Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

সুজিত বসুর কবিতাগুচ্ছ

নীল জামা

মাঝে মাঝেই সে আসে
সুপুরির বন আমের বীথির ছায়ায়
আর নীল নূপুরের মায়ায়
কীসের যেন কুয়াশায়
চাঁদনিরাতের ওড়না দিয়ে সে ঢাকে আমার মুখ
তার চিবুক দেখি, হিরে মোতির মত তার বুক দেখি।
সে অবসর পায়, বাঁধে আমায় চিকন জরির নাগপাশে।
বাতাসে তখন শাল পিয়াশাল মহুয়ার গন্ধ ভাসে
এবং আকাশে দ্যুতিময় সব তারা, আমি যেন
পথহারা হয়ে যাই আর সেই অবকাশে
সে আসে, তার জোড়া নূপুরের সুর তোলে আমার দরজায়।
হিরেমন টিয়ামন লালমোহন পাখিরা সবাই ঘর যায়।
সে এসে দাঁড়ায় আমার দরজায় আর ডাকে ‘তুতুল’
যদিও কস্মিনকালেই আমার নাম তুতুল নয়
মায়ের বুকের দুধসাদা জ্যোৎস্না ছড়িয়ে থাকে মাঠময়
মাথার ওপরের চাঁদোয়ায় পেঁজাতুলো মেঘ;
কিন্তু আমার ঘরে কেউ নেই যে
সেরকম আবেগ নিয়ে একাই খেলবে পুতুল,
কেউই নেই, যক্ষপুরী আগলে আমি একাই
বসে আছি, কিন্তু সে শোনে না
মেলে ধরে চোখের সামনে একটা নীল জামা,
সে নাকি এসেছে আমার কাছে চাইতে ক্ষমা।

কবে নাকি সে চুরি করেছিল নীল জামাটা
সলমাচুমকির ঝলমলে কাজ তাতে, ভেলভেটের মত নরম,
আর কী তার ওম,
হিমঝরা রাতে লেপের তলায় নীলপরীদের বুক যেমন গরম থাকে।
আমি বলি এ তো পরীর জামা, এ আমার নয়।
আমার গোলাপ ডালিয়া বাগানে সে দেয় জলের ঝারি
আর বলে, ‘এ তোমারই’, আমি শুনি না, আমার হতাশ লাগে,
তা কি হিরে মুক্তোর বদলে শুধুই ঝিনুক দিচ্ছে বলে!
তবু বসে থাকি উৎসুক হয়ে
যদিই এখনও কিছু সোনা বাকি থাকে,
অথচ তার হাতে শুধুই জরি
ঠিনঠিন করে চুড়ি, সে বলে ‘ভালবাসা নিয়ে ভালবাসা দিয়ে
জামাটা তোমায় জড়িয়ে রাখবে, জানো না
ভালবাসার রং নীল হয়!’
এপক্ষে শুধু সন্দেহ ভয়, কেন না নীল তো হয় বিষও।
চার দেওয়ালে চারটে প্রতিধ্বনি ঠিকরে ওঠে,
মিশো না মিশো না ওদিকে যেয়ো না,
হোক না আঙুল চাঁপাকলি
আমি বলি জামাটা অনেক অনেক ছোট
হবে না আমার গায়ে।
তবু সে এগোয় পায়ে পায়ে।
রাগ হয়ে যায়, ঠেলে দিই ওকে, আর বলে উঠি, যাও তো,
বলছি না ওটা মাপের থেকে ছোট,
কখনও এসো না আর যদি ভাল চাও তো,
যেন কঁকিয়ে ওঠে তার চুড়ি, ঝিরঝির করে ইলশেগুঁড়ি
বৃষ্টি পড়ে, সে ফিরে যায়, চায়ের পাতার ছায়ায় ছায়ায়
একা একাই… একেবারে একাই।

*

লোলজিহ্বা মেলে ধরো

নির্লিপ্ত সংসারত্যাগী দৃষ্টি মেলে বসেছ যোগিনী:
রুদ্রাক্ষের রুদ্র তেজে কত আতঙ্কের স্পর্শ, শেষ বরাভয়
ত্যাগমন্ত্রে দীক্ষা নেয়, ব্যাপ্ত করো ভিক্ষাবৃত্তি, তিতিক্ষা আশ্রয়
করেও তো নেশাগ্রস্ত, জলদগম্ভীর শব্দে গুপ্ত অক্ষৌহিণী
নেচেছে শৈথিল্যে, তা-ও ইচ্ছাকৃত অপরাধ, সব আবর্জনা
প্রেতের তাণ্ডবে মুছে শুদ্ধ হবে উপত্যকা, গভীর প্রপাত
দৈন্যকে প্রকট করে আরো প্রসারিত হয়, সৈন্যের সংঘাত
উরুতে গুরুত্বহীন, ভিক্ষুণী ভৈরবী বেশে ছল প্রতারণা
অসঙ্গত অবান্তর, লোলজিহ্বা মেলে ধরো অবনতস্তনী
সুস্থির প্রত্যয়ে, তবু নিছক লাবণ্যময়ী বলেই কবিরা
বর্ণনা করেছে, রোমে সঞ্চিত উষ্ণতা আছে, সেবারে তো স্তন
মাধুর্যে মণ্ডিত ছিল, আধারবিহীনভাবে বিষাদ মদিরা
সযত্নে করাও পান সেবাশ্রমে, তার সঙ্গে জড়িত লবণ
স্তন থেকে ঝরে পড়ে, বৈরাগ্যের সুরে উরুসন্ধিতে খঞ্জনি।

*

সন্ধানী

গল্পটল্প হচ্ছিল বেশ, সঙ্গে অনেক গান
গোলপাতারই ছাউনিঘেরা, দরমা দেওয়া চাঁচের বেড়া
নীল চাঁদোয়ার নিচে বসে মধুর এ সুখটান
বন্দুকেরই ঝলসানিতে হঠাৎ কাটা তান

গিলতে আসে ঘরপোড়ানো আগুন লেলিহান
দিবারাত্রির কাব্য মলিন, ধূসর হল সোনালি দিন
অলক্ষিতে সদ্য কাটা খালে জলের বান
সবুজবরণ গাছের গায়ে রিক্ত সাদা থান

বিষমাখানো তিরের ফলায় স্তব্ধ মাঠের গান
চখাচখির মেলা ভাঙা, নদীর পারে শুকনো ডাঙা
অন্য পারে দিচ্ছে ওরা ছুরির ধারে শান
হৃৎপিণ্ড এফোঁড় ওফোঁড়, অব্যর্থ বাণ।

*

Advertisement

বিবর্তন

আগুন ঘিরে সেই আমাদের প্রথম অঙ্গীকার
সপ্তপদী ভালবাসার রেশমি মায়াজাল
অটুট থাকবে সারাজীবন, স্বচ্ছ অমলিন
সুখের দিনে বৃষ্টি স্নেহের, দুঃখ রোখার ঢাল

পাখির পালক জীবন তখন, দিনগুলি মসৃণ
রোজই তখন শুক্লপক্ষ, জ্যোৎস্না সারারাত
চাঁপার সুবাস চতুর্দিকে, বাতাস ছুঁয়ে উড়ি
জানতাম না প্রস্তুতিতে অদূরে আঘাত

প্রেমের রঙে ঘর রাঙানোর সেই যে প্রতিশ্রুতি
দিয়েছিলাম তা ভুলিনি, মনোহারী কথা
রাতপোশাকে সাজিয়ে রাখি, হয়নি কোনো ত্রুটি
তবে কেন এখন ঘরে পাষাণ নীরবতা

শরীর দিয়ে প্রদীপ জ্বেলে উষ্ণ নিবেদনে
অর্ঘ্য দিতাম, আঁচলভরে স্নিগ্ধ যে মমতা
তার কথা কি ভুলেই গেলে, আর পড়ে না মনে!
ফুল শুকিয়ে বাগান জুড়ে কেবল কাঁটালতা

হিমেল বাতাস ছড়াও শুধু, উষ্ণতা নেই ঘরে
মনের মধ্যে পাথর জমে, সাহায্য হাত তুমি
বাড়াও না তাই যাতনাময় ভালবাসার ঝড়ে
হ্রদ শুকোল, বাড়ি এখন রিক্ত বনভূমি

পুরোনো সেই বিদেশি গান সত্যি হল তবে
একবারটি বুঝতে দিলে কি আর হত ক্ষতি
কোথায় মধুর ভালবাসা, হারিয়ে গেল কবে
ফেরানো কি যায় না তাকে, এই শুধু মিনতি।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Kishore Dutta
Kishore Dutta
2 years ago

আমার প্রিয় কবি সুজিত বসুর কবিতাগুচ্ছ থেকে আবারও ছন্দেভরা, অর্থপূর্ণ কবির লেখা কবিতা নীল জামা, লোল জিহ্বা মেলে ধরো, সন্ধানী, বিবর্তন আমার খুবই ভালো লেগেছে। কবির এই সুন্দর সুন্দর কবিতা পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আবারও ভালভাষাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

Amitava Bhattacharya
Amitava Bhattacharya
2 years ago

অমিতাভ ভট্টাচার্য কলকাতা,
কবি শ্রী সুজিত বসুর নীল জামা, সন্ধানী, বিবর্তন এই কবিতা গুচ্ছ থেকে পড়ে খুব খুব ভালো লাগলো. কবিতা গুলি ওনার সুন্দর ছন্দে লেখা. “ভাল বাসা” কে ধন্যবাদ আমার এই প্রিয় কবি সুজিত বসুর এই কবিতা গুলো উপহার দেয়ার জন্য. খুব ভালো লাগলো. কবিকে ধন্যবাদ এবং আরও অনেক এরকম কবিতা আসায় থাকব.

শুভ্র মুখোপাধ্যায়
শুভ্র মুখোপাধ্যায়
2 years ago

অসাধারণ কবিতাগুচ্ছ। ভালভাষাকে ধন্যবাদ; প্রিয় কবির কবিতা আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।‌‌ সুজিত বসুর সেই অনন্য মুন্সিয়ানা যা মুহূর্তে বদলে ফেলতে পারে কবিতার চলন, দীর্ঘ কবিতায় ছন্দ ভেঙে চুরে বিষয়কে বিশিষ্ট করে তোলেন, তেমনই সাবলীল ছন্দে ছুটে যান বিষয়ান্তরে; ঠিক তেমন অনায়াস ছন্দ আর বিষয় নিয়ে খেলা করেছেন এই কবিতাগুচ্ছে। অথচ সব বৈচিত্র্য ছুঁয়ে থাকে এক গভীর জীবনবোধ আর যেন জেগে থাকে চিরবিরহী কোনো মন। হাজার সালাম কবিকে।

Last edited 2 years ago by শুভ্র মুখোপাধ্যায়

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনানন্দ দাশের সময়চেতনা: পুরাণ, প্রকৃতি ও আধুনিক নিঃসঙ্গতার নন্দনতত্ত্ব

পৌরাণিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রকৃতিগত সময়চেতনা তাঁকে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে এক স্থায়ী ও ব্যতিক্রমী মহাকবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর শিল্পকর্ম আমাদের শেখায়— দ্রুত ধাবমান জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধীরে চলতে, নীরবতার গভীরে কান পাততে এবং প্রতিটি ক্ষণিকের মাঝে অনন্তের ইশারাকে খুঁজে পেতে। তাঁর সাহিত্য ভবিষ্যতের প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকের জন্য আধুনিকতার এক অমূল্য পাঠ হয়ে থাকবে, যা মানুষের জীবনকে শিল্প ও প্রকৃতির একাত্মতায় আবিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং প্রমাণ করে দেয়— কাব্যই চূড়ান্ত আশ্রয়, যখন সমস্ত পথ ফুরিয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

জীবনানন্দ: প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

হেমন্তকাল ও জীবনানন্দ অভিন্ন, ওতপ্রোত ও পরস্পর পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বারবার নানা অনুষঙ্গে, বিভঙ্গে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেমন্তের বসতি যেন। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/ শিশিরের জল’, ‘ধানক্ষেতে, মাঠে,/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা’! কুয়াশা আর শিশির, এই দুই অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হেমন্তের, চিনিয়ে দেন তিনি। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল’, হেমন্তকে বাহন করে এই যে প্রকৃতির অপরূপতা মেলে ধরা, তা অন্য কোন বাঙালি কবির আছে?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গা মাঈ কী! জয়!

ঢাকা বা সমগ্র বাংলাদেশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুজোর চাঁদা আদায়ের চল খুব একটা নেই। মণ্ডপে এসেই পাড়ার লোক চাঁদা দেন। জবরদস্তি করে চাঁদা আদায়ের যে বীভৎসতা কলকাতা তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে আছে, তা অন্তত ঢাকা আর বরিশালে দেখিনি। পুজোর দিনেও অনেকে এসে প্যান্ডেলের পাশে চাঁদা আদায়কারীদের টেবিলের সামনে এসে চাঁদা দিয়ে যান। পাড়ার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। স্বেচ্ছায় এসে চাঁদা দিয়ে যান। এটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

Read More »
সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

দুর্গাপুজো সর্বদা শারদ নয় পৃথিবীতে যত জনগোষ্ঠী আছে, প্রত্যেকের বার্ষিক ধর্মীয় আনন্দোৎসব আছে। বৌদ্ধদের বুদ্ধপূর্ণিমা, মুসলমানদের ইদ, খ্রিস্টানদের বড়দিন, তেমনই বাঙালি হিন্দুদের দুর্গাপুজো। এখানে মিল

Read More »
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

বিশেষ নিবন্ধ: নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

দুর্গাপূজার আকালিক সমাধান দুর্গাপুজো এলেই এই কথাটা ‘কুইজ’-এর প্রশ্নে থাকবে। অকালবোধন কে করেছেন? রামচন্দ্র অকালবোধন করেছেন— উত্তর এটাই। কিন্তু কেন এটা অকালবোধন, কেন বলব অকালবোধন—

Read More »
তীর্থঙ্কর মৈত্র

অপ্রকাশিত: তীর্থঙ্কর মৈত্রের কবিতা 

হলুদ পাতার ফাঁকে সব স্মৃতি সুখ আনে, সব গান আকাশে মিলায়! হলুদ পাতার ফাঁকে, তোমার প্রেমিক খুঁজে যায় আহত ঘুড়ির স্বপ্ন— অঘ্রাণের বিকেলবেলায়! তবুও মাটির

Read More »