Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

যৌবনের স্বর্গদ্বারে

(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণে)

‘পাপীকে চুম্বন করো তুমি, তাই দ্বার খোলে স্বর্গের প্রহরী’:
এসব লাইন পড়ে কেঁপে উঠি কে আমি যে অর্জুন অর্জুন
সুদূর ঝরনার জলে ডুবে আছি মত্ততায়, আধো জ্বর ঘুম
নীরা সুজাতারা কেউ ভাঙায়নি, হিমভয়ে নড়ে উঠি নড়ি
স্বপ্ন যদি লজ্জাহীন তবে স্বপ্নে কেন আজও মায়াবী মনীষা
চুম্বনে খোলে না মৃদু স্বর্গদ্বার, আমি এত পাপী মহাপাপী
আত্মপ্রকাশের জন্য আর কত অভিমানে বিষাক্ত মদিরা
গলায় জ্বলন্ত নেব, আমার এ একটুকরো পৃথিবীর চাবি
কোথায় লুকোনো আছে, প্রবাস বরফে জমে যে আকণ্ঠ তৃষা
জমাট কঠিন তা কি কোনোদিন বৃষ্টি হবে, তুমি কিংবা নীরা
কেউ কি তা বলে দেবে, এ জীবন যেরকম চলে যাচ্ছে হিম
তুহিন ধূসরভাবে পায়ের আলতা হয়ে সুজাতার, ঝিম
তুষারপাতের শব্দ তির হয়ে বিঁধে যায় বুকে, কত কাল
কথা রাখছে না কেউ, সুজাতা রাখে না বুকে সুগন্ধি রুমাল।

**

অনামী বিদেশিনিকে

নাতাশা ইরা তোমার কী যে নাম
কী হবে জেনে, তোমাকে নিয়ে আজ
একটি শুধু কবিতা লেখা চাই
হরিণী চুলে শাসন ও সমাজ
কাঁপানো ছবি, কপালে মণি ঘাম
তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা তাই

শোষণে ঘন কোনো প্রকার ছলে
তোমার সব হারানো যদি যেত
তুমি যে এই মস্কো শহরিণী
সে কথা ছাই ভস্মে বল্কলে
সাজিয়ে নিয়ে তোমাকে আদরিণী
ফেলেছি লিখে শেষের পরিচ্ছেদও

আমি অনেক দূরের শমীগাছে
রেখেছি তিরধনুক সব তুলে
মৃগয়া তবে কীভাবে আর হবে
রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে থাকা কাচে
আহত আমি বিশ্ব বাউনডুলে

মেয়েটি তুমি সরল সাদাসিধে
নিজের হাতে করোনি যেন কিছু
আমি কি যাব তোমার পিছু পিছু
তিনটি পুরো মিনিট ভেবে নিতে
হয়েছে, মনে এতটা জটিলতা

মাত্র তুমি কুড়ি বছর ধরে
ঝিকোনো এই বরফে জমে জমে
হয়েছ হিম আমি সে উৎসবে
অনধিকারী, ভালই রাখা করে
ভূমিকাটুকু, বাকিটা ক্রমে ক্রমে
কী জানি পাব সুযোগটুকু কবে

বাতাসে ছুঁচ নাকি তোমার মুখে
উঁচিয়ে আছে ধারালো কোনো ছুরি
কখনো যেন রাত্রি দ্বিপ্রহরে
পড়োনি তুমি বিপজ্জনক ঝুঁকে
মৃত্যু ছুঁয়ে ভাঙা রেলিং ধরে
তাহলে ধরে ফেলতে এ চাতুরি

না তুমি যাও উঁচু জুতোর খুরে
মাড়িয়ে ধীর তলানো যত পাপ
বাদামি চুলে ঝাপটা মেরে হেসে
কেন না জানো সাতটা কালো সাপ
ঘুমিয়ে ঝিম এবং আরো দূরে
আমাকে দাও গেরোয় যেতে ফেঁসে

কবিতা শেষ, এখন তবে এসো
বলছ কিছু, আবার তুমি কবে
দেখতে পাবে আমাকে, পাবে কি না
দুদিকে এত শব্দ কেন, ঘেসো
জমিতে ভরা নুড়ি, আবার কবে
সত্যি আমি শুনতে পাচ্ছি না।

***

সুখের ঘরে

বৃষ্টি গেছে নির্বাসনে গহীন নিরুদ্দেশে
রোদের তাপে পুড়তে থাকে রোজ আমাদের মুখ
যতই খুঁজি তৃপ্তি জলে, তৃষ্ণা থাকে শেষে
আগুন হাতে দাঁড়িয়ে অবাঞ্ছিত আগন্তুক

জ্বলছি আমি একাই নাকি এই নিয়ে সন্দেহ
পৃথিবী মা তোমার মনে আর কি আছে সুখ
উষ্ণায়নের জ্বালায় গেছে ঝলসে তোমার দেহ
বৃষ্টি তুষারপাতের জন্য তুমিও তো উন্মুখ

পেট্রোল আর ডিজেল পোড়ার গন্ধে ভরা বুক
বাতাসে বিষ, পৃথিবী মা ধনসম্পদ লুটে
নিঃস্ব করি মা তোমাকে, ছড়িয়েছি অসুখ
বিষুব অক্ষ দ্রাঘিমা আর দু-দুটি মেরুতে

বন কেটে মা প্রাসাদ গড়ি, আমরা সবাই সুখী
ডালে বসেই ডাল কাটত মূর্খ কালিদাস
আমরা কাটি দাঁড়িয়ে দূরে, নিই না কোনো ঝুঁকি
মত্ত থাকি নেশার ঘোরে, সুখের ঘরে বাস

ধ্বংস করি সব পরিবেশ, মন করি কঠিন
মৈথুন আর আহার ঘুমে সুখেই কাটে দিন।

****

এখনও অনেক যুদ্ধ

এখনও অনেক যুদ্ধ জয় করা বাকি
উষ্ণায়নে পরিশ্রান্ত পৃথিবী মায়ের মুখ
দূষণের কালো বিষ হৃদয়ের প্রতি কোণে কোণে
জলকণা বয়ে আনে প্রতিদিন নতুন অসুখ
মধুর কয়েক বিন্দু সুখাবেশ তবু আজও গভীর গোপনে
উদাস নদীর তীরে আজও ঘুরি বিকেলে একাকী
এখনও অম্লান হাসে নবজাত শিশুদের দল
সবুজ কিশোরী মুখ ভেজা আজও ভোরের শিশিরে
আজও স্বপ্নে ভেসে আসে মায়াবী যুবতী
এখনও পবিত্র আছে বৃষ্টিধারা, ঝরনাদের জল
অহল্যা অরণ্য কিছু বিষাক্ত নয় আজও মানুষের ভিড়ে
জীবন মেশায় আজও মিঠেকড়া লাভ আর ক্ষতি
হলুদ ভোরের ঘুম ভাঙায় এখনও এসে নীলকণ্ঠ পাখি
এখনও অনেক যুদ্ধ জয় করা বাকি।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
শুভ্র মুখোপাধ্যায়
শুভ্র মুখোপাধ্যায়
1 year ago

কী অসাধারণ লিখেছেন কবি। আপনার পরিবেশ চিন্তনে সৃষ্ট কবিতা দুটি এসময়ের অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে। অন্য দুটি কবিতা পাঠকে চিনিয়ে দেয় কবির মননের বিস্তার। কী অসাধারণ কাব্যময় পংক্তিতে নির্মাণ এসব কবির শরীর। তবে প্রথম কবিতার প্রথম লাইনে উদ্ধৃতিতে সামান্য ছাপার ভুল রয়ে গেছে। সংশোধন করে দিলে। ভালো হয়।‌‌ভালোভাষাকে ধন্যবাদ, তাঁরাই এমন গুচ্ছকবিতা উপহার দিচ্ছেন

Bipasha
Bipasha
1 year ago

এই নতুন কবিতাটি একটি চিত্তাকর্ষক এবং সুন্দরভাবে তৈরি করা লেখা যা পাঠকদের আকৃষ্ট করবে। কবিতাটি তার প্রাণবন্ত চিত্র এবং আবেগপূর্ণ ভাষা দিয়ে প্রথম লাইন থেকেই পাঠককে আকর্ষণ করে। শব্দগুলি অনায়াসে প্রবাহিত হয়, একটি বাদ্যযন্ত্র এবং ছন্দময় গুণ তৈরি করে যা উভয়ই প্রশান্তিদায়ক এবং অনুপ্রেরণাদায়ক।

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »