এসে ঠোঁটের কোণ ছুঁয়ে হারিয়ে যেত। আমি জানি না কীভাবে তাদের উচ্চারণ করতে হয়। অনেক কিছু শিখেছি জীবনে, কিন্তু নিজের সম্বন্ধে কোনও শব্দ গঠন করে আজ অবধি কিছু বলে উঠতে পারিনি।

সেদিন রাতে যেন ঘুমের মধ্যে কে জানি এসে আমার হাতটা ধরল। বরফ-ঠান্ডা সেই ছোঁয়া, এক বিস্তরতার ইঙ্গিত দিল যেন। সেই আবার ওই মুখ। জলছবির মত একদৃষ্টিতে আমাকে দেখছে, হাতটা বাড়িয়ে আমায় স্পর্শ করছে। বুঝতে পারলাম, আমার শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। সেই উষ্ণতার ছোঁয়া কি তার লাগছে? সে কি বুঝতে পারছে আমি জীবন্ত?

কী চাও তুমি?

তার জবাব নেই। সে আবার ছায়ার সঙ্গে মিলিয়ে যায়, আমি চোখ খুলে এদিক-ওদিক চেয়ে বিছানায় উঠে বসি। সেই জলছবি যখন মিলিয়ে যায়, আমার দিকে লক্ষ্য করে যেন একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।

এখনও?

এখনও।

দিবাকর ছাড়া আর আমার সেরকম কোনও বন্ধু ছিল না। ও সবটাই জানত, সেটা নিয়ে কোনওদিন বিরক্ত হওয়া বা অভিযোগ, কিছুই করেনি, বুঝতে পারতাম ও চায় না আমি একা থাকি। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর কলকাতায় একাই থাকতাম, তবুও বেশিদিনের জন্য না। তখনই সাক্ষাৎ হয়েছিল বিনয়ের সাথে। একসঙ্গে থেকেওছিলাম। কিন্তু সে পুরোনো কথা। আমাদের ঘরটা আর নেই, সব জিনিস অগোছালো থাকা সত্ত্বেও আমাদের স্মৃতিগুলো পরিচ্ছন্ন, খোলামেলা। আমাদের বন্ধ ঘরের মধ্যে যেন আলো জ্বালার অপেক্ষায় আজও বসে আছি।

রিসার্চের জন্য পন্ডিচেরি ইউনিভার্সিটির উদ্দেশে রওনা হলাম। দিবাকরও ছিল আমার সঙ্গে। ছ’মাসের জন্য কলকাতাকে বিদায়, নতুন কিছুর অপেক্ষার আরম্ভ। এই জন্যেই বোধহয় যার স্বপ্ন দিন রাত আমাকে গ্রাস করে রাখত সে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিল। একটা চাপা ব্যথা যেন ক্রমশ কমতে লাগল।

নতুন শহর, নতুন লোক, এবং নতুন সাহিত্যের ছোঁয়া খুবই অদ্ভুত লাগে। প্রথমে অচেনা লাগলেও, সেখানকার সংস্কৃতি যেন নিজের মধ্যে আপনা থেকেই বেড়ে ওঠে। তবুও যেন একটা ভয় লুকিয়ে ছিল, মনে হল সে অভিমান করেছে, আর দেখা দেয় না। প্রায়শই কলেজ থেকে ফেরার পথে এদিক-ওদিক ঘুরে যেতাম, পিজি-তে ফিরতে দেরি হত।

প্রায় তিন মাস কেটে যাওয়ার পর দিবাকর জোরজবরদ